Magic Lanthon

               

তাওকীর ইসলাম সাইক

প্রকাশিত ১৬ জানুয়ারী ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘ছোটো ছোটো করে আমরা ইকুইপমেন্ট এবং নিজেদের ইন হাউজ ক্যাপাসিটি ডেভেলপড করেছি’

তাওকীর ইসলাম সাইক

তাওকীর ইসলাম সাইক-এর জন্ম রাজশাহীতে ১৯৯৪ খ্রিস্টাব্দের ১৬ ফেব্রুয়ারি। খুব ছোটোবেলা থেকেই চলচ্চিত্রের প্রতি প্রচণ্ড আগ্রহী তাওকীর প্রথম চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়, ২০০৯-এ। শুরুটা হয়েছিলো মূলত চিলড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটির সদস্য হিসেবে। রাজশাহীর চলচ্চিত্রিক পরিবেশে শৈশব-কৈশোর পেরোনো তাওকীর একসময় চলচ্চিত্র নিয়ে পড়তে যান ভারতের নৈডা’র ‘এশিয়ান স্কুল অব মিডিয়া স্টাডিজ’-এ। সেখান থেকে তিনি বি এস সি করেন চলচ্চিত্রে। তার স্পেশালাইজেশন ছিলো সিনেমাটোগ্রাফিতে। কৈশোরে প্রথম নির্মিত সেই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম ছিলো কঙ্কপূরাণ (২০০৯)। এর পর একে একে নির্মাণ করেন গ্যাস বেলুন (২০১০), লামা (২০১০), দ্য ইফনিট (২০১১), গোল ও যোগ (২০১২), সিনেমার নাম খুঁজছি (২০১৩), আয়না (২০১৫) ও সর্বোচ্চ গতিসীমা (২০১৯)। ২০২২ খ্রিস্টাব্দে তাওকীর ‘শাটিকাপ’নামে একটি ওয়েব সিরিজ নির্মাণের মধ্য দিয়ে বেশ আলোচিত হন। মূলত ঢাকার বাইরে থেকে একেবারে অপেশাদার অভিনয়শিল্পী, কলাকুশলী এবং নিজেদের গল্প, ভাষা ও প্রযোজনা নিয়ে হাজির হয় ‘শাটিকাপ’। তাওকীরের দ্বিতীয় ওয়েব সিরিজ ‘সিনপাট’ মুক্তি পেয়েছে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম ‘চরকি’তে ১১ জানুয়ারি ২০২৪। স্থায়ীভাবে রাজশাহীতে বসবাস করা তাওকীর নির্মাণের পাশাপাশি ‘ফুটপ্রিন্ট ফিল্ম প্রোডাকশন’নামে একটি প্রতিষ্ঠানও পরিচালনা করছেন।

ওভার দ্য টপ (ওটিটি) নিয়ে একটি অ্যাকাডেমিক গবেষণার অংশ হিসেবে তাওকীর ইসলাম সাইকের সঙ্গে রাজশাহীর পদ্মা আবাসিক এলাকায় তার কার্যালয়ে ৬ সেপ্টেম্বর ২০২২ দীর্ঘ এই আলাপচারিতায় অংশ নেয় আ-আল মামুন ও কাজী মামুন হায়দার। সেই আলাপচারিতার প্রথম পর্ব ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’-এর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।


আ-আল মামুন : যেখান থেকে এই রিসার্চের শুরু মানে প্রশ্নটার শুরু, বাংলাদেশে সিনেমা নাই হয়ে যাচ্ছে এবং এই সময়ে দেখা যাচ্ছে যদিও করোনা একটা কারণ, তার আগে থেকেই ওটিটি এসেছে ওটিটিতে ভালো কনটেন্ট, গল্পের বিষয়বস্তু, গল্প বলার ধরন, সবমিলিয়ে একটা ফরমেট দাঁড়িয়েছে। এবং প্রচুর নতুন মুখ আসছে, নতুন ইনভেস্টমেন্ট হচ্ছে, নতুন প্লাটফর্ম আসছে, তারা ব্যবসাও করছে। সবমিলিয়ে ভিজ্যুয়াল কালচারের একটা নতুন চর্চা শুরু হয়েছে। আমাদের মনে হচ্ছে, এটার এক ধরনের ইম্প্যাক্ট পড়বে সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে। হাওয়াপরাণ দেখে বোঝা যাচ্ছে, নতুন ধরনের একটা ভিউয়িং কালচার, একটা এনভায়রনমেন্ট তৈরি হয়েছে, যেটা আগে নির্ভরশীল ছিলো অন্যদের ওপর। এই ধরনের পরিস্থিতিতে একটা প্যারালাল অ্যাজাম্পশন হচ্ছে, ওটিটিগুলো রিজিওনাল কনটেন্টের দিকে যাবে। কারণ ইউরোপ, আমেরিকাতে এই বিজনেস সে আর করতে পারছে না, ফলে তাকে রিজিওনাল কনটেন্টের দিকে যেতে হচ্ছে। তারা ইন্ডিয়া ও বাংলাদেশে ইন্টারভেন করছে। এবং বাংলাদেশেও এটা ঘটবে একইভাবে, যেহেতু ঢাকা ইন্ডাস্ট্রি অচল হয়ে গেছে। ফলে এখানেও রিজিওনাল কনটেন্টের একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে। আর এখানেই আপনাদের কাজ মানে ‘শাটিকাপ’একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে হাজির হয়েছে। সবমিলিয়ে আমরা দেখতে চাই, ওটিটি, সিনেমার সম্ভাবনা, ভিউয়িং কালচার এবং ভিউয়িং প্র্যাকটিসের রূপান্তর। এই অবস্থায় আপনার অভিজ্ঞতা কী? স্পেশালি ‘শাটিকাপ’এবং আপনাকে কেস ধরে আমরা এগোতে চাই। যেহেতু ‘শাটিকাপ’একটা ইউনিক কেস ইউনিক কেস মনে হয়েছে এ কারণে যে, প্রসেসটা যেভাবে শুরু হলো, প্রথমে আপনি ‘শাটিকাপ’নিয়ে গেলেন, ওরা ফেরত পাঠালো।

তাওকীর ইসলাম সাইক : ওটিটি এবং সিনেমাহল এই দুইটা আসলে প্যারালালি চলে। দেখেন, আমাদের দেশে যখন সিনেমার পরিস্থিতি খারাপ, তখন ওটিটি এসে নতুন একটা আশা জাগিয়েছে। আবার এখানে পরাণ, হাওয়ার কথাও আসছে। দেখেন, মানুষ যখন ইন্টারেস্টেড হয়েছে আমাদের বাংলা কনটেন্ট দেখতে, তখন একইভাবে সিনেমাহলের প্রতিও তাদের আগ্রহ বেড়েছে। ফলে এই দুইটা খুবই প্যারালালি কাজ করে। এই দুই জায়গার কনটেন্টের কথা যদি আমি বলি, তাহলে সেখানে কিন্তু দুই ধরনের আবেদন কাজ করে। অনেক কিছুই আছে যেগুলো পারসোনাল স্ক্রিনে দেখার মতো ইভেন্ট। সেটা সিনেমাও হতে পারে, ওয়েব সিরিজও হতে পারে বা ডকুমেন্টারি ফিল্ম হতে পারে বা অন্য যেকোনো কিছু। এসব ক্ষেত্রে একটু পারসোনাল স্ক্রিন হলে দর্শক কিংবা নির্মাতার জন্য কমফোর্টেবল হয়। আবার অনেক সিনেমা আছে যেগুলো বড়ো পর্দার মানে ফিল্ম স্ক্রিন, ভালো অডিও ছাড়া দেখে পুরা এক্সপেরিয়েন্স নেওয়া যায় না। ওই ধরনের সিনেমার জন্য ওই ধরনের সিনেমা লারজার দ্যান লাইফ ওই ধরনের গল্পের জন্য সিনেমাহল কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমরা কিন্তু কোনোটাকেই ছোটো করে দেখতে পারবো না। দুইটাই খুব ইম্পরটেন্ট।

আর এবার ‘শাটিকাপ’এর কথায় আসি, আসলে ওটা আমরা যখন বানাই তখন কনফিডেন্সে ছিলাম না। কারণ এর আগে আমাদের এ রকম কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না ওয়েব সিরিজ বানানোর কিংবা এতো বড়ো টাইম লাইনের কোনো কনটেন্ট ডিল করার। সেই ক্ষেত্রে আমরা নিজেরাই আসলে কাজটা করে দেখতে চেয়েছিলাম, ঠিক কী দাঁড়াচ্ছে। আমাদের নিজেদের ডিসিশন ছিলো, নিজেরা আগে বানিয়ে দেখি কী দাঁড়াচ্ছে। তারপর ওইটার বিপণন কীভাবে হবে তার কাজ আমরা শুরু করি। তখনই মোটামুটি ‘চরকি’আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং এই তো তারপর স্ক্রিনে আসে।

কাজী মামুন হায়দার : হ্যাঁ, আমরা আসলে সেই গল্পটাই জানতে চাই। কেননা ঢাকার ওরা তো প্রত্যেকেই বলছে, ‘শাটিকাপ’একটি স্পেশাল কেস। মানে রাজশাহীতে একটা প্রোডাকশন হচ্ছে, ওরা সেটা এভাবে নিচ্ছে। এ বিষয়ে ঢাকার মানুষজন বেশ পজিটিভও।  সেকারণে কেস হিসেবে সেই জার্নিটা আমরা বুঝতে চাই।

আল মামুন : ‘চরকি’তো এটা সরাসরি প্রোডিউস করেনি। তাই সেই প্রসেসটা বোঝা আরকি। কিন্তু প্রায় ৮০ ভাগ কাজ শেষ হবার পর ‘চরকি’এতে যুক্ত হয়েছে। মূলত তারা পোস্ট প্রোডাকশনের কাজে জয়েন করে। তো তার আগেও কি ‘চরকি’র সঙ্গে যোগাযোগ ছিলো?

সাইক : না, কোনো যোগাযোগ ছিলো না।

আল মামুন : তাহলে, এটা করার পরই যোগাযোগ হয়েছিলো? নির্মাণ প্রক্রিয়া, প্ল্যান এবং বিজনেসে মূলত ‘চরকি’যুক্ত হয়? এক্ষেত্রে আমরা বিজনেস পটেনশিয়ালিটি’র জায়গা থেকে দেখতে চাচ্ছি। ক্রিয়েটিভ প্রকাশপত্রটা ঘটবে সেটা এক বিষয়। কারণ ওটা না ঘটলে তো বিজনেস হবে না। আর বিজনেস না করলে ইন্ডাস্ট্রি টিকবে না। গ্লোবাল বিজনেসের তুলনায় বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটা তরুণ সমাজ গড়ে উঠেছে, মূলত তারেক ভাইদের (তারেক মাসুদ) পরে। তারেক ভাই, বাচ্চু ভাইদের (নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু) একটা আলাদা চোখ আছে। ওদের চোখটা হলো ন্যাশনাল, গ্র্যান্ড, অমুক তমুক এবং ওরা একটি সর্বজনীন চরিত্র তৈরি করবে, যা সারা বাংলাদেশকে রিপ্রেজেন্ট করবে এ রকম একটা ভয়েস। কিন্তু পরের যে জেনারেশন, এরা ভিন্ন। এরা থাকে খুপড়ির মধ্যে। খুপড়ি খুপড়ি করে ভাবে। এই ডিফারেন্সটা তৈরি হয়েছে পরের জেনারেশনের সঙ্গে। ফলে এই জেনারেশনের যে গড়ে ওঠা এবং তার যে সাহস; সে গ্লোবালি কমপিট করতে পারছে। সে বিভিন্ন জায়গায় যাচ্ছে; ফান্ড কালেক্ট করে নিয়ে আসছে; মানে যা খুশি করতে পারছে। এটা কিন্তু ২০১০ সাল পর্যন্ত আমরা জানতাম না। যেটা ফারুকী প্রথম করেছে। তার পরে দেখা যাচ্ছে, সবাই যাচ্ছে।

আমাদের মনে হয়েছে, গ্লোবালি কমপিট করার মতো ওয়ার্কফোর্স, ক্যাপাসিটি, ব্রেইন, সাহস, ছেলেমেয়েদের মধ্যে বেগবান হচ্ছে। ওই জায়গা থেকেই কাজটা করা যে, বিজনেস আমরাও করতে পারবো। বাংলা কনটেন্ট ও কালচারের জায়গায় ওয়েস্ট বেঙ্গলের ডমিনেন্সের বাইরে এসে একটা নতুন জার্নি তৈরি হবে। এগুলো সবই আমাদের অনুমান। এখান থেকে আপনার জার্নিটা আমরা ধরতে চাইছি।

মামুন হায়দার : এবং সেখানে থিয়েটার মানে সিনেমাহল কোথায় থাকতে পারে, সেটাও আমাদের একটা কনসার্নের জায়গা।

আল মামুন : কারণ একটা ভীতির ব্যাপার হলো, যদি ওটিটি এভাবে রাইজ করে, তাহলে ফিল্ম ব্যাপারটা থাকবে না। কিন্তু ব্যাপারটা হয়তো আসলে তা নয়।

সাইক : একদম ঠিক বলেছেন।

আল মামুন : হ্যাঁ। আমি ঘরে বসে একটা জিনিস দেখছি, যেটা প্রাইভেট-আমাদের ধারণা, টেলিভিশন কিংবা সিনেমা পাবলিক ও সোশাল এন্টারটেইনমেন্ট। যেখানে স্পেশালি পাঁচ জন বসলাম, গল্প করছি ঘরের মধ্যে, কিংবা সপ্তাহে একদিন সিনেমা দেখতে যাচ্ছি, ওটা সোশাল এবং পাবলিক। কিন্তু ওটিটি হলো খুবই পার্সোনাল এবং প্রাইভেট। আমি গোপনে দেখছি, শুয়ে, বসে, বাঁকা হয়ে, চিৎ হয়ে আমার ইচ্ছামতো। কিন্তু মানুষের তো সোশাল চাহিদা আছে। তাহলে সে কোথায় যাবে? তারা সিনেমাহল বা মাল্টিপ্লেক্সে যাবে। আমাদের কাছে মনে হয়, পাঁচ-সাত বছরের মধ্যে আমরা আরো সিনেমাহল পেয়ে যাবো।

সাইক : ওইটা নিয়ে অবশ্যই আমরা আশাবাদী হতে পারি।

আল মামুন : যাহোক ওখান থেকেই ‘শাটিকাপ’কে দেখা। মানে ‘নেটফ্লিক্স’বা অন্যান্য ওটিটির কনটেন্টের সঙ্গে ‘শাটিকাপ’কমপিট করতে পারছে। দক্ষিণে যেসব কনটেন্ট হচ্ছে, যেগুলো কমপিট করছে, বলিউডকে তাড়িয়ে দিচ্ছে, এখানেও সেটা হতে পারে। ‘শাটিকাপ’-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, একটা উদাহরণ তৈরি করেছে যে, বাংলাদেশের সব জেলায় শিল্পকলা আছে, সিনেমার সোসাইটি আছে, কিন্তু তারা খুব বেশি কিছু করতে পারছে না। খুব মান্ধাতার আমলের চিন্তা নিয়ে তারা বসে আছে। বিভিন্ন ফিল্ম সোসাইটি বানিয়ে বসে আছে। কথা হচ্ছে, ওখানে তো ছেলেমেয়েরা আসে। এই ছেলেমেয়েগুলো এবার কানেকশন পাবে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, কয়েকটা ছেলেমেয়ে এসব বৃত্ত ভেঙে বেরিয়ে আসছে।

মামুন হায়দার : ওই বৃত্তগুলো কিন্তু এখন ভাঙছে। ও (সাইক) নিজেও কিন্তু চিলড্রেন’স ফিল্ম সোসাইটি করা।

আল মামুন : যাহোক, এসব মিলিয়েই আমাদের বাস্তবতা। সেখান থেকেই ` শাটিকাপ’-এর জার্নিটা বোঝা দরকার।

সাইক : মূলকথা হলো ‘শাটিকাপ’আমরা কোনো স্কেল ধরে বানাইনি যে, এটা এই স্কেলে হবে, এটা অমুক জায়গায় যাবে, ও রকম হবে। আসলে কোভিড লকডাউনের আগে এবং লকডাউনের যে সিচুয়েশন তার মধ্যে বিশাল পার্থক্য ছিলো। ধরেন, লকডাউনের আগে আমরাও রেগুলার সারভাইভ করছিলাম। ‘শাটিকাপ’-এর আগে আমরা একটা শর্টফিল্ম বানিয়েছি, যেটা করতে আমাদের আড়াই-তিন বছর লেগে গেছে। মানে আমাদের তো সারভাইভ করতে হচ্ছে। আমাদের কমার্শিয়াল কাজ করতে হয়েছে। আমাদের অন্য অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে।

লকডাউন শুরুর কিছুদিন আগে আমরা একটা অ্যান্থোলজিকাল ফিল্ম বানাচ্ছিলাম, ১১ নম্বর সেক্টর নিয়ে। যেটা নিয়ে রিসার্চের কাজ শুরু হয়ে গেছে; ঠিক সেই সময় কোভিড চলে আসলো। আর আমরা সবাই রাজশাহীতে বন্দি হয়ে পড়লাম। তখন আসলে এই সুযোগটা আসে, একদম ঠাণ্ডা মাথায় নিজেদের মন যা চায় করা যাবে। সবচেয়ে বড়ো কথা, যেহেতু আমরা ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকার, মানে ট্রু ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্মমেকার। কারণ, ছোটো থেকে আমাদের প্র্যাকটিসটাই এমন, আমরা এই ধাঁচের সিনেমা বানাবো। সেটার জন্য আগে থেকেই ছোটো ছোটো করে আমরা ইকুইপমেন্ট এবং নিজেদের ইন হাউজ কাজের ক্যাপাসিটি ডেভেলপড করেছি। এই জিনিসটা করতে হবে, আর্ট ডিরেকশন দিতে হবে, ফলে আমাদেরই আর্ট ডিরেকশন শিখতে হবে। সাউন্ড দিতে হবে, প্রোডাকশন করতে হবে, যা-ই করতে হোক, আমাদের ইন হাউজ করতে হবে।

আসলে ঢাকায় কী করতে হয়? ঢাকায় কোনো প্রজেক্ট করতে গেলে, প্রথমেই একটা হাউজে বা একজন ডিরেক্টরকে ভাবতে হয়, অমুককে হায়ার করতে হবে। আমাদের ক্ষেত্রে কিন্তু ওই চ্যালেঞ্জটা ছিলোই না।

আল মামুন : আসলে ওই চ্যালেঞ্জটা আছে বলেই আপনারা ভিন্ন কিছু ডেভেলপড করেছেন। আপনারা যেটা করেছেন, নিজেরা একেবারে প্রস্তুত হয়েই গেছেন।

সাইক : জি। ‘শাটিকাপ’-এর জার্নির আগে আমাদের ওই রকম কোনো টেনশন ছিলো না যে, কোথা থেকে কী আসবে। তবে প্রথমে আমাদের আইডিয়া ছিলো একটা ঢিসুম ঢিসুম ওয়েব সিরিজ বানাবো, যেটা আগে কোনোদিন বানাইনি। একটা অ্যাকশন সিরিজ হবে, যেটার সিরিজ হবে। এটার জন্য প্রথমে আমরা একটা টেস্ট শ্যুট করি। আমি আসলে পুরো জার্নিটাই বলছি। এটা যেহেতু কোভিডের মধ্যে ছিলো, তাই রাতে না হলে তো হবে না। সেই অনুযায়ী আমরা তিন-চার রাত বিভিন্ন জায়গায় শ্যুট করলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন, মেডিকেল ক্যাম্পাসের ভেতরে, যেসব জায়গায় পুলিশ অন্তত ঝামেলা করবে না। শ্যুট করার পর আমরা এডিট করি। তখন ২০-২২ মিনিটের একটা কাজ দাঁড়ালো। এতে দুইটা জিনিস বুঝলাম, একটা হলো, আমাদের শুটিং করার প্রসেস খুব ছোটো, একদিনে এক মিনিটের বেশি ফুটেজ বের করা কঠিন হয়ে যায়। সেখানে আমরা তিন-চার রাত শ্যুট করে ২২ মিনিটের একটা কাজ দাঁড়িয়ে গেছে। সেটাও পুরো পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়া তুমি চোর, তুমি পুলিশ, এখানে একটা ঘটনা ঘটবে। ওইভাবে আমরা কাজটা করেছি। দ্বিতীয়ত, আমরা দেখলাম এটা একটা অ্যাকশন ক্রিয়েট করে; খুবই ইন্টারেস্টিং এবং আমরা তা করতেও পারছি। এর আগে আমরা এ রকম কাজ করিনি। এর পর আমরা গল্প খুঁজতে শুরু করি। এইবার গল্প খুঁজতে গিয়ে আমরা ড্রাগ ওয়ার্ল্ডের মানুষের সঙ্গে মিশতে শুরু করলাম। যেহেতু আমাদের ওই ধরনের কোনো ব্যাকগ্রাউন্ড নাই। বরং ওই মানুষগুলোর সঙ্গে দূরত্বই ছিলো। কারণ আমি তো ডিলার কিংবা ইউজার না।

তাদের (ড্রাগ রিলেটেড লোকজন) সঙ্গে মিশে যেটা দেখলাম, আমরা আসলে চোখে যা দেখি, অ্যাকচুয়ালি ওই মানুষগুলো সেটা রিপ্রেজেন্টে করে না। আকাশপাতাল তফাত। আমাদের প্রসেসটা ছিলো ওদের সঙ্গে গ্রো করা। এক্ষেত্রে আমরা হুকড হয়েছি কয়েকটা জায়গায়। সোহেল নামে একটা লোকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয় (এই সোহেলই ‘সিনপাট’ এর প্রোটাগনিস্ট হিসেবে অভিনয় করেছেন)। সোহেলের বাড়ি পাবনার নগরবাড়ি। ও মূলত ছোট্ট একজন ডিলার। সে নগরবাড়ি থেকে গোদাগাড়ী আসে হেরোইন কিনতে। তার পর কিনে নিয়ে যায়। আমরা তাকে বাসস্ট্যান্ডে ধরে অফিসে নিয়ে আসি। আমাদের দুই-তিনজন ছিলো, যারা ওকে নিয়ে আসে। ও তো খুবই রিস্কি। কারণ ওর পকেটে তখন জিনিসপত্র আছে। খুব ইন্টারেস্টিং! আমরা ওর সঙ্গে যে কয়েকটা মিটিং করেছি, মানে একটা ট্রিমেন্ডাস ক্যারেক্টার! এ রকম মানুষ জীবনেই দেখেছি কম! কথাবার্তা, চালনচলন, জীবনবোধ সবই আলাদা।

কিন্তু দেখলাম, আমরা ওই পর্যন্ত মিট করতে পারবো না। আমাদের এই গল্পের ব্যাক স্টোরি ডেভেলপড করতে হবে। যেই গল্প আমাদের সাধ্যের মধ্যে হবে আর পরের সিজনে গিয়ে আমরা আরো ডিটেইলে বলতে পারবো। কারণ আমাদের তখন সীমাবদ্ধতা হলো, নিজেরা প্রোডিউসার। এবং ফান্ড একেবারে লিমিটেড।

ফলে আমরা চিন্তা করলাম, ওকে, বাকি যে চরিত্রগুলো পেয়েছি ওগুলো নিয়েই কাজ শুরু করি। তবে আমাদের স্ক্রিপ্ট লেখার বিষয়টা খুব অর্গানিক ছিলো, ওই লোকেশনগুলোতে গিয়ে, ঠুসঠাস মাথায় যা আসে তাই লেখা হতো। আরো কিছু জায়গায় আমরা ঘোরাঘুরি করতাম শহরের পশ্চিমের দিকে; পূর্ব দিকের ইউসুবপুরওই এলাকাগুলো আরকি। ওসব জায়গা থেকে আমরা বিভিন্ন ঘটনা ও বিভিন্ন ক্যারেক্টারের রেফারেন্স পাই। যেগুলো নিয়ে আমরা ওইভাবে লিখতে শুরু করি।

সবচেয়ে বড়ো কথা হলো, সিরিজের কুকিং প্রসেসটা একদমই আলাদা, যেটা আমরা একেবারে জানি না। আমাদের ওই ধরনের অভিজ্ঞতাই নাই। আমি যে ফিল্ম স্কুলে পড়েছি সেখানেও ওয়েব সিরিজ পড়ায়নি। সাম্প্রতিক সময়ে পড়ানো শুরু হয়েছে।

আল মামুন : আরেকটা বিষয় হলো, টেলিভিশন নাটক  এবং ওয়েব সিরিজের মধ্যে অনেকখানি পার্থক্য।

সাইক : শুরু থেকেই বাংলাদেশে টেলিভিশন ড্রামার নিজস্ব একটা নেটিভ ল্যাংগুয়েজ আছে, স্টাইল আছে। যেইটা আমরা বলতে পারি, অনেকাংশেই হয়তো সেটা ইন্ডিয়ান টেলিভিশন ড্রামা থেকে ইনফ্লুয়েন্সড। আবার আমাদের নিজেদেরও কিছু যেহেতু আমরা একটা লম্বা সময় ধরে টেলিভিশন ড্রামা বানিয়ে যাচ্ছি, এটার একটা প্রচলন রয়েছে নিজস্ব একটা ভাষা তৈরি হয়েছে। কিন্তু আমরা যদি বিদেশি টেলিভিশন ড্রামা দেখি এখন আমরা ওটিটি প্লাটফর্মে যে ধরনের ওয়েব সিরিজ দেখছি, এর আদিরূপ আসলে এসেছে বিদেশি টেলিভিশন ড্রামা থেকে। ইভেন এখন যে বিদেশি টেলিভিশন ড্রামাগুলো হচ্ছে এগুলো এবং ইন্টারন্যাশনাল ওটিটির যে কাজ সেগুলোর মধ্যে আসলে কোনো পার্থক্য নেই। মানে সিরিজের যে প্রচলন এটা আসলে ওইখান থেকেই এসেছে। আমরা যখন বাংলাদেশে টেলিভিশন ড্রামা বানিয়েছি এবং ওখান থেকে এখন যখন ওয়েব সিরিজ বানাচ্ছি, তখন দেখা যাচ্ছে আমাদের ওয়েব সিরিজের ভাষা আমরা আসলে বিদেশি ওয়েব সিরিজ ও টেলিভিশন ড্রামার যে স্ট্রাকচার, যে গল্প বলার ধরন, ওইখান থেকে রপ্ত করেই বানাচ্ছি। এই জন্য আমাদের বাংলাদেশে টেলিভিশন ড্রামা এবং ওয়েব সিরিজের মধ্যে একটা সুক্ষ্ম পার্থক্য দেখা যায়।

আল মামুন : ফ্রেমের ব্যাপার।

সাইক : ফ্রেমের ব্যাপারে কিছুটা, অ্যাসপেক্ট রেশিও বা ফোকাল লেন্থে-ও কিছু ব্যাপার রয়েছে আমি কতোটুকু কীভাবে দেখাবো। কারণ মানুষ তো মোবাইলের স্ক্রিনে সিনেমাহলের মতো দেখতে পারবে না। ফলে ওই দিক থেকে কিছুটা আলাদা, কিন্তু কুকিং প্রসেসটা এক। আমাদের টিভি নাটকে নিজেদের একটা প্রসেস ছিলো; আমরা নিজেদের মতো ধারাবাহিক বানিয়েছি। ‘ শাটিকাপ’বানানোর পর অনেকগুলো টার্ম জানলাম। যেমন, ক্লিপ হ্যাঙ্গার বলে একটা টার্ম আছে। কীভাবে মাউন্ট করতে হয় পরের সিজনে। তার পর নিজের মেকিং প্রসেসে কী কী বিষয় মাথায় রাখতে হয় এ রকম স্ট্রাকচারের ব্যাপার আছে।

মামুন হায়দার : এগুলো ওই ২২ মিনিটের শুটিংয়ের আগে জানতেন কি না?

সাইক : ওয়েব সিরিজ নিয়ে একটা বেসিক ধারণা আমাদের ছিলো। কিন্তু এটার ইনডিটেইলে কুকিং প্রসেস আমরা জানতাম না। আমরা আসলে প্রথম থেকেই জানতাম এই প্রজেক্টটা আমাদের রেঞ্জের বাইরে। এজন্য আমরা খুব কনশাসলি প্রত্যেকটা কাজ গুছিয়ে করার চেষ্টা করেছি। এবং করতে করতে নতুন নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি। মজার ব্যাপার হলো, আমরা এডিটিংয়ের সময় জানতে পেরেছি প্রত্যেক এপিসোডের শেষে একটা ক্লিপ হ্যাঙ্গার প্রয়োজন।

আমাদের প্ল্যান ছিলো প্রথম লট-এ ২৭ দিন শ্যুট করবো। যেটা ৪২ দিনে গিয়ে ঠেকেছে। এবং পরে প্যাচ শ্যুট করতে করতে ৬৩ দিন শ্যুট করতে হয়েছে। এগুলো হয়েছে আমাদের না জানার জন্য। আমরা আগে সিনেমা যেভাবে বানাতাম, সেভাবেই এটা বানিয়েছি। কোনো সিন পাঁচ বার শ্যুট করেছি পাঁচ দিনে। যখন পর্যন্ত না মনে হয়েছে সিনটা পারফেক্ট হয়েছে। কারণ তখন নিজেরা করেছি, ভাবতে হয়নি, কোথা থেকে কী আসবে। ডেভেলপমেন্ট ফেইজে আমাদের কোনো প্রোপার স্ক্রিপ্ট রাইটার ছিলো না, আমরা চারজন খুব স্ট্রাগল করেছি গল্পটা ঠিক কীভাবে বলবো তা নিয়ে। যেমন, অনেক সিন ডেভেলপড হয়েছে-আমরা অন লোকেশনে গিয়ে নিজেরা অ্যাক্টিং করতাম। ওইখান থেকে যা যা ভালো লাগতো তাই স্ক্রিপ্টে ইনকরপোরেট করতাম। আর সিরিজের মূল ব্যাকগ্রাউন্ডটা ডেভেলপড হয় ওই সোসাইটির মানুষদেরকে অবজার্ভ করে। অ্যাক্টিং ফেইজে যদি বলি, আমরা ক্যারেক্টার পিক করেছি একরকম রাস্তাঘাট থেকে; ওকে দেখে মনে হয়েছে, ও ক্যারেক্টারটা করতে পারবে। ওকে আমরা কয়েকদিন দেখেছি। এভাবে প্রাইমারি কাজগুলো হয়েছে-মূলত আমাদের নিজেদের মধ্যেই মেইন প্রাইমারি কাস্টগুলো করি। যারা লেখার সঙ্গে ছিলো, ওরা প্রথম দিন থেকেই কাজ করেছে; ফলে ও ওই ক্যারেক্টারটা জানে। ও দেখেছে। সে কারণে তার জন্য অ্যাক্টিং করা একটু সহজ ছিলো। কিন্তু বাইরে থেকে যাদের নিয়েছি, তাদের সঙ্গে আমরা লম্বা অ্যাক্টিং ওয়ার্কশপ করেছি, টেস্ট শ্যুট করেছিতারা আসলে এই প্রসেসের সঙ্গে একেবারে নতুন, তা নয়। এই প্রসেসগুলো আমরা মূলত অ্যাক্টিং এবং টেকনিকাল টিমের জন্য করেছি।

এখানে মজার ব্যাপার হলো, মাল্টি ক্যামেরায় কাজ করতে হবে সেটা আমরা আগে থেকেই জানতাম। ফলে কোনো ক্যারেক্টারের সাবলীল কাজের পর আরেকজন যে ডায়ালগটা দেবে, ওটা মিলবে না কখনো। কারণ, ওরা তো প্রফেশনাল আর্টিস্ট না, ওরা একই এক্সপ্রেশন একইভাবে দিতে পারবে না। তাই আমাদের মাথায় ছিলো একসঙ্গে পুরো জিনিসটা শ্যুট করে ফেলতে হবে। যে টেকটা ওকে হবে, সেটা পুরোটাই ওকে। সে কারণে আমরা স্টেপ বাই স্টেপ কাজ করেছি। পুরো জিনিসটা ভাবারই সময় হয়নি। সেটা পারতামও না। যেমন, ছোট্ট একটা স্টেপ, আমাদের এতোগুলো ক্যামেরা লাগবে, কিন্তু টাকা তো নাই। তখন আমরা সনি’র কাছে গিয়েছি। তাদের বলেছি আমাদের এতোগুলো ক্যামেরা লাগবে। আমরা আপনাদের টেকনিকাল পার্টনার হিসেবে চাই। তখন ওরা বলেছে, এতে তাদের বেনিফিট কী? তখন আমরা বলেছি, সনির ক্যামেরায় শ্যুট করবো, সনিতে শ্যুট করার ফলে যে বিষয়গুলো হয়, সেসবের পুরো ফিডব্যাক দেবো, যেটা আপনাদের প্রমোশনালে কাজ করবে। সেখান থেকে আমরা কিছু ক্যামেরার বডি ও লেন্স পেয়েছি, মানে যা চেয়েছি তাই।

এভাবে যখন আমরা ভেবেছি সিন সাউন্ড রেকর্ড করবো, তখন আমাদের মধ্যে একজনকে সেভাবেই রেডি করেছি। আমরা মিনিমাম কিছু জিনিস নিজেরা দিয়েছি; কিছু জিনিসপত্র ভাড়া করেছি, পুরোটা ছবি কিন্তু সিন সাউন্ড রেকর্ড। আরেকটি বিষয় হলো, ক্যামেরা না হয় পেলাম, এতোগুলো ক্যামেরা চালাবে কারা? তখন আমরা এখানে ওয়ার্কশপ করেছি চার দিন। এর পর ছোটো ছোটো টিম করেছি, বলেছি এবার শর্টফিল্ম শ্যুট করেন। আলাদা আলাদা টিম, নিজে নিজে শর্টফিল্ম শ্যুট করেছে। এতে করে যেটা হয়েছে, যে ক্যামেরা চালাতে পারতো না, সেও একটা বেসিক পেয়েছে, ভেবেছে, কোথাও যদি সাতটা ক্যামেরা চলে, আমি কী করবো? আমাকেও ক্যামেরা চালাতে হবে। এভাবে বেসিক অপারেশনটা আমরা সবাই শিখেছি। এমনকি ওই সময় আমরা ওয়ার্ক আউটও করতাম। কেননা কোভিডের জন্য আমাদের ফিজিকাল স্ট্যান্ড কমে গিয়েছিলো। ওই সময় আমরা বাসায় থাকতাম। আমরা একটানা ১৫-২০ দিনও ওয়ার্ক আউট করেছি। কারণ আমাদের স্ট্যামিনার অবস্থা খুবই খারাপ ছিলো। এটা খুবই অর্গানিক ছিলো, সবাই একসঙ্গে থাকা এবং একটা জিনিসের জন্য সবাই একই প্র্যাকটিসের মধ্যে দিয়ে যাওয়া। এর ফলে যে সম্পর্কটা হয়ে যায় আল্টিমেটলি আমাদের জীবনের টার্গেট ‘ শাটিকাপ’বানাবো।

আল মামুন : অর্থাৎ ‘শাটিকাপ’-এর কাহিনি এবং জীবন, ওটা খুব এক্সাইটিং ছিলো। মানে একদিকে পুলিশ, একদিকে মৃত্যু, একদিকে টাকা আর একদিকে ফিল্ম।

সাইক : এটা খুব সরল গল্প। এই গল্পে আহামরি কোনো ট্রিক্স নাই। এটা একটা সহজ চোর পুলিশের গল্প, আমরা সেটাই বলতে চেয়েছি।

মামুন হায়দার : তারপর ‘ শাটিকাপ’নিয়ে কী হলো?

সাইক : আমরা শ্যুট শুরু করলাম। আমাদের হাতে যে পরিমাণ টাকা ছিলো তাতে হয়তো সর্বোচ্চ ২৭-২৮ দিন শ্যুট করতে পারবো। এটার জন্য যতো জায়গার পারমিশন, হেনতেন, হাবিজাবি প্রসেসগুলো তিন-চার মাস আগে থেকে শুরু করেছিলাম। কোভিডের বিষয়টা মাথায় ছিলো আমরা যে ধরনের সিন শ্যুট করবো-পুলিশ এসব ক্ষেত্রে খুব গুরুত্বপূর্ণ। সে কারণে আমরা তিন-চার মাস আগে থেকে-বিভিন্ন অফিস, তাদের সঙ্গে কমিউনিকেশন করা, চিঠি দেওয়া, কোথায় কখন কীভাবে শ্যুট করতে চাই, সেটা জানাই, যেনো না বলার জায়গা কমে যায়। আমাদের দিক থেকে আমরা খুব প্রফেশনাল থাকার চেষ্টা করেছি। যখনই আমরা যার কাছে গিয়েছি এগুলো জিনিস তো এর আগে ফেইস করি নাই এগুলোতে কী হয়! আমরা বলেছি, এ রকম শ্যুট করবো, এতে কোনো কিছুর ক্ষতি হবে না। আমরা এই জায়গায় যে এই কাজটা করছি, সেটা আপনাদের জানিয়েই করতে চাই। আমরা যে কাজটা করছি, তার জন্য যে ফাঁকা স্পেস দরকার, সেটা এই লকডাউন শেষ হয়ে গেলে আর পাবো না। এভাবেই আমরা অনুমতি পেয়েছি। অনেক স্পট রেস্ট্রিকটেড ছিলো এমন যে, এ পাশে বাংলাদেশ তো ওপাশে ভারত। একদম জিরো পয়েন্টে শ্যুট করেছি। এভাবে স্টেপ বাই স্টেপ আমরা সব করেছি।

প্রথম লটের শুটিং শেষের পর দেখা গেলো আমাদের বাজেট শেষ। ততোদিনে আমাদের যার কাছে যা ছিলো, সব টাকা ইনভেস্ট করে ফেলেছি। এটা আমরা ইনভেস্টমেন্ট হিসেবেই ধরেছিলাম আমার কাছে দুই টাকা, ওর কাছে পাঁচ টাকা আছে, সবাই সবটা দিয়েছি। আমার কাছে এইটা ছিলো বা আমি অমুক জায়গা থেকে এটা এনে দিয়েছি। এভাবে আমরা গ্যাদার করতে করতে শেষমেশ ৪২ দিন শ্যুট করেছি।

আগে থেকেই আমাদের ইচ্ছা ছিলো, এই সিরিজটা যেহেতু আমরা নিজেরা বানিয়েছি, আমরাই এর প্লাটফর্ম ফাইন্ড আউট করবো। আসলে আমরা চেয়েছি, দেখি এটাকে কতোদূর নিয়ে যেতে পারি, পুশ করতে পারি। কারণ ‘চরকি,‘হইচই’৫০-৬০ ভাগ শ্যুটের পর থেকেই কমিউনিকেশনটা রেখেছিলো। ‘চরকি’তখন কেবল নতুন আসছিলো, আর ‘হইচই’আগে থেকেই ছিলো। আমরা একটা গভীর প্রেমের মধ্যে ছিলাম! এই প্রেম থেকেই এটা বানানো। এটা দাঁড়াবে, কী দাঁড়াবে না, সেটা নিয়ে আমাদের হেডেক ছিলো না। আমরা দেখতে চেয়েছিলাম, জিনিসটা আসলে কী দাঁড়ায়। আমরা নিজেরা কী পারছি। তার পর আমরা অফিসিয়ালি নেক্সট স্টেপে মুভ করা শুরু করবো। শুটিং শেষে আমরা যখন এটার ফার্স্ট কাট দাঁড় করাই তখন আমরা মোটামুটি কনফিডেন্ট হই আমরা যা বলতে চেয়েছি তা স্ক্রিনে দেখা যাচ্ছে। কিন্তু এর পরের পথটা আরো কঠিন। আমরা বুঝেছি, পোস্ট প্রোডাকশন অনেক এক্সপেনসিভ হবে! কারণ এই ধরনের প্রোডাকশনের ক্ষেত্রে যে ধরনের পোস্ট দরকার, তা অনেক এক্সপেনসিভ হয়। ইভেন, ফুল শুটিংয়ের চেয়ে আমাদের পোস্টের খরচ বেশি ছিলো। এইবার আমরা অফিসিয়ালি একজন কো-প্রোডিউসার খুঁজতে শুরু করি যে কিনা আমাদের পোস্ট প্রোডাকশনের ব্যয়ভার বহন করবে, প্লাস কাজটা একটা ভালো ওটিটি প্লাটফর্মের কাছে পৌঁছাতে সাহায্য করবে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে আমরা একটা কো-প্রোডিউসারও পেয়ে গেলাম।

তারা খুবই প্রোমিনেন্ট। তাদের সঙ্গে কথা হলো। কিন্তু পরে দেখা গেলো, তাদের সঙ্গে আসলে যে ধরনের কথা হয়েছে, সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে না! অথচ আমরা ছয় মাস বসে আছি এইটা ওইটা এগ্রিমেন্ট হচ্ছে, ইত্যাদি ইত্যাদি। ফাইনাল এগ্রিমেন্ট করতে গিয়ে আমরা আরেক দফা বিপদে পড়লাম, সেই কোম্পানি এটার ৫০ ভাগ মালিকানা দাবি করে বসলো। তাদের নামই মূল হিসেবে থাকবে, আমরা থাকবো সাপোটিং হিসেবে! সেটাও আমরা একপর্যায়ে মেনে নিয়েছিলাম। ঠিক আছে। আমাদের তখন ওই টাকাটা দরকার ছিলো! আর আমরা তো নামের জন্য বানাইনি। আমাদের কাজটা করতে হবে। তার পরও ওরা কাজের জন্য ঢুকছে না। শেষমেশ ওরা যখন কাজের মধ্যে ঢোকা শুরু করলো, দেখা গেলো তারা বলছে, এইটা এ রকম হবে, এইটা এই হবে না ওরা খুব ইন্টারফেয়ার করতে থাকলো। ওদের একজন বিদেশি কনসালটেন্ট বললো, ‘শাটিকাপ’নামটা ওয়ার্ক আউট করবে না, পরিবর্তন করতে হবে। ওরা ওদের মতো একটা লিস্ট করে দিলো, এই হবে সেই হবে। আমরা তখন দেখলাম জিনিসটা আমাদের ওয়ার্ক করছে না।

এই পর্যায়ে সবচেয়ে কঠিন ডিসিশন নিতে হয়, শুটিং পর্যন্ত আমরা যেমন একলা চলো নীতিতে চলেছিলাম পরের পথটাও আমাদের নিজেদেরকেই চলতে হবে। তার পর যা হয় হবে ফাইন্যান্সার নাই, কোনো সমস্যাও নাই।

মামুন হায়দার : এর পর তাহলে আপনারা কী করলেন?

সাইক : এর পর আমরা ঠাণ্ডা মাথায় নিজেদের একটা ফাইনেস্ট এডিটিং কাট রেডি করলাম। পাশাপাশি নিজেরাই ডিস্ট্রিবিউশন প্ল্যান শুরু করি। বিদেশি প্লাটফর্মগুলো আসলে ডিস্ট্রিবিউটর দিয়েই কনটেন্ট প্লাটফর্মে নেয়। সাধারণত প্লাটফর্ম ডিরেক্ট কিছু কেনে না। এক্ষেত্রে ওদের অফিসিয়াল কিছু ডিস্ট্রিবিউটর কাজ করে। যারা প্রজেক্টটা নিয়ে ওই পর্যন্ত যায়।

প্রথমে আমরা একেবারে ঢালাও পিচিং ডেক পাঠানো শুরু করলাম। আমরা একটা পিচিং ডেক বানিয়েছিলাম, অফিসিয়ালি সিরিজটা যেহেতু শেষই হয়েছিলো। একদম শেষ পর্যায়ে আমরা ড্রাফট রেডি করে পিচিং ডেক আর একটা ট্রেইলার শেয়ার করতে শুরু করলাম। এভাবে আমরা কয়েকটা জায়গা থেকে রিপ্লাই পেলাম। এর মধ্যে একটা জায়গা হলো কিউ (ভারতীয় নির্মাতা কৌশিক মুখার্জি)। তাদের একটা প্রোডাকশন কোম্পানি আছে ‘অড জয়েন্ট’, যারা কিনা ডিস্ট্রিবিউশনও করে। এছাড়াও ফারহান আখতারের `এক্সেল এন্টারটেইনমেন্ট’-এর সঙ্গেও আমাদের কথা হয়েছে। ওরা বললো, একদম ইনিশিয়াল আইডিয়া লেভেলে তাদের কাছে আসতে হতো। এটা যেহেতু অলরেডি ফিনিসড প্রজেক্ট। কারণ প্লাটফর্মগুলোর নিজস্ব কিছু ক্রাইটেরিয়া থাকে। ফলে আপনারা যদি ইনিশিয়াল পর্যায়ে আসতেন, তাহলে এই প্রজেক্টটা করা আমাদের জন্য ইজি হতো।

কিউয়ের সঙ্গে আমরা কথা বললাম। তারা এটা দেখে ডিস্ট্রিবিউশন করতে ইন্টারেস্টেড হয়। কিউয়ের সঙ্গে যখন এই পর্যায়ে কথা হচ্ছিলো, সেই সময় `চরকি’,‘হইচই’ও আমাদের সঙ্গে কথা বলছে। পোস্টেরই একটা অংশে `চরকি’র সঙ্গে আমাদের ফাইনাল ডিলটা লক হয়।

পোস্টের আরেকটু শুরুর দিকের গল্প যদি আমরা বলি, একটা খুব মজার অভিজ্ঞতা হয়। ‘শাটিকাপ’-এর জন্য আমরা খুব অর্গানিক সাউন্ড এবং ফলি দিয়ে একটা ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক করতে চেয়েছি। আমরা একটু অ্যাকোস্টিক টোনে রক ঘরানার মিউজিক করতে চেয়েছি। এই সময় ট্যাংরা ব্লুজ মুভিতে আমরা নবারুণ বোসের মিউজিক শুনি। তার পর ওনার সঙ্গে যোগাযোগ করি। তাকে জানাই, আমরা এ রকম, আমরা এই কাজটা করেছি, আমরা এটা করতে চাই এবং সেটা আপনার সঙ্গে। আমরা এই বলে ড্রাফট পাঠিয়ে দিলাম। উনি পুরোটা দেখে আমাদের প্রস্তাবে সম্মতি দেন; বলেন, আমি এতো টাকা পারিশ্রমিক চাই, স্টুডিও বিল এতো এবং অন্যান্য হ্যান্ডসের জন্য এতো টাকা। যদিও তা বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। আমাদের গান লেখাই ছিলো, সুর করা, ইভেন একটা লেভেল পর্যন্ত কম্পোজ করাও ছিলো। ওনাকে আমি বললাম, দেখেন, এখন তো আমাদের ওই সামর্থ্য নাই, টাকাপয়সার জন্য চার মাস সময় দিতে হবে। এটা যদি বিক্রি নাও হয়, আমরা আপনাকে টাকাটা দিয়ে দেবো।

একইভাবে আমরা এডিটিংয়ের জন্য গেলাম, ‘ফিল্ম নয়ার’এর অনিম ভাইয়ের কাছে। তিনি তখন খুব জনপ্রিয় সিরিজ ‘তাকদীর’-এর এডিটর এবং প্রোডিউসার। ওরা আমাদের পূর্ব পরিচিত ছিলো এবং এটা দেখে তারা কোনো টাকাপয়সা চায় নাই। বলে, এটা যদি বিক্রি হয় কোনো দিন, তখন তোমাদের মনে হলে টাকা দিও। আর যদি কখনো দিতে না চাও, দিও না। আমরা এটা করবো। এই মানুষগুলো যে লেভেলে ডেডিকেশন দিয়েছে, সেটা আমরাও দিতে পারি নাই। একটা প্রফেশনাল এডিটিং হাউজ হয়েও ওরা ছয়-সাত মাস ধরে এই কাজটা করেছে। নবারুণ বোস এতো কাজ করেন; উনি ছয় মাস অন্য কোনো কাজ করেননি। পুরো সময় শুধু এটার মিউজিক করেছেন। মজার ব্যাপার হলো, ধরেন, উনি একটা মিউজিক বানিয়ে পাঠিয়েছেন; আমি শুধু বলেছি, দাদা এটা একটু সমস্যা! উনি আর সেকেন্ড থট-ই করেননি। উনি আবার কম্পোজ করেছেন। ওনার ভাষ্য, ডিরেক্টরের সমস্যা মনে হয়েছে, তাহলে এই মিউজিক চলবে না। এতো অসাধারণ মিউজিশিয়ান আমি আগে দেখি নাই! তিনি কোনো আর্গুমেন্ট চান না। আমি যে একটা নন-মিউজিশিয়ান, মিউজিকই বুঝি না! আমার মতো লোকের সঙ্গে উনি ইমব্যারেস ফিল করছেন। উনি আসলে এমন এক মিউজিশিয়ান, যিনি সব ধরনের মিউজিক কম্পোজিশনই জানেন! তার পরও উনি ভাবছেন, এই মিউজিকটা ঠিক হলো কি না! ঠিক একইভাবে আমরা সাউন্ডও করেছি।

আর এসব ক্ষেত্রে একটা জিনিস তো থাকেই-গ্রাম থেকে এসেছে, সব রিজিওনাল ছেলেপেলে আমরা সবাই মিলে থাকি ওর পাশে। প্রথম পর্যায়ে এটা তো একটা দিক। দ্বিতীয়টা হলো, সিরিজ দেখার পর হয়তো খুব ভালো লেগেছে। তখন কাজটা করা। আমরা তো ড্রাফটটা করে ফেলেছিলাম।

(চলবে)

তাওকীর ইসলাম সাইক

Touqir.footprint@gmail.com

আ-আল মামুন ও কাজী মামুন হায়দার, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ান।

abdullahmamun@ru.ac.bd

kmhaiderru@gmail.com

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন