Magic Lanthon

               

ফার্নান্দো মেইরেলেস, ভাব-ভাষান্তর : রাশেদ রিন্টু

প্রকাশিত ১৫ এপ্রিল ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘লিখিত স্ক্রিপ্টে অভিনয় করে নিজের চরিত্র ফুটিয়ে তোলা বেশ কঠিন’

ফার্নান্দো মেইরেলেস, ভাব-ভাষান্তর : রাশেদ রিন্টু


চলচ্চিত্রনির্মাতা, চিত্রনাট্যকার ফার্নান্দো মেইরেলেস-এর জন্ম ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের ৯ নভেম্বর ব্রাজিলের সাওপাউলোতে। পুরো নাম ফার্নান্দো ফেরিয়া মেইরেলেস। পড়াশোনা করেছেন সাওপাউলো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য ও নগর পরিকল্পনা বিষয়ে। স্থপতি হিসেবে কর্মজীবন শুরু করলেও চলচ্চিত্রের প্রতি আগ্রহ ছিলো ছোটোবেলা থেকেই। ফলে পরে চলচ্চিত্র বিষয়ে গ্রাজুয়েশনও করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় মেইরেলেস তার চার বন্ধু¾পল মরেলি, মার্সেলো মাসাদো, ডারিও ভিজুও, বব সালাতিনির সহযোগিতায় পরীক্ষামূলক কিছু ভিডিও নির্মাণ করেন। এরপর টিভি শো ও বিজ্ঞাপন নির্মাণ নিয়েই ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় মেইরেলেস ও তার বন্ধুদের। ৯০ দশকের শুরুর দিকে পল মরেলি ও আন্দ্রেয়া বারাতা রিবেরিওকে সঙ্গে নিয়ে মেইরেলেস ও টু নামে চলচ্চিত্র প্রোডাকশন কোম্পানি গড়ে তোলেন। সেখান থেকেই ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে মেইরেলেস নির্মাণ করেন জীবনের প্রথম কাহিনিচিত্র ও মেনিনো মালুকুইনহো ২ : অ্যা অ্যাভেনচুরা (O Menino Maluquinho 2: A Aventura)। এরপর আর থামানো যায়নি তাকে। ২০০২ খ্রিস্টাব্দে নির্মাণ করেন তার বিখ্যাত চলচ্চিত্র সিটি অব গড। চলচ্চিত্রটির অসাধারণ নির্মাণশৈলী ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে মেইরেলেসকে সেরা পরিচালক হিসেবে এনে দিয়েছে অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড। এর পরের বছরই মেইরেলেস নির্মাণ করেন তার আরেক বিখ্যাত চলচ্চিত্র দ্য কন্সট্যান্ট গার্ডেনার

মেইরেলেস-এর উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে¾ব্লাইন্ডনেস (২০০৮), থ্রি সিক্সটি (৩৬০, ২০১১), ব্রাজিল অ্যানিমাডো (২০১১), এলেনা (২০১২), রিও, আই লাভ ইউ (২০১৪)। ৫৯ বছর বয়সী এই নির্মাতার অন্যতম বিখ্যাত চলচ্চিত্র দ্য কন্সট্যান্ট গার্ডেনার নিয়ে চলচ্চিত্রবিষয়ক স্টাম্পড ম্যাগাজিন-এর পক্ষ থেকে তার সঙ্গে কথা বলেছেন ম্যাগাজিনটির প্রকাশক ক্রিস নিউমার। ইংরেজি এই সাক্ষাৎকারটি ম্যাজিক লণ্ঠন-এর জন্য বাংলায় ভাব-ভাষান্তর করেছেন রাশেদ রিন্টু

 

ক্রিস নিউমার : এই চলচ্চিত্রে (দ্য কন্সট্যান্ট গার্ডেনার) আপনি যেভাবে বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন তা আগ্রহোদ্দীপক, রোমাঞ্চকর ও দুর্দান্ত। পর্দায় বিচিত্র সব রঙসজ্জা, আপনার শুটিং-শৈলী মুগ্ধ হওয়ার মতো। আপনি চাইলেই মাস্টার শট্ নিতে পারতেন, দুটি শটের মাঝামাঝিও কিছু নিতে পারতেন। কিন্তু যখন আপনি এমন কিছু দেখালেন যেখানে বস্তুগুলো ঝুঁকে আছে, সেখানে উজ্জ্বল রঙের ব্যবহার ছিলো অসাধারণ ...। প্রথম দিকের একটা শট্ তো আমাকে অতীতে নিয়ে গিয়েছিলো। প্রথম কিংবা দ্বিতীয় দৃশ্যে, যেখানে র‌্যাচেল ও রাল্ফ কথা বলছিলো; তারা একটি সাদা রঙের সেট-এ হাঁটছে এবং ধীরে ধীরে পর্দায় রঙ বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে। অসাধারণ এক দৃশ্য!

ফার্নান্দো মেইরেলেস : হ্যাঁ।

নিউমার : এমন দৃশ্য সাধারণত দেখা যায় না। আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, অসাধারণ! এমন চিন্তা আপনার আসলো কোথা থেকে? চলচ্চিত্রে পারিপার্শ্বিক এই আবহাওয়া বা ইমেজইবা আপনি কীভাবে তৈরি করেছিলেন?

মেইরেলেস : সিটি অব গড নির্মাণসহ অনেকগুলো কাজ আমি ও সিজার কার্লোন (মূলত সিনেমাটোগ্রাফার, সঙ্গে পরিচালনা করেন এবং চিত্রনাট্য লেখেন) খুব ঘনিষ্ঠভাবে করেছি। এবার যখন লোকেশনের জন্য আফ্রিকায় ঘুরছিলাম, তখনই মূলত আমরা পরিকল্পনাগুলো করতে থাকি। অন্যদিকে শুটিংয়ের ক্ষেত্রেও সচরাচর যে পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়, আমরা তা করিনি। সাধারণত পরিচালক প্রথমে ক্যামেরা সেট করেন, তারপর আলোর ব্যবস্থা করা হয়। এরপর অভিনেতারা আসেন এবং তারা একটি নির্দিষ্ট ক্যামেরার সামনে অভিনয় করেন। তারপর কাট করা হয়। এ সময় ক্যামেরা-কোণ পরিবর্তন হয়, আলো পরিবর্তন হয়; অভিনেতাদের পুনরায় সেটে আনা হয় এবং আবার তারা অভিনয় করেন। এই পদ্ধতিতেই সাধারণত দৃশ্য ধারণ করা হয়। কিন্তু এ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে কার্লোন আলোর জন্য শুধু বাল্ব পরিবর্তন করলেন, দৃশ্য-সাজ-সরঞ্জাম ছিলো আগের মতোই।

নিউমার : হুম, সেখানে কিছু ...।

মেইরেলেস : এটা ঠিক, মাঝে মাঝে অবশ্যই প্রথাগতভাবে শুট করতে হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ দৃশ্যেই কার্লোন কোনো সাজ-সরঞ্জাম ব্যবহার করতেন না। তাই সেট একই থাকতো, শুধু অভিনেতারা আসতো এবং তাদের আমরা সম্পূর্ণ দৃশ্যই একেবারে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত করতে বলতাম। তাদের বলা হতো, আপনারা ক্যামেরা ভুলে অভিনয় করতে থাকেন। প্রতিটি সময়ই ক্যামেরা থাকতো ভিন্ন ভিন্ন স্থানে। এ পদ্ধতিতে খুব দ্রুত কাজ করা সম্ভব। আপনি শুধু চারিদিকে হাঁটবেন এবং প্রামাণ্যচিত্রের মতো অনুভূতিটাকে ধারণ করার চেষ্টা করবেন। আপনি নিশ্চয় জানেন, অভিনেতারা নির্দিষ্ট কোনো ক্যামেরা-কোণের দিকে লক্ষ রেখে অভিনয় করে না। বরং তারা প্রামাণ্যচিত্রের মতোই সেখানে থাকা ক্যামেরার সামনে অভিনয় করেন।

নিউমার : আপনার কি মনে হয় না, অভিনেতাদের ওই ধরনের একটি মানসিকতায় নিয়ে যাওয়া কঠিন? অন্তত প্রথম কিছুদিনের জন্য?

মেইরেলেস : এক্ষেত্রে প্রথমেই বলে নিই যে, আমরা একটু আলাদা পথে হেঁটেছি। যেখানে দৃশ্য ভাঙা হয়নি। আর স্ক্রিপ্টের প্রত্যেকটা লাইন হুবহু করতেও আমি খুব একটা আগ্রহী নই। তাই সবসময়ই আমি অভিনয়শিল্পীদের তাৎক্ষণিক কিছু একটা করতে বলি। এবং কাট বলার পরিবর্তে চালিয়ে যাও, চালিয়ে যাও বলতেই আমি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি।

নিউমার : আপনি বেশ স্বাধীনচেতা।

মেইরেলেস : হ্যাঁ। যখন তাদের স্ক্রিপ্টের বাইরে অভিনয় করার সুযোগ দেবেন, তখন এমন কিছু এক্সপ্রেশন পাবেন, যেটা স্ক্রিপ্ট দিয়ে হবে না। এটা অভিনয়শিল্পীর স্বাধীনতা। আমি মনে করি, এ পদ্ধতি অভিনেতারাও পছন্দ করেন, বিশেষ করে র‌্যাচেল। আমি তার সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি সবসময় বলতেন, ‘এ ধরনের অভিনয়ের সময় নিজেকে মুক্ত মনে হয়। আপনি নিশ্চয় জানেন, সেটে দাঁড়িয়ে অভিনেতাদের এমন ভান করতে হয় যে, তারা এসব সাজসজ্জা ও কলাকুশলীদের দেখছে না। তবে লিখিত স্ক্রিপ্টে অভিনয় করে নিজের চরিত্র ফুটিয়ে তোলা বেশ কঠিন।

নিউমার : আমি এটাও জানি, একটা সময় আপনি পাঁচ জনের ছোটো একটি দল নিয়ে শুটিং করেছেন। এটার সফলতা নিয়ে নিশ্চয় অনেকের সন্দেহ ছিলো?

মেইরেলেস : হ্যাঁ, সবগুলো দৃশ্যই ভিন্ন ভিন্ন স্থানে ছিলো। যেমন : বাজারের দৃশ্য, মঞ্চনাটক দেখার দৃশ্য। আপনি তো জানেন, নাটক দেখার সময় কেমন ভিড় থাকে।

নিউমার : হ্যাঁ।

মেইরেলেস : এই সব দৃশ্য মাত্র পাঁচ-ছয় জন সহকারী নিয়ে শুট করা। কেননা আপনি যদি শুটিংয়ে বেশি সাজসরঞ্জাম ও কর্মী আনেন, তাহলে বাজার ও নাট্যশালায় সাধারণ অবস্থায় যা ঘটছে তার কিছুই ঘটবে না। প্রত্যেকেই নাটক দেখা বন্ধ করে দিবে, সবার নড়াচড়ার ফলে আপনি আলোও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না। কিন্তু যখন এটা ছোটো পরিসরে করবেন, তখন নির্বিঘ্নে শুট করতে পারবেন। অনেক ভিড়ের মধ্যেও কেউ বুঝবে না, চলচ্চিত্রের শুটিং চলছে।

নিউমার : এজন্য আপনি কী ধরনের ক্যামেরা ব্যবহার করেছিলেন?

মেইরেলেস : খুব ছোটো একটা ক্যামেরা, অ্যাটোন-এর অ্যা-মিনিমা বলা হয়। আপনার দেখা উচিত, এটা খুবই ছোটো।

নিউমার : ডিজিটাল না ফিল্ম?

মেইরেলেস : ফিল্ম ক্যামেরা, ১৬ মি মি।

নিউমার : হুম, ঠিক আছে।

মেইরেলেস : আমরা কিছু ক্ষেত্রে ৩৫ মি মি এবং কিছু ক্ষেত্রে ১৬ মি মি ক্যামেরা ব্যবহার করেছিলাম। বিশেষ করে এ ধরনের অবস্থার ক্ষেত্রে এ ক্যামেরাগুলো খুবই ভালো। তবে আপনি যখন একটি ছোটো কর্মীবাহিনী নিয়ে কাজ করবেন, তখন বাস্তবধর্মী সেট ও জনগণ পাবেন। কেউ জানবেই না চলচ্চিত্রের শুটিং করছেন। এর মাধ্যমে আসল পরিস্থিতি তুলে আনতে পারবেন। আপনি যখন শুটিংয়ের জন্য অতিরিক্ত সহযোগীশিল্পী আনবেন, নতুন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করবেন, তখন বাস্তবতার সঠিক মাত্রা পাবেন না।

নিউমার : তার মানে সেখানে নাটক চলছিলো এবং আপনি সেটা শুট করেছিলেন?

মেইরেলেস : ব্যাপারটা ঠিক তা নয়। আমরা সেখানে পুনরায় নাটকটি মঞ্চায়নের ব্যবস্থা করেছিলাম। আমরা মঞ্চ তৈরি করে অভিনেতাদের নিয়ে এসেছিলাম। তারা এসে সাধারণত যেভাবে উন্মুক্ত দর্শকের জন্য নাটক হয়, সেভাবেই অভিনয় করেছিলো। আমরা শুধু বস্তির জনগণকে জানিয়েছিলাম, এখানে নাটক চলছে; যেনো তারা এসে দেখতে পারে। ফলে সেখানে প্রচুর লোকজন এসেছিলো। তবে তারা (বস্তির লোকজন) কিন্তু সহযোগীশিল্পী হিসেবে আসেনি, তাই আমরা তাদের চলচ্চিত্রে অভিনয়ের জন্য কোনো পারিশ্রমিকও দিইনি।

নিউমার : ভালো। আমার মনে হয়, এটা আপনার কাজকে গতিময় করেছে।

মেইরেলেস : এবং তা যথেষ্ট কম খরচে।

নিউমার : আমার মনে হয়, যদি আলো পরিবর্তনকারী কর্মীদের টাকা না দিতে হতো, তাহলে আপনার খুবই সুবিধা হতো।

মেইরেলেস : হ্যাঁ, কিন্তু আপনি যদি আলাদা করে আলো সংযোজন করেন, তখন শুধু কর্মী নয়, দর্শককেও পারিশ্রমিক দিতে হবে। কারণ প্রত্যেকেই তখন সহযোগী অভিনেতা। এটা সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত। তাই বাজারের মতো এই ধরনের বড়ো জায়গায়; যেমন এই চলচ্চিত্রেও এ ধরনের দৃশ্য রয়েছে যেখানে রাল্ফ বাজারের মধ্যে কুয়েলেকোকে খুঁজছিলো। এই বাজারটা ছিলো সত্যিই একটা বড়ো বাজার।

নিউমার : এবং তিনি (রাল্ফ) এটা পরিকল্পনা অনুযায়ী শেষ করেছিলেন।

মেইরেলেস : চলচ্চিত্রে এরপর তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়ার আগের দৃশ্যপটে সেখানে রাল্ফ এবং ছোটো একটি শুটিং দল ছিলো। তাই রাল্ফ সত্যি সত্যি বাজারে থাকা জনগণের সঙ্গে কথা বলছিলো এবং জিজ্ঞাসা করছিলো। আর জনগণও সত্যি সত্যি উত্তর দিচ্ছিলো যে, ‘কুয়েলেকো, আমি তাকে সত্যিই চিনি না!

নিউমার : কিন্তু চলচ্চিত্রের শুটিং হচ্ছে এটা তো তারা জানতো, তাই না?

মেইরেলেস : তাদের মধ্যে কেউ কেউ এদিক-ওদিক তাকানোর ফলে ক্যামেরা দেখতে পেয়েছিলো। তাই মাঝে মাঝে অনেকেই থেমে যেতো। অন্যরা যারা ক্যামেরা দেখতেই পায়নি, তারাই মূলত ওই সব প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলো।

নিউমার : সম্ভবত রাল্ফকে কেউ চিনতে পারেনি।

মেইরেলেস : না, কেউই রাল্ফকে চিনতো না। সে ছিলো পুরোপুরি অপরিচিত। আর যারা ওখানে উপস্থিত ছিলো, তারা কেউই চলচ্চিত্র তেমন একটা দেখে না।

নিউমার : হ্যাঁ, সম্ভবত সে কারণেই জায়গাটা নিরাপদ ছিলো। আপনি বলছিলেন, লোকেশন নিয়ে আপনার প্রধান ক্যামেরাম্যান-এর সঙ্গে কীসব কথাবার্তা হয়েছিলো। চলচ্চিত্রে একটা ট্রেনের কথা মনে পড়ে। রেললাইনটি ছিলো বস্তির ভিতর দিয়ে। আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম, বস্তির ভিতর দিয়ে রেললাইন গেছে ঠিক এমন একটা জায়গা আপনারা কোথায় পেলেন? এর জন্য কি বিশেষ কাউকে নিয়োগ করেছিলেন? নাকি অন্য কোনো উপায়ে এটা খুঁজে পেয়েছিলেন?

মেইরেলেস : না, কাউকে কিছু করতে হয়নি। মূলত আমরাই গিয়েছিলাম বস্তিতে। তারপর আমরা ট্রেনটি দেখলাম। ভাবলাম, অসাধারণ এই লোকেশনটা তো ব্যবহার করা যায়। যেমনটি প্রায়ই হয়। চলচ্চিত্রটিতে একটি শট্ আছে, যেটা আমার সত্যি খুব পছন্দের। ওই দেশ সম্পর্কে আমার অনুভূতির অনেক কিছুই এই শটে ফুটে উঠেছে। গল্ফ মাঠের দুই জনের ওই দৃশ্যটি, যেখানে তাদের ওপর থেকে ক্যামেরা প্যান করা হয়। তারপর ক্যামেরা বস্তিতে ঢুকে যায়। আমরা যে রেললাইনের সামনে দিয়ে হাঁটছিলাম সেখানে সেই দেয়ালটি ছিলো; আর দেয়ালের ভিতরের দিকে সেই সুন্দর গল্ফ মাঠটি। এটা অনেকটা হাইড পার্কের মতো।

সুন্দর সবুজ বাগান, যেনো ইংল্যান্ডেরই কোনো জায়গা। মনে হবে, আপনি সত্যিই ব্রিটেনের হাইড পার্কে আছেন। তারপর ঘুরে বস্তির ভিতর দেখালেন। যখন তারা গল্ফ খেলছিলো তখনই দৃশ্যটি ধারণ করা হয়। এই দৃশ্যটি ছিলো বার-এর (নাইরোবির একটি ক্লাব) ভিতরে। আমাদেরকে গল্ফ মাঠের পাশেই ডায়ালগ নিতে হয়েছিলো, শুধু এই শট্টির জন্য; এটি ছিলো খুবই বিস্ময়কর। সুতরাং লোকেশনে গিয়েও আপনি দৃশ্য পরিবর্তন করতে পারেন। আর আপনার কাছে যা আছে, তার সঠিক ব্যবহারও করতে পারেন।

নিউমার : আমি আপনার কিছু সাক্ষাৎকার পড়েছিলাম। এর একটিতে আপনি একাধিকবার বলেছেন, আমেরিকান বা হলিউডের কোনো প্রজেক্টে কাজ করবেন না। কিন্তু কী এমন হয়েছিলো যে এ চলচ্চিত্রটি করলেন? তবে পরে আবার আমার মনে হয়েছে, সম্ভবত এটাকে আপনি হলিউড প্রোডাকশন হিসেবে বিবেচনাই করছেন না।

মেইরেলেস : না, আমি সত্যিই বিবেচনা করি না। কিন্তু আমি জানি, যা বলেছিলাম, আমি তাই করতাম। শুধু এখনই না, পরবর্তী দুই-তিন বছরেও। তবে দূর ভবিষ্যতে হয়তো সেটা অন্যরকম হতে পারতো। কিন্তু এটা সত্য। তবে সিমন (ব্রিটিশ চলচ্চিত্র প্রযোজক) যখন আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তখন তার সঙ্গে কোনো স্টুডিও সংযুক্ত ছিলো না। সেটা ছিলো ব্রিটেনের একটি ছোটো স্বাধীন প্রোডাকশন কোম্পানি। এরা মূলত মাইক লে’র (Mike leigh, ব্রিটিশ নির্মাতা ও লেখক) চলচ্চিত্রগুলো নির্মাণ করতো। আমার মনে হয়, আমারটাই ছিলো তাদের সবচেয়ে বড়ো প্রোডাকশন। তাই এটি সত্য। কিন্তু পরে ব্রিটিশ আইনে কিছু পরিবর্তন আসায়, সিমন এই চলচ্চিত্র থেকে যতটা অর্থ আশা করেছিলেন তা করতে পারেননি।

নিউমার : এ চলচ্চিত্রটি থেকে?

মেইরেলেস : হুম, এই চলচ্চিত্রটি থেকে। ফিল্ম কমিশন ও ফিল্ম কাউন্সিল থেকে ওই চলচ্চিত্রে অর্থায়নের প্রায় ৪০ শতাংশ তিনি হারিয়েছিলেন। যখন তিনি (সিমন) চলচ্চিত্রটি ফোকাস-এর (যুক্তরাষ্ট্রের একটি স্টুডিও) কাছে পাঠালেন, তখন তারাই সামনে চলে আসলো। সত্যি বলতে কি, ওই সময়ে আমি শুটিংয়ের জায়গা খুঁজছিলাম। তারপর যখন ফোকাস সামনে চলে আসলো, আমি ভাবলাম, ‘ভালোই হলো, এখন আমেরিকানরা আমাকে বলবে, আমার কী করা উচিত! ফোকাস-এর লোকজন লন্ডনে এসেছিলো, তবে এতে হিতে বিপরীত হয়। তারা যথেষ্ট শ্রদ্ধা সহকারে খুব সহজেই চুক্তি করে। সত্যিই তারা এই প্রজেক্টে আগ্রহী ছিলো এবং স্ক্রিপ্ট সম্পর্কে নোটও পাঠিয়েছিলো। তবে শেষে মন্তব্য লিখেছিলো, এটা আপনার চলচ্চিত্র, আমরা শুধু পরামর্শ ও সাহায্য করার চেষ্টা করছি। তবে এটা আপনার ইচ্ছানুযায়ীই হবে।

আমি সবসময় শুনেছি, স্টুডিও কতোটা কঠোর হতে পারে; কিন্তু এবার সেটা সম্পূর্ণ বুঝতে পারছি। যখন আপনি কোনো প্রজেক্টে ৮০ মিলিয়ন খরচ করবেন, তখন অবশ্যই আপনার টাকা ফেরত আসার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। চলচ্চিত্রটি খুবই কম বাজেটের¾পাঁচ মিলিয়নেরও কম, তাই হয়তো ফোকাস-এর পক্ষে এমন ব্যবহার করা সম্ভব হয়েছে। অথবা এমনও হতে পারে যে, তারা আসলেই খুব ভালো মানুষ। আমি আমার পরবর্তী প্রজেক্টের কাজ করছি। আর তারাই হবে আমার প্রথম আমেরিকান পরিবেশক, যেমনটি আমি খুঁজছিলাম। ফোকাস এই কাজের যোগ্য ছিলো।

নিউমার : আমি মনে করি, যখন আপনি হলিউডে কাজ না করার কথা বলেন, তখন ওই ৮০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের চলচ্চিত্রের কথাই বলেন। তারপর?  আর কোনো ছোটো বাজেটের চলচ্চিত্র?

মেইরেলেস : হ্যাঁ, হ্যাঁ। কিন্তু আপনি জানেন, কিছু ক্ষেত্রে আমি ৮০ মিলিয়ন বাজেটের চলচ্চিত্রে কাজের জন্য চেষ্টা করবো। এমন বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রে আমাকে কাজ করার জন্য বলা হয়েছে। কিন্তু আমি প্রস্তুত নই। সম্ভবত সামনের আট বছরের মধ্যে আমি এ চেষ্টা করতে পারি। কিন্তু নির্দিষ্টভাবে হলিউডে ক্যারিয়ার গড়া, সেখানে যাওয়া¾এগুলোর কোনোটাই আমার পরিকল্পনায় নেই।

নিউমার : কেউই লস অ্যাঞ্জেলসে যেতে চায় না!

মেইরেলেস : আমি লস অ্যাঞ্জেলস ভালোবাসি। কিন্তু ...।

নিউমার : আপনি লস অ্যাঞ্জেলসে ঘুরতে ভালোবাসেন, তাই না? কিন্তু আমি সেখানে থাকার কথা ভাবতেই পারি না।

মেইরেলেস : সত্যি? আমি শহরটি খুব পছন্দ করি; সঙ্গে সেখানকার একেবারে নিরুদ্বেগ জনগণকেও। কিন্তু ওটা আমার সংস্কৃতি নয়। তাই আমি মনে করি, আমেরিকান সংস্কৃতির চলচ্চিত্রে আমার নতুন করে সংযোজন করার কিছুই নেই।

নিউমার : তবে অধিকাংশ পরিচালক শুধু এজন্য এটা (চলচ্চিত্র) করা থেকে বিরত থাকে না।

মেইরেলেস : আমার মনে হয়, আমি এর চেয়ে আরো ভালো চলচ্চিত্র বানাতে পারতাম, আমার দূরবর্তী লক্ষ্য সামনে রেখেই।

নিউমার : সেটা ঠিক।

মেইরেলেস : একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্রাজিলের গল্পগুলো দেখেন। এমন অনেক বিখ্যাত পরিচালক আছেন, যারা ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই বিষয়গুলো দেখেছেন। তাই আমি মনে করি, আমার এতে নতুন কিছু যোগ করার নেই।

নিউমার : দ্য কন্সট্যান্ট গার্ডেনার বা যে বইটার ওপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্রটি হয়েছে¾সেটি আমি পড়িনি। কিন্তু চলচ্চিত্র দেখে মজা পেয়েছি। এটি ওই ধরনের চলচ্চিত্র, যার প্রথম তিন মিনিটেই প্রধান চরিত্র মারা যায়। এ চলচ্চিত্রে টেসাও মৃত। আমার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, এর মধ্যে কী এমন চিন্তা ছিলো, যার জন্য এটাকে আপনি কালানুক্রমিক বলতেন?

মেইরেলেস : হ্যাঁ, আমরা চলচ্চিত্রের জন্য প্রথম যে ডামিটা (চলচ্চিত্রের প্রাথমিক ভিডিও) ভিডিও করি সেটা সময় ধরে ধরে করেছিলাম। এবং এটা সম্পাদনা করতে আমি ক্লাইরি সিম্পসন’কে ডাকি। কারণ তিনি দীর্ঘদিন ধরে চলচ্চিত্র সম্পাদনা করছেন এবং একজন লেখকও।

নিউমার : তাকে এ কাজের জন্য পছন্দ করার ক্ষেত্রে একজন সম্পাদকের মধ্যে কোন গুণগুলো খুঁজেছিলেন? আর ক্লাইরির মধ্যে এমন কী ছিলো, যেটা আপনি পছন্দ করতেন?

মেইরেলেস : হুম, আমি তার সম্পাদিত বেশকিছু চলচ্চিত্র পছন্দ করি¾প্লাটুন (১৯৮৬) অথবা অলিভ স্টোন (আমেরিকান নির্মাতা) ও রিডলি স্কট (আমেরিকান নির্মাতা) নির্মিত চলচ্চিত্রগুলো। তিনি এমন কিছু পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছেন, যাদের আমিও খুব পছন্দ করি। বিশেষ করে তিনি একজন লেখক। আর স্ক্রিপ্ট এমন একটি বিষয়, যা কাজ চলাকালীন কখনোই চূড়ান্ত অবস্থায় আসে না। তাছাড়া প্রক্রিয়াটাও খুবই দ্রুত। প্রথমবারের মতো আমি যখন স্ক্রিপ্টটা পড়লাম, এটা নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারি শুরুর মধ্যে হবে। এর ৪৮ দিন পরে আমি লোকেশন ঠিক করতে আফ্রিকা যাই।

এ সময় স্ক্রিপ্টে কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করি। এবং স্ক্রিপ্টের বহু বিষয় আমি পরিবর্তনও করি। কিন্তু কখনোই আমি চূড়ান্ত পর্যায়ে আসতাম না; যেটুকু হতো সেটাই। আমি সবসময় প্রথমে চরিত্রানুযায়ী অভিনেতা খোঁজার চেষ্টা করি, তারপর স্ক্রিপ্টে সামান্য পরিবর্তন এনে শুটিং করি। সেজন্যই মূলত ক্লাইরিকে ডেকেছিলাম, কারণ শেষের দিকে এটার কিছু বিষয় পরিবর্তন করতে আমার এমন একজনকেই লাগতো। আমরা প্রথমে এটা সম্পাদনা করেছিলাম। কিন্তু সেটা খুব বিরক্তকর ছিলো। সত্যিই তখনো কিছুই হয়নি। তারপর আমরা ভিন্ন ভিন্ন পাঁচ-ছয়টি উপায়ে চলচ্চিত্রটি শুরু করার চেষ্টা করি। শেষমেষ তাতেও ব্যর্থ হই।

তারপর বইটি আমি আবার পড়ি। দেখলাম প্রথম পৃষ্ঠাতেই টেসা মারা গেছে। এবার যখন তার (টেসা) মৃত্যু দিয়ে চলচ্চিত্রটি শুরু করলাম, তখন সবকিছুই ঠিক হয়ে গেলো। এটা ছিলো সত্যিই বিস্ময়কর। এর অধিকাংশ কাজ হয়েছিলো কাটিং রুমেই। চলচ্চিত্রটির এই ধারাবাহিকতা বইটিতে খুঁজে পাওয়া সহজ, সহজলভ্য ও যুক্তিসঙ্গত ছিলো। কিন্তু আমার সময় না থাকাতেই বিড়ম্বনায় পড়েছিলাম।

নিউমার : যদিও এটা একেবারেই শেষ মুহূর্ত ছিলো, তার পরও আপনাকে পিছন ফিরতে হয়নি বা পুনরায় শট্ নিতে বা এমন কিছুই করতে হয়নি?

মেইরেলেস : না। কিন্তু আমি সিকোয়েন্সটি কানাডার মানিটোবা প্রদেশের রাজধানী উইনিপেগ-এ শুট করেছিলাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেটি কোনো কাজেই লাগেনি। শুধু সময় ও টাকা নষ্ট হয়েছিলো।

নিউমার : আপনি কি আসলেই এটা তিনটি ক্যামেরায় শুট করেছিলেন?

মেইরেলেস : হ্যাঁ। এই দৃশ্যটি আমরা উইনিপেগ-এ শুট করেছিলাম। ডাই প্রক্সিন তৈরির একটি ফ্যাক্টরিতে। সেখানে আবিষ্কারক ওই বিজ্ঞানীর সঙ্গে কথা বলেছিলাম। এটা ছিলো খুবই রোমাঞ্চকর সিকোয়েন্স। শট্টিতে তুষারের মধ্য দিয়ে তাদের ধাওয়া করা হয়েছিলো এবং কোনো মতে তারা পালাতে পেরেছিলো। তারপর গোপন চুক্তি ফাঁস করার অপরাধে বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়। খুবই রোমাঞ্চকর।

নিউমার : এটা কি আমরা ডিভিডিতে দেখতে পাবো?

মেইরেলেস : হ্যাঁ।

নিউমার : আপনি কি আল পাচিনো (আমেরিকান অভিনেতা ও নির্মাতা) অভিনীত কারলিটোস ওয়ে (Carlito’s Way, আমেরিকান অপরাধবিষয়ক চলচ্চিত্র) দেখেছেন? ওই চলচ্চিত্রের শুরুতেও কারলিটো মারা যায়। দ্য হিউম্যান স্টেইনও (আমেরিকান নাট্যধর্মী চলচ্চিত্র) অনেকটা ওটার মতোই ছিলো। এসব ক্ষেত্রে নির্মাতার কাজটা বেশ কঠিন। কারণ শুরুতেই প্রধান চরিত্র মারা যায়। সেক্ষেত্রে আপনি (নির্মাতা হিসেবে) কীভাবে ওই চলচ্চিত্রের প্রতি দর্শকের আগ্রহ তৈরি করবেন বা ওই চরিত্রটিকে তুলে ধরবেন¾যে চরিত্রটির শেষ পরিণতি সম্পর্কে দর্শক আগে থেকেই জানে?

চলচ্চিত্রটির এই বিষয়টি আমি এখনো বিশেষভাবে উপভোগ করি। এটা আমাকে এখনো ভাবায়। আমি আশ্চর্য হয়েছিলাম, কীভাবে এটা (দ্য কন্সট্যান্ট গার্ডেনার) নির্মাণ করলেন! আপনার কি কখনো শঙ্কা জাগেনি, যেহেতু তিনি (টেসা) আগেই মারা গেছেন, তাই দর্শক চরিত্রটার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলতে পারে?

মেইরেলেস : এটাই চ্যালেঞ্জ ছিলো। কিন্তু আমরা চেষ্টা করেছি এবং সফল হয়েছি¾এটাই সত্য। আমার মনে হচ্ছিলো যেনো পাশাপাশি দুটো চলচ্চিত্র¾আর এই কারণে এটা আরো মজার লাগছিলো। আমরা এর শুরুটা করেছিলাম জাস্টিন ও টেসার একটি বক্তৃতা কক্ষে সাক্ষাৎ এবং তাদের বিছানায় যাওয়া দিয়ে। তার ৪৫ মিনিট পর টেসা মারা যায়। তার পর পরই দ্বিতীয় গল্পের অনুপ্রবেশ ঘটে। জাস্টিন তার স্ত্রী হত্যার কারণ খুঁজতে শুরু করেন, যেটা ছিলো বিরক্তিকর। কারণ আপনি আপনার সমস্ত ধৈর্য এই চরিত্রটির পিছনে ব্যয় করেছেন। প্রথম ৪০ মিনিট টেসা ছিলেন, তারপর তিনি মারা যান। এরপর আবার ৫০ মিনিট অন্য গল্প চলতে থাকে¾দুটো গল্প।

সুতরাং মৃত্যুটাকে শুরুতে রেখে, সব একই গল্প; শেষটা কী হবে আপনি তা জানেন। টেসার প্রতি আগ্রহ ধরে রাখতে পারবো কি না, আমরা সন্দিহান ছিলাম। এটা আমার জন্য কঠিন ছিলো। কারণ তিনি চলচ্চিত্রের শুরুর প্রথম কয়েকটি দৃশ্যের পর অনুপস্থিত, কিন্তু চলচ্চিত্রের পুরো গল্পটাই তাকে ঘিরে। তাছাড়া শুরুর দিকে আমি টেসার প্রতি দর্শকের ঘৃণা জন্মাতে চেয়েছিলাম। তাকে দুশ্চরিত্রা হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলাম। কারণ সে তার সীমা অতিক্রম করেছিলো, মহৎ কেউ ছিলো না।

আমি চাইনি চলচ্চিত্রের শুরুতেই তার প্রতি দর্শকের ভালোবাসা তৈরি হোক। তাই জাস্টিন তার স্ত্রীর খুনিদের খুঁজে ফেরার সময় যেমন আস্তে আস্তে স্ত্রীকে বুঝতে শুরু করে, তার সঙ্গে সঙ্গে আপনিও (দর্শক) চলচ্চিত্রের শেষে গিয়ে তাকে পছন্দ করবেন। এই চরিত্রের জন্য এটা একটি চাপ ছিলো। কারণ এই চলচ্চিত্রে তার পরিবর্তিত রূপ ফুটিয়ে তোলা ও সেটার বিকাশ করা বেশ কঠিন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এটাই ঘটেছে।

নিউমার : আচ্ছা, আপনি কেনিয়াতে এ ধরনের অনেক কিছুই শুট করেছিলেন, সেখানে কি আপনার জন্য শিক্ষণীয় কিছু ছিলো?  শুটিংয়ের সময় এমন কিছু কি হয়েছিলো যেটা আপনি চাচ্ছিলেন না?

মেইরেলেস : আমার জন্য এটা বেশ সহজ ছিলো, কারণ আমি শুধুই একজন পরিচালক। সচরাচর আমি যেটা চাই সেটাই নির্মাণ করি এবং এটা যথেষ্ট জটিল।

নিউমার : সিমন প্রচুর সাহায্য করেছিলেন?

মেইরেলেস : হ্যাঁ, শুধু পরিচালক হিসেবে কাজ করাটা খুব সহজ। যাই হোক, আমরা দৃশ্যটিতে সুদানের কোনো গ্রামকে দেখাতে চাচ্ছিলাম। ফলে আমাদের গায়ানাতে শুট করতে হয়েছিলো। কিন্তু সেখানে কোনো অবকাঠামো ছিলো না। তাই প্রচুর অসুবিধায় পড়েছিলাম। পুরো ইউনিট, খাবার ও প্রয়োজনীয় সবকিছুই সেখানে উড়িয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিলো। থাকারও কোনো ব্যবস্থা সেখানে ছিলো না। আমরা আড়াইশো শয্যার একটি তাঁবু স্থাপন করেছিলাম। খাবার ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিজেদেরই তৈরি করতে হতো। আর দিনে সূর্যের তাপ এতই প্রখর ছিলো যে, সেখানে থাকা যেতো না। কিন্তু রাতে শিকাগোর মতোই তীব্র বাতাস বয়ে যেতো।

নিউমার : তাঁবুগুলো আকারে কেমন ছিলো, খুব ছোটো?

মেইরেলেস : ১০ ফিট, ডাবল বেড এবং পিছন দিকে একটি করে ছোটো গোসলখানা ছিলো। আসলে ঠিক গোসলখানা না, ওখানে হোসপাইপ রাখা ছিলো, যা থেকে ঠাণ্ডা পানি পাওয়া যেতো।

নিউমার : অসাধারণ, ইউনিটের সবাই কি এই তাঁবুগুলোতে থাকতো?

মেইরেলেস : ঠিক সবাই না, সেখানে ১২ কক্ষের একটি লজও ছিলো, তার সঙ্গেই ক্যাম্পটি বানিয়েছিলাম। তো অভিনয়শিল্পীরা ওই কক্ষগুলোতে থাকতো এবং দলের বাকি সদস্যরা তাঁবুতে। আমি অন্য একটি তাঁবুতে থাকতাম। আমরা শেষ সিকোয়েন্সটি শুট করেছিলাম¾যেখানে টেসা মারা যায়; সেই লোকেশনটা অনেক সুন্দর ছিলো, তিনি হাঁটতেন সেখানে। আসলে তাঁবু বললে ভুল হবে, ৪৫টি তাঁবুর ছোটোখাটো একটি ক্যাম্প ছিলো সেটা। তবে অন্য ক্যাম্পটি খুব গরম ছিলো। কারণ সেখানে আড়াইশোটি তাঁবু ছিলো, লোক ছিলো প্রায় পাঁচশো জন। এই যখন পরিস্থিতি তখন খাবার, কাগজ এমনকি ঘোড়াগুলোও উড়োজাহাজে আনতে হয়েছে।

নিউমার : আচ্ছা, এই অতিরিক্ত খরচের কারণেই বাজেট হয়েছিলো ২৫ মিলিয়ন ডলার! আমি জানি এটা জেরি ব্রখেইমার-এর (Jerry Bruckheimer) মতো প্রযোজকের কাছে কিছুই না। কিন্তু যারা এ ধরনের বাজেটের কাজ করতে অভ্যস্ত নয়, তাদের জন্য এই বাজেট তো বিরাট কিছু।

মেইরেলেস : হ্যাঁ, এটা আমার ভাগ্যে ছিলো বলতে পারেন। তাছাড়া সবসময় তাদের অকারণে টাকা খরচ নিয়ে আমার অভিযোগও ছিলো।

নিউমার : কোনো উদাহরণ? সেখানে এমন কোনো বিষয় ছিলো, যেটা দেখে আপনার মনে প্রশ্ন জেগেছে¾এটা কীভাবে কিনলেন?

মেইরেলেস : একটা সিকোয়েন্স নিয়ে আক্রমণকারী দলের (অভিনেতাদের) সঙ্গে কথা বলতে বলতে একদিন লোকেশনে গিয়েছিলাম। গাড়িতে যেতে যেতে কিছু উট দেখতে পেলাম¾তিন-চার জোড়ার মতো। পরে শুটিং পরিকল্পনার সময় আমি বলেছিলাম, উটের কিছু দৃশ্য নেওয়া উচিত। তার ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় প্রযোজক একজনের সঙ্গে আমার পরিচয় করালেন, যার হাতে তার উটগুলোর ছবিও ছিলো। তিনি সোমালিয়ার একজন উট ব্যবসায়ী। তার খামার থেকে প্লেনে করে উট আনার কথা জানালেন প্রযোজক। আমি বললাম, আপনি কী করছেন এসব? তিনি বললেন, আপনি উট চেয়েছেন, তাই ভাবলাম সেগুলো সোমালিয়া থেকে আনাই। অবাক হয়ে ভাবলাম, এ লোক বলে কী! সেটা ছিলো পাগলামি, এবং আমি যথেষ্ট ভয়ও পাচ্ছিলাম। ব্যাপারটা এমন যে, আপনি যা চাইবেন তাই পাবেন। তাই এ বিষয়ে আমার অনুভূতি হলো, চাওয়ার বিষয়েও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কেননা চাওয়ামাত্রই তা হাজির হবে।

নিউমার : ৮০ মিলিয়ন ডলারের চলচ্চিত্রটি নির্মাণ না করা পর্যন্ত অন্তত অপেক্ষা করুন!

মেইরেলেস : আসলে আমি বুঝতেই পারিনি, এই বাজেটটা ৮০ মিলিয়নে পৌঁছাবে। কেননা, তাদের তো শুধু অভিনেতাদের টাকা দিতে হয়েছিলো¾হাস্যকর যে তা দিতেই বাজেটের অর্ধেক গেছে। আমার মতে, এ চলচ্চিত্রটিতে ২৫ মিলিয়ন খরচ করাই বেশ কঠিন।

নিউমার : প্রযোজক সিমন, মানে তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে, এই প্রজেক্ট বা প্রোডাকশন সম্পর্কে তার জ্ঞান, মেধা আপনাকে কি কোনোভাবে সাহায্য করেছিলো? আপনার সময় বাঁচানো ছাড়া?

মেইরেলেস : হ্যাঁ, মূলত তার সঙ্গে ট্রেসি সিওয়ার্ড (ব্রিটিশ চলচ্চিত্র প্রযোজক) নামে আরেকজন প্রযোজক ছিলেন। তিনিই মূলত সবকিছু দেখাশোনা করতেন। আর সিমন এখানকার অন্যান্য বিষয়গুলো দেখতেন।

নিউমার : কেনিয়া না, ফোকাস-এর বিষয়?

মেইরেলেস : উভয় জায়গাতেই। কেনিয়াতে তিনি চারিদিকে আমাদের ঘোরাঘুরির অনুমতি প্রসঙ্গে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। কিন্তু প্রাত্যহিক কাজগুলো ছিলো খুবই অদ্ভুত। তবে হেনিং মলফেন্টার (Henning Molfenter, বার্লিনে অবস্থিত Babelsberg Film studioর ব্যবস্থাপনা পরিচালক) সত্যিই জানেন, কী করে এগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হয়। সেখানে আমাদের দেশের মতো কিছুই ছিলো না; সত্যিই বিস্ময়কর। মূলত আমি সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করেই অভ্যস্ত। কেননা পর্যাপ্ত অর্থ যদি না থাকে, তখন সবকিছুই দ্রুত করতে হয়। চলচ্চিত্রের পরিকল্পনা থেকে শুটিং, সব কাজই তাই আমাকে এতদিন দ্রুত করতে হতো। কিন্তু এ চলচ্চিত্রটির ক্ষেত্রে একটা বড়ো পার্থক্য ছিলো। আসলেই এ অভিজ্ঞতার অনুভূতি অসাধারণ, রোমাঞ্চকর। প্রথমবারের মতো সত্যিই ধনী হলাম।

নিউমার : সফলতা আসলেও সুন্দর।

সূত্র : https://www.stumpedmagazine.com/interviews/fernando-meirelles/

অনুবাদক : রাশেদ রিন্টু, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

rashed.rin2@gmail.com


বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।



এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন