Magic Lanthon

               

হরিসাধন দাশগুপ্ত

প্রকাশিত ১৭ জানুয়ারী ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘আমি কাঙাল হয়ে রয়েছি মানে বিশ্বাস করো বাংলাদেশ আমার দেশ’

হরিসাধন দাশগুপ্ত


ভারতিয় চলচ্চিত্রের পুরোধা ব্যক্তিদের অন্যতম হরিসাধন দাশগুপ্ত। চলচ্চিত্র জগৎ থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন বহুদিন; সে ছিলো তার স্বেচ্ছা-নির্বাসন। মূলত প্রামাণ্যচিত্র নির্মাতা হলেও তিনি কমললতা (১৯৬৯), একই অঙ্গে এত রূপ (১৯৬৫) কাহিনীচিত্রের অনুবর্তী আরো অনেক চলচ্চিত্র বানাতে পারতেন, কিন্তু বানাননি। সত্যজিৎ রায়, সি দাশগুপ্ত, অসিত সেনের সঙ্গে ছিলেন কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। টাটা স্টিলের ঐতিহ্যসন্ধানী তথ্যচিত্রের পরে আরো বহু ব্যক্তি ও সংস্থা হয়ে উঠতে পারতো তার তথ্যচিত্রের বিষয়, কিন্তু তার সংখ্যা নেহাতই হাতেগোনা। 

কলকাতার চলচ্চিত্রসমাজে তার নেতৃত্ব প্রয়োজনীয় ছিলো, তবু নিতান্ত অবহেলায়, হয়তো কিছুটা বৈরাগ্যেও তিনি সব ছেড়েছুড়ে বাসা বেঁধেছিলেন পল্লিগ্রামে, শাহরিক বলয় থেকে দূরে। কমলকুমার মজুমদারের গুণমুগ্ধ, সত্যজিৎ-ঋত্বিকের ঘনিষ্ঠ সহশিল্পী, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ সাহেবের মন্ত্রশিষ্য হরিসাধন দাশগুপ্তের এই শেষ সাক্ষাৎকারটি নেওয়া হয়েছিলো তার প্রয়াণের দুমাস আগে। আসলে এটিকে সাক্ষাৎকার না বলে সরল আত্মকথন বললেই উপযুক্ত নাম দেওয়া হয়। প্রচণ্ড আগ্রহ নিয়ে অভিমানী এই মানুষটির সঙ্গে ১৪ জুলাই ১৯৯৫ সালে কলকাতার শান্তিনিকেতনে বসে কথা বলেছিলেন আরিফ হায়দার।

 

ভূমিকার পরিবর্তে

রক্তের বন্ধনের চেয়ে একটি দেশের মানচিত্রের বন্ধন যে হৃদয়ে কতোটা রক্তক্ষরণ করে তা বুঝতে পেরেছিলাম হরিসাধন দার চোখের ভাষায়। আমি তখন রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ছাত্র। কলকাতার ‘নন্দন কানন সন্তোষপুরে আমরা চার বন্ধু এ.টি.এম. জাহাঙ্গীর (রবীন্দ্রসঙ্গীতের ছাত্র), অনিক রেজা (ভাস্কর্যের ছাত্র), সাজু (ইংরেজির ছাত্র) ও আমি একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকি। বাংলাদেশের অনেক শিক্ষার্থী তখন লেখাপড়া করে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের জোড়াসাঁকো ক্যাম্পাসে। আমার মতো বাংলাদেশি শিক্ষার্থীরা এভাবেই বাসা নিয়ে থাকে, হাতেগোনা দু-একজন হোস্টেলে থাকার সুযোগ পায়।

কলকাতা শহরে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জীবন বেশ ভালোই কাটছিলো। সবাই সবার খোঁজ-খবর রাখে; এমনকি অর্থের অভাব হলে ধার দেবার লোকের খুব একটা অভাব হয় না। এক কথায় ভালো-মন্দ যাই হোক তা ভাগ করে নেওয়ার একটা চেষ্টা ছিলো সবার মধ্যে।

একদিন একটা সংবাদ পেলাম, রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের শিক্ষার্থী লাবণী সরকার (বাংলাদেশের মেয়ে) অসুস্থ, তাকে কলকাতা পি.জি. হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। সে অ্যাপেন্ডিক্সের ব্যাথায় কাতর এবং অপারেশন না করলেই নয়। অপারেশনের প্রস্তুতি চলছেÑকিন্তু বাধ সাধে একটি সিদ্ধান্ত। রুগি অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার আগে বন্ডে স্বাক্ষর করতে হবে, নইলে ডাক্তার অপারেশন করতে পারবেন না। লাবণীর স্থানীয় অভিভাবক বাংলাদেশেরই এক ছাত্র, আমার বন্ধুও বটে যাকে লাবণী দাদা বলেন, তিনিও উপস্থিত কিন্তু স্বাক্ষর করতে ভয় পাচ্ছেন। এদিকে ডাক্তার বারবার বলছেন, অপারেশনে দেরি হলে ক্ষতি হতে পারে। বিষয়টা সহ্য করতে না পেরে একটা সময় আমি সামনে গিয়ে বললাম, ‘ডাক্তার সাহেব আমরা এক সাথে একই ক্লাসে পড়ি, আমরা মানে আমি স্বাক্ষর করলে কোনো অসুবিধা? ডাক্তার চোখের দিকে তাকিয়ে একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘করুন। ব্যস, অপারেশন হলো। রুগি বিছানায় ফিরে এলো ভালোভাবে। তারপর থেকে দায়িত্বের একটা অংশ হিসেবে রুগিকে দেখতে যেতাম আর এই দেখার মধ্যে এ-কেবিন ও-কেবিন একটু ঘুরে দেখতাম অন্য রুগিদের। একদিন আমাদের পাশের কেবিন থেকে একজন পরিচিত মুখ হেঁটে চলে যেতে দেখলাম। চিনলাম, পরিচালক গৌতম ঘোষ না? ভাবলাম এখানে কোথায় এসেছিলেন? তার বের হয়ে যাওয়া কেবিনে গিয়ে উঁকি দিলাম। দেখলাম, জরাজীর্ণ শরীরে বয়স্ক একজন কাত হয়ে শুয়ে আছেন। আমার উঁকি দেওয়া দেখে হাতের ইশারায় ডাকলেন। ভয়ে ভয়ে কাছে গেলাম। কারণ দেখছিলাম, জরাজীর্ণ কাঠামোর মানুষটির চোখে যেনো অনেকগুলো প্রশ্ন। আমার সঙ্গে ছিলো বন্ধু সাজু। ও আর আমি কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই জড়ানো কণ্ঠে আলতো করে তিনি বললেন, তোমার নাম কী? কোথায় লেখাপড়া করো? তুমি এখানকার নাকি? আমি সবকটা উত্তর ঠিকঠাক মতো দিলাম। শুধু শেষ উত্তর যখন করি ‘আমি বাংলাদেশের ছেলেশুনে ওনার চোখের কোণে যেনো একটা ইচ্ছা, একটা শক্তি, হারিয়ে যাওয়া কাউকে খুঁজে পাওয়ার একটা কিছু ঝিলিক দিয়ে উঠলো।

এমন সময় আমাদের মানে বাংলাদেশের অধিকাংশ পরিচিত শিক্ষার্থী এবং কাছের একজন আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষ লাবণীকে দেখতে ওর কেবিনে আসেন। আর পাশের কেবিনের রুগির পরিচয় জানতে পেরে প্রদীপ দা তাকেও দেখতে আসলেন। প্রদীপ দার সঙ্গে তার দু-একটা কথা হলো এবং কথার ফাঁকে তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আর সেই সঙ্গে আমাদেরকে বললেন, ‘ইনিই হচ্ছেন হরিসাধন দাশগুপ্ত।

তখনই প্রথম তার নাম জানতে পারি। প্রথম দেখার পর্ব সেদিনের মতো শেষ হয়। এরপর প্রতিদিনই ক্লাস শেষ করে একবার অন্তত আমাকে যেতে হতো রুগিকে দেখতে।  সেই সুবাদে হরি দার সঙ্গেও একবার দেখা করতাম। কিন্তু এই দেখা করাটা যে দীর্ঘমেয়াদি রূপ নেবে তা বুঝতে পারিনি।

বাংলাদেশের রুগি ফিরে গেলো ঘরে। কিন্তু আমার আর ফেরা হলো না। আমাকে নিয়ম করে প্রতিদিন বিকেলে হাসপাতালে আসতে হতো হরি দার কাছে। একবার ভেবেছিলাম যাবো না, কেনো যাবো? উনি কে হন আমার? এই ভেবে সত্যিই দুদিন যাওয়াই হয়নি। কিন্তু এরই মধ্যে একদিন আমার স্থানীয় অভিভাবক অপলা দাসগুপ্ত মানে কঞ্চি দি (লেখক মহাশ্বেতা দেবীর ছোটো বোন) ও সমীর দাসগুপ্তের (সমীর দা বরিশালের ছেলে) বাসায়, সেখানেই গোলটা বাঁধলো। কঞ্চি দির বাসায় গেছি, বসার ঘরে ঢুকতেই তিনি বললো, ‘তোর কথাই বলছিলাম ওদের কাছে। পরিচয় করিয়ে দেইও হচ্ছে রাজা দাশগুপ্ত, ওর স্ত্রী চৈতালী। পরিচিত হবার পর বললাম, আমার কথা কেনো? দিদি পানীয় মুখে দিতে দিতে বললো, ‘তোর সাথে পি.জি. হাসপাতালে হরি দার নাকি পরিচয় হয়েছে; হরি দা তোর কথা ওদের বলেছে। ওরা বলছিলো, তুই যদি একটু বিকেলে গিয়ে গিয়ে হরি দার সাথে দেখা করিস, মানে গল্প-টল্প করিস তাহলে ওনার চিকিৎসা করাটা সুবিধা হবে।

আমি অবাক হয়ে রাজা দাশগুপ্তের দিকে তাকাতেই তিনি বললেন, ‘বাবা বাংলাদেশের মানুষদের খুব পছন্দ করেন। আপনাকে তার ভালো লেগেছে। বাবাই আপনার কথা বারবার বলছিলো। এই কথা শোনার পর নিজের কাছে নিজেকে যেনো খুব ছোটো মনে হতে লাগলো। ভাবলাম আমি ওই মানুষটাকে দুদিন দেখতে যাইনি! কথায় কথায় হরি দাকে কঞ্চি দির কথা, অন্নদাশঙ্কর রায় যে আমার কলকাতার অভিভাবক তা বলেছিলাম। এমনকি আমার অগ্রজ দাউদ হায়দারের সুবাদে তাদের সঙ্গে পরিচয় তা বলতেও বাকি রাখিনি। সেই কথা তিনি ঠিক মনে রেখেছেন। সেই কথা শুনে রাজা দাশগুপ্ত যে কঞ্চি দির বাসায় চলে আসবে তা আমার কল্পনার মধ্যেও ছিলো না। তারপর আমি উনাদের কথা দিলাম, প্রতিদিন বিকেলে দাদার কাছে যাবো, দেখা করবো, কিছুটা সময় কাটাবো। পরদিন থেকে যথারীতি রুটিনমাফিক যেতে শুরু করলাম। এই যাওয়ার মধ্যে জানতে পারলাম হরি দা বাংলাদেশের বিক্রমপুরের ছেলে।             

এরই মধ্যে একদিন বিকেলে পরিচালক গৌতম ঘোষ আসলেন, উনার সঙ্গে হরি দা আমায় পরিচয় করে দিলেন, ‘গৌতম এইটা বাংলাদেশের ছেলে আরিফ হায়দার। আজকে যে আমাকে সুস্থ দেখছো, সেটা ওর সঙ্গে প্রতিদিন গল্প করার কারণে। গৌতম দা শুধু বললেন, ‘যদি আসা সম্ভব হয়, তাহলে আসবেন। গৌতম দার মুখে আপনি শুনে আমি লজ্জা পেয়ে শুধু বলেছিলাম, জি আসবো।

হরি দা আস্তে আস্তে বিছানা ছেড়ে হুইল চেয়ারে বসলো। তারপর একসময় বারান্দায় হাঁটতে আরম্ভ করলো; এবার বাড়ি ফেরার পালা। সত্যিই খুব খারাপ লাগছিলো এই ভেবে যে, হরি দার সঙ্গে আর দেখা হবে না। কিন্তু বিধিবাম, হরি দা প্রস্তাব করলো, ‘আমি তোমার ওখানে গিয়ে উঠবো, শুনে আমি তার এ কথার কোনো উত্তর দেইনি। শুধু বলেছিলাম, তাই? এর মধ্যে বুঝেছিলাম হরি দার অতিরিক্ত মদ্যপান করাটা তার বড়ো ছেলের সংসারে ভালোভাবে নেয় না। সে কারণে একা থাকেন তিনি।

হরি দা হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে চলে গেলেন শান্তিনিকেতনে। যাবার সময় আমাকে তার একটা ছবি (যেটি রাজা দাশগুপ্তের তোলা) দিয়ে যান। আমি যত্ন করে সেই ছবিটা রেখেছিলাম। পরে শান্তিনিকেতনে তার ওখানে গেলে কী ভেবে যেনো ওই ছবিটা তিনি আমার কাছ থেকে চাইলেন। আমি প্রথমে দেবো না ভেবেছিলাম। কিন্তু কখন জানি মনে মনে ভেবে ছবিটা তাকে ফেরত দেওয়ার মনস্থ করি। এরপর বেশ কিছুদিন আর হরি দার সঙ্গে দেখা হয়নি।

হঠাৎ এক বৃষ্টির সন্ধ্যায় কী যেনো ভেবে হরি দার বাসায় উপস্থিত হই। অবশ্য সেদিন ছবিটা নিতে ভুলিনি। হরি দা তো আমায় দেখে অবাক। প্রথম প্রশ্নই তুমি নিশ্চয় আমার ছবিটা এনেছো? আমি ছবিটা তার হাতে দিয়ে বললাম, ছবি দিলাম কিন্তু আমাকে যে কিছু একটা দিতে হবে।

উনি বললেন, ‘কী নেবে বলো? আমার আর দেবারই বা কী আছে?

বললাম আছে, আছে অনেক কিছু আছে দাদা, শুধু হ্যাঁ বললেই হবে।

‘ঠিক আছে, বলো কী চাও?

একটা সাক্ষাৎকার আপনার।

‘বলো, কী কী প্রশ্ন করবে বলো?

কিন্তু প্রশ্ন আর আমার করা হলো না। ছবিটি নিয়েই কথা বলতে শুরু করলেন তিনি, একেবারে তার কথা, আমি কেবল তাতে সায় দিয়েছিলাম...

হরিসাধন দাশগুপ্ত : আমি নানারকমভাবে মানে নানাভাবে জীবনের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলি। আমি ভেবেছিলাম যে, আই উইল রান; আমি পালাবো। কিন্তু আই রিয়েলাইজ, পালাবার পথ নেই। প্রথমে আমি গিয়েছিলাম রাজপুর বলে একটা জায়গায়। আসলে আমার ভাইদের মধ্যে ইয়ঙেস্ট ভাই যে, সে বাজ পড়ে মারা যায়। আমার সেজো ভাই, সে আমার স্ত্রী যেদিন আমাকে ছেড়ে চলে যায়, সেদিনই মনের দুঃখে সে ছাদের উপর থেকে নিচে পড়ে গিয়ে মাথা চুরমার হয়ে যায়। এবং সে ৯০ দিন অজ্ঞান হয়ে ছিলো নার্সিং হোমে, তারপর আস্তে আস্তে জ্ঞান ফেরে। সে একদম হাফ ইনভ্যালিড হয়ে থাকে। আমার একটা দায়িত্ব ছিলো, তাকে যেনো আমি লুক আফটার করি। আমার মার কাছে আমি এটা প্রমিজ করি। তো সেই সব করছিলাম যখন এর মধ্যে একটা ভুল বোঝাবুঝির জন্য আমার ছেলে রাজা এবং তার স্ত্রী আমাকে ছেড়ে চলে যায়। তারা ইন্ডিপেন্ডেন্ট থাকা শুরু করে।

আমি তখন বিরাট ফ্ল্যাটে একদম একা। তো আমি একদিন হঠাৎ-ই ঠিক করে ফেললাম, আমিই বা কেনো এখানে একা কলকাতায় বসে থাকবো। তো এই বলে আমি রাজপুরে গিয়ে থাকতে শুরু করলাম। সেখানে আমি তিন-চার বছর একটানা ছিলাম। সেই সময় একটা খুব ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটেছিলো; আমার কন্যা মানে আমার স্ত্রীর কন্যা মানে বাই দ্য আদার ম্যান মানে রবার্তো রোসেলিনির কন্যা, যার সঙ্গে আমার স্ত্রী চলে গেলেন।

আরিফ হায়দার : মানে যার সঙ্গে উনি চলে গিয়েছিলেন।

হরিসাধন : তাদের দুজনের আর কী যে কন্যা, সে আবার ডান্সার, ওদের একটা গ্রুপ ছিলো, কলকাতায় এসছিলো। তারা এখানে পারফরমেন্স করেছিলো, খুব নাম-টামও হয়েছিলো। আমার ছেলেই সমস্ত ব্যবস্থা করেছিলো। ওরা হঠাৎ-ই একদিন দলবল বেঁধে আমার সেই রাজপুরের ভাঙা বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত। সঙ্গে আমার ছোটো ছেলেও ছিলো, ও ওর মার সঙ্গে বিদেশে চলে গিয়েছিলো। এসে আমি যেটা অবাক হয়ে গেলাম, আমার নিজের ছোটো ছেলে আমাদের এখানে থাকার সময় ওর নাম ছিলো ‘বল্টু, ওখানে গিয়ে ও ‘জিন হয়ে গেলো। জিন রোসেলিনি। আর ওদের ওই মেয়ের নাম রাধা, রাধা রোসেলিনি। সে একটু একটু বাংলা জানতো। আর আমার যে নিজের ছোটো ছেলে, সে কিন্তু একটা অক্ষরও বাংলা জানতো না, ইংরেজিও জানতো না। সে শুধু ইতালিয়ান শিখেছিলো বলে সে আমার সাথে কথাও বলতো না। আমি যখনই দু-একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, খালি তখনই ইয়া ইয়া করে।

সেই রাধার সঙ্গে অনেক কথা হলো। এই রাধা সত্যিকার অর্থে তো আমার মেয়ে না; সে কিন্তু আমাকে অসম্ভব রকমের অ্যাফেকশন দেখালো। ওর যে বয়ফ্রেন্ড ছিলো, মানে যার সঙ্গে ও থাকতো আর কি, ওই ডান্স গ্রুপটার যে ডিরেক্টর সেও দেখালো। 

আরিফ : উনি কি আমেরিকান?

হরিসাধন : না, এরা সবাই ইতালিয়ান। এরা সক্কলে সেদিন ভীষণ একটা আনন্দ দিলো। যদিও তখন আমি নিকৃষ্ট একটা ঘরে রয়েছি। ছবি-টবি তুললো প্রচুর, আর খাওয়া-দাওয়া সবকিছু করলো, সারাদিন আমার সঙ্গে থাকলো। 

রাধারা ফিরে গেলো নিজবাসভূমে। কিছুদিন পরে আমার বড়ো ছেলে রাজার কাছে রাধা একটা চিঠিতে লিখলো, ‘আমরা এখানে একটা Dance Drama করছি, এবারের নাটকের নাম হচ্ছে No place to hide রাধা বলেছে, আমরা যে একজনের সঙ্গে কথা বলেছিলাম হরিসাধন দাশগুপ্ত বলে; তিনি একটা কথা বলেছিলেন No place to hide মানে ‘পালাবার পথ নেই। সেই নাম দিয়েই তাদের নাটকটা হচ্ছে। এতো গেলো ওই ব্যাপার।

এখন আমি মানে আমার মনে হয় তোমাদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে, আমার ভীষণভাবে বাংলাদেশের ব্যাপারটা মনে পড়ে। ছোটোবেলা থেকেই একটা বিষয় বোধ হয়, আমার দেশ ঢাকার বিক্রমপুর। আমি কোনোদিন আগে যাইনি। একবার মনে হয় ছোটোবেলায়, আমার মামাতো দিদির বিয়েতে গিয়েছিলাম। কিন্তু যখন বাংলাদেশের এই লিবারেশন মুভমেন্টটা হলো, তখন আমি মানে আমি চিরকালই কিন্তু একটু বিদ্রোহী গোছের এবং যেহেতু আমি কোনো সুযোগ পাইনি, তাই আমি এই প্রথম সুযোগেই ইনভল্ব হয়ে গেলাম। সেই সময় আমাদের কলকাতার বাড়িতে ৬ নম্বর সাদার্ন অ্যাভিনিউ, যেটা আমাদের প্রধান বসতবাড়ি ছিলো। সেখানে প্রথমে জহির রায়হান আর আলমগীর কবির আমার অতিথি হিসেবে ছিলো।

আরিফ : বাংলাদেশের পরিচালক।

হরিসাধন : এবং ইভেনচ্যুয়ালি আমার দাদারও কিছু লোক ছিলো বাংলাদেশি। মূলত আমাদের এই বাড়িটা ছিলো সেই সময়ের জন্য বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী অ্যাসোসিয়েশনের অফিস আর কি। তোমাদের ওখানকার  ইউনিভার্সিটির যে ভাইস-চ্যান্সেলর তাকে প্রেসিডেন্ট করে, জহির রায়হান ছিলো সেক্রেটারি। 

আরিফ : সেটা মানে ১৯৭১ সালে...

হরিসাধন : অবভিয়াসলি। আমাদের বাড়িতে তখন বেশ একটা বাংলাদেশ নিয়ে আলোড়ন। আমি নিজে সেসময় কিছু ছবি-টবি করছিলাম। যাই হোক, আমি কিন্তু সবকিছু ছেড়ে বাংলাদেশ নিয়ে মেতে গেলাম। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে, যুদ্ধের ছবি তুলবো বলে। বিশেষ করে জহির রায়হানের জন্য। জহির, যেরকম আমি প্রথম আমেরিকা থেকে ফিরে এসে...

আরিফ : আমেরিকাতে কী জন্য গিয়েছিলেন?

হরিসাধন : সত্যি কথা বলতে কি, আমার বাবা চেয়েছিলেন আমি যেনো ইঞ্জিনিয়ার হই, সায়েন্টিস্ট হই এসব, মানে অন্তত সায়েন্সের জগতে থাকি। কারণ আমার সাবজেক্ট ছিলো ম্যাথমেটিক্স; ভালো ছাত্রও ছিলাম। ওখানে গিয়ে কিন্তু আমার ভিতরে ভিতরে যেটা একটা গ্রো করছিলো, বিশেষ করে আমার মায়ের রেফারেন্সে, আমি সিনেমার জগতের হয়ে গেলাম।

আরিফ : মানে হলিউডে?

হরিসাধন : হলিউডে। কিন্তু হলিউড সম্বন্ধে আমি কিছুই জানতাম না মানে হলিউডের কোনো প্রোডিউসারের নামও জানতাম না, কোনো ডিরেক্টরের নামও জানতাম না। কোনো ছবিও সেরকমভাবে দেখিনি। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, আরভিন পিচেল (Irving Pichel) বলে একজন ডিরেক্টর আমাকে সাহায্য করলেন। উনি নিজেও একজন ইন্টেলেকচ্যুয়াল, হলিউডের একটা কাগজের চিফ-এডিটর। ওর আমার সম্বন্ধে বা ভারতবর্ষ সম্বন্ধে বা বাংলাদেশ সম্বন্ধে যে আগ্রহ, সেটা হচ্ছে উনি ছাত্রজীবনে হাভার্ডে যখন পড়তেন তখন একটা মজলিশে মানে বাংলাদেশের স্টুডেন্টদের একটা জমায়েতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে মিট করেছিলেন মানে দেখা হয়েছিলো। সেটাই হচ্ছে ওর প্রথম ইন্টার‌্যাকশন টু আস, তারপর হলাম আমি। আমাকে পেয়ে উনি ভীষণভাবে একটা মানে আমায় খুব সাহায্য করলেন। এবং এই যে আমি ওখানে গিয়ে একটা কাজ শেখা অবজারভার অ্যাপ্রেন্টিস হিসেবে, এটা কিন্তু খুব কম লোকের ভাগ্যে সেই সুযোগটা হয়। যাই হোক আমি মাত্র দুই-আড়াই বছর সেখানে ছিলাম।

আরিফ : বছর দুই আড়াইয়ের মধ্যে ওখানে কোনো ছবির সঙ্গে কাজ করেছেন?        

হরিসাধন : হ্যাঁ। ওর ছবিগুলোও কিন্তু খুব বিখ্যাত। প্রথমে অ্যা... অ্যা... নামগুলো বলা তো মুশকিল। যে দুটো ছবিতে আমি অনেক কিছু শিখবার সুযোগ পেয়েছিলাম। প্রথম ছবিটি ডি-আনাডাডনি। এবং আরো একটা ছবি দে অল বিলিভ মি। তাতে হিরোইন ছিলো সুজান হেওয়ার্ড বলে একজন, তো সেই ছবিটাই তার প্রথম ছবি এবং তখন সে ছিলো একটা বেবি ডল, অপূর্ব সুন্দরী। তার অ্যাক্টিংয়ের প্রতিভা না থাকলেও সুন্দরী হিসেবেই সে রোল পাচ্ছে। সেই মহিলাটি কিন্তু ইন ফিউচার এমনই ছবির মধ্যে ইনভল্বড হলেন যে তারপর ভদ্র মহিলা ড্রিম অ্যাডিক্ট হয়ে গেলেন; বোধ হয় ওর একটা পার্সোনাল ডমিস্টিক ব্যাপারে কিংবা নিজস্ব ইয়েতে, আমাকে সকলে বেবি ডল হিসেবে ব্যবহার করছে, কিন্তু আই ওয়ান্ট টু গো, বাট আই অ্যাম অ্যা ভেরি হাইলি, আই ক্যান বি অ্যা ভেরি পাওয়ারফুল অ্যাক্টর। পরে তিনি সেটা হয়েছিলেন।      

আরিফ : আপনি যে রেঁনোয়ার সঙ্গে কাজ করেছেন...

হরিসাধন : হ্যাঁ, আসবো। সেই বিষয়টা তো অবশ্যই এসে যাবে। যাই হোক যখন হলিউডে ছিলাম, তখন আমার একটা ফ্রিডম ছিলো, আমি যেকোনো সেটে যেকোনো ডিরেক্টরের কাজ দেখতে পারতাম। কখনো হিচকক শুটিং করছে, আবার কখনো হলিউডের অন্য কোনো বড়ো ডিরেক্টর। তবে আমি এটা বলবো না যে, হলিউডে ঘোরাঘুরি করেই কাজ শিখেছি। শিখেছি বড়ো বড়ো মাপের অভিনেতা ডিরেক্টরদের সঙ্গে থেকে, কাজ করে।

তারপর তো ফিরে এলাম ভারতে, কলকাতায়। কিন্তু কী করবো? হতাশায় ভুগছিলাম, এমন সময় আমার বন্ধু অসিত সেন বললো, ‘এখানে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, জানিস কি? চল, তোকে এক জায়গায় নিয়ে যাই, ভালো লাগবে। তাছাড়া ওরা তোর সঙ্গে দেখাও করতে চায়। এই বলে আমাকে সোজা নিয়ে গেলো সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে, সেখানেই ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটির মিটিং। সত্যজিতকে দেখে আমি ভীষণ উৎসাহ পাই। মনে হলো, যাক তাহলে এখানে কিছু অসাধারণ লোক আছেন যারা ফিল্ম সম্বন্ধে ভীষণ উৎসাহী। আর সত্যজিৎ রায় ও তার পরিবার, তারা হলিউড নিয়ে খুব চর্চা করেছে। তারা সমস্ত কিছু জানতো, ছবিও দেখেছে প্রচুর।

সেই থেকে সত্যজিতের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলো। ওরা হলিউডের গল্প-টল্প শুনতে চাইতো। আমরা লেকের পাড়ে কিংবা কখনো আমাদের বাড়িতে বসে এগুলো করতাম। মানে তখন আর আমার এখানে যে একটা ইন্ডাস্ট্রি আছে এবং তাদের লোকজনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে তা টোটালি আমি ইগনোর করলাম। তখন আমি সমস্ত কিছু ছেড়ে দিয়ে এই গ্রুপটাতে মিশতে আরম্ভ করলাম, বিশেষ করে সত্যজিতের সঙ্গে। ঠিক সেই সময় সত্যজিৎ আর আমি রবীন্দ্রনাথের ‘ঘরে-বাইরে ছবি করবার জন্য উঠে পড়ে লাগলাম। কথা হলো, সত্যজিৎ চিত্রনাট্য করবে, আমি ডিরেকশন দেবো। এই সব যখন পরিস্থিতি, তখন আমরা বুঝলাম আমরা ভীষণ আনপ্র্যাকটিকাল, আমাদের টাকা-টাকা কেউ দেবে না।

আমরা নিজে পার্সোনালি প্রচুর টাকা নষ্ট করে, আবার একটা হতাশার মধ্যে পড়ে গেলাম, এবার কী হবে? ঠিক সেই সময় আবার জ্যঁ রেঁনোয়া আসলেন।

ও আর একটা কথা, ঘরে-বাইরে নিয়ে যখন কাজ করার কথা ভাবছি তখন আমার জীবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছিলো। সোনালী নামে একজন সুন্দরী ও ট্যালেন্টেড ভদ্রমহিলা আমার স্ত্রী ছিলেন। তখন ঘরে-বাইরে ছবির নায়িকা হিসেবে আমি ও সত্যজিৎ সোনালীকেই পছন্দ করি। তখন ক্রমশ ক্রমশ সোনালীর সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা বাড়ে এবং তারপরে আমরা বিয়ে করি। তখন আমরা থাকতাম বোম্বেতে। সেসময় বিখ্যাত পরিচালক রোসেলিনি ভারতে আসেন ছবি করার জন্য; তখন সোনালীর সঙ্গে তার পরিচয় হয়, ঘনিষ্ঠতা বাড়েযার ফলে আমাদের সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। সোনালী ওর সঙ্গে চলে যায়। 

আরিফ : জ্যঁ রেঁনোয়ার আসাটা কতো সালে?

হরিসাধন : ধরো নাইনটিন ফোরটি এইটে উনি একবার এসছিলেন, ফোরটি নাইন ফিফটি-তে শুটিংটা হয়। রেঁনোয়ার আসাটা আমাদের, পার্সোনালি আমার, সত্যজিৎ রায়ের এবং সারা ভারতবর্ষের ফিল্মের জগতে একটা বিরাট পরিবর্তন আনলো। সেটাতে আমি বা আমরা ইন্সপায়ার্ড হই। আমি তার আগে কিছু ছোটো ছোটো বিজ্ঞাপনের ছবি-টবি করে কোনো রকমে চালাচ্ছিলাম। তখন আমি সুযোগ পেলাম বারমাসেলের হয়ে কিছু মেজর ডকুমেন্টারি করবার। সেখানেও জ্যঁ রেঁনোয়ার ইনফ্লুয়েন্স। সত্যজিৎ রায়ও খুব ইনফ্লুয়েন্স হয়েছিলেন। যদিও সত্যজিৎ রায় পরবর্তীকালে সেটাকে খুব বেশি অ্যাকসেপ্ট করেননি। উনি বোধ হয় ডি সিকার বাইসাইকেল থিভস্ দেখেই বেশি ইন্সপায়ার্ড হয়েছিলেন।

আমাদের ইনভল্বমেন্টটা ছিলো আমার দেশটাকে বুঝবার, এই যে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের যে সৌন্দর্য, এই যে নদী, আশেপাশে যেসব ঘাট, সেই ঘাটে মেয়েরা স্নান করতো। এই জিনিসগুলোকে আমরা কোনোদিন মনের মধ্যে কোনো স্থান দেইনি। সেগুলো কিন্তু জ্যঁ রেঁনোয়ার চোখ দিয়ে আমরা দেখলাম; সত্যি তো এই সবই তো খুব সুন্দর। এই যে সৌন্দর্য বোধটা এইটা আমাদেরকে জ্যঁ রেঁনোয়া শিখিয়েছেন। ছবিটা হলো, আমি ওর চিফ অ্যাসিস্টেন্ট ডিরেক্টর ছিলাম।

আরিফ : এটা কোন্ ছবিটা, ছবিটার নাম?

হরিসাধন : দ্য রিভার (১৯৫১)। এভাবে বছরখানেক চলে যেতে লাগলো। আমিও প্রচুর পরিশ্রম করতাম দিনে প্রায় ১৮ ঘণ্টাই কাজ করতাম। আমি কাজ করতাম মানে কী, জ্যঁ রেঁনোয়া একজন বয়স্ক ভদ্রলোক পৃথিবীর অতো বড়ো একজন পরিচালক। আর একটা মজার কথা বলি, এই জ্যঁ রেঁনোয়া যখন প্রথম ইউরোপে যুদ্ধকালীন মানে হলিউডে পালিয়ে যান, তখন ওর প্রথম ছবির প্রোডিউসার ছিলো আরভিন পিচেল, যার সঙ্গে আমি কাজ করেছিলাম। সেই ছবিটির নাম দ্য সাদানা

ঠিক সেই সময় আরেকজন আমাদের বন্ধু কমল মজুমদার বলে; তিনি বিরাট পণ্ডিত, ফরাসি ভাষায় তার পাণ্ডিত্য ছিলো। ফরাসি ভাষায় কবিতাও লিখতেন। যাই হোক আমাকে সবচাইতে প্রভাবিত করেছিলেন কমলকুমার মজুমদার। ওর কথা বলতে গেলে ইতিহাস হয়ে যাবে। ফরাসি ভাষায় অগাধ জ্ঞান ছিলো কমলকুমারের। আমাদের প্রথম দেখা কফি হাউসে। সত্যিকারের মানুষ কমল। কমলকুমার আমাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন। ভবিষ্যতে আমি যদি কোনো শর্টফিল্ম করি তবে তা করবো কমলকুমার মজুমদারের ওপর; যদি নয়, করবোই। আমার দেখা অন্যতম সেরা মানুষ কমলকুমার। তবে আমার দেখা মহান মানুষ হলেন আলাউদ্দিন খাঁ; যাকে নিয়ে আমি তথ্যচিত্র করেছি। আমি জ্যঁ রেঁনোয়ার সঙ্গে যখন কমল মজুমদারের পরিচয় করিয়ে দেই, ওদের মধ্যে অসাধারণ একটা হৃদ্যতা হলো এবং শুধু তাই নয়, কমল বাবু আমি তো মনে করি যেমন জ্যঁ রেঁনোয়া আমাদেরকে ইনফ্লুয়েন্স করেছিলেন, তেমনি জ্যঁ রেঁনোয়া আবার কমল বাবুর দ্বারা ইনফ্লুয়েন্স হয়েছিলেন। এই কমল বাবুকে সত্যজিৎ রায়ও খুব বড়ো চোখে দেখতেন। আর উনি নিজে খুব সাধারণ জীবন-যাপন করতেন। (এমন সময় দরজার কড়া নড়ে ওঠে) আচ্ছা, এখনকার মতো বন্ধ করো আমি একটু তালা খুলে দি।

আরিফ : ঠিক এই অবধি বলে একটু থামলেন হরিসাধন বাবু। হাতে গ্লাস তুলে নিতেই আমি কোনো কিছু না ভেবেই বলি, আপনি এতো মদ্যপান করলে তো...।

হরিসাধন : আমি ঋত্বিক ঘটক নই। আমি জানি কী খেলে, কতোটুকু খেলে একটা লোক ভদ্রভাবে বেঁচে থাকতে পারে। বর্তমানে আমার তো ৭৩ বছর বয়স। কিন্তু আমি মরবার কোনোরকম লক্ষণই দেখছি না। দিন দিন আমি আরো ইয়ঙ হয়ে যাচ্ছি।

আরিফ : ইয়াঙ বন্ধু হয়ে যাচ্ছেন।

হরিসাধন : আমার কিন্তু আমার বয়সী কোনো বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্ক নেই। যেমন একসময় আমার বন্ধু হয়ে উঠলো গৌতমদের জেনারেশন; গৌতম ঘোষ, সুখদেব আরো অনেকে। তারা আবার একটু দূরে চলে গেছে; এখন আমি আবার ইনভল্বড আরেকটা ইয়ঙ্গার জেনারেশনের সঙ্গে। এরা তো ৩০-এর নিচে, যারাই ছবি-টবি করার কথা ভাবে তারাই আসে।

আরিফ : (একটু হেসে) এই আরিফ আসে, গৌতম (রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলার শিক্ষার্থী) আসে...

হরিসাধন : শোনো আমি বলছি, আমার ভীষণ ভালো লাগে তোমাদের বয়সী ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলতে। এবং মনে হয়, এসব কারণেই আমার বয়সও বোধ হয় কমে যাচ্ছে; আই অ্যাম ভেরি ইয়ঙেস্ট হেয়ার। যাই হোক বাংলাদেশের সঙ্গে আমার ইনভল্বমেন্ট সম্বন্ধে আমার কিছু বক্তব্য আছে।

আরিফ : ডকুমেন্টারিতে ঋত্বিক ঘটক যে আপনার সঙ্গে কাজ করেছে। এই কাজটা কেমন, কীভাবে, কার কাজ?

হরিসাধন : শোনো আমি বলছি, সত্যি কথাটাই আজ বলে ফেলছি। ঋত্বিক ঘটকের অযান্ত্রিক দেখবার পর থেকেই আমি ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়ি। ঋত্বিক একজন জিনিয়াস আর ব্রিলিয়ান্ট ফিল্মমেকার। তবে ওর পার্সোনাল স্টাইল অব লাইফটাকে আমি কোনোদিন অ্যাকসেপ্ট করতে পারি নাই। ও ডেসপারেট ছিলো, গায়ের জোরে টাকা নিয়ে যেতো, গায়ের জোরে ড্রিঙ্কস্-এর ব্যবস্থা করতো। অ্যাজ অ্যা হিউম্যান বিঙ আমি ওকে খুব...। কিন্তু আমার এক বন্ধু যে নাকি অযান্ত্রিকটা প্রোডিউস করেছিলো প্রমোদ লাহিড়ী বলে, সে আমাকে হঠাৎ একদিন বললো...। সেই সময় আমি সঙ্গীত নাটক অ্যাকাডেমি থেকে একটা সুযোগ পেলাম তিনটে মেজর ছবি করবারবাবা আলাউদ্দিন খাঁ, বড়ে গুলাম আলী খাঁ আর একজন সাউথ ইন্ডিয়ান কেরামানজো আরিটেডো, সে এক বিশাল নাম, এদের ওপর।

আরিফ : এটা কতো সালের দিকে?

হরিসাধন : এই ধরো নাইনটিন সিক্সটি ফোর-টোর হবে। সঙ্গীত অ্যাকাডেমির চেয়ারম্যান আমাকে খুব ভালোবাসতেন। উনি আমাকে বেশ ভালো টাকা অ্যাডভান্সের ব্যবস্থা করে দিলেন। আমার তখন মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি খেললো যে, এবার আমি ফিচার ফিল্ম করবো। তাছাড়া কিছু সাবমিটেড ডকুমেন্টারি তখন আমার হাতে।

তখন আমাকে প্রমোদ দা বললো, দ্যাখ তুই তো মিউজিকের খুব একটা কিছু বুঝিস না; ঋত্বিক ভীষণ মিউজিক বোঝে; তাই বলছিলাম, ঋত্বিককে দিয়ে এই ছবিগুলোর কাজ করা।

এরপর আমি যখন প্রথম ওর বাড়িতে গেলাম, ঋত্বিক আমাকে ইম্প্রেস করবার জন্য, তখন দেখি ওর বসবার জায়গায় একটা সরোদ, হাতে একটা কী বেঁধেছে; বললো বাহাদুর খাঁ ওর শিক্ষক। তারপর ও একটু পিরিং-পিরিং করলো, আর তাতে আমি গলে গেলাম। বাবা আলাউদ্দিন খাঁর ছবিটা করবার জন্য ঋত্বিককেই বললাম; সেও রাজি হয়ে গেলো। কিন্তু ছবিটা যে আদৌ হবে না, তা তখন বুঝতে পারিনি। আর বড়ে গুলাম আলীর ছবিটির দায়িত্ব দিয়েছিলাম আরেকজনকে। সেও একটা গবেট, একটা ইউজলেস।

আরিফ : তার নামটা মনে আছে আপনার?

হরিসাধন : এটুকু মনে আছে, সে ছিলো বুদ্ধদেব বসুর ভাইপো। যেটা দুঃখের এবং আমার পক্ষে খুবই ফিন্যান্সিয়াল একটা লসের ব্যাপারসে হচ্ছে গিয়ে এরা দুজনই আমাকে একেবারে ডোবালো। ঋত্বিকের সঙ্গে আলাউদ্দিন খাঁর ছবি করবো বলে মাইহার গেলাম। গাড়ি করে গেলাম, সে একটা হরর মানে হরিবল এক্সপেরিয়েন্স। আমি অতো ডিটেইল বলতে পারবো না; তবে এতোটুকু বলছি ওর কোনো ডিসিপ্লিন ছিলো না। মানে আমি দুটো ক্যামেরা নিয়ে কাজ করছি। আলাউদ্দিন খাঁ একেবারে ভগবানের মতো মানুষ। কিন্তু ক্যামেরা, সাউন্ড সব যখন চলছে তার মধ্যেই ঋত্বিক ঘটক উল্টোপাল্টা কথা বলছে। এই করে করে আমি দেখলাম যে, আমার বেশকিছু ক্ষতি হচ্ছে। মাইহারে যাওয়ার সময় সারা রাস্তায় আমিও মদ্যপান করি; কিন্তু ও এতো ভয়ঙ্করভাবে মদ খেয়েছিলো যে, হি ডিডেন্ট ইন সেন্স। ও ওর পরিবারের অনেককেই নিয়ে গিয়েছিলো মাইহারে। পরে সকলেই বুঝলো, বিশেষ করে আলি আকবর খাঁ বললো, হরি দা এভাবে ছবি হয় না বরং বন্ধ করে দিন। আমাদের সাউন্ড রেকর্ডিংয়ের যে চিফ ছিলো, আমি এখানকার সবচেয়ে ভালো লোকদের নিয়ে গিয়েছিলাম, সত্যেন চ্যাটার্জি ও ক্যামেরাম্যান দীনেন গুপ্ত, তারা বললো এভাবে ছবি হয় না।

আর আমি তো প্রচুর ছবি তার আগে করেছি। আমার মতলবটা ছিলো যে, আমি ওই যে টাকাটা পেয়েছি সঙ্গীত অ্যাকাডেমির, তাই দিয়ে আমি আমার প্রথম ফিচার ফিল্ম করবো; আর ঋত্বিক-টিত্বিক তারা আমার এই অন্য ছবিগুলো করে দেবে। এবং আমি একটা বিখ্যাত লোককে অ্যাপয়েন্ট করেছি এই জন্য যে, আমার কনসেপ্ট ইজ ক্লিয়ার, আমি জানি আমি এমন লোককে ইমপ্লয়েড করেছি, যে নাকি একটা ভালো ছবি করবে। কিন্তু সে ছবি যে হবেই না, সেটা তখন বুঝলাম যখন ওই সত্যেন চ্যাটার্জি বললো।

ও আর একটা কথা, আমরা যেখানে ছিলাম মানে থাকার ব্যবস্থা যেখানে হয়েছিলো, সেখান থেকে বাবা আলাউদ্দিন খাঁর বাড়িতে যেতে হলে একটা রেললাইন ক্রস করতে হয়। হঠাৎ ওর স্ত্রী (মানে ঋত্বিকের) অ্যানাউন্স করলেন যে, যদি ঋত্বিককে ছবিটা করতে দেওয়া না হয়, তাহলে ও রেললাইনে মাথা দিয়ে আত্মহত্যা করবে।

আরিফ : এটা ঋত্বিক ঘটক বললেন?

হরিসাধন : না, ঘটকের স্ত্রী। সমস্ত ঘটনাটাই হচ্ছে নাটক। একদিন এমন হলো, হঠাৎ মাঝরাতে আমরা একটা ঘরে শুতাম; আমরা মানে ক্যামেরাম্যান দীনেন গুপ্ত, তার স্ত্রী, আমরা সকলে মিলেই ছিলাম। হঠাৎ দেখি মাঝরাতে ঋত্বিক ঘটক আমার ঘাড়ে চেপে আমার গলা টিপে ধরলো আমায় মারবে বলে। এসব ঘটনা দেখে সবাই মিলে আমায় বুদ্ধি দিলেন আপনি আপাতত ছবিটা স্থগিত করেন। তাই হলো, আমরা সবাই মিলে যে গাড়িতে গিয়েছিলাম সেই গাড়িতে ফিরে এলাম। পরে আমি নিজে আলাউদ্দিন খাঁর এই ছবিটা করি। এতে ঋত্বিকের কোনো কন্ট্রিবিউশন নেই। এবং বড়ে গুলাম আলী খাঁর ছবিটার একই অবস্থা। ওই ছোকরা মানে বুদ্ধদেব বাবুর ভাইপো এমন একটা অ্যাবস্ট্রাক্ট ছবি করলো। সঙ্গীত অ্যাকাডেমির কমিটি যখন ছবিটা দেখছিলো তখন আমার মুখে কোনো কথা ছিলো না, কারণ ছবিটা আগে আমি দেখিনি। এই কমিটিতে ছিলেন সত্যজিৎ রায়, উদয়শঙ্কর ও আরো অনেকে। ছবিটার বিষয়ে যদি কিছু বলি, তবে বলবো সেটি একটা উদ্ভট কাণ্ড।

তখন সঙ্গীত অ্যাকাডেমির সেক্রেটারি ড. নারায়ণ ব্যানার্জি, অতি বুদ্ধিমান মানুষ। তিনি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সবাইকে বললেন, আসলে ছবিটা হরিসাধন দাশগুপ্ত বানাননি, তাই এই রকম একটা কাণ্ড। আমি ওসব দেখে-শুনে ভয়-টয় পেয়ে গিয়ে শেষ অবস্থায় এই ছবি থেকে ওকে বাতিল করি। আর সেই কারণে ও আমার বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত করে। অবশ্য মামলা করে কোনো লাভ হয়নি।

তবে আজকের এই স্টেটম্যান কাগজে (পত্রিকাটা হাতে নিয়ে) বড়ে গুলাম আলীকে নিয়ে একটা ফাংশনের রিপোর্ট আছে। এতে ওর নাতির বরাত দিয়ে লিখেছে। সে বলেছে, আই লাইক হাউ দ্য ইভিনিং লাইফ দ্য ফিল্ম বাই হরিসাধন দত্ত; যিনি একটা অসাধারণ ছবি করে বড়ে গুলাম আলীকে খুব ইয়ে করেছেন। বড়ে গুলাম আলীর সঙ্গে আমি কথাবার্তায় সবকিছুতে একটা ভীষণ ইয়ে হয়েছিলো। যেরকম আলাউদ্দিন খাঁকে আমি বাবা হিসেবে নিয়েছিলাম, ঠিক তেমনি আমি বড়ে গুলাম আলীর খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিলাম।

আরিফ : আচ্ছা, জহির রায়হানের সঙ্গে যখন আপনার আলাপ ছবি নিয়ে...

হরিসাধন : সেটাই, সেটাই বলছি। আমি কিন্তু আসলে ছবি-টবি করলেও ছোটোবেলা থেকেই আমার একটা রেভ্যুলেশনারি অ্যাটিটিউড ছিলো। আমি কখনো অন্যায়কে প্রশ্রয় দেইনি। আমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে ফাইট করতে চেয়েছি। আমি কিন্তু বিদ্রোহী গোছের একটা কিছু করতে চেয়েছি; যদিও সরাসরি এটা করার সুযোগ আমার হয়নি। কারণ আমাদের স্কুল লাইফ, কলেজ লাইফ পরে কর্মজীবনে তখন এ রকম কিছু হয়নি, ওই এক নকশাল মুভমেন্ট ছাড়া, তখন অবশ্য আমার অনেক বয়স হয়ে গিয়েছিলো। আমি কোনো বিদ্রোহী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারিনি। যেমন নাইনটিন ফোরটি টুর মুভমেন্টে আমার পরিচিত অনেক লোক ইনভল্বড হয়েছিলো।

আমার বাবা নিজে সিনিয়র গভর্মেন্ট অফিসার ছিলেন। কিন্তু আমাদের বাড়িতে তখন আমি ছোটোবেলায় দেখেছি অনেক বড়ো বড়ো দেশপ্রেমিক সূর্যসেন দাদা-টাদারা আমাদের বাড়িতে থেকেছে, অনেক জিনিস লুকিয়ে রাখা হতো। এইগুলো কিন্তু ভিতরে ভিতরে আমার মধ্যে একটা বীজ বপন করেছিলো। এই জন্য ছোটোবেলা থেকে আমি ভীষণভাবে মেন্টালি... তারপর যখন বাংলাদেশের ব্যাপারটা হলো তখন আমার হাতে প্রচুর কাজ-টাজ, টাকা-পয়সার অভাব ছিলো না, গাড়ি-টাড়ি ছিলো। সেই সময় জহির এবং আলমগীর কবির এরা দুজন এলো, এদেরকে আমি আশ্রয় দিলাম। আমি জহিরকে দেখে আশাবাদী হলাম, যেমন হয়েছিলাম আমেরিকা থেকে ফিরে সত্যজিৎ রায়কে দেখেঠিক তেমনই হলাম জহিরকে দেখে। জহিরকে দেখে আমার মনে হলো, এবার আমি বাংলাদেশকে ডিসকভার করতে পারবো।

আরিফ : মানে একটা ওয়ে পাওয়া গেলো?

হরিসাধন : হ্যাঁ। শুধু তাই নয়; অনেক কিছু প্ল্যান তখন আমাদের মাথায় ঘুরছে যে আমরা এই করবো, সেই করবো। তখনো জহিরের যে কী স্ট্যাটাস বাংলাদেশে সেটা কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি। এই নোংরা জামাকাপড় পরে ঘুরতো। একটা ছোট্টো ঘটনা বলছি, রাস্তায় একটা গাড়ি আটকে গিয়েছিলো, জহির গিয়ে কী যেনো করলো কারবুরেটরটা পরিষ্কার করে দিলো না কী করলো না করলো, ভালো হয়ে গেলো। জহিরের যে নিজের পাঁচ-ছয়টা গাড়ি এবং ও যে এতো একটা টপ লেভেলের সেটা তখনো বুঝিনি। এখানে আরেকটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা বলি, জহির আমাদের বাড়িতেই রয়েছে, বাড়িতেই ওদের অফিস। হঠাৎ একটা টেলিফোন পেলাম, একজন ফোন করে বললো, দাদা, আপনাকে একটা খুব প্রাইভেট কথা বলছি। জহিরের ছবি, চাবি-টাবি নিয়ে কী যেনো ছবিটার নাম; যাই হোক ওর লেটেস্ট ছবিটা, বর্ডারে কোথায় যেনো দেখানো হয়েছিলো, তারা সেটা স্মাগলিং করেছে এবং এনেছে। সেই ছবিটা আমরা আপনার কাছে পৌঁছে দিতে চাই। আপনি যা ভালো বোঝেন করবেন।

আরিফ : ওই ছবিটার নাম মনে হয় জীবন থেকে নেয়া

হরিসাধন : তো আমি বললাম যে আমার সঙ্গে কথা বলে লাভ নেই, যে ছবিটা করেছে সে আমার পাশেই আছে, তার সঙ্গে কথা বলেন। তখনই লোকগুলো কুঁকড়ে গেলো, মানে ওরা ব্যবসার একটা চিন্তা করছিলো। তো জহিরের সঙ্গে কথাবার্তার পর ওরা ছবিটা দিয়ে গেলো এবং ওরা একধরনের পালিয়েই গেলো ভয়ে। জীবন থেকে নেয়া আমাদের কলকাতায় ‘মেট্রোতে রিলিজ হলো এবং এর সমস্ত টাকা ওই সময়কার প্রোবলেমের রিফিউজিদের জন্য দেওয়া হলো। এর মাঝখানে জহিরের স্ত্রী সুচন্দাও চলে আসলো, জহির তখন একটু রিলিফ। কারণ সুচন্দা কী করে পালিয়ে আসবে সেটাও একটা সমস্যা ছিলো।

যাই হোক সুচন্দা, জহির এবং আলমগীর কবিরএরা দুজনেই দুটো থাকার জায়গা পেলো গভর্মেন্টের সাহায্যে। এরপর জহির বললো, হরি দা আমি একটা ছবি করবো। ও প্রথম যে ছবিটা করলো আসার পরে, সেটা হলো স্টপ জোনোসাইড। সেটা আমার মতে, অ্যাজ অ্যা ডকুমেন্টারি ফিল্মমেকার আমি বলবো একটা অসাধারণ ছবি। এবং সেই ছবিটার জন্য কোনো খরচই হয়নি। কারণ শুধু ওর আইডিয়া আর আমার রিসোর্সেস। সামান্য রিসোর্সেস, আমার ইকুইপমেন্ট আছে, আমার কন্ট্রোলে এডিটিং রুম, এটা ওটা আছে। তখন এমনিতেই আমি ছবি-টবি করছি। জহিরের জিনিয়াসটা আমি তখনই ভালোভাবে বুঝেছি।

তখন জহির কিন্তু রাশিয়ার সঙ্গে একটা কো-প্রোডাকশন করছে, বিরাট বাজেটের বিরাট ছবি। যাই হোক, ঠিক সেই সময় জহিরের মতনই আরেকটি ছেলে এসেছে সুখদেব সিং, আমারই ছাত্র। সে একটা ছবি করতে এসেছিলো কলকাতায়, নাইন মান্থ টু ফ্রিডম, বাংলাদেশের লিবারেশন ওয়ার নিয়ে। আবার রিভার-এর যে ক্যামেরাম্যান ছিলো ক্লদ রেঁনোয়া, সে আমার জীবনের প্রথম ডকুমেন্টারির ক্যামেরাম্যান। আর হ্যাঁ, টাটা কোম্পানির সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ওরা আমাকে দিয়ে একটা ডকুমেন্টারি করিয়েছিলো। দ্য স্টোরি অব টাটা স্টিল। এটা দেশে-বিদেশে বেশ প্রশংসা পেয়েছিলো। ক্যামেরায় ছিলেন ক্লদ রেঁনোয়া। সঙ্গীতে রবিশঙ্কর। এছাড়া কোনারক, দ্য মালাবার স্টোরি ডকুমেন্টারিগুলো আমাকে প্রচুর সম্মান দিয়েছে। হ্যাঁ আমার আরো দুটি ফিচার ছবিও জনপ্রিয়তা পেয়েছিলো। কমললতা আর একই অঙ্গে এত রূপ। এই দুটি ফিচার ফিল্ম নাকি একটা প্রজন্মকে নাড়া দিয়েছিলো। তাই ‘দ্য স্টেটম্যান লিখলো, ‘ It is impossible not to see Eki Ange Eto Rup, as a Variation on the Charulata theme  আমাকে এইভাবে প্রশংসিত হতে দেখে আমার তৎকালীন সহকর্মীরা (যারা এখন অনেকেই বিখ্যাত) বললেন, তুমি ফিচার ফিল্ম করে আর কী করবে, তুমি বরং শর্ট ফিল্ম-ই করো। ওতেই তোমাকে অনেকে চিনবে, জানবে। আমি কোনো সাড়া না দিয়ে সরে এসেছিলাম ওদের পথ থেকে। সেই ক্লদ রেঁনোয়ার ছেলে জ্যঁ রেঁনোয়া ও তার একজন বন্ধু কিছু টাকা জমিয়ে এখানে এসেছিলো বাংলাদেশের ওপর এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা ছবি বানাতে। তারা কিন্তু এসে ফিল করলো ইট ইজ নট অ্যা দ্যাট কাইন্ড অব অ্যা লিবারেশন মুভমেন্ট; এটা হচ্ছে ইন্ডিয়া হ্যাপেন্ড বাংলাদেশ টু গেট ফ্রিডম। কারণ তোমাদের নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট করে এখানে একটা সরকার হয়েছিলো। ওরা বুঝলো যে, এটা কোনো ব্যাপার নয়, এটা ঠিক সেই ধরনের কোনো যুদ্ধও নয়। আমি সরি টু সে; যদিও সত্যি সত্যি বহুলোক বহু স্ট্রাগল করেছিলো, কিন্তু ওরা ফিল করলো যে আমাদের টাকা-পয়সার শ্রাদ্ধ করে লাভ নেই, কারণ এটা একটা লিবারেশন ওয়ার নয়। তাই ওরা লিটারেরি পালিয়ে গেলো, চলে গেলো। যা দু-তিন দিন সাত দিন ছিলো, ওরা অগ্রাহ্য করলো। কিন্তু আমি বা জহির বা সুখদেব আমি পারলাম না। আমরা ইমোশনাল লোক। সুখদেব একটা ছবি করছে, সুখদেব আমার ছেলের মতো। ও সবসময় বলতো ‘মেরা পিতা হ্যায়, মে পুত্র হুঁএই করেই ওর সঙ্গে আমার সম্পর্কটা; যেরকমভাবে গৌতম ঘোষ হচ্ছে আমার সেকেন্ড সান। আমার যে ছেলে রাজা, সে হলো আমার তৃতীয় পুত্র।

আরিফ : এখন বাংলাদেশে যদি আপনার কোনো ব্যবস্থা হয়, আপনি কি যাবেন?

হরিসাধন : ১০০ বার যাবো। আমি কাঙাল হয়ে রয়েছি মানে বিশ্বাস করো বাংলাদেশ আমার দেশ। শুধু তাই না ওই মুভমেন্টের সঙ্গে আমি ইনভল্বড ছিলাম। জহিরের মৃত্যু নিয়ে আমি একটু বলি। জহির যখন ওই আমারই ক্যামেরাটা নিয়ে সারেন্ডারের সিকোয়েন্সটা তোলার জন্য গেলো, ওই শটটা নেওয়ার পর যখন সে বাইরে বেরিয়ে এলো, তখন শুনলো ওর দাদা শহীদুল্লাহ্ কায়সারকে মেরে ফেলেছে। সেইটা ওর মনে এমনই আঘাত দিয়েছিলো ও ক্যামেরাটা কাকে না কাকে দিয়ে বললো যে, ছবি-টবির বিষয়ে আমার এখন আর ইন্টারেস্ট নেই, আমার দাদা বেঁচে আছে দাদাকে আমি খুঁজে বের করবো। এই যে অসাধারণ একটা ভালোবাসার ব্যাপার। শহীদুল্লাহ্ কায়সার ও দেশের একজন বিরাট বুদ্ধিজীবী। সব মিলিয়ে এমনই কাণ্ড হলো যে ও আসলে স্বাভাবিক থাকলো না। ও ছিলো ভীষণ লিবারেল, ওকে নিয়ে আমার দাদা কালীঘাটের মন্দিরে গিয়ে পূজা দিয়েছে মানে তখন ওর স্ত্রী সুচন্দা আসছিলো দেশ থেকেওর সেফটির জন্য এসব কা- করা হয়েছিলো। কিন্তু পরে যখন আমরা জহিরকে দেখলাম তখন ও টোটালি...

আরিফ : মুসলিম?

হরিসাধন : ও বোধ হয় ভাবলো যে, যেহেতু ও কিছু কিছু অন্যায় করেছে।

আরিফ : কোন্ ধরনের অন্যায়?

হরিসাধন : এই যে কালীঘাটে গিয়ে এসব আর কি। তো ও তখন কিন্তু একটু দাড়ি রাখলো, কতো বার করে নামাজ পড়তো, আজমীর শরীফ সেখানে ঘন ঘন যেতে শুরু করলো। বিফ খেতে শুরু করলো। মানে যেগুলো মুসলিমের মধ্যে পড়ে আর কি। তখন আমি আর কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়, আমরা দুজনে ওকে খুব ভালোবাসতাম। ও শেষের দিকে কলকাতায় একটা হোটেলে ছিলো, সেখানে সুভাষ দা গিয়ে ওকে বলেছিলো, দেখো তুমি যেভাবে সবাইকে বলে বেড়াচ্ছো আমেরিকানদের কন্সপাইরেসির জন্য এমন ঘটনা ঘটেছে এবং তোমার হাতে তার ডকুমেন্টস আছে এবং সেটা আমি প্রকাশ করে দেবোএসব কথা বলে তুমি বাংলাদেশে গিয়ে বাঁচতে পারবে না। তুমি বরং আমাদের আশ্রয়ে থাকো, তুমি যেও না।

জহির তখন গাড়ি করে বাংলাদেশ থেকে এখানে এসেছিলো। ও কিন্তু আমাদের কথা-টথা অগ্রাহ্য করে পরের দিন চলে গেলো বাংলাদেশে। আমিও পরের দিন চলে গেলাম, আমার তো তখন শুটিং লাটে উঠে গেছে। আমি তখন বাংলাদেশ নিয়ে এতোই মাতোয়ারা, আমার যে নিজের কমিটমেন্ট যেখান থেকে আমার টাকা-পয়সা আসে সেগুলো আর কি সেকেন্ডারি করে ফেলেছি। আমি আবার তখন ক্যামেরাম্যানকে নিয়ে কাজ শুরু করলাম। আমরা জোরহাটকে বেসক্যাম্প করে কাজীডাঙ্গায় শুটিং করছিলাম। তো একদিন পাশেই বাজারে কী যেনো কিনতে গেছি, সেখানে গিয়ে ‘আনন্দবাজার খুলে দেখি একেবারে হেডলাইন নিউজ মানে একেবারে এতো বড়ো করে লেখা ‘জহির রায়হানকে মেরে ফেলা হয়েছে, মিথ্যা প্রলোভন দেখিয়ে। পুলিশের লোক, না সিআইএর লোক বলেছে দাদা আপনি এখানে আসুন, যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে...। খবরটা শোনার পর তখনি আমি কলকাতায় চলে এলাম, তারপর সেখান থেকে ঢাকায়। এর আগেই আমার জহির রায়হানের পরিবারের সঙ্গে বিশেষ করে ওর মায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিলো। ওর মাকে দেখে আমার মায়ের কথা ভীষণ মনে পড়ে যায়। তারপর আর কি তাকে বুঝিয়ে-সুজিয়ে আমাকে ফিরে আসতে হলো কলকাতায়, কারণ কাজ চলছিলো। সেই থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। এখন আবার নতুন করে বাংলাদেশ মানে বাংলাদেশিদের সঙ্গে আমার একটা যোগাযোগ হচ্ছে।

এর প্রথম হলো গৌতম ঘোষের পদ্মা নদীর মাঝিপদ্মা নদীর মাঝি একটা জয়েন কনসেপ্ট তো; প্রোডিউসাররা বললো, আপনাকে আমরা একসময় নিয়ে যাবো। সেই সময় একটা যোগাযোগ হয়। এখন তোমরা, এই হাসপাতালেই আমার আবার অনেকের সঙ্গে পরিচয়।

আরিফ : তার মানে হাসপাতালেই অনেকের সঙ্গে...

হরিসাধন : এটা হলো একটা রিভাইভাল। এখন আমি বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য মুখিয়ে আছি। শুধু তাই নয় আমি ভিতরে ভিতরে বাংলাদেশ নিয়ে গভীরভাবে ভাবছি। বাংলাদেশ এখন তো টোটালি করাপ্টেড কান্ট্রি। আমি এখন খুব অ্যাক্টিভ, আমি স্ক্রিপ্ট লিখছি, একটা ছবি হওয়ার কথা; তার পরও আমি বাংলাদেশ সম্পর্কে কনসার্ন এবং এমন কিছু করার কথা ভাবছি যা এখন আমি বলতে চাই না। তাতে বাংলাদেশ এবং সারাপৃথিবী একভাবে কাজ করতে পারবে।

আরিফ : তার মানে আপনি আবার কাজ শুরু করছেন।

হরিসাধন : কাজ শুরু করছি।

আরিফ : করছেন মানে করেছেন?

হরিসাধন : শুরু করেছি, লেখালেখি দিয়ে। কিন্তু সেটাই আমার আল্টিমেট গোল নয়। আমার আল্টিমেট গোলটা এখনই বলা মুশকিল। তবে আমার দুর্বলতা বাংলাদেশ সম্বন্ধে এটা নিয়ে কোনো রকম কোনো কনফিউশন নেই। ভারতবর্ষ সম্বন্ধে আমার কোনো দুর্বলতা নেই। কারণ এটা মাল্টিন্যাশনাল, মাল্টিস্টোরেজ, এতো গণ্ডগোলের দেশ। আমার মনে হয়, আমার যে ভাষা সেখান থেকেই আমি যতোটুকু শিখেছি, যতোটুকু বলেছি। তাই বাংলাদেশ সম্পর্কে আমার দুর্বলতাটা ভীষণ রকম। কিন্তু আমি পথ থেকে পথে এসে পড়িনি, এসেছি গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলোর কাছে। এদের সঙ্গে ভারি আনন্দে আছি। লিখছি, বিশাল আকাশ দেখছি। শহরের সভ্যমানুষদের কাছ থেকে দূরে সরে এসে আশ্রয় নিয়েছি শান্তিনিকেতনের সুভাষ পল্লিতে। আবার যদি কোনোদিন আমাকে খুঁজতে আসো, তবে এই মাটির মানুষদের মাঝেই আমাকে পাবে।

                               

দায়স্বীকার : এই সাক্ষাৎকারটি ১৯৯৫ সালে সংক্ষিপ্ত আকারে ভারতের ‘সানন্দা পত্রিকায় প্রকাশ হয়। বর্তমান লেখাটি মূল অডিও থেকে পুনরায় ট্রান্সক্রিপ্ট করে পূর্ণাঙ্গ রূপে প্রকাশ করা হলো। 

 

আরিফ হায়দার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের শিক্ষক। তিনি ভারতের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নাট্যকলা বিষয়ে পড়াশোনা করেছেন।

 

বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৪ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের ষষ্ঠ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন