Magic Lanthon

               

শার্লি ক্লার্ক

প্রকাশিত ২৬ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘শুধু নারী হওয়ার কারণেই তিনি আমাকে অত্যন্ত ঘৃণা করতেন’

শার্লি ক্লার্ক


নৃত্যশিল্পী হিসেবে তার পরিচয় ছিলো সর্বত্র। অথচ একদিন সেই পথকে পাশ কাটিয়ে চলচ্চিত্রকে ভালোবেসে এসেছিলেন বর্ণিল এই মাধ্যমে। যদিও সিদ্ধান্তটি নিয়ে এতটুকু ঠকেননি; স্বাধীন চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবে আজ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত তিনি। ধনী-গরিব, সাদা-কালো, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যিনি বলতে ভালোবাসেনআমি মানুষ। আবার আমেরিকার মতো দেশের চাকচিক্যময় মূলধারার চলচ্চিত্রকে ছুড়ে ফেলে যিনি হেঁটেছেন অন্য এক পথে; যে পথ স্বাধীনতার কথা বলে, সমতার কথা বলে, অন্ধকারকে দূরে ঠেলে দেয়। অন্তহীন সংশয়, ভয় আর কণ্টকাকীর্ণ পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে পথ চলা এই মানুষটির নাম শার্লি ক্লার্ক।

নিউইয়র্কের ব্রিমবার্গ শহরে ১৯১৯ সালের ২ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করা ক্লার্ক পড়ালেখা করেছেন স্টিফেন্স কলেজ, বেনিংটন কলেজ, জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয় ও নর্থ ক্যারোলিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। কর্মজীবন শুরু করেন নিউইয়র্কের আধুনিক আঁভগার্দ নৃত্য আন্দোলনের একজন শিল্পী হিসেবে। তারপর পেশা বদল করে চলচ্চিত্রে মনোনিবেশ করেন তিনি। ১৯৫৩ সালে নির্মাণ করেন প্রথম স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ডান্স ইন দ্য সান। প্রথম চলচ্চিত্রেই সাফল্য। নিউইয়র্কের ডান্স ফিল্ম সোসাইটি এটিকে বর্ষসেরা চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচন করে। তার নির্মিত দ্য কুল ওয়ার্ল্ডই (১৯৬৪) ছিলো ভেনিস আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত প্রথম স্বাধীন চলচ্চিত্র।

তার নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্র হলো : বুলফাইট (১৯৫৫), অ্যা মোমেন্ট ইন লাভ (১৯৫৭), ব্রাসেলস লুপ (১৯৫৮), ব্রিজস-গো-রাউন্ড (১৯৫৮), অ্যা স্ক্যারি টাইম (১৯৬০), রবার্ট ফ্রস্ট : অ্যা লাভস কোয়ারেল উইথ দ্য ওয়ার্ল্ড (১৯৬৩), পোর্ট্রেট অব জসন (১৯৬৭), ম্যান ইন পুলার বিজনেস (১৯৬৭), ট্রান্স (১৯৭৮), ওয়ান টু থ্রি (১৯৭৮), সিসটেরিয়াম ইনিশিয়াশন (১৯৭৮), স্যাভেজ লাভ (১৯৮১), টাংস (১৯৮২), অরনেট : মেড ইন আমেরিকা (১৯৮৫)।

শার্লি ক্লার্ক ১৯৬২ সালে রবার্ট ফ্রস্ট : অ্যা লাভস কোয়ারেল উইথ দ্য ওয়ার্ল্ড-এর জন্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। সান ডিয়াগোর ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চলচ্চিত্রনির্মাতা ও গণমাধ্যমকর্মী ডি ডি হালেক ১৯৮৫ সালে নিউইয়র্কের চেলসি হোটেলে ক্লার্কের এই সাক্ষাৎকারটি নেন। সাক্ষাৎকারটি ম্যাজিক লণ্ঠন-এর জন্য বাংলায় ভাষান্তর করেছেন প্রদীপ দাস

 

ডিডি হালেক : যুক্তরাষ্ট্রে মায়া দেরেন (আমেরিকান নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্রনির্মাতা, নৃত্যশিল্পী, নৃত্যনির্দেশক; ১৯১৭১৯৬১), অ্যাভন রেইনার (আমেরিকান নৃত্যশিল্পী, নৃত্যনির্দেশক ও চলচ্চিত্রনির্মাতা) আর আপনার মতো অনেক নারী চলচ্চিত্রনির্মাতা রয়েছে; এদের প্রত্যেকের কর্মজীবন শুরু নৃত্যশিল্পী হিসেবে।

শার্লি ক্লার্ক : চলচ্চিত্রে এক বিস্ময়ের নাম মায়া দেরেন; তিনি এক মহান বিপ্লবী।

হালেক : চলচ্চিত্র নিয়ে কাজ করার জন্য অ্যাভনকে প্রথম সমর্থন দিয়েছিলো চারু ও নৃত্য জগতের মানুষেরাই, চলচ্চিত্রের কেউ নয়।

ক্লার্ক : হ্যাঁ, নারীবাদী শিল্পী গোষ্ঠীগুলো ওকে সমর্থন দিয়েছিলো।

হালেক : নৃত্যশিল্পের উন্নয়নের জন্য তো এখন অনেক কিছু করা হচ্ছে, সংশ্লিষ্ট কর্পোরেশনগুলো আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে।

ক্লার্ক : সত্যিই, এটি আশার কথা। গুরুত্বপূর্ণ যেকোনো রাজনৈতিক আধেয়কে তুলে ধরতে নৃত্যশিল্পকে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়। তবে যখনই নৃত্যশিল্পীরা এটি করে ফেলে, তখনই তারা আর কোনো আর্থিক সাহায্য পায় না। আমি কিন্তু কখনোই নৃত্যের জন্য কোনো আর্থিক সাহায্য পাইনি। অ্যাভনও বলেছে, সেও কোনো উৎস থেকে আর্থিক সাহায্য জোগাড় করতে পারেনি।

হালেক : এর কারণ হিসেবে আমার মনে হয়েছে, আপনার চলচ্চিত্রগুলো অত্যন্ত সহজবোধ্য। নারীবাদী তত্ত্ব সংকলনে অ্যাভনের কাজ নিয়ে অনেক লেখা আছে। তবে আপনার চলচ্চিত্রগুলো বোঝার জন্য কিন্তু কোনো ব্যাখ্যাকার সাহিত্যের প্রয়োজন পড়ে না। আপনি কাজের মধ্য দিয়ে প্রচুর সমালোচক তৈরি করেছেন।

ক্লার্ক : দেখুন, মূলধারার সমালোচকরা আমাকে নিয়ে লিখেছে। মাঝে মাঝে তারা বেশ জোরালো সমালোচনাও করে। সম্প্রতি একটি নাটকের ব্যাপারে আমি লস অ্যাঞ্জেলসে গিয়েছিলাম। সেখানকার আঁভগার্দ সাময়িকী (avant-garde weeklies) নাটকটি সম্পর্কে লিখলো যেপাগলামি, কাল্পনিকতা থাকলেও চমৎকার এক নতুন ধারার উদ্ভাবন এটি। অথচ দেখুন, প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলো নাটকটির মধ্যে অপেশাদারিত্ব, নির্বুদ্ধিতা ও অসামঞ্জস্যতার ছাপ খুঁজে পেলো। আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, একই বিষয় নিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা দুটি জায়গা থেকে আলোচনা করা হয়েছে। তবে এটি ঠিক, কাউকে বিরক্ত কিংবা রাগানোর মতো খুব সামান্য উপাদানই কিন্তু আমার ওই নাটকটিতে ছিলো।

হালেক : আপনার চলচ্চিত্রগুলোতে তো নারী বিষয়ক তেমন কিছু দেখতে পাই না।

ক্লার্ক : আমি নারীবাদী চলচ্চিত্র দেখতে পছন্দ করলেও এ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়ে ওঠেনি। অবশ্য এ ধরনের চলচ্চিত্র-নির্মাণের জন্য আজ পর্যন্ত ভালো কোনো বিষয়ও আমি পাইনি। আসলে আমার যা করতে ভালো লাগে আর যা দেখতে ভালো লাগেএর মধ্যে আমি ঠিক নির্দিষ্ট করে সম্পর্ক করতে পারি না। আর একটি কথা, আমি আসলে আঁভগার্দ ধারার শিল্পের প্রতি খুব একটা আগ্রহী নই। কিন্তু তার পরও কমবেশি আমি সেটি করে থাকি।

হালেক : নৃত্য, নাটক, সাহিত্যশিল্পের এসব শাখায় তো আপনার অবাধ যাতায়াত। অনেক চলচ্চিত্রনির্মাতারই অবশ্য এটি নেই। যুক্তরাষ্ট্রে আপনাদের মানে আমাদের জগৎ তো অন্যদের থেকে আলাদা। দৃক শিল্পমাধ্যম নিয়ে যারা কাজ করেন তাদের জগৎ আলাদা। নিরীক্ষাধর্মী কাজ করা চলচ্চিত্রকারদেরও আলাদা একটি জগৎ আছে। ওদিকে চিত্রকর ও নৃত্যশিল্পীদেরও আলাদাভাবে কাজ করতে দেখা যায়। তবে এদের মধ্যে তেমন কোনো সমন্বয়ই দেখতে পাওয়া যায় না।

ক্লার্ক : আমি নিশ্চিত করে বলতে পারছি না, আমি এগুলোর মধ্যে ঠিক কোন্ জগতে বাস করি। ১৯৬৩ সালে দ্য কুল ওয়ার্ল্ড নির্মাণের পর অটো প্রিমিঙ্গার (অস্ট্রিয়ান বংশোদ্ভূত আমেরিকান প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা; ১৯০৫১৯৮৬) আমাকে দেখতে চাইলেন। তিনি আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমি মূলত কী করতে চাই? কিছুক্ষণ কথা বলার পর প্রিমিঙ্গার নিজেই বললেন, আমার মনে হয় না, তুমি এই হলিউডকে চাও! আমার সত্যিই মনে হয় না, হলিউডের যে জীবনাচরণ, সেভাবে তুমি চলতে চাও এবং সেখানে যে ধরনের কাজ হয়, সেগুলো তুমি করতে চাও।

সৃষ্টিকর্তাকে সাক্ষী রেখে বলছি, কয়েক বছর লজ্জায় আমি কাউকে বলতেই পারিনি, আমি দ্য কানেকশন-এর (১৯৬১) জন্য অ্যাকাডেমিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি। সত্যি বলতে কি, এ ধরনের পুরস্কার জয়ের কোনো আশাই আমার ছিলো না। কিন্তু এটি বলতে পেরে আমার সত্যিই ভালো লাগতো, দ্য কানেকশন কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কার জিতেছে। ভেনিস চলচ্চিত্র উৎসবে প্রথমে যে স্বাধীন চলচ্চিত্রটি প্রদর্শন হয়, সেটি দ্য কুল ওয়ার্ল্ডএটি বলতেও আমার ভালো লাগতো।

চেলসি হোটেলে কাজ করার পাঁচ বছর পর একদিন রজার করম্যান (আমেরিকান প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা) আমাকে হলিউডে চলচ্চিত্র-নির্মাণের প্রস্তাব দিলেন। আমার ২২ বছর কর্মজীবনের পর রজার আমাকে দিয়ে এমন কিছু করাতে চাইলেন, যা আমাকে কষ্ট দিয়েছিলো। তার ধারণা, আমি জীবনে কিছুই করিনি। আমাকে বলতে দাও (হালেক-এর উদ্দেশে), সে আমাকে কী বলেছিলো। আমরা তো একসঙ্গেই বসেছি, তাই না? একবার তিনি ক্যামেরা-সঞ্চালকের কাছ থেকে জানতে পারেন, তিনি (করম্যান) যেভাবে কাজ করেন আমি ঠিক সেভাবে কাজ করছি না। করম্যান তাই আমার কাছে এসে বললেন, শুনলাম শুটিংয়ে দৃশ্যধারণ নিয়ে তোমার কোনো পরিকল্পনা নেই। আমি তখন নিষ্পাপ শিশুর মতোই তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিসের পরিকল্পনা! তিনি বললেন, ওয়াইড, মিডিয়াম ও ক্লোজআপ শট্এগুলোর।

আমি বললাম, কেনো আমি সেগুলো করবো? তাছাড়া আমি তো সবসময় প্রয়োজনীয় শট্ই নিই। আর যদি দৃশ্যকে জোরালো বা হালকা করার জন্য একটু কাটছাঁট বা সংযোজন কিংবা অতিরিক্ত ক্লোজআপ শটের প্রয়োজন পড়ে, সেটি নিবো। এটি শুনে করম্যান আমাকে বললেন, সম্ভবত আমাদের আর একসঙ্গে কাজ করা সম্ভব না। আমি দুঃখিত। আমার আশা ছিলো, মার্টিন স্করসেস (আমেরিকান পরিচালক, চিত্রনাট্যকার, প্রযোজক, অভিনেতা ও চলচ্চিত্র ঐতিহাসিক) ও পিটার বগডনোভিচ-এর (আমেরিকান পরিচালক, প্রযোজক, অভিনেতা, চলচ্চিত্র ঐতিহাসিক ও সমালোচক) জন্য আমি যা করেছি, তোমার জন্যও সেরকম কিছু একটি করবো।

পরে করম্যান বেশ কয়েকজন নির্মাতার তালিকা তৈরি করলেন, যারা প্রত্যেকে তাদের প্রথম চলচ্চিত্রটি তার সঙ্গে নির্মাণ করেছিলো। সেই নির্মাতারা সবাই আমার থেকে কমপক্ষে ১০ বছরের ছোটো। পরে উপলব্ধি করলাম, আমি কতোটা খারাপ সে সম্পর্কে করম্যানের কোনো ধারণাই ছিলো না! আমি একটি বিষয়ে পরিষ্কার হয়েছিলাম, করম্যান কোনো অভিজ্ঞ কিংবা পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠিত নির্মাতার সঙ্গে কথাই বলতেন না। তিনি হয়তো জানতেন না, আমি আসলে কে! করম্যান চাইতেন আমি তার স্ক্রিপ্টে শুট্ করি, যেখানে প্রতিটি দৃশ্য হবে ওয়াইড, মিডিয়াম ও ক্লোজআপ। আর পরে তিনি তা সম্পাদনা করবেন। তবে সস্তা কোনো স্ক্রিপ্টের প্রতি মনোযোগ দেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব ছিলো না। আমি যেভাবে কাজ করতে চাই, কমপক্ষে ততোটুকু অধিকার ছাড়া, শপথ করে বলছি, আমার পক্ষে কাজ করা সম্ভব নাহতে পারে সেটি আমার পাগলামি।

হালেক : আপনার কি মনে হয়, আপনার সম-মর্যাদাসম্পন্ন কোনো পুরুষ চলচ্চিত্রনির্মাতা করম্যান-এর কাছে আসলে, তিনি তার সঙ্গেও একই রকম আচরণ করতেন?

ক্লার্ক : আমিও এটি ভেবেছি; আমার সঙ্গে তিনি যে ঢঙে কথা বলতেন, একইভাবে কি পুরুষের সঙ্গেও বলেন? এটি সত্য, আমাকে তিনি বিশ্বাস করতেন না। এখানে (যুক্তরাষ্ট্রে) নারী শিল্পীরা ব্যাপক বৈষম্যের শিকারযা এখনো খুব জোরালোভাবেই আছে। মূলত আমি এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছিলাম। একজন নারী নির্মাতা হিসেবে আমার নিজের ওপর এই বিশ্বাসটুকু ছিলো। আসলে কেউ এই দায়িত্বটুকুও নিতে চায় না। সন্দেহ নেই, পুরুষ হলে আমার কর্মক্ষেত্র ভিন্ন হতো। তবে আমি যদি পুরুষ হয়েও জন্ম নিতাম, তাহলে হয়তো অন্য ধরনের মানুষই হতাম।

হালেক : আমার মনে হয়, বর্তমানে হলিউডে নারী নির্মাতাদের চেয়ে নারী প্রযোজকদের সংখ্যা বেশি।

ক্লার্ক : নারী প্রযোজকরা টাকা সংগ্রহ করার ক্ষেত্রে বেশ দক্ষ। চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে একত্রীকরণের ক্ষেত্রেও তারা দক্ষতার পরিচয় দেয়এটি আপনি ভালোই জানেন।

হালেক : আমি এখন যে কথাটি বলবো, তা আপনার কাছে উপহাস মনে হতে পারে, কিন্তু সত্য। আমার মতে, সব বিষয়ের জন্য আপনিই শ্রেষ্ঠ শিক্ষক।

ক্লার্ক : আমি প্রচণ্ড রকমের কৌতূহলী, সম্ভবত এ কারণেই আমি ভালো শিক্ষক। কিন্তু চারপাশের অন্যান্য নারীদের মতো প্রযুক্তি সম্পর্কে আমার অতোটা জানাশোনা নেই। এ সম্পর্কে নারীরা ভালো জানলেও পুরুষের চেয়ে তারা পিছিয়ে আছে। তার মানে এই নয় যে, পুরুষরাই ভালো জানে। হাতেগোনা দুই-একজন পুরুষ শিক্ষক পাওয়া যাবে, যারা ভালো। ইউ সি এল এ-তে (ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস অ্যাঞ্জেলস) অনেক শিক্ষক আছেন যারা একেবারেই অযোগ্য। অবশ্য ইউ সি এল এর চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন বিভাগে নারী শিক্ষক প্রায় নেই বললেই চলে।

কি নারী কি পুরুষ, চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিতে ইউ সি এল এর স্নাতকদের (কাজ করার) পরিসংখ্যানও প্রায় শূন্যের কোঠায়। এন ওয়াই ইউ (নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি) ও ইউ এস সির (ইউনিভার্সিটি অব সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়া) ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। বর্তমানে এসব প্রতিষ্ঠানে সত্যিকারের কিছু কর্ম উদ্যোমী শিক্ষার্থী আছে। এরা বিশ্ববিদ্যালয়ে না গেলেও ভালো করতো। এদের শুধু যন্ত্রপাতির ব্যবহারটা জানা প্রয়োজন ছিলো। এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটিই তাদের একমাত্র কারণ। কৃষ্ণাঙ্গ হলে নিশ্চিতভাবেই এরা আর্থিক অনুদান পেতো। এই টাকা তাদের বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্র-নির্মাণে কাজে আসতো। এখন বাফেলোতে তো কৃষ্ণাঙ্গ চলচ্চিত্র উৎসব চলছে; ইউ সি এল এর যেসব শিক্ষার্থী যন্ত্রপাতি ব্যবহারের সুযোগ পেয়েছিলো, উৎসবের প্রায় অর্ধেক চলচ্চিত্রই তাদের নির্মিত।

হালেক : তাহলে অন্যান্য স্নাতকদের বেলায় কী ঘটে?

ক্লার্ক : তাদের কেউ প্রযোজক, কেউ এজেন্ট, কেউ বা চলচ্চিত্র বিক্রেতা হবে; তবে বেশিরভাগই হবে লেখক। অবাক করার বিষয় হলো, আমি যাদের পড়িয়েছি তাদের প্রায় সবারই হলিউড নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা আছে। তবে আমি কখনো ভাবিনি, হলিউড থেকে ফান্ড নিয়ে কাজ করবো। নিজেকে আমি ইউরোপের নির্মাতা রোসেলিনি, ডি সিকা ও ফেলিনির সহযাত্রী মনে করি। গদার ও তার পুরো দলের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। আমি তাদের মধ্যেই নিজেকে আবিষ্কার করেছি।

হালেক : তাদের অনেকেই কিন্তু সরকার, আর্ট কাউন্সিল কিংবা ইউরোপিয়ান টেলিভিশনের সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছে।

ক্লার্ক : ও আচ্ছা, অ্যাগনেস ভারডা (ফরাসি চলচ্চিত্রনির্মাতা, চিত্রনাট্যকার ও প্রযোজক) আমেরিকাতে দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। তবে এর জন্য তিনি আর্থিক সাহায্য নিয়েছিলেন ফ্রান্সের কাছ থেকে। অবশ্য তাকে শেষ পর্যন্ত ফ্রান্সেই ফিরে যেতে হয়েছিলো; কারণ আমেরিকাতে তার এই ফিল্মগুলো বিক্রি হচ্ছিলো না।

হালেক : আপনি তো দেশের সবচেয়ে বড়ো সরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ডব্লিউনেট-এর ল্যাব ব্যবহারের অনুমতি পেয়েছিলেন?

ক্লার্ক : হ্যাঁ। কিন্তু সেটি এমন একটি জায়গা ছিলো, যেখানে বৈষম্যের সবচেয়ে কুৎসিত রূপটি আমি দেখেছিলাম। সেখানকার প্রকৌশলী ছিলেন অত্যন্ত বাজে লোক। তিনি সবসময় আমার কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির চেষ্টা করতেন। বোঝা যেতো শুধু নারী হওয়ার কারণেই তিনি আমাকে অত্যন্ত ঘৃণা করতেননারী হওয়াটা কি আসলেই খারাপ! আমার জীবনে ঘটে যাওয়া বৈষম্যগুলোর মধ্যে সম্ভবত এটিই সবচেয়ে ভয়াবহ।

হালেক : আসলে প্রকৌশলীরা প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন (পুরুষ) কর্মকর্তাদের মতো সূক্ষ্মভাবে হয়রানি করতে পারে না। আমার জানা মতে, সেখানে বেশকিছু নারী সমস্যায় পড়েছিলো। ওই জায়গাটি আসলে কাজের জন্য মোটেও ভালো ছিলো না। ন্যান্সি হোল্ট নামে এক নারী এখানে তার ধারণকৃত শব্দ মুছে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে কাজের সুযোগ পাওয়া কোনো পুরুষের ক্ষেত্রে কিন্তু এমনটি ঘটেনি। দুঃখজনক বিষয় হলো, শিল্পীরা কোনো অনুষ্ঠানে দিন-রাত পরিশ্রম করে যে বেতন পেতো, প্রকৌশলীরা তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি বেতন পেতো। মূলত শিল্পীদের জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ দিয়েই কিন্তু প্রকৌশলীদের বেতন ও টিভি সরঞ্জামাদির ভাড়া দেওয়া হতো, অথচ তারাই (শিল্পীরা) ঠিক মতো বেতন পেতো না।

ক্লার্ক : আমার সেই অভিজ্ঞতা ছিলো খুবই হতাশার; আমার মনোবল নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো। আমার জীবনে খুবই খারাপ সময় ছিলো সেটি; সত্যিই তখন আমি খুব হতাশ ছিলাম। এই কষ্টের কথা আমি কখনোই বলতে পারিনি; কারণ, আমি নারী। আমার আত্মোপলব্ধি হলো, সেখানে কোনো একটি মারাত্মক সমস্যা আছে। নারী হওয়াতে সেখানে আমার কর্মজীবন সঙ্কীর্ণ ছিলো। অবশ্য আমি নির্দিষ্ট কোনো উদাহরণ দিয়ে এটি বোঝাতে পারবো না। এটি ছিলো একটি সামগ্রিক পরিবেশ। বাতাসে একধরনের শিহরণ, চারদিকে আলোকসজ্জা ছিলো। আপনি যদি দেখতেন তাহলে বুঝতে পারতেন, লোকগুলোর চিন্তা কী অদ্ভুত। আর এর একটি প্রভাব আছে, যা আপনাকে পরিবর্তন করে দিবে। আমি সেরকম কেউ নই যে, সহজে আমাকে প্রভাবিত করে ফেলবে। আমি যদি পুরুষ হতাম, তাহলেও নারীদের কর্ম পরিবেশের মান দ্বিগুণ করার জন্য তাদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতাম না। সবচেয়ে বড়ো কথা, আমি একটু ব্যতিক্রমই হতাম।

হালেক : এই ধরনের সংগ্রামে লড়তে আপনাকে তো অনেক বেগ পেতে হয়েছে।

ক্লার্ক : সে কথা আর বলো না, আমি যতোটুকু না দৃঢ়, বাইরে তার চেয়ে বেশি দৃঢ়তা দেখাতাম। ফলে পুরুষ বা অন্য যাদের সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিলো, শেষ পর্যন্ত তাতেও ফাটল ধরে। কোনো দায়িত্বে থাকা অবস্থায় আমি সবসময় সামনেই থাকতাম। ফলে আমাকে দায়িত্বের চেয়ে অনেকখানি বেশিই কাজ করতে হতো। সম্ভবত বিষয়গুলো এখন পরিবর্তন হচ্ছে।

আর অতীতকে নিয়ে আমার মোটামুটি পাঁচ ধরনের চিন্তা হয়। অবসরে আমি যখন ভাবি, চিন্তা করি, তখন কিছু মানুষের প্রতি আমার একধরনের শ্রদ্ধা কাজ করে। আমি সর্বক্ষণ এগিয়ে যেতে চাইতাম, তবে এখন মনে হয় খুব বেশি তা পারিনি।

আসলে আমি কখনোই মহান হলিউডি চলচ্চিত্র-নির্মাণের আশা করিনি। কিন্তু চলচ্চিত্র নিয়ে আমার নিজস্ব কিছু চিন্তা আছে। আমার খুবই ইচ্ছে, শেলি উইন্টারস্-এর (আমেরিকান অভিনেতা, ১৯২০২০০৬) সঙ্গে একটি চলচ্চিত্র-নির্মাণের। ঠিক জানি না, আমরা এই দুই নারী কাজটি একসঙ্গে কখনো করতে পারবো কি না। সম্ভবত কোনো পুরুষ নির্মাতার সঙ্গে কাজ করার চিন্তা-ভাবনা তার (উইন্টারস) আর নেই। আমরা দুজনই নিজেদেরকে অতি উৎসাহী ভাবতাম, বলতে পারেনপাগল মনে করতাম। তবে আমি ওকে (উইন্টারস) এবং আমাকে খুব ভালো করেই চিনি; তা থেকে আমি বলতে পারি, আমরা কেউ মোটেও অতি উৎসাহী নই। কিন্তু যেকোনো স্পষ্টভাষী নারীই নিজেকে কিছুটা হলেও অতি উৎসাহী মনে করে।

হালেক : আপনি যদি পুরুষ হতেন তাহলে আপনাকে সত্যিকারের শিল্পী ও প্রতিভাবানদের কাতারেই ফেলা হতো।

ক্লার্ক : চমৎকার ব্যক্তিত্ব আর কোনো কিছু এগিয়ে নেওয়ার শক্তিএমন অনেক গুণাবলীর কারণেই আমরা (নারী) বিস্ময়কর মানুষ হিসেবে পরিগণিত হতে পারতাম। কিন্তু নারী হয়েও মনে হয় আমরা একটু খ্যাপাটে। যে কথা বলছিলাম, আমার ব্যক্তিত্বের কিন্তু পরিবর্তন হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই আমি নিজের একটি চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দাঁড় করাতে চেষ্টা করছিলাম। আমি যদি ইঁদুরের মতো থাকতাম (যা আমার সহজাত চরিত্রেরই একটি অংশ), তাহলে কিছুই পেতাম না, নিঃসন্দেহে কোথাও পৌঁছাতেই পারতাম না।

আমার এই সাফল্যের পিছনে কিছু কারণ আছে। প্রথমত, আমার যথেষ্ট টাকা ছিলো, সে কারণে টিকে থাকার জন্য কারো অধস্তন হিসেবে আমাকে কাজ করতে হয়নি। দ্বিতীয়ত, মানুষ হিসেবে যেভাবে আমি বাঁচতে চেয়েছি ঠিক সেভাবেই আমার ব্যক্তিত্ব গড়েছি। আমি যদি হস্তশিল্পের কাজ করতাম, বাড়িতে বসে বেত, গাছের পাতা ইত্যাদি দিয়ে সুন্দর সুন্দর ঝুড়ি বানাতাম; মাঝে মাঝে ভাবি, এটি করলে বোধ হয় বেশি ভালো হতো।

কিন্তু আমি এমন একটি ক্ষেত্র বেছে নিয়েছি, যেখানে বাঁধাধরা নিয়ম থেকে বেরিয়ে সব জায়গায় আমি যোগাযোগ করতে পারি; প্রচুর অর্থ, লোকবল ও যন্ত্রপাতি নিজের মতো করে ব্যবহার করতে পারি। অথচ, এখন নারীরা নির্দিষ্টভাবে এগুলোর কোনোটিতেই ভূমিকা রাখতে পারে না।

হালেক : আমাদের সমাজে বর্ণবৈষম্যের শিকার (কালো) মানুষদের যেভাবে মূল্যায়ন করা হয়, সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ নিয়ে আজকে যে প্রচুর কথা হচ্ছে, তার আগেই সেগুলো আপনি চলচ্চিত্রে তুলে ধরেছেন!

ক্লার্ক : আমি কৃষ্ণাঙ্গদের সমস্যার সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেছি, কারণ নারী বিষয়ক প্রশ্নগুলো নিয়ে তখনো আমি দ্বিধায় ছিলাম; তাই এ দুটি বিষয় একইভাবে আমার চিন্তায় উঠে এসেছে। আমি কৃষ্ণাঙ্গদের সমস্যা সহজেই বুঝতে পারতাম, কারণ পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে আমি নিজেকে তাদের সমতুল্য মনে করতাম। যখন হেরোইন আসক্তদের নিয়ে আমি দ্য কানেকশন নির্মাণ করি, তখনো এই আসক্তি ও অমনোযোগিতা সম্পর্কে বলতে গেলে আমি কিছুই জানতাম না। সমাজের প্রান্তিক মানুষদের এখানে প্রতীকী উপস্থাপন করা হয়েছে। আমি যে সমাজ-সংস্কৃতিতে বেড়ে উঠেছি তাতে আমি নিজেই প্রান্তিক ছিলাম, সেখানে আমি সবসময় একাকিত্ব বোধ করতাম। আমি এমন একটি সময়ের মধ্যে বেড়ে উঠেছি, যেখানে নারীরা কিছুই করতো না বা করতে দেওয়া হতো না। আর তারা এখনো কিছুই করে না। 

হালেক : এখন আবার দ্য কুল ওয়ার্ল্ড প্রসঙ্গে ফিরে আসি।

ক্লার্ক : দ্য কুল ওয়ার্ল্ড-এর প্রসঙ্গটি একটু ভিন্ন। কারণ ওয়ারেন মিলার-এর এই উপন্যাস অবলম্বনে একটি নাটক হয়েছিলো। তবে নাটক হিসেবে এটি সফল হয়নি। এরপর আমি তা থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণ করি। নাটক হিসেবে এটি ব্যর্থ হওয়ার পর তা নিয়ে অবশ্য খুব বেশি কিছু করার ছিলো না। মিলার এতে এতটাই হতাশ হয়েছিলেন যে, তিনি বললেনতুমি এটি নিয়ে যা ইচ্ছে তাই করো।

হালেক : এক ভাবে দেখলে তিনি (মিলার) তো কোনো সহযোগিতাই করেননি।

ক্লার্ক : হ্যাঁ, কারণ আমি মূলত কাজ করেছিলাম কার্ল লির (আফ্রো-আমেরিকান অভিনেতা; ১৯২৬১৯৮৬) সঙ্গে, ওয়ারেন মিলারের সঙ্গে নয়। কার্ল লি-ই উপন্যাসটির সব প্রতিবন্ধকতা দূর করে, নতুন করে সংলাপ লিখে চরিত্রের সঙ্গে সম্মিলন ঘটান। তারপর আমি সেটি নিয়ে কাজে নেমে পড়ি। মোট কথা, আমার যতোটুকু অবদান তা কেবল চলচ্চিত্র-নির্মাণে।

হালেক : চলচ্চিত্রের ইতিহাসে অল্প যে কয়েকজন নারীর নাম পাওয়া যায়, তাদের মধ্যে আপনি অন্যতম। গত সেমিস্টারে চলচ্চিত্রে নারী নিয়ে একটি কোর্স পড়িয়েছিলাম আমি। আপনি যদি এর যেকোনো একটি পাঠ্যবই খোলেন, তাহলে সেখানে দেখতে পাবেন দুজন নারীর কথা; একজন আপনি, অন্যজন মায়া দেরেন।

ক্লার্ক : যেসব বইয়ে আমি নেই, সেখানে আমার নাম বলাটা কোন্ ধরনের ঠাট্টা; তাছাড়া সেসব বইয়ে তো কোনো নারীরই উল্লেখ নেই।

হালেক : আপনি হয়তো জানেন না, নারী ও চলচ্চিত্র নিয়ে নতুন কিছু বই এসেছে।

ক্লার্ক : চলচ্চিত্রনির্মাতাদের নিয়ে লেখা বইয়ে থাকতে পারাটা আমার জন্য আনন্দের। কারণ, রেনেঁ ক্লেয়ার (ফরাসি চলচ্চিত্রনির্মাতা; ১৮৯৮১৯৮১) ও রেনেঁ ক্লেমন্টদের (ফরাসি চলচ্চিত্রনির্মাতা; ১৯১৩১৯৯৬) সঙ্গে শার্লি ক্লার্ক! আমি আসলে বলতে চাচ্ছি, শুধু চলচ্চিত্রনির্মাতা হিসেবেই আমি পরিচিত হতে চাই, নারী পরিচয়ে নয়। নারী যদি নিজেদেরকে এভাবে সব জায়গায় তুলে ধরতে পারে, তাহলে সেটিই সবচেয়ে বড়ো কাজে দিবে।

 

হালেক : নারীরা যে কাজগুলো করেছে তা গভীরভাবে দেখতে বা উপলব্ধি করতে এই বোধটি তো সহায়তা করে। এটি কি নারীদের কোনো গণ্ডির মধ্যে না রেখে বরং বিশেষ সুবিধা দেয়?

ক্লার্ক : নারীরা বর্তমানে যে ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণ করছে তা শ্রেণিবিভাগ করে বিশ্লেষণ প্রয়োজন। আর এজন্য আমাদের নিজেদের প্রতি আরো গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এক্ষেত্রে মৌলিক যে প্রশ্নটি চলে আসে তা হলোনারী সচেতনতা কী? এটি অবশ্যই রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক হতে হবে। তবে এর সঙ্গে জৈবিক কিছু বিষয় ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। আমরা জানি, নারীরা জন্মদাত্রী। কিন্তু আমি মনে করি, একজন পুরুষ যখন বীর্যপাত ঘটায়, তখন সেও একটি শিশুর জন্ম দেয়। মূল পার্থক্যটা হলো আমাদের সংস্কৃতিতে। স্বাভাবিক মানুষ হিসেবে দেখলে নারী-পুরুষের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যাবে না। আপনি যে মানুষই হন, নারী- পুরুষের থেকে যেকোনো একটিকে বেছে নেওয়া ছাড়া আপনার কিছু করার থাকবে না।

এজন্য সবকিছুই এখন মারাত্মকভাবে পুরুষের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। আমার মনোভাব নারী বা পুরুষবাদী নয়। এগুলো সাধারণ রাজনৈতিক ধারণা মাত্র। কিন্তু পৃথিবীকে তো আরো হাজার হাজার বছর পাড়ি দিতে হবে, আর সে সস্পর্কিত আমার একটি মতবাদ (তত্ত্ব) আছে। বিষয়টি এমন যে, ভবিষ্যতে যদি জীবের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন ওঠে, সেক্ষেত্রে আমি পুরুষকে বেছে নিবো না। কারণ পুরুষের টিকে থাকার ক্ষমতা কম। সে অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারে না। বরং সে প্রাণী জগতের ধ্বংসাত্মকদের একজন। আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি, নিরাপদ কোনো স্থানে যদি পুরুষের সব বীর্য সংরক্ষণ করা যায়, তাহলে পরবর্তী ১৫শো বছর টিকে থাকা সম্ভব।

হালেক : আপনার মতবাদে (তত্ত্বে) আপনি মানবজাতি ধ্বংসের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাহলে কেনো তারা ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করে?

ক্লার্ক : আমার মনে হয়, পুরুষ জাতি এখন আতঙ্কিত। পৃথিবী যেসব কারণে প্রাণশূন্য হবে তার একটি এই ক্ষেপণাস্ত্র। তারা নিজেদের ধ্বংস দেখতে পাচ্ছে। পুরুষেরা এমনই এক জাত, যারা অধঃপাতে যাচ্ছে জেনেও সবকিছু তাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে চায়। খেয়াল করুন, এই মানুষগুলোই এল সালভাদরে বোমা মারতে চায়। আপনি নিশ্চয়ই নারীদের এভাবে নীচে নামতে দেখবেন না। বরং, তারা অর্থনৈতিকভাবে এল সালভাদরকে সচ্ছল করতে (পুরুষ) রিগান সরকারের পক্ষে লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলছে। আপনি কি চিন্তা করতে পারেন, সেই রিগান সরকার গোপনে সারাদেশে ছোটো পরিসরে বোমা সংরক্ষণ করছে? রিগান কখনোই এই জঘন্য কাজ করা থেকে বিরত হননি।

হালেক : আপনি আপনার চলচ্চিত্রের রাজনীতিকে কীভাবে শ্রেণিবিভাগ করবেন?

ক্লার্ক : তরুণ বয়সে আমি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলাম। আমি সবসময় কমিউনিস্টদের মতো করেই থাকতাম এবং তাদের সব কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলাম। আর অ্যাটম বোমার বিরুদ্ধে আমরা গোড়া থেকেই বিভিন্ন পদক্ষেপ নিই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে আমরা কারখানাগুলোতে বোমা নিক্ষেপ বন্ধের জন্য আদালতের শরণাপন্নও হয়েছিলাম। আমি মূলত রাষ্ট্র নামক প্রতিষ্ঠানটির বিরোধী। আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলো, আমি একজন নৈরাজ্যবাদী। একজন নৈরাজ্যবাদী কিন্তু কিছুটা হলেও মার্জিতভাবে জীবনযাপন করে। আমি আমার আন্দোলন চালিয়ে যাবো কিন্তু বোমার মতো বিধ্বংসী কোনো কিছুর সঙ্গে এখনো আপোস করছি না। আমি এমন একধরনের সমাজ চাই, যা তার কাজের মাধ্যমে নৈরাজ্যবাদ প্রতিষ্ঠা করবে। আর সেখানে আমরা টিকে থাকবো একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে।

হালেক : আপনার চলচ্চিত্র একদিকে যেমন সমাজের সমালোচনা করে, অন্যদিকে গণমাধ্যমেরও সমালোচনা করে থাকে।

ক্লার্ক : আসলে বর্তমান বিশ্ব সম্পর্কে এটি আমার মন্তব্য। কারণ আপনি যদি বর্তমান বিশ্বে যা ঘটছে তার সমালোচক হন, তাহলে মনে রাখবেনআপনি একই সময়ে গণমাধ্যমেরও সমালোচক। আসলে দুটি বিষয়ই একসঙ্গে এগিয়ে চলে।

হালেক : আর গণমাধ্যমই তো এখন আমাদের সমাজকে সবচেয়ে বেশি পুঁজিবাদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

ক্লার্ক : হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন, এখন গণমাধ্যমই তো বিশ্ব।

 

সূত্র : http://davidsonsfiles.org/shirleyclarkeinterview.html

অনুবাদক : প্রদীপ দাস, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী।

pradipru03@gmail.com

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন