Magic Lanthon

               

কাজী হায়াৎ

প্রকাশিত ০১ এপ্রিল ২০২৪ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা ৫

বাংলাদেশে ডিজিটাল সময়ের চলচ্চিত্র কী পেলাম, কী হারালাম

কাজী হায়াৎ


১২৩, রবীন্দ্র কলাভবন

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

৭ এপ্রিল ২০১৫

বিকেল সাড়ে চারটা

 

সঞ্চালক-১ : ১৪২১ বঙ্গাব্দের চৈত্র মাসের আজ ২৪তম দিন; ৭ এপ্রিল ২০১৫ খ্রিস্টাব্দ।

সঞ্চালক-২ : অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। অনেকটা শামসুর রাহমানের সেই উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। সবাই নিজের অস্তিত্ব রক্ষার মিছিলে শামিল। কারো পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে, কেউবা পাকাপোক্ত করছে স্বীয় ক্ষমতার ভিত। সচলের বাতাবরণে অচল হয়ে আছে প্রিয় মাতৃভূমি। তবে ম্যাজিক লণ্ঠন থেমে নেই। এক এক করে আমরা আজ নবমে (সংখ্যা ৯)।

সঞ্চালক-১ : শ্মশানে দাঁড়িয়ে কী করে জীবনের জয়গান গাইতে হয় সেটা আমরা জানি। তাই সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ আমরা শুরু করতে যাচ্ছি ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা ৫। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় আমি নাজমুল রানা।

সঞ্চালক-২ : এবং আমি তানজিনা তাসনিম। নুরুল আলম আতিকের কথা উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে কথামালার যাত্রা শুরু হয় ২০১২-তে। যখন জার্নালটি সবে দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় সংখ্যায় হাত দিয়েছে। আমরা সাধারণত এখানে আমন্ত্রণ জানিয়ে থাকি চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত পেশাদার ব্যক্তিদের। এরই ধারাবাহিকতায় এসেছেন নির্মাতা আবু সাইয়ীদ, গোলাম রাব্বানী বিপ্লব ও অভিনেতা জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। এবারে আমরা আমন্ত্রণ জানিয়েছি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত জনপ্রিয় পরিচালক ও অভিনেতা কাজী হায়াৎকে, তিনি আমাদের মধ্যে কথা উপস্থাপন করবেন বাংলাদেশে ডিজিটাল সময়ের চলচ্চিত্র : কী পেলাম, কী হারালাম বিষয়ের ওপর।

সঞ্চালক-১ : সম্মাননীয় অতিথিকে মঞ্চে আসন গ্রহণ করার জন্য অনুরোধ করছি। এবারে সম্মাননীয় অতিথিকে শুভেচ্ছা স্মারক দিয়ে বরণ করে নিবেন ম্যাজিক লণ্ঠন-এর সদস্য এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক মাসুদ পারভেজ। (সম্মাননীয় অতিথির শুভেচ্ছা স্মারক গ্রহণ; হাততালি) ধন্যবাদ, মাসুদ পারভেজকে।

সঞ্চালক-২ : এবারে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন ম্যাজিক লণ্ঠন-এর সহকারী সম্পাদক মাজিদ মিঠু। মাজিদ মিঠুকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করছি।

মাজিদ মিঠু : চৈত্রের এই বিকেলে সবাইকে শুভেচ্ছা। রাজনৈতিক বৈরী আবহাওয়া, আর কালবৈশাখীর তাণ্ডবে বিপর্যস্ত পরিবেশে আমাদের এই ছোটো পরিসরে বৃহৎ আয়োজনে আপনারা এসেছেন, সেজন্য ম্যাজিক লণ্ঠন পরিবার থেকে আপনাদেরকে জানাচ্ছি উষ্ণ অভিনন্দন। আমরা ম্যাজিক লণ্ঠন পরিবার। আমরা মনে করি, চলচ্চিত্র জীবন ও সমাজকে বোঝার জন্য অন্যতম এক শিল্পমাধ্যম। অন্যান্য যে শিল্পমাধ্যম আজ পর্যন্ত এসেছে তার মধ্যে চলচ্চিত্র একমাত্র মাধ্যম, যেটা অন্যান্য মাধ্যমকে একীভূত করেছে। এবং এমন একটি অবস্থানে দাঁড়িয়েছে যে, মানুষের জীবন এবং সমাজকে বুঝতে, তুলে ধরতে এর কোনো বিকল্প নেই।

চলচ্চিত্র আজকে যে পর্যায়ে এসেছে, তার জন্ম ঠিক এমন ছিলো না। এই চলচ্চিত্র শুরুই হয়েছিলো প্রাযুক্তিক পণ্য হিসেবে। প্রাযুক্তিক পণ্য হিসেবে এই জন্যই বলছি যে, তখন এর সঙ্গে মানবীয় আবেগ, আবেদন ও মানুষের কল্যাণের জন্য যা কিছু¾ঠিক তেমনভাবে ছিলো না। কিন্তু সময়ের পরিবর্তনে চলচ্চিত্রের সেই অসীম ক্ষমতা, যেটার মধ্য দিয়ে মানুষের মননকে চিন্তিত করতে পারে, সেটা যুক্ত হয়েছে; মানে ধীরে ধীরেই শিল্পে পরিণত হয়েছে। এটি যেমন অন্যান্য শিল্প থেকে অকাতরে গ্রহণ করেছে, তেমনই প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে উন্নয়ন সাধন করেছে। কিন্তু আমরা দেখেছি, বরাবরই শাসকগোষ্ঠী, পুঁজিপতি এই শিল্পের প্রকাশকে সঠিকভাবে হতে দেয়নি।

এমন একটি সময় ছিলো যখন এই মাধ্যমটির মধ্য দিয়ে মানুষের কথা বলা, সমাজকে তুলে ধরা ব্যয়বহুল ও কষ্টকর ছিলো। কিন্তু প্রযুক্তির বিভিন্ন আবিষ্কার এটাকে যেমন গতি দিয়েছে, তেমনই এটাকে পিছনেও টেনে নিয়েছে অনেকখানি। চলচ্চিত্রে যখন ভাষা আসলো তখনো অনেকে মনে করেছিলো এতে শিল্পের যে বহিঃপ্রকাশ, সেটা ক্ষুণ্ন হবে। তার পরও শব্দ, রঙ ধীরে ধীরে পরিবর্তন হলো। তখন চলচ্চিত্র সেলুলয়েডে। কিন্তু ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে আসা একটি প্রযুক্তি চলচ্চিত্রের পুরো আঙ্গিকটাই বদলে দিলো। ককতো বলেছিলেন, চলচ্চিত্র সরলীকরণের কথা, চলচ্চিত্র গণতন্ত্রায়ণের কথা। যখন কিনা চলচ্চিত্র থাকবে সবার জন্য, সবাই সেটাকে ছুঁতে পারবে চাইলে। সেই ধারাতেই ইরানি পরিচালক সামিরা মাখমালবাফ বলেছিলেন, ক্যামেরা যখন কলমের মতো হয়ে যাবে, তখন মানুষের জন্য যারা চিত্রকর আছেন, যারা চলচ্চিত্র করেন, তাদের জন্য এটা খুব সহজ হবে। চলচ্চিত্র হয়ে যাবে পুঁজিপতিদের হাত থেকে মুক্ত।

আপনারা অনেকে নিশ্চয়ই ইরানের নির্মাতা জাফর পানাহির নাম শুনেছেন। যাকে রাষ্ট্র গৃহবন্দি করে রেখেছে (এখন অবশ্য তিনি স্বল্প পরিসরে দেশের ভিতরে চলাফেরা করতে পারেন)। তার চলচ্চিত্র-নির্মাণের কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি; ছোটো একটি ক্যামেরা সঙ্গে নিয়েই নির্মাণ করেছিলেন দিস ইজ নট অ্যা ফিল্ম। এই ফিল্মটি তিনি কেকের মধ্যে করে পেনড্রাইভে পাঠিয়েছিলেন দেশের বাইরে, আমাদের জন্য। সেটা সম্ভব হতো না, যদি না আজকের এই ডিজিটাল পদ্ধতি আসতো। তার পরে তিনি নির্মাণ করেছেন ক্লোজড কার্টেনট্যাক্সি। এভাবে চলচ্চিত্রে ডিজিটাল পদ্ধতি আসার মধ্য দিয়ে এটি স্বাধীন হয়েছে।

কিন্তু কোনো প্রযুক্তি চলতে গেলে তার একটা অবকাঠামো দরকার হয়। একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে এই প্রযুক্তি বাংলাদেশে আসে। তারপর থেকে ধীরে ধীরে দেশের চলচ্চিত্র ডিজিটাল পদ্ধতিতে নির্মাণ শুরু হয়। সময় পেরিয়ে গেলেও এর জন্য যে অবকাঠামো, দক্ষতা, মানসিকতার পরিবর্তন দরকার তা এখানে হয়নি। ফলে আজকের বাংলাদেশে যে অবস্থা সেখানে ডিজিটাল পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার  প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এ নিয়েই আজকের আয়োজন ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা ৫। এই আয়োজনে আমরা এবারে এমন একজনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছি, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সেই শৈশব থেকে এর সঙ্গেই আছেন। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা কাজী হায়াৎ (দর্শকের হাততালি)। আজকের এই বৈরী আবহাওয়া ও রাজনৈতিক ডামাডোলের মধ্যেও উনি আসতে পেরেছেন, এজন্য ম্যাজিক লণ্ঠন পরিবার থেকে, আমাদের সবার পক্ষ থেকে আবারও অভিনন্দন ও প্রাণঢালা শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আজকে আমরা তার কাছ থেকে শুনবো তার অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশে ডিজিটাল পূর্ববর্তী, পরবর্তী সময়ের কথা। ধন্যবাদ সবাইকে।

সঞ্চালক-১ : ধন্যবাদ, মাজিদ মিঠু। প্রতিবারের মতো এবারেও আমাদের কথামালায় থাকছে দুটি পর্ব। প্রথম পর্বে সম্মাননীয় অতিথির কথা উপস্থাপন এবং দ্বিতীয় পর্বে থাকছে প্রশ্নোত্তর। আমরা লিখিত আকারে আপনাদের কাছ থেকে প্রশ্ন নেবো। আমাদের দায়িত্বরত সদস্যরা আপনাদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট কাগজে প্রশ্ন সংগ্রহ করবেন।

সঞ্চালক-২ : কথা অনেক হলো, আর নয়; এবারে আমরা চলে যাচ্ছি আমাদের সম্মাননীয় অতিথি কাজী হায়াতের কাছে।

কাজী হায়াৎ : বসন্তের এই বিকেলে সবাইকে শুভেচ্ছা। আমি অনেককেই চিনি না, কাউকেই চিনি না, আবার সবাইকে চিনি। কারণ, এরা সবাই বাংলাদেশের মানুষ, সবাই বাংলা ভাষায় কথা বলে। অনেকেই আমার সিনেমাও দেখেছে, আমাকেও চেনে। এটি আমার জন্য একবারেই ভিন্ন অভিজ্ঞতা যে, আমি একটি সিংহাসনের মতো জায়গায়, একক একটি চেয়ারে বসা। আমার পাশে আর কেউ নেই। আমার মনে হচ্ছে আমি রাজা, আর এরা প্রজা, আমি তাদের প্রভু। যদিও বিষয়টা মোটেও এমন নয়, আমি আপনাদের মতো, তোমাদের মতো মানুষ। একজন সিনেমা নির্মাতা। ১৯৭৪ সালে সিনেমায় আগমন। এই দীর্ঘ সময়ে ৪৯টি সিনেমা নির্মাণ করেছি। ৫০তম সিনেমার ঘোষণা দিয়েছি। জানি না, সেটা শেষ করে যেতে পারবো কি না! ম্যাজিক লণ্ঠন থেকে আমাকে বেশকিছু দিন ধরে ফোন করছে কিছু ছেলে। ওদের নামও ভালো করে জানি না। তবে সত্যিই আমার সৌভাগ্য, আমাকে এখানে আসতে হলো। একজন শিক্ষকও আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, যার বাসার ভাত খেয়েছি আমি। ভালো লেগেছে পরিবেশ। খুবই ভালো। একেবারে নতুন অভিজ্ঞতা।

অনেক জায়গায় বক্তব্য রেখেছি, অনেকবার কথা বলেছি, ইন্টারভিউ দিয়েছি। কিন্তু এমন জায়গায় আমি জীবনেও আসিনি। সেই অনেকটা রাস্তা পেরিয়ে, সারারাত ট্রেনে করে এসে, বিকালে চলে এসেছি কিছু কথা বলতে। কী কথা? ডিজিটাল সিনেমার সেকাল-একাল অথবা কী পেলাম, কী হারালাম? আসলে বিষয়বস্তুতে চলে আসা ভালো। এর আগের ছেলেটি, ম্যাজিক লণ্ঠন-এর সহকারী সম্পাদক, অনেক কথা বলেছে। তার কথার সূত্র ধরে আমি বলতে চাই, চলচ্চিত্রকে ও মাঝে মাঝে শিল্প বলেছে। আসলে এটি যদি শিল্প হয়, তাহলে আমি বলবো¾এই ডিজিটাল চলচ্চিত্র স্বাধীনতা দিয়েছে শিল্পকে, গণতান্ত্রিক করেছে, কলমের মতো লেখার সুযোগ দিয়েছে, পুঁজির কবল থেকে বেরিয়ে এসেছে চলচ্চিত্র। কিন্তু এটা যদি ইন্ডাস্ট্রি হয়, তাহলে ডিজিটাল চলচ্চিত্র এটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে। কিন্তু কীভাবে¾আমি বলবো। আগে এর ইতিহাস বলেনিই।

একটি ক্যারম বোর্ডে যখন গুটি সাজিয়ে স্ট্রাইক দিয়ে আঘাত করা হয়, তখন তার আঘাতে সমস্ত সাজানো গুটিগুলো ভেঙে যায়। ঠিক তেমনই এদেশেই এককালে লোকগান, যাত্রাপালা, কবিগান, পালা, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগ লড়াই, খাসির লড়াই গ্রাম ও শহরের মানুষের বিনোদনের মাধ্যম ছিলো। একটি বিনোদন এসে স্ট্রাইক করে ভেঙে-গুঁড়িয়ে দিলো সবকিছু। সেই বিনোদনের নাম চলচ্চিত্র। চলচ্চিত্র আসার পরে এগুলো আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে লাগলো। চলচ্চিত্রের এতো জৌলুস আর এতো গ্রহণযোগ্যতা হলো যে, এই সমস্ত বিনোদন মাধ্যমগুলো একেবারে শেষ; এবং কোনো কোনোগুলো একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেলো। কিছু কিছু অবশ্য এখনো আছে।

কিন্তু চলচ্চিত্রের যে জৌলুস ছিলো, প্রচণ্ড প্রতাপ ছিলো, একক আধিপত্য ছিলো¾চলচ্চিত্র আজ ডিজিটাল নামক স্ট্রাইকের আঘাতে ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। যে চলচ্চিত্রকে একটু আগে শিল্প বলা হয়েছে, সেই শিল্পটি আর নেই। হ্যাঁ, চলচ্চিত্র পোক্ত হয়েছে, চলচ্চিত্র সাধারণ মানুষের কাছে এসেছে। আজ হয়তো একটি মোবাইল দিয়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণ সম্ভব, পেনড্রাইভে সারাবিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া সম্ভব, স্বল্পব্যয়ে চলচ্চিত্র-নির্মাণ সম্ভব; সব সম্ভব। কিন্তু এটা ইন্ডাস্ট্রিটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

ইন্ডাস্ট্রি বলতে এটাকে আমি চলচ্চিত্র বলবো না। ইন্ডাস্ট্রি বললে আমি এটাকে সিনেমা বলবো। সম্ভবত ডিকশনারিতে সিনেমা শব্দটির অর্থ হলো¾

যাহা সিনেমাহলে প্রদর্শিত হয় তাহা সিনেমা। আমি জানি না, কবে, কখন, কে এর অর্থ দিয়েছে। তবে আমার দুটি শব্দ সম্পর্কে আপত্তি আছে। একটি হলো রাজনীতি, আর একটি হলো চলচ্চিত্র। পলিটিকসের ইংরেজি থেকে বাংলা প্রতিশব্দ রাজনীতি করা হলো। কেনো রাজনীতি করা হলো, আমি বুঝি না। আর চলচ্চিত্র কেনো করা হলো তাও বুঝি না। তবে এখন যে একেবারেই বুঝি না, তা নয়। কিন্তু আমার আপত্তি আছে। আপত্তি কোথায়?

পলিটিকস্ শব্দটা দরকার হলো তখন, যখন এটা পড়বার প্রয়োজন হলো। অনেক পুরনো দিনের কথা, আমাদের এখানে তখন রাজতন্ত্র ছিলো, গণতন্ত্র বলে কিছুই জানতো না এদেশের লোক। অর্থাৎ তারা ধরে নিলো যে, রাজার নীতিই রাজনীতি। অতএব পলিটিকসের বাংলা প্রতিশব্দ রাজনীতিই হওয়া উচিত। অথচ যদি পলিটিকসের বাংলা প্রতিশব্দ জনসেবা, জননীতি, করনীতি, গণসেবা¾এমন কিছু হতো, তাহলে হয়তো আজকের যে বীভৎস পলিটিকস্ আমরা দেখতে পাচ্ছি, অভিশপ্ত রাজতন্ত্রের যে গন্ধ আমরা পাচ্ছি, যেটা এখনো আমাদের এই যুগেও বসে আছে¾সেই রাজতন্ত্র থেকে হয়তো কিছুটা হলেও মুক্তি দিতো।

চলমান চিত্র চলচ্চিত্র, এটি বেশিদিন আগের কথা না; একশো ২০ বছর হবে। উপমহাদেশে তো চলচ্চিত্র এসেছে চলচ্চিত্র উদ্ভাবনের আরো ৩০ বছর পরে। তাহলে কে এটার বাংলা প্রতিশব্দ করলো? সিনেমা থেকে প্রতিশব্দ চলচ্চিত্র কেনো হলো? চলমান চিত্র, চলচ্ছবি¾এগুলো কেনো হলো না, কেনো চলচ্চিত্র হলো? হ্যাঁ, জানা যায়, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কোনো এক চিঠিতে ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে সিনেমা দেখে তার বন্ধুকে লিখেছিলেন, চলচ্চিত্র দেখলাম। সেই থেকে সম্ভবত বাংলা ভাষায় সিনেমা শব্দটার প্রতিশব্দ চলচ্চিত্র হলো।

আমার আপত্তিটা হলো, তখন কিন্তু চিন্তা করাও হয়নি, আজকে মোবাইল দিয়ে, ছোটো পকেট-ক্যামেরা দিয়ে এই চলমান চিত্র বা চলচ্চিত্র ধারণ করা যাবে। তখন শুধু সেলুলয়েডের কথা ভাবা হয়েছিলো। তাই রবীন্দ্রনাথ চলচ্চিত্র বলেছিলেন। আজকে কিন্তু আমি চলমান চিত্র, চলচ্ছবি, চলচ্চিত্র এগুলোকে আলাদা করতে পারবো না। কলকাতার, পশ্চিম বাংলার কিছু লোক এই নাটক, টেলিফিল্মকে চলচ্ছবি বলে। চলচ্চিত্রও বলে না, সিনেমাও বলে না। তো আমাদের এখানে দেখেছি আমি যেটার সূত্র ধরে বলছিলাম। চলচ্চিত্র আসলে মুক্ত হয়েছে, একেবারে সাধারণ মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। যে কেউ ইচ্ছা করলে চলচ্চিত্র তৈরি করতে পারবে, বিতরণ করতে পারবে এবং সবকিছু স্বল্পব্যয়ে হচ্ছে, তাই এটা ডিজিটাল।

সম্ভবত অনেকেই দাবি করবে। তবে আমি সর্বপ্রথম বাংলাদেশে ডিজিটাল নামে আজকের যে চলচ্চিত্র, সেটা করেছিলাম। যদিও এখনো বাংলাদেশে ডিজিটাল চলচ্চিত্র হয় না, এটার অনেক ক্যাটাগরি আছে। যাক সে কথা, আমি একটি ডিজিটাল ক্যামেরা দিয়ে সিনেমা নির্মাণ করেছিলাম। যেটা হয়তো অনেকে দেখে থাকতে পারেন, ক্যাপ্টেন মারুফ। এটা আমি সর্বপ্রথম ডিজিটাল ফরমেটে জমা দিয়েছিলাম সেন্সর বোর্ডে। অনেক অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছিলাম। প্রয়োজনে আমি প্রজেক্টর ও প্রদর্শন ব্যবস্থার সমস্ত খরচ বহন করবো, তবু দয়া করে আমার ছবিটি সেন্সর বোর্ড থেকে মুক্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হোক।

আমি অনুরোধ করে বলেছিলাম, সিনেমাহলে না দেখাতে পারলেও, ডিজিটাল প্রজেক্টর দিয়ে বিভিন্ন অডিটোরিয়ামে প্রদর্শন করবো এবং পরবর্তী সময়ে আমি এটা কোনো টিভি চ্যানেলে মুক্তি দিবো। তখন তারা আমাকে নিরুৎসাহিত করেছে। সেন্সর বোর্ড মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বহু আলোচনার পর শেষ পর্যন্ত মন্ত্রণালয়ের সবাইকে নিয়ে মিটিং করে সিদ্ধান্ত হলোজ্জনা, এতে চলচ্চিত্র-নির্মাণে অনেকে উৎসাহিত হবে, চলচ্চিত্র সহজলভ্য হয়ে যাবে, তাই এটাকে এইভাবে বাড়তে দেওয়া উচিত হবে না। তাই চলচ্চিত্রটিকে সেন্সর দেওয়া হলো না। আমাকে বাধ্য করা হলো ওই সিনেমাটা ৩৫ মিলিমিটারে ট্রান্সফার করতে। পরবর্তী সময়ে ৩৫ মিলিমিটারে ট্রান্সফার করে সেন্সর বোর্ডে জমা দিলাম; অযথা আমার অনেক টাকা খরচ হলো। একই সঙ্গে আমাকে হয়রানির শিকার হতে হয়েছিলো। আজ কিন্তু সেই হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে না। আমাকে তারা সেদিন মেনে নেয়নি। আধুনিক প্রযুক্তিতে পদার্পণে আমার যে পদক্ষেপ ছিলো, সেই পদক্ষেপটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিলো।

যাক, কী পেলাম, না পেলাম সেই হিসাবে আসি। আমি বলেছি, ডিজিটাল আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংস করেছে। এখন প্রশ্ন, কীভাবে ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংস করেছে? সিনেমা তো বিষয় হিসেবে বিনোদন ছাড়া আর কিছু নয়। বিষয়টা তো এমন নয় যে, আমি সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখলে আমার পেটের ব্যথা সেরে যাবে বা আমার মা-বাবার অসুখ ভালো হবে। এটা জাস্ট বিনোদন, মনের ক্ষুধা। আমি জানি, বিনোদনের ক্ষুধা পেটের ক্ষুধার চাইতেও অনেক সময় বড়ো হয়ে যায়। আমরা জানি, এই দেশে অনেক সুপারহিট মুভির কথা, ঘরের খাবার চাল বিক্রি করে দর্শক বেদের মেয়ে জোস্না দেখেছে। অর্থাৎ, পেটের ক্ষুধার চাইতে মনের ক্ষুধা অনেক সময় অনেক বেশি জোরালো হয়ে যায়। আর সিনেমা এমন একটা মাধ্যম যা শুধু মনের ক্ষুধা মেটায় না। এটা দেখে মানুষ আবেগতাড়িত হয়, উচ্ছ্বসিত হয়, উত্তপ্ত হয়, রাগান্বিত হয়, কখনো উত্তেজিত হয়।

এর বাইরে আরো বিনোদন আছে, যেমন : ক্রিকেট। এখন এই উপমহাদেশে সবচেয়ে বড়ো বিনোদন মাধ্যম। দুই-Ñতিনটা চ্যানেলে প্রতিনিয়ত শুধু ক্রিকেট খেলা দেখানো হয়। কিন্তু এখানে শুধু উচ্ছ্বাস আছে; আবেগ নেই, কান্না নেই, নেই শিক্ষা, নেই নীতিকথা। অনেক কিছুই এই বিনোদন মাধ্যমটায় নেই; যেটা সিনেমায় আছে, সেটার অনেক প্রাপ্তি আছে। আমি একটি দৃষ্টান্ত দেই, সিনেমা কী? ধরুন, একজন কৃষকের মেয়ে খুব অসুস্থ। ডাক্তার বলেছে অপারেশনের জন্য অনেক টাকা লাগবে। কৃষকের গোয়ালে একটি দুধালো গাই (গাভী) আছে, সে গাইটি বিক্রি করতে হাটে নিয়ে যায়। খুব দুঃখ নিয়ে মেয়ের চিকিৎসার জন্য সে গাইটি বিক্রি করতে নিয়ে যায়, বিক্রিও করে ১০ হাজার টাকায়। ওই টাকা নিয়ে সে রাতে যখন বাড়ি ফিরছিলো, পথিমধ্যে কয়েকজন ডাকাত তার টাকাটা ছিনিয়ে নেয়¾এটি মূলত সিনেমার গল্প। কৃষক ধর ধর করে চিৎকার করছে; বলছে, আমার সবকিছু নিয়ে গেলো, বাঁচাও।

এটি সিনেমার গল্প¾আগেই বলছি, আমার সিনেমার নায়ক সেখানে উপস্থিত। নায়ক তখন রুদ্ধশ্বাসে দৌড় দিলো। সেই দৃশ্যটি আমি ধারণ করলাম মনে করেন, স্লো মোশনে। নায়ক যখন দৌড় দিবে, তখন সারা প্রেক্ষাগৃহের লোক কী করবে বলুন তো? হাততালি দিবে; বলবে, ধর ধর ধর। আর যখন নায়ক ছিনতাইকারীকে ধরে ফেলবে, তখন কী বলবে সিনেমাহলের দর্শক? বলবে মার; গালাগালি দিবে, পারলে উঠে গিয়ে নিজে মারবে। দর্শক, একটি কথা বলি। মনে করেন, এই মুহূর্তে এমন একজন বৃদ্ধ লোকের কাছ থেকে একটি ছেলে ১০ হাজার টাকা ছিনতাই করেছে। সেই ছিনতাইকারী ওই ১০ হাজার টাকা থেকে কিছু টাকা দিয়ে টিকিট কেটে সিনেমা দেখতে এসেছে। সেও সিনেমা দেখছে, সে কী করবে তখন? সে হাততালি দিবে, নাকি দৌড়াবে?

আমি জানি, আমার অভিজ্ঞতায় বলে, সেও হাততালি দিবে, সেও চিৎকার করে বলবে, ধর ধর¾এটাই সিনেমা। ওই প্রেক্ষাগৃহ, ওই পরিবেশ তাকে একক একটি মানুষে পরিণত করেছে, ভালো মানুষ। যখন সে টিকিট কেটে ওই সিনেমাহলে ঢুকেছে, সে তখন একজন ভালো মানুষ হয়ে ঢুকেছে; সমস্ত খারাপ গুণাবলি সে তার কাঁধ থেকে ঝেড়ে ফেলে দিয়েছে। সে একজন ভালো মানুষ, ওই সিনেমার সব ভালোটুকু সে গ্রহণ করবে আর খারাপটুকু বর্জন করবে। একই সঙ্গে যেখানে নায়কের জয় হবে, সেখানে সে হাততালি দিবে। যেখানে খারাপ লোকের মৃত্যু হবে, সেখানে সে উচ্ছ্বাস করবে। এটিই হলো সিনেমার ম্যাজিক। ইটস্ ম্যাজিক অব সিনেমা। সিনেমার ম্যাজিক এমনইভাবে অন্ধকার প্রেক্ষাগৃহে একটি খারাপ মানুষকে একেবারে একক মানুষ তৈরি করে, তিন ঘণ্টার জন্য একজন ভালো মানুষ করতে পারে।

সেই গ্রেট ম্যাজিক আজকে ডিজিটাল পর্দায় ধাবিত হচ্ছে। এই গ্রেট ম্যাজিক কী করে সিনেমায়? আপনাকে আবেগপ্রবণ করে, নিজের অজান্তে আপনি চোখের পানি ফেলেন সিনেমা দেখে, আড়চোখে তাকিয়ে দেখেন পাশের দর্শক দেখছে কি না, তাই না? যদি দেখে, তাহলে একটু লজ্জা পাচ্ছেন, চোখটা মুছে নিচ্ছেন। দিস ইজ ম্যাজিক অব সিনেমা। এই গ্রেট ম্যাজিক, মানে সিনেমার ম্যাজিক হারিয়ে যাচ্ছে। ডিজিটাল হারিয়ে দিয়েছে, বিলুপ্ত করে দিচ্ছে। তাহলে সে কী করছে? আপনার ঘরের মধ্যে সিনেমাকে নিয়ে এসে একটি ছোট্ট পরিসরে টেনে নিয়ে গেছে। ঝড়ঝাপটা হচ্ছে, আপনি সিনেমা দেখছেন, কিন্তু নায়ককে মনোযোগ দিয়ে দেখছেন না। আপনি কাঁদবেন কীভাবে? ওই সিনেমা আপনার আবেগকে স্পর্শ করবে কীভাবে?

আর সিনেমা ব্যবসার ইন্ডাস্ট্রিকে শেষ করছে কীভাবে? সেটি হলো, আমার এই চশমাটা (নিজের চশমা দেখিয়ে) যেখান থেকে ক্রয় করেছি, তাদের ব্যবসায়িক ধরন হলো, এই চশমাটা যিনি কিনবেন তিনি টাকা দিবেন। আর আমার ব্যবসার ধরন হলো, আমার সিনেমা দেখবেন, টাকা দিবেন। কিন্তু ডিজিটাল হওয়ার পরে আপনি সিনেমা দেখছেন কিন্তু টাকা দিচ্ছেন না। ফলে ডেস্ট্রয় হয়ে গেছে ইন্ডাস্ট্রি। সিনেমা সাধারণ মানুষের হাতের কাছে গিয়েছে, কলম দিয়ে যেমন কবিতা লেখা যায় সেরকম। এখন মোবাইলফোন দিয়েও সিনেমা তৈরি করা যায়। বিনোদনের শূন্যতা পূরণ হয়েছে কতোটুকু, সেটা আপনারাই বিবেচনা করবেন। তবে আমি যেটা বলবো, সেটা হলো অ্যাজ অ্যা সিটিজেন অব দিস কান্ট্রি, অ্যাজ অ্যা কালচার অব দিস কান্ট্রি; আপনারা জানেন, আমি কী ধরনের সিনেমা বানিয়েছি। সেই সিনেমা নির্মাণে আপনারা আমার পরিচয় পেয়েছেন। আমি বলবো, এখন সমাজের যে অবস্থা, চলচ্চিত্র দিয়ে যদি মানুষ বিনোদিত না হয়, তবে সবাই আবেগশূন্য হয়ে যাবে। অথচ এদেশ থেকে আজ চলচ্চিত্র নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পথে। এটা নিঃশেষ হলে সমাজ আলোহারা হয়ে যাবে।

একটি যুবক ছেলে আর একটি যুবক ছেলেকে চাপাতি দিয়ে কোপাচ্ছে। সে বলছে, আমাকে মেরো না, আমার জীবন ভিক্ষা দাও। তার পরও যুবকটি কোপাচ্ছে, আবেগশূন্য হয়ে গেছে মানুষ। আবেগ নেই, কী কারণ? সিনেমা নেই। বইমেলায় বহু বই কেনা হয়, পড়া হয় না। বই পড়ার সময় ফুরিয়ে এসেছে। আমরা ছোটোবেলায় দেখেছি, প্রতিটি স্কুলে বাৎসরিক অনুষ্ঠান হতো, কলেজে দেখেছি বাৎসরিক ফুটবল হতো; স্বাধীনতা দিবসের দিন নাটক হতো¾সেগুলো এখন আর নেই। সমাজ থেকে এগুলো চলে গেছে। আমি প্রতি সপ্তাহে এই ছেলেকে আবেগপ্রবণ করে দিতাম; যেখানে সে চরিত্র গঠনের সহায়ক হিসেবে উপদেশমূলক বাণী শুনতে পেতো। আবেগকে আমি শাণিত করতাম, খারাপও করে দিতাম। আবার সিনেমা দিয়ে তার আবেগকে জাগ্রত করতাম।

যারা সিনেমাহলে যাচ্ছে না, যারা সিনেমা দেখছে না, তাদের আবেগ ছোটো হয়ে গেছে। তাই ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার, সামনে আরো অন্ধকার। আমি এদেশকে ভালোবাসি। হয়তো বলতে পারেন, আপনার মতো অনেকে ভালোবাসে। হ্যাঁ, আমি ভালোবেসে এদেশের জন্য যুদ্ধ করেছি। আমার ছেলেমেয়েরা বলে, কোথায় কী হয়েছে না হয়েছে তা তো অনেকবার শুনেছি; এই প্যাঁচাল আর ভালো লাগে না। আমি বলি, তোমরা মূর্খ; ওই নয় মাস আমি অনেক কিছু হারিয়েছি। যার ফলে আজ আমি আমার সিনেমার সঙ্গে জড়িয়ে আছি। এগুলো আমার জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে আছে।

এই দেশের জন্য আমি যুদ্ধ করেছি। আজকে একটা ছেলেকে আমি সকালে বলেছি, তোমরা জানো না, আমি স্বাধীনতাকে স্পর্শ করেছি, জড়িয়ে ধরেছি স্বাধীনতাকে; যেটা তোমরা ভাবতে পারবে না। ১৪ ডিসেম্বর আমাকে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কলকাতায় যেতে হয়েছিলো সাইকেল নিয়ে। মায়ের বুক দুরুদুরু করছিলো, ফিরতে দেরি হয়েছিলো। ফিরতে রাত আটটা বেজে গিয়েছিলো। আমার মা অসুস্থ ছিলেন, হাই প্রেসার। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন মা¾সকলে আসে, আমার ছেলে আসে না। আমি যখন বাড়ির ওপরে গিয়ে ডাক দিলাম¾মা? তখন আমার মা ছুটে এসেছিলেন। আমি জড়িয়ে ধরেছিলাম। আমি মনে করেছিলাম, আমার স্বাধীনতাকে জড়িয়ে ধরেছি। আমি ধরেছিলাম আমার স্বাধীনতাকে, আমি স্পর্শ করেছিলাম আমার স্বাধীনতাকে, যাকে স্পর্শ করার সৌভাগ্য তোমাদের কারো কোনো দিন হবে না। এই প্রজন্মের কোনো ছেলের আর কোনো দিন এ সৌভাগ্য হবে না।

আমি, আই অ্যাম দিস কাজী হায়াৎ, স্পর্শ করেছিলাম স্বাধীনতাকে। সেই জন্য আমি স্বাধীনতার কথা ভাবি, দেশের কথা ভাবি। এটা যদি আমার ভুল হয়ে থাকে, সে ভুল আমি করতে চাই। হ্যাঁ, বোকার মতো আমি সিনেমা তৈরি করি সাধারণ মানুষের জন্য। নান্দনিকতা ভুলে যাই, মুক্তিযুদ্ধের কথা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা করি। নান্দনিকতা নয়, শুধু সিনেপ্লেক্সে মুক্তি দিয়ে নয়, হাজার হাজার গণমানুষের কাছে, অশিক্ষিত মানুষের কাছে, যাদের শিক্ষা বলে কোনো কিছু নেই, তাদের জন্য আমি সিনেমা করি।

ইউ আর দ্য এডুকেটেড বয়, অল আর ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস। তোমাদের সৌভাগ্য হয়েছে এখানে লেখাপড়া শেখার। আমি যদি বলি, তোমার চেয়ে অনেক মেধাবী ছাত্র, মেধাবী ছেলে আছে, যারা লেখাপড়া করার সুযোগ পায়নি। তোমরা হয়তো অনেক বির্তক করতে পারো। না, বিতর্ক করবে না। কারণ, অনেক ছেলে বস্তিতে থাকে, তাদের সুযোগ হয়নি লেখাপড়া করার। সমাজ তোমাদের সুযোগ করে দিয়েছে, ওদের দেয়নি। আমি যদি বলি, ওদের ভালোলাগার কথা যদি চিন্তা করি; তাহলে তোমরা হয়তো রাগ করবে। হ্যাঁ, আমি ওদের ভালোলাগার কথা চিন্তা করি। ওরাও এদেশের মানুষ, ওরাও এদেশের ভাত খায়। ওরাও এদেশে জন্ম নিয়েছে। তোমার সুযোগ হয়েছে ভাববার, ওর সে সুযোগ নেই। ও রাতে নাক ডেকে ঘুমায়, নিশ্চিন্তে ঘুমায়। তোমার মতো এতো চিন্তা নেই বিত্ত-বৈভব করার। ওর এতো চিন্তা নেই রাজনীতি করে বড়ো হওয়ার। গাড়ি চালানোর স্বপ্ন নেই ওর। ও একেবারেই সাধারণ মানুষ। ও শুধু ভাত চায়, পেটে ভাত থাকবে। ওর ভালোলাগায় আঘাত করে আমি যদি ভালো লাগাই, তাহলে আমার দোষ কোথায়?

হ্যাঁ, তোমরা বলতে পারো¾আমি নান্দনিকতা বুঝি না। না, আমি তো নান্দনিকতা বুঝি, আমি তো ব্যক্তিগতভাবে ভালো সিনেমা দেখি। কিন্তু আমি ওদের কথা বলি, গণমানুষের কথা বলি, সাধারণ মানুষের স্বার্থের কথা বলি। ডিজিটাল সিনেমা আজ সাধারণ মানুষকে সুযোগ দিচ্ছে না সিনেমা দেখার। ডিজিটাল সিনেমায় সুযোগ হবে শুধু বিত্তবানদের সিনেমা দেখার। বিত্তবানরা উপভোগ করবে তাদের এই বিনোদন; যারা পেনড্রাইভ, ফেইসবুক বোঝে; যারা কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারে। তাদের কম্পিউটার, ফেইসবুক, পেনড্রাইভ ব্যবহারের সুযোগ নেই, তাদের কাছ থেকে হারিয়ে যাবে সিনেমা।

সিনেমাহলে এখন পাঁচ জন দর্শক। এক কোটি টাকার সিনেমায় ব্যবসা এখন সর্বোচ্চ ৫০ লক্ষ টাকা। এর পরেও সিনেমা বানাচ্ছি কেনো বলতে পারেন? কিছু মানুষ এখনো একেবারেই জানে না সিনেমার ব্যবসাটা কী? তারা একেবারেই নতুন; ডিরেক্টররা তাদের তুলে আনেন এখানে। সিনেমা বানানোর পর সেটা যখন মুক্তি পায়, তারা দেখেন সিনেমা চলছে না। সিনেমাহল সব বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আজ সকালে এক ছেলে বললো, তার বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সেখানে অনেকগুলো সিনেমাহল ছিলো। এখন মাত্র একটি সিনেমাহল সারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায়। সারা দাউদকান্দিতে একটি সিনেমাহল। সারা কুড়িগ্রাম জেলায় সিনেমাহল একটি।

আমি তোমাদের আরো পরিষ্কার করে দিই। গত কোরবানি ঈদে সর্বোচ্চ সংখ্যক সিনেমা রিলিজ হয়েছিলো। সারাদেশে মোট তিনশো ২২টি সিনেমাহলে এসব সিনেমা মুক্তি পেয়েছিলো। এর মধ্যে প্রায় ৪০টি সিনেমাহল ছিলো সিজনওয়ারি, যেগুলো বিভিন্ন উৎসবে, যেমন : পহেলা বৈশাখ, ঈদের সময় চালু থাকে। দুই সপ্তাহ আগের তথ্য, বাংলাদেশে এখন হয়তো দুইশো ৫০টি সিনেমাহল আছে। এর থেকেও মাইনাস হয়ে যাবে ৫০টি। সিনেমাহল যদি না থাকে, তাহলে ইন্ডাস্ট্রি শেষ হয়ে যাবে। মোবাইলফোন দিয়ে সিনেমা তৈরি হবে; তারা সেই সিনেমা ঘরে ঘরে পৌঁছাবে, নতুন নতুন ছেলে-মেয়েরা তাদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাবে। কিন্তু ইন্ডাস্ট্রি যেটা ছিলো, সেই ইন্ডাস্ট্রি শেষ হয়ে যাবে। সেই যে সিনেমা দেখার সংস্কৃতি, টিকিট কেটে অপেক্ষা করা; তারপর প্রেক্ষাগৃহে বসা, শৈল্পিক অভিনয়, পর্দা সরে যাওয়া, অধীর আগ্রহে কয় রিল সিনেমা সেটা দেখা¾সেই সংস্কৃতি, সিনেমার সংস্কৃতি, শেষ; সব শেষ।

যদি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই শিল্পটিকে বাঁচানো না যায়, ব্যক্তিগতভাবে এই শিল্পকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। কারণ হলো, সিনেমাহলে দর্শক না-যাওয়া। তার পরও ডিজিটাল সিনেমা হচ্ছে, অনেকে সেটা দেখতেও যায় ভালো মনে করে। কিন্তু গরমের মধ্যে পাখা নষ্ট, বাথরুম ভালো নেই, কীভাবে সিনেমা দেখবে?

আমার কৃষক কছিমউদ্দিনের ছেলে, সে এখন জিন্সের প্যান্ট পরে, তার সুন্দর একটি মোবাইল আছে। সে প্রতিদিন মোবাইলে ২০ টাকা রিচার্জও করে। তার আর্থ-সামাজিক উন্নতি হয়েছে; তার পায়ে একজোড়া জুতো থাকে। সে আগে সিনেমা দেখতে গিয়ে দেখতো টিনের ছাপড়া ঘর, বেঞ্চি, ফ্যান নাই। সেও এখন ওই জায়গায় বসে সিনেমা দেখতে আগ্রহী না; যতই ডিজিটাল হোক আর ভালো হোক।

তাই, আমি কী বলছিলাম? সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন। বাহিরের কেউ এসে সিনেমা শিল্পকে আর বাঁচাতে পারবে না। একেবারে শেষ, ডেথ। এখন কথা, সরকারিভাবে কী প্রচেষ্টা? কমপক্ষে ৬৪ জেলায় ৬৪টি সিনেপ্লেক্স তৈরি করতে হবে। সিনেমা বাদেও সেখানে আরো বিনোদনের ব্যবস্থা থাকতে হবে। যেখানে থাকতে পারে ছেলে-মেয়েদের ফাস্টফুডের দোকান, গল্প করার জায়গা, চিলড্রেন পার্ক। বাচ্চাদের জন্য দেখার বানর থাকবে, বাচ্চাদের খেলার ব্যবস্থা থাকবে, নানাবিধ বিনোদনের ব্যবস্থা থাকবে। আর এ নানাবিধ বিনোদন ব্যবস্থার মাঝখানে থাকবে সিনেমা। তাহলে একের ভিতর পাঁচ। একটা দেখতে গিয়ে পাঁচটা দেখে ফেলবে। এই ব্যবস্থা করতে হবে।

আপনি সিনেমা দেখতে গেলে কী কী পাচ্ছেন? পার্কে ঘুরতে পারছেন, রেস্টুরেন্টে খেতে পারছেন, গল্প করার জায়গা পাচ্ছেন¾এটি সরকারকে করতে হবে। কারণ, এক একটি ডিজিটাল কমপ্লেক্স নির্মাণ করা অনেক ব্যয়। হাইওয়ের পাশে জমি সস্তা রয়েছে এখনো। পাঁচ একর জমি করে একটি কমপ্লেক্স তৈরি করা হবে, তাই না? প্রত্যেকটা ডিস্ট্রিক্টের পাশ দিয়ে একটা করে হাইওয়ে রয়েছে। ডিস্ট্রিক্টের মাঝখানে করে ঝামেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। কারণ মানুষ মুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে চায়। শহুরে জীবন থেকে একটু মুক্তভাবে বসবাস করতে চায়, মুক্ত জায়গায় যেতে চায়। আর সেই জায়গাটি যদি হয় রাস্তার পাশে তাহলে সবাই সেখানে যাবে। আমার মনে হয়, সিনেমাকে বাঁচাতে পারে একমাত্র সরকার।

সিনেমা ডিজিটাল তো হয়েই গেছে, এই সিনেমাকে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব। আবারও বলছি, সেই ইন্ডাস্ট্রি, সেই ডিজিটাল সিনেমাকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে একমাত্র সরকার, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা। আর কোনোভাবেই এটাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। কারণ দর্শক ক্ষেত্রটা, প্রদর্শন ক্ষেত্রটা এতো নোংরা হয়েছে যে, আমি সামান্য একটা দৃষ্টান্তের কথা বলি¾ঢাকার একটা সিনেমাহলে আমার লাস্ট সিনেমা ইভটিজিং চলছিলো। আমার বাসায় একটা কাজের মেয়ে আছে। সে বললো, খালু, আমি সিনেমা দেখবো। তখনই আমি তাকে পাঁচশো টাকা বের করে দিলাম, ঠিক আছে যা সিনেমা দেখ। আমার স্ত্রী বললো, তোমার কাছ থেকে ফাঁকি দিয়ে টাকা নিচ্ছে। সে সিনেমা দেখবে না। আমি বললাম, না, তুই যা; কয়টা থেকে সিনেমা? ও বললো, তিনটা থেকে ছয়টা। আমি বললাম, যা। ও দেখি সাড়ে চারটার মধ্যে বাসায় চলে এসেছে। আমার স্ত্রী বললো, কই? দেখলে, ও কি সিনেমা দেখেছে? টাকা তো চুরি করে নিয়ে গেছে, ও সিনেমা দেখার লোক না। আমি তখন ওকে ডাকলাম। এই তুই সিনেমা দেখিস নাই? কয়, দেখছি। আমি ভাবলাম, ভালো লাগেনি বোধ হয়। ওকে বললাম, কিরে সিনেমা তোর ভালো লাগে নাই? না খালু, ভালো লাগছে। আমি বললাম, তাহলে চলে আসলি কেনো? কথা কয় না। আমি বললাম, চলে আসলি কেনো সিনেমা ছেড়ে? আমি আইছি, মানে খালু, আমি যখন ঢুকছি তখন না কয়েকটা ছেলে আমার দিকে খুব খারাপ নজরে তাকাইছে। তারপর আমি যখন সিনেমা দেখতেছিলাম তখন অন্ধকারে আমার গায়ে হাত দিছে। কোথায় হাত দিয়েছে, সে কিন্তু লজ্জায় বললো না। এবং সে বললো আমি ভয়ে পালিয়ে এসেছি।

দিস ইজ দ্য সিচুয়েশন অব আওয়ার সিনেমাহল। আমরা আমাদের মা-বোনকে সিনেমা দেখার জায়গা, সুন্দর পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে পারি না, পারছি না। তো মা-বোনদের একটি অংশ আমরা মাইনাস করে দিলাম। বিত্তবানদের মাইনাস করে দিলাম। স্টুডেন্টদের মাইনাস করে দিলাম। তাহলে সিনেমা দেখবে কারা? শুধু বস্তিবাসীদেরকে দিয়ে কি আর সিনেমা চলবে? অতএব, সবার জন্য সিনেমা যদি করতে হয়, সবার জন্য নির্মাণ, দেখার ব্যবস্থা করতে হবে। নির্মাণ সবাই করুক আমার আপত্তি নেই। কিন্তু সবার জন্যে দেখার ক্ষেত্রটা যদি সরকারিভাবে করে দেওয়া হয়, তাহলে সবার জন্য সত্যিকার অর্থে সিনেমা হবে। ডিজিটাল সিনেমা সবার জন্যই হবে এবং সবার জন্যই ডিজিটাল সিনেমা হোক। সে আশাবাদ ব্যক্ত করে আমি সবার কাছ থেকে এখনকার মতো বিদায় নিচ্ছি। এর পরে নিশ্চয়ই আমাকে প্রশ্ন করা হবে, সেটার উত্তর দেবো। সবাইকে ধন্যবাদ। (দর্শকের হাততালি)

সঞ্চালক-১ : ধন্যবাদ। এবারে আমরা চলে যাবো প্রশ্নোত্তর পর্বে।

সঞ্চালক-২ : ইতোমধ্যেই আপনারা প্রশ্ন লেখার জন্য আমাদের সরবরাহ করা নির্ধারিত কাগজটি পেয়ে গেছেন। প্রশ্নকর্তা অবশ্যই নিজের পরিচয় লিখে আমাদের দায়িত্বরত সদস্যদের কাছে প্রশ্নটি জমা দিবেন।

রাশেদ রিন্টু, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ : আপনার চলচ্চিত্র দিয়ে সমাজকে কতোটুকু পরিবর্তন করা সম্ভব হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? যদি ডিজিটাল চলচ্চিত্র দ্বারা আবেগ ধরা যায়, তাহলে আপনি কেনো বলছেন, ডিজিটাল চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস করছে?

কাজী হায়াৎ : আমার চলচ্চিত্র দিয়ে সমাজের পরিবর্তন কতোটুকু হয়েছে, আমি জানি না। তবে আমি চেষ্টা করেছি। কতোটুকু হবে, আমি তাও জানি না। আমি যেটা জানি, কোনো দেশ, কোনো সমাজকে চলচ্চিত্র পিছিয়ে নিয়ে যায়নি, আবার কোথাও কোনো বিপ্লবও ঘটায়নি। হ্যাঁ, আমার প্রচেষ্টা আছে। বলতে পারেন, তাহলে কি কেবল বিনোদন দিচ্ছে? সেটাও না, তবে চলচ্চিত্র আপনাকে জাগ্রত করার চেষ্টা করছে। আপনার আবেগ-অনুভূতিকে জাগ্রত করার চেষ্টা করছে। এতে ভালো হবে কিনা জানি না, হয়তো ভবিষ্যতে একদিন না একদিন ভালো হবে, সেই স্বপ্নটুকু দেখি। বিবর্তন কতোটুকু হবে বা হয়েছে তা আমি জানি না।

বিবর্তন নিয়ে আমি বলেছি; পৃথিবীর এমন কেউ বলতে পারবে না, চলচ্চিত্র কোনো দেশের সামাজিক বিপ্লব ঘটিয়েছে বা বিবর্তন এনে দিয়েছে। হয়তো সামান্য; আমাদের দেশে অনেকে বলে থাকেন, জহির রায়হানের জীবন থেকে নেয়া, নবাব সিরাজউদ্দৌলা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধে অনেকটা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। হ্যাঁ, অস্বীকার করার উপায় নেই। হয়তো কিছুটা সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। কিন্তু স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রেক্ষাপট ছিলো এক রকম। সেটার একজন মহাগায়ক ছিলেন, সেই গায়ক ডাক দিয়েছিলেন, ফলে যুদ্ধ হয়েছিলো। আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি।

দ্বিতীয় প্রশ্নটি ছিলো, যদি ডিজিটাল চলচ্চিত্র দ্বারা আবেগ ধরা যায়, তাহলে আপনি কেনো বলছেন, ডিজিটাল চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস করছে? আসলে ইন্ডাস্ট্রি আর আবেগ কিন্তু এক কথা নয়। ইন্ডাস্ট্রি মানে ব্যবসার দিকটা আমি বলছি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, বাংলা শব্দে আর্টকেও শিল্প বলা হয়, আবার ইন্ডাস্ট্রিকেও শিল্প বলা হয়। তো চলচ্চিত্রের বেলায় এ দুটো একেবারে পাশাপাশি থাকে তো; এজন্য আমরা অনেক সময় তালগোল পাকিয়ে ফেলি। তো আমাদের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি যেটা, সেই ইন্ডাস্ট্রিকে কী কী ভাবে আঘাত করেছে ডিজিটাল সিনেমা বা ডিজিটাল মাধ্যম? আমি বলছি যে, সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ক্ষেত্রে, প্রদর্শনের ক্ষেত্রে এটা এখন পৌঁছে গেছে ধরাছোঁয়ার মধ্যে। বাজারে এক কাপ চা খেয়ে বসে টেলিভিশনে সিনেমা দেখছে। অনেকে দুই-তিনটা সিনেমা দেখে সারাদিন পার করছে। প্রত্যেক বাজারে এ ধরনের অন্তত চার-পাঁচটা মিনি সিনেমাহল আছে। এগুলো আমার ইন্ডাস্ট্রির অংশ না। এরা আমার চলচ্চিত্রশিল্পকে ধ্বংস করছে। আপনি সিনেমা দেখছেন, কিন্তু আমি টাকা পাচ্ছি না। এই প্রেক্ষাপটে আবেগের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই, আবেগ তো ডিজিটাল চলচ্চিত্রেও থাকবে, ছিলো। মানুষের আবেগকে সিনেমা জাগ্রত করবে। এবং সিনেমা যতদিন থাকবে ততদিনই আবেগপ্রবণ করবে মানুষকে এবং জাগ্রত করবে। সবাইকে ধন্যবাদ।

মো. মেহেদী হাসান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ : ডিজিটাল তো সরিয়ে ফেলা সম্ভব নয়, কীভাবে এর সঙ্গে মানিয়ে নেওয়া যায়?

কাজী হায়াৎ : আমি বোধ হয়, আমার শেষের দিকে সবকিছু বলেছি। আমি মোটেও ডিজিটালকে ডিনাই করছি না। সেটাকে স্বীকার করতে হবে, মর্যাদাও দিতে হবে। আমি কিন্তু কখনোই ডিজিটালকে ডিনাই করিনি। ডিজিটাল সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছে সিনেমাকে। অতএব আমি বলবো, সবমিলিয়ে এখন সব মানুষের জন্যই সিনেমা দেখার বিষয়টি নিয়ে ভাবতে হবে। প্রদর্শন ক্ষেত্রটি আরো সুন্দর করতে হবে, লাইট করতে হবে, সাধারণ মানুষের জন্য দেখার ব্যবস্থা করতে হবে। এটিই আমি বলবো।

আমি ডিজিটাল সিনেমাকে অবজ্ঞা করছি না। ডিজিটাল মাধ্যম সিনেমার অনেক উন্নতি করেছে। এই মাধ্যম সাধারণ মানুষের কাছে, সাধারণ মানুষের আবেগ নানা রূপে বদলে দিয়েছে। অনেকেই এই মফস্বলে ডিজিটাল সিনেমা তৈরি করছে। ক্যামেরার মধ্যেই এডিটিং করছে কিংবা ছোট্ট একটি এডিটিং প্যানেল দিয়ে এডিটিং করছে। এগুলোও সিনেমা হচ্ছে। সেই সিনেমা অনেকেই টিভিতে বসে দেখছে, অনেকে সিডি প্লেয়ারে দেখছে। এসব চলচ্চিত্র নিয়ে গ্রামগঞ্জে একটা এলাকাভিত্তিক লাইব্রেরি হোক, সেই এলাকার মানুষের কাছে সেটা বিক্রি করা যেতে পারে।

হয়তো কারো নাটক বা সিনেমা তৈরি করতে ৫০ হাজার টাকা খরচ করতে হয়েছে। তারা এটা বিক্রি করে ৫০ হাজার টাকা তুলে ফেলুক। অর্থাৎ, আমি বলছি যে, সবাইকে একত্রিত করে এটাকে কীভাবে ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে আনা যায় সেটা করতে হবে। সেটা একমাত্র সরকারি পদক্ষেপ ছাড়া আর কোনোভাবেই কারো দ্বারা করা সম্ভব নয়।

মাহমুদুল হাসান পারভেজ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ : ইন্ডাস্ট্রি জরুরি কেনো? ইন্ডাস্ট্রি মানে তো পুঁজির খপ্পর, সরকারের সেন্সরশিপ। ডিজিটাল চলচ্চিত্র কি এসব বাধা দূর করছে না?

কাজী হায়াৎ : হ্যাঁ, আমি বলেছি, যদি ইন্ডাস্ট্রির প্রয়োজন না হয় সেটা আলাদা কথা। কিন্তু আমার একটি ইন্ডাস্ট্রি আছে, আমি কি আক্ষেপ করতে পারবো না তার জন্য? আমার একটি গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রি ছিলো। সেই গার্মেন্ট ইন্ডাস্ট্রিটা ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি কি তার জন্য আক্ষেপ করতে পারবো না? সেখানে অনেক মানুষের পেটের ভাতের যোগান হতো। একটি সিনেমাহলে ১০ জন কর্মচারী ছিলো, ১০টা পরিবার চলতো। দুই জন ব্ল্যাকার ছিলো, তাদের পরিবার চলতো, কর্মসংস্থান হতো। এ রকম করে ১২শো সিনেমাহল ছিলো এককালে। তাহলে একটা লোক বা সেই লোকগুলোর কর্মসংস্থান হারিয়ে যাচ্ছে¾এটা কি দুঃখের বিষয় নয়?

ইন্ডাস্ট্রি রক্ষা জরুরি কেনো? যদি এতো মানুষের কাছে জরুরি না হয়, আমার আপত্তির কী আছে? আমার কোনো আপত্তি নাই। তোমার আপত্তি হলো পুঁজির খপ্পর। পুঁজির খপ্পর থেকে এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় কারো মুক্তি পাবার কোনো অবকাশ নেই। অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কারণে আমাকে পুঁজির খপ্পরের মধ্যে পড়তে হচ্ছে। মনে রাখতে হবে, এই সমাজটিই পুঁজিবাদী সমাজ। এখান থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো পথ নাই। যদি শুধু পেনড্রাইভের মধ্যে সিনেমা চলে যায়, সেখানেও দেখা যায়, পুঁজি চলে এসেছে।

আমি একটি উদ্ভাবনের কথা বলি, আমার নিজের ব্রেন থেকে উদ্ভাবন; সেটি হলো¾দেখলাম, আমার সিনেমা সর্বনাশা ইয়াবার ভিডিও পাইরেসি হলো মুক্তির ১৪ দিনের মাথায়। আমার সমস্ত ব্যবসা শেষ হয়ে গেলো। আমার পার্টনার ছিলেন এটিএন-এর মালিক মাহফুজুর রহমান। তাকে বললাম, মাহফুজ ভাই, একটা পথ আছে টাকা তোলার। তখন তিনি বললেন, কী বলেন তো? আমি বললাম, আপনাদের তো অনেক টেলিফোন কোম্পানির সঙ্গে পরিচয় আছে। যেকোনো একটা টেলিফোন কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে আমরা সেই টেলিফোন কোম্পানির বিজ্ঞাপন করবো এবং বিজ্ঞাপন খরচসহ তারা দিবে। আর আমাদের যে অর্থ পাওয়া গেলো সে অর্থের ভ্যাটটা তারা নিয়ে নিবে।

তারা আমাদের কাছে খবর পাঠালো¾পদ্ধতিটা কী বলেন। আমরা বললাম, আমরা বিজ্ঞাপন করবো, বাংলালিংকের এতো এতো এতো নাম্বারে আপনি একশো টাকা জমা করুন। আগামী এতো তারিখের মধ্যে যদি এক লক্ষ গ্রাহক হয়ে যায়, তাহলে আপনার মোবাইলে আমার সিনেমাটি পাঠিয়ে দেবো। এতো তারিখের মধ্যেই যতো দ্রুত সম্ভব আপনার একশো টাকা প্রেরণ করুন। আমরা এটা বার বার বিজ্ঞাপন দিতে থাকবো। যখন আমাদের এক লক্ষ গ্রাহক হবে, অর্থাৎ এক কোটি টাকা চলে আসবে, এর মাত্র ১৫ লাখ টাকা ভ্যাট দেওয়া লাগবে। যেটা বাংলালিংক কেটে রাখবে। ৮৫ লক্ষ টাকা আমাদের রিটার্ন দিবে।

আমি বললাম, এটা এককালে প্রচলন হয়ে যাবে। তখন নতুন প্রজন্ম এটা মাথায় রেখে নিজে নিজেই সিনেমা তৈরি করবে। একসময় সিনেমাহল ভর্তি মানুষ আসতো। সিনেমাহল ভরার আলাদা একটা সংস্কৃতি আছে সিনেমার। সিনেমাহল রাখতেই হবে তা কিন্তু আমি বলিনি। আমি বলেছি, এটি আলাদা একটা সংস্কৃতি। কী সেই সংস্কৃতি? এটি যদি রাখা প্রয়োজন মনে না হয়, তাহলে থাক। তবে এটি থাকলে সমাজের অনেক উপকার হয়।

কিন্তু মনে রাখতে হবে, মুক্ত সিনেমা হলেও সিনেমা সেন্সরশিপ থেকে মুক্ত হবে না। কীভাবে মুক্ত হবে না? দেশে অনেক আইন আছে, আইন তৈরি করা আছে। পর্নোগ্রাফি আইন তৈরি আছে। আপনার ক্যামেরা, মোবাইলে যদি একটা পর্নোগ্রাফি পায় পুলিশ; আপনার মোবাইলটা সিইজ করতে পারে, আপনাকে জেলে ঢুকাতে পারে। এমন আইন তৈরি হবে যে, আপনার মোবাইলে বা পেনড্রাইভে কোথাও আপনি সেন্সরশিপ বা সেন্সর ছাড়া সিনেমা মুক্তি দিয়েছেন তো আপনাকে পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। এ আইন তৈরি হয়নি এখনো, তবে খুব তাড়াতাড়ি হয়তো হতেও পারে।

কারণ, কয়েকদিন আগে সংবাদপত্রে দেখেছেন যে, পুলিশের পোশাক ব্যবহার, পুলিশের উপস্থিতি যদি চলচ্চিত্রে থাকে; তাহলে পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে অনুমতি নিতে হবে। সিনেমা শুরুর আগে স্ক্রিপ্ট তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। তারা পাস করে দিবে। তারপর সিনেমা তৈরির অনুমতি পাবে। দেখেছেন, আইন কোথায় গিয়েছে? তো সরে যাওয়ার পথ নেই বা পালিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই। সেন্সরশিপ যদি সরকার চায় বা কর্তৃপক্ষ চায়, মুক্ত হওয়া বা মুক্তভাবে ছুটাছুটি করার কোনো পথ নেই।

ড. হাসান রাজা, সংস্কৃতিকর্মী : একজন প্রকৃত চলচ্চিত্রনির্মাতার কী কী গুণাবলি থাকা উচিত? ভারতীয় চলচ্চিত্রের তুলনায় বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের মান কীভাবে পিছিয়ে আছে বলে আপনি মনে করেন?

কাজী হায়াৎ : আমি প্রথমেই বলবো, আমি শিখেছিলাম আলমগীর কবির সাহেবের সহকারী হিসেবে। তখন উনাকে বলেছিলাম, সিনেমার ওপর তো বই আছে; আমাকে একটা বই দিবেন? তখন উনি আমাকে একটা বই দিয়েছিলেন। বইয়ের প্রথম প্যারায় লেখা আছে, ডিরেক্টর মাস্ট বি হোম ক্যারেক্টারিস্টিক অ্যান্ড ফাস্টলি। তারপর এলাবোরেটলি যা দেখায়, তাহলো তার অবজারভেশন, তার চিন্তা, তার ভাবনার সবকিছুই অ্যাক্সিকিউট অব প্রেজেন্টস ডিরেক্টর। আর এটাই একজন ডিরেক্টরের প্রথম গুণ।

এখন আমি যেটা বলবো সেটাই হয়তো আপনি প্রশ্ন করেছেন; পরিচালক হতে কী কী গুণাবলি দরকার? বা আমি পরিচালক হতে পারবো কি না? আমি তাদের সবাইকে এক বাক্যে বলছি, সিনেমার পরিচালক হওয়ার জন্য কোনো টেকনিকাল নলেজ অথবা কোনো প্রশিক্ষণের প্রয়োজন নেই। হয়তো বলতে পারেন, এটা একটা অদ্ভুত কথা।

কিন্তু মোটেও না। আমি বলবো, আপনার দরকার অবজারভেশন। আপনি একটি সিনেমা তৈরি করবেন। আপনি কী বিষয় নিয়ে সিনেমা তৈরি করবেন, বিষয়টি চুজ করেন। এটা এখন আপনার মানস পর্দায় আপনি দেখছেন শুধু। ইফ ইউ আর অ্যা গুড ডিরেক্টর, তাহলে আপনার মানস পর্দায়, মনের পর্দায় সেটা সুন্দর করে প্রতিদিন দেখতে পাবেন। আর যখন সেটা আপনার নিজের ভালো লাগবে, তখন আপনি বলেন, আমি একটা সিনেমা বানাবো। তারপর আপনি সিনেমা বানানোর জন্যে যে যে সেক্টর আছে, সেই সব সেক্টরের লোকদের কাছে চলে যাবেন।

কী কী সেক্টর? আপনার আইডিয়াটা অ্যাক্সিকিউট করার জন্যে গল্প বানাতে হবে, তাই তো? একজন কাহিনিকারের কাছে চলে গেলেন, দিস ইজ মাই আইডিয়া। এই আইডিয়াতে আমাকে একটি সিনেমা বানাতে হবে, একটি কাহিনি দিতে হবে, সে দিলো। এর পরে আপনি চলে গেলেন একজন চিত্রনাট্যকারের কাছে। দিস ইজ মাই স্টোরি, আপনি এটির একটি সুন্দর চিত্রনাট্য করে দেন। এসব ক্ষেত্রে যতক্ষণ না আপনার ভালো লাগবে, ততক্ষণ আপনি রিজেক্ট করতে থাকবেন। বিকজ আপনি তো দেখছেন, অবজারভেশন কিন্তু আপনার। আপনি সেটিসফাইড হয়ে চলে আসলেন।

এরপর আপনি নিজের মনে ভাবলেন যে, এই এই শিল্পী নিলে আমার এই অবজারভেশন, মানে যেটাকে দেখেছি সেটা বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব। আপনি সেই সেই পাত্র-পাত্রী সিলেক্ট করবেন। এরপরে একজন এক্সপার্ট ক্যামেরাম্যানের কাছে যাবেন। আপনার লেন্স সম্পর্কে কিছুই জানার দরকার নেই। ক্যামেরায় কীভাবে ছবি উঠে তাও জানার দরকার নেই। কতো কিলোবাইটে ছবি উঠে, তাও জানার দরকার নেই। শুনলে অবাক হবেন, অনেকদিন আগের কথা, হুমায়ূন আহমেদ যখন ছবি করতে গেলেন তখন ক্যামেরার ব্যবহারও তিনি জানতেন না। যাকগে, এটা টেকনিকাল ব্যাপার।

পৃথিবীর বহু বিখ্যাত সিনেমা যারা নির্মাণ করেছে তারা আসলে ডিরেক্টর নয়। ভিয়েতনামের একজন যোদ্ধা, যুদ্ধ শেষ করে তিনি চলে গেছেন হানিমুনে। হানিমুনে গিয়ে তিনি তার ডায়েরি পড়ছেন। পড়ে ভাবলেন যে, ইট মে বি ফিল্ম। তখন তিনি প্রযোজকের কাছে গেলেন। প্রযোজক তখন সেটা পড়লো। পড়ে বলেছে, এটা তুমি বানাতে পারবে? ওই লোকটি বললো, হ্যাঁ পারবো, কারণ আমি তো সেটা দেখেছি। প্রযোজক বিস্মিত হয়ে বললো, তুমি দেখেছো? তিনি বললেন, হ্যাঁ, আমার চোখে যেটা দেখার সেটাই দেখেছি। প্রযোজক বললো, তো তুমি ওরকম বানাতে পারবে? যোদ্ধা বললো, হ্যাঁ পারবো। এরপর প্রযোজক তাকে টাকা দিলো, তিনি বানালেন বিখ্যাত ছবি দ্য স্ট্রাগল। পৃথিবীর বহু ফেস্টিভালে বহু পুরস্কার পেয়েছে সিনেমাটি, অস্কারও পেয়েছে।

দ্বিতীয় প্রশ্ন ছিলো, ভারতীয় চলচ্চিত্রের তুলনায় বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের মান কীভাবে পিছিয়ে আছে বলে আপনি মনে করেন? তার মানে, আপনি মনে করেন ভারতীয় চলচ্চিত্র আমাদের পিছিয়ে রেখেছে। প্রথমেই একটা কথা বলি আপনাকে; বলুন তো, আপনি কালো কেনো, আর বোম্বের (মুম্বাই) মানুষ ফরসা কেনো? ইংরেজরা ফরসা কেনো? আফ্রিকানরা কালো কেনো? বলতে পারবেন? না। বিষয় হলো স্থান। এখন যদি বলেন, আপনার এখানে শাহরুখ খানের মতো নায়ক নাই কেনো? কারণ, আমার তো শাহরুখ খানের মতো চেহারা নাই। বোম্বের সব ছেলে-মেয়েকে নায়ক-নায়িকা মনে হয়।

রাজস্থানে আমি একবার আমার এক বন্ধু ক্যামেরাম্যানসহ রাস্তায় নেমেছি। একটা স্কুল ছুটি হয়েছিলো। তো, ও ট্যাক্সি থেকে নেমে দাঁড়িয়ে গেলো রাস্তায়। আমি বললাম, কারণ কী? বললো, এখানে সবাইকে তো নায়িকা লাগছেরে। আমি বললাম, হ্যাঁ। এখানকার মানুষের চেহারাই এ রকম¾সবাই নায়িকা। তো এদেশে একটা নায়িকাও খুঁজে পাবেন না, কারো চেহারাই ওরকম সুন্দর না। এটা আসলে কিছুই না। আমার আবহাওয়া, আমার ভৌগোলিক অবস্থান আমাকে এ রকম করেছে। আমার অর্থনৈতিক অবস্থাও দুর্বল।

একশো ৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারত। সেখানে একসঙ্গে সিনেমা রিলিজ হয় তিন থেকে চার হাজার সিনেমাহলে। একদিনে উঠে আসে একশো থেকে দেড়শো কোটি টাকা। সেই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যদি আমার ৫০ লক্ষ টাকা বাজেটের সিনেমার কথা চিন্তা করেন, তাহলে এর মান নিয়ে কী বলবো? এটা যে এখনো আছে, এইতো অনেক (হেসে)। (দর্শকের হাততালি) তাই ওই ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। ধন্যবাদ।

নাজ, বাংলা বিভাগ : আপনি সিনেমাহলের কথা বললেন, কিন্তু সিনেমা বানানো বা নির্মাণের ব্যাপারে কিছু বলেননি। সিনেমা ভালো হলে মানুষ এখনো সিনেমাহলে যায়। আপনার কি মনে হয় না, যখন থেকে সিনেমা মানুষের মনের চাহিদা মেটাতে অসমর্থ হলো বা রুচিহীন হলো¾সেই ৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে সিনেমাহলে যাওয়া একটু একটু করে কমে গেলো?

কাজী হায়াৎ : হ্যাঁ। এই যে অবক্ষয়, এটি নির্মাতাদের অবক্ষয় নয়। আমি সে তথ্যটি আপনাদের কাছে দেবো। এই যে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার দেখছেন, তাই না? আপনারা দেখছেন, ভালো লেগেছে; প্রধানমন্ত্রী সুন্দর বক্তব্য দিয়েছেন। আপনি জানেন, এর পেছনে সরকারিভাবে কতো অন্যায় হয়েছে? জানেন না। সারা পৃথিবীতে যা হয় না, তাই বাংলাদেশে হয়। সারা পৃথিবীতে কোনোদিন কখনো কোনো জুরি বোর্ডের মেম্বার পুরস্কৃত হয়নি। জুরি বোর্ডের মেম্বারের সঙ্গে যদি কোনো সিনেমার কোনোভাবে সংশ্লিষ্টতা থাকে, তাহলে সে কখনোই জুরি বোর্ডের মেম্বার হতে পারে না।

আপনাদের আরো জানা উচিত। পৃথিবীর মাত্র দুইটি দেশে ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড আছে। একটি ভারত, আরেকটি বাংলাদেশে। আর পৃথিবীর কোথাও ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড নেই। কারণ গুটিকয়েক লোক জুরি বোর্ডের মেম্বার, তারা হোল ন্যাশনালের দায়িত্ব নিতে পারে না। আর এ কথাই বিবেচনা করে সারাবিশ্বের আরো বড়ো বড়ো দেশ কিন্তু ওই ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড রাখে নাই। আমিও মনে করি, রাখা উচিত নয়।

ভারতে রয়েছে, কিন্তু তারা বহু বিভাগে চলচ্চিত্র পুরস্কার দিচ্ছে। এবং তাদের ওখানে জুরি বোর্ডের মেম্বার কখনো সরকারি প্রতিনিধি হয় না। আমাদের এখানে সরকারের মার্শাল ল পিরিয়ডে আমরা দেখেছি, চলচ্চিত্রবোদ্ধারা জুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান হয়েছেন। আর এখন দেখছি, একজন আমলা যিনি মন্ত্রণালয়ে সেক্রেটারি থাকেন, তিনি চলচ্চিত্র বোঝেন আর না বোঝেন, তিনিই বোর্ডের চেয়ারম্যান। এবং তিনিই জুরি বোর্ডে মেম্বার নিয়োগ করবেন। কতো অনিয়ম হয়েছে¾আপনারা শুনলে অবাক হবেন।

বিগত দুই বছরে জুরি বোর্ডের মেম্বাররা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে। আপনারা বলেন, আলমগীর হলো জুরি বোর্ডের মেম্বার এবং তার স্ত্রী রুনা লায়লা। সে (আলমগীর) কি জুরি বোর্ডের মেম্বার থাকতে পারবে? রুনা লায়লা যখন পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়, আলমগীর তখনো জুরি বোর্ডের মেম্বার ছিলো। এমনকি জুরি বোর্ডের মেম্বার থাকা অবস্থায় আলমগীর নিজেও একটি পুরস্কার পেয়েছিলো। নিজেও পুরস্কার নেয়, আবার জুরি বোর্ডের মেম্বারও থাকে।

এছাড়া চ্যানেল আই-এর একজন স্টাফ, যিনি কর্মচারী, তিনিও জুরি বোর্ডের মেম্বার। তো এই যে সিনেমার অবক্ষয়, মানুষের চাহিদা মেটাতে হয়নি; সিনেমার অবক্ষয়, রুচিহীনতা এখান থেকে হয়নি। এর অবক্ষয় হয়েছে সর্বোচ্চ মহল থেকে, মন্ত্রণালয়, সেন্সর বোর্ড থেকে। সেন্সর বোর্ড দুর্নীতি করে অশ্লীল ছবি প্রদর্শন করেছে। কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে গাড়ি-বাড়ি বানিয়েছে এই সেন্সর বোর্ডের মেম্বাররা। এদেশের প্রথিতযশা চলচ্চিত্রকাররা জুরি বোর্ডের মেম্বার ছিলেন। তার পরও অশ্লীল চলচ্চিত্র প্রদর্শন করার অনুমতি দিয়ে তারা এদেশের চলচ্চিত্রশিল্পকে শেষ করেছে। সেই যে ধারাবাহিকতা, এটা নির্মাতাদের দোষ নয়, প্রযোজকদের দোষ। প্রযোজকরা ঘুষ দিয়ে সিনেমায় অশ্লীল দৃশ্য লাগিয়েছে।

আমার ব্যক্তিগত কথা বলি। আমার পাঞ্জা নামক সিনেমায় একটি ধর্ষণের দৃশ্য ছিলো। আমি ওই ধর্ষণ দৃশ্যটি শুট করলাম, একটি বাঘ একটি হরিণকে ধাওয়া করছে¾এটা ন্যাশনাল জিওগ্রাফি থেকে নেওয়া। এক সময় হরিণটাকে খেয়ে ফেললো বাঘ। তারপর দেখা গেলো মেয়েটা পড়ে আছে। আমার প্রযোজক বললেন, হায়াৎ ভাই, এখনকার দিনে কি এসব চলে? আমি শুটিংয়ের ব্যবস্থা করছি, আপনি একটু কালকে শুট করে নিয়েন। আমি বললাম কী শুট? ওহাবের বাড়িতে একটা মেয়ে আর একটা ছেলে যাবে, ওরা নুড হয়েই শটটা দেবে, আপনার কিছু বলা লাগবে না, আপনি শুধু শুটটা করবেন। আমি তখন উঠে দাঁড়ালাম এবং বললাম, মো. শফিউদ্দিন, আজকের কাজী হায়াৎ একদিনে তৈরি হয়নি। তিলে তিলে তার মেধা দিয়ে তৈরি হয়েছে। তোমার ছবির জন্য কাজী হায়াতের মৃত্যু হতে পারে না। ইম্পসিবল, ফরগেট ইট এবং তুমি যদি আমার ছবিতে এমন দৃশ্য লাগাও তাহলে আমি কোর্টে কেস করবো, মামলা করবো।

পরবর্তী সময়ে আমি জানতে পারলাম, সেই ছবিতে এমন দৃশ্য সংযুক্ত করা হয়েছে। তখন আমি সমস্ত সমিতির লোকজনদের ডাকলাম। তাদেরকে বললাম, আমার অজানতে, অলক্ষ্যে এই দৃশ্যগুলো সংযোজিত হয়েছে। অনতিবিলম্বে তাহাকে এই দৃশ্য কর্তন করে ফেলে দিতে বলেন, না হলে আমি মামলার আশ্রয় নেবো। তারপর সে কর্তন করে ফেলে দিলো। দ্যাট ওয়াজ দ্য সিচুয়েশান অব আওয়ার ইন্ডাস্ট্রি ওয়ান ডে। সেই সময়ে মানে ৯৭-৯৮-এর সময় তো নির্মাতাদের কিছু করার ছিলো না। সেসময় প্রযোজক, অর্থ, পুঁজি, সেন্সর বোর্ড, দুর্নীতি সবমিলিয়ে আমাদের চলচ্চিত্রকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিলো। মধ্যবিত্ত সমাজকে লাথি মেরে সিনেমাহল থেকে ফেলে দেওয়া হয়েছিলো।

রাকিবুল হাসান, ম্যানেজমেন্ট স্টাডিজ : ডিজিটাল সময়ে প্রেমের সিনেমা ছাড়া অন্যান্য বিজ্ঞানমূলক সিনেমার ভবিষ্যৎ কেমন দেখছেন?

কাজী হায়াৎ : বিজ্ঞান, হয়ার? বিজ্ঞান মানে সায়েন্স ফিকশন যেটাকে বলে, তার দু-একটা ছবি হচ্ছে। আর এখন তো ডিজিটালি সব হয়। তবে প্রযুক্তিগতভাবে শুনলে অবাক হবেন। একটি তথ্য তোমাদের সবার জানা উচিত। বিশেষ করে গণমাধ্যমে যারা কাজ করছে। এখন অনেক ডিজিটাল ছবি হচ্ছে, ডিজিটাল ক্যামেরা এসেছে, ডিজিটাল ফেভরিক কাঠামো এসেছে, ডিজিটাল সিনেমাহল হয়েছে; কিন্তু একটি জিনিস এখনো বাংলাদেশে সিনেমা উপস্থাপনে আসে নাই। সেটা হলো কালার কারেকশন। এই বিদ্যাটার সঙ্গে ভালোভাবে পরিচিত কোনো বিদ্বান এখানে নেই, যে এই প্যানাল রাইজ করতে পারে। যে দু-একজন আছে তাদের হাতুড়ে মিস্ত্রি বলা যেতে পারে।

যার ফলে আমাদের মূল ছবিটি দেখতে ভালো হচ্ছে না। ভারতীয় ছবি, বোম্বের ছবি যেভাবে সুন্দর দেখা যাচ্ছে, আমাদের ছবি অতো সুন্দর দেখা যাচ্ছে না। আর কেউ কেউ ওই প্রযুক্তিটার জন্য চলে যাচ্ছে বাইরে, যারা কিছুটা নান্দনিক ছবি করেন। তাদের অর্থ কোন জায়গা থেকে আসে, কেউ জানে না। তবে তারা টাকা পায়। তারা স্পন্সর পায়, স্পন্সর পেয়ে তারা চলে যায় বোম্বে, দিল্লি।

তো বিজ্ঞানমূলক, বিক্ষণমূলক যে ছবি হবে, তার জন্য দরকার এডিটিং প্যানেল। কারণ, এসব সিনেমার বড়ো অংশ তৈরি হয় এডিটিং প্যানেলের জন্য। এখন এমন একটি ছবি তৈরি হয়েছে হলিউডে, শুনলে তোমরা অবাক হবে, অনেকে হয়তো শুনেছেনও, সেই নায়িকার পৃথিবীতে এখনো জন্মই হয়নি; অথচ সিনেমায় ছিলো। পূর্ণাঙ্গ দেহের একজন মানুষ হিসেবে সে একটি সিনেমায় কাজ করছে। অর্থাৎ, মানুষ ওই ডিজিটাল পদ্ধতিতে তাদের প্রয়োজনে মানুষও তৈরি করছে। তো সেই প্রযুক্তি বা সেই মেধা আমাদের কারো নেই। তার পরও আছে। এবার অস্কার পেলো যে ছেলেটি। সে ছেলেটা বাংলাদেশি। তো এই হলো অবস্থা।

খায়রুল ইসলাম, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ : সিনেমাহল তৈরিতে সরকারের পাশাপাশি সচেতন ও উৎসাহী ব্যক্তিরা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন?

কাজী হায়াৎ : একটি তথ্য আপনাদের জানাই, হয়তো কেউ কেউ জানেনও। সারাদেশে সরকারিভাবে কমপক্ষে ৪০ থেকে ৫০টি সিনেমাহল রয়েছে। এগুলো বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে ও বিনিয়োগ সেন্টারে। এই সিনেমাহলগুলোতে আপনি চাইলে সিনেপ্লেক্সের মতো করে ডিজিটালাইজড করতে পারেন। এগুলোকে আকর্ষণীয় ও সুন্দর করে যদি ডিজিটাল প্রক্ষেপণ যন্ত্র আনা যায়, তাহলে অন্তত ভালো সিনেমাহল হতে পারে। তবে সুন্দর প্রজেকশন ব্যবস্থাও প্রয়োজন।

মনে রাখতে হবে, এই সিনেমাহলগুলো মোস্ট প্রটেক্টেড। যেখানে মা-বোনেরা এবং একটা সাধারণ মানুষও নিরাপত্তা নিয়ে সিনেমা দেখতে যেতো। যেমন : জোনাকি সিনেমাহল; এটা কিন্তু বাইরের মালিকানায় না। এটি বিডি আর-এর একটি সিনেমাহল। ‘জোনাকি’ হলে পুলিশ মোতায়েন হয়। এছাড়া বিডি আর-এর মধ্যে একটা বিরাট সিনেমাহল রয়েছে। ক্যান্টনমেন্টেও নতুন চারটা সিনেমাহল রয়েছে। এখন এগুলোও যদি চালু থাকতো তাহলে সুন্দরভাবে ডিজিটাল সিনেমা চলতো। অথচ এগুলো প্রাইভেটভাবে ভাড়া দেওয়া, তারা প্রচুর ট্যাক্স নিচ্ছে পাবলিকের কাছ থেকে এবং পরিচালনা পরিষদের কাছ থেকে।

মো. গোলাম মোস্তফা, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ : আমরা দেখছি, ডিজিটাল চলচ্চিত্র অনেকটা নাটকের মতো হয়ে গেছে। এর কারণ কী? যদি এটি সমস্যা হয়, তাহলে কীভাবে কাটিয়ে ওঠা যায়?

কাজী হায়াৎ : সিনেমা, নাটক নিয়ে আমি তো কোনো কথা বলিনি। চলচ্চিত্র, চলচ্ছবি এখন কীভাবে এগুলোকে আলাদা করবে? তুমি কোনো কিছুকে নাটক হিসেবে নেবে, নাকি সিনেমা হিসেবে নেবে দ্যাট ইজ ইয়োর কনসার্ন। নির্মাতা কী হিসেবে বানাচ্ছে সেটা বিষয় না। আমি যেটা বানাই, এটাকে কেউ যদি সিনেমা না বলে, আমার বলার কিছুই নেই। এটি যদি সোপ সিনেমা বলে, তাহলেও কিছু বলার নেই। নাটককে কেউ যদি চলচ্চিত্র বলে, তাহলেও আমার বলার কিছু নেই। এ নিয়ে আমাকে কেউ গালি দিলেও আমার কিছু যায় আসে না।

কারণ, কোথাও সেমিনারে গেলে, আমার পরিচয় যখন আসে, তখন আমি উঠে দাঁড়িয়ে বলি, আমি কাজী হায়াৎ, ভারতীয় উপমহাদেশের একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা। অর্থাৎ আমি খুব গর্ব বোধ করি। ভারত এবং অন্যান্য জায়গায় নির্মিত ছবির মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। ভারতীয় উপমহাদেশে যে সিনেমা তা সারা পৃথিবীর থেকে আলাদা; নাচগান, অ্যাক্রোবেটিক মারামারি¾এটি সাধারণত বিশ্বের অন্যান্য চলচ্চিত্রের মতো না। আমার দেশে, এ উপমহাদেশে আলাদা ধরনের চলচ্চিত্র। নায়ক-নায়িকা হাত ধরলেই পার্কে গান, তারপর সুইডেন চলে গেলো, তারপর আমেরিকা, তারপর বোম্বে, তারপর বাংলাদেশ, কক্সবাজার হয়ে ফিরে আসলো ঢাকায়। (দর্শকদের হাসি) এটা হাসির বিষয় না, এটাকে এনজয় করো। দিস ইজ স্টাইল অব ইন্ডিয়া। ভারতীয় উপমহাদেশে একটি আলাদা সত্তা। এটি আমার সিনেমার কথা বলে। তাই কে কী বললো, তাতে কিছুই যায় আসে না। আই ফিল প্রাউড।

আমি একবার ফ্রান্স অ্যাম্বাসেডরকে বলেছিলাম, সে আমাকে একটা অনুষ্ঠানে দাওয়াত দিয়েছিলো। এসব নিয়ে কথা হচ্ছিলো। আমি বললাম, এই সিনেমা নিয়ে আই ফিল প্রাউড। আওয়ার সিনেমা ইজ আওয়ার প্রাউড। তার পর আলাদা বৈশিষ্ট্যের বিষয়গুলো তাকে গুছিয়ে বললাম। এরপর থেকে সে যতদিন বাংলাদেশে ছিলো যেকোনো অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকতো। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেলে বলতো, কাজী হায়াৎ, ইয়োর সিনেমা ইজ ইয়োর প্রাউড। তোমাদের সিনেমার আসলেই একটি স্বাতন্ত্র্য আছে। সো, আর কিছু বলার আছে?

নাটক, সিনেমা ছাড়াও চিত্রায়ণ হয়, সেটা তথ্য চিত্রায়ণ। সেটাও ঠিক সিনেমা হয়। পৃথিবী বিখ্যাত অনেক ছবি আছে এক মিনিটের। পৃথিবী বিখ্যাত একটি ছবি, নাম এখন বলতে পারছি না। তবে সেটি এক শটের। একজন ৮০ বছরের বুড়ি, একটি সুচ আর সুতা হাতে। সুচটার ফুটো দিয়ে সুতোটা দেওয়ার চেষ্টা করছে। বার বার ব্যর্থ হচ্ছে; বার বার ব্যর্থ হচ্ছে। সাডেনলি শি উইল সাকসেস। পৃথিবী বিখ্যাত ছবি। কে, কোথায়, কীভাবে, কোনটা নির্মাণ করবে বলা মুশকিল¾এটা মুক্তচিন্তা। সবার স্বাধীনতা আছে।

নিঝুম সরকার, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ : বাংলাদেশে যদি ভারতীয় চলচ্চিত্র দেখানো হয় বা যদি আমদানি করা হয়, তাহলে কী ধরনের প্রভাব পড়বে?

কাজী হায়াৎ : একটা জলোচ্ছ্বাস আসবে। সেই জলোচ্ছ্বাসে সব আগাছা ভেসে যাবে। জলোচ্ছ্বাসে কচু গাছ থাকে? কলা গাছ? ডালপালা ঝড়ে ভেঙ্গে যায় না? ছোটো ছোটো ডালপালা ভেঙে গেছে না? তালগাছটা ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে। একটা জলোচ্ছ্বাস হবে, কিন্তু তালগাছ দাঁড়িয়ে থাকবে। তারা আমার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির কোনো ক্ষতি করতে পারবে না (দর্শকদের হাততালি)। আমার সিনেমার তুলনা হবে তখন ভারতে। আমি চলে যাবো ভারতে; আমার সিনেমার সঙ্গে যখন ভারতের একজন নির্মাতার ছবি মার খাবে, তখন তার খবর পৌঁছে যাবে বোম্বে; কার ছবির সঙ্গে মার খেয়েছে? আরে কে ওই ডিরেক্টর, উসকা নাম বোলো ভাই। ভাই, উহাকা এক মশহুর ডিরেক্টর কাজী হায়াৎ, উসকা ফিল্ম; আদেশ দেতা হে, যা লাগাতে হে, ও দেখতা হে। ইয়ে কাজী হায়াৎ কোন হে ভাই? কিয়া ফিল্ম বানায় দেখাওতো, দেখলো, আরে উসকা বুলাও না, হাম বানায়গা ফিল্ম¾এইতো। জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যাবে আগাছা, যাক ভেসে। উন্মুক্ত হোক আমার চলচ্চিত্র। আমি এতে বাধা দেবো না।

আজমেরাতুন জিম্মি নিঝুম শাহ্, বাংলা বিভাগ : আপনি বললেন, বস্তির মানুষরাও মানুষ, তাদের কথা চিন্তা করে চলচ্চিত্র নির্মাণ হচ্ছে। কিন্তু যারা শিক্ষার্থী, অন্তত ন্যূনতম চিন্তাশক্তি রয়েছে, তারা যা ভাবছে তা চলচ্চিত্রে এতো কম আসছে কেনো?

কাজী হায়াৎ : তারা কী ভাবছে আমি জানি না। তবে আমি জানি, তাদের ভাবনা আর আমার ভাবনা একই। তারাও মাঝে মাঝে দেশকে নিয়ে ভাবে। তবে তারা সিনেমা দেখতে চায় না। তাদের একটা উন্নাসিকতা আছে। অনেক দিন আগে একজন ডিরেক্টর, নাম হয়তো শুনেছেন। তার একটি প্রেমের ছবি রিলিজ হয়েছিলো। ওই সিনেমার একটা বাংলা গান ছিলো, ফেরদৌস ওয়াহিদের ছেলে হাবিবের গাওয়া। যেটা আগেই মিডিয়াতে, মানে সিডিতে প্রকাশ পেয়েছিলো। কিন্তু পরে সেটা সিনেমায় লাগানো হয়। বসুন্ধরা শপিংমলের একটি অডিও সিডির দোকানে ওই ডিরেক্টর বসে আছে, একটি মেয়ে ওই গানটি খুঁজতে এসেছে। মেয়েটা দোকানিকে প্রশ্ন করেছে, এই গানটা কোন সিডিতে আছে? তখন ওই ডিরেক্টর বলেছে, এটা তো অমুক ছবির গান। তখন ওই মেয়েটি বলেছে, ও, এটা বাংলা সিনেমার গান! না, না, ওটা রেখে দেন।

বাংলা সিনেমা অচ্ছুত হয়ে গেছে। কীভাবে অচ্ছুত হয়ে গেছে, একটা ছোটো গল্প বলি। ভালো লাগবে। এই গল্পটি হয়তো শুনে থাকবেন ভিন্নভাবে। একজন ঠাকুর বন থেকে সাধনা করে ফিরছে। বেশ কিছুদিন সে জঙ্গলে ছিলো ঈশ্বরের সাধনা করেছে। সেখান থেকে সে একটি হরিণের বাচ্চা কাঁধে নিয়ে ফিরছে। পথিমধ্যে তিন বাটপার একত্রিত হয়ে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছে, আরে ঠাকুরের কাঁধে হরিণের বাচ্চা, এটা তো নিতে হয়। পথে তারা তিন জন লাইন হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। প্রথম জন দেখেই বললো, কাকা, এ কুকুরের বাচ্চা কোথা থেকে আনলেন? ঠাকুর হয়ে কাঁধে কুকুরের বাচ্চা নিচ্ছেন? এটা কি শোভা পায়? ঠাকুর বলেন, এই তুমি এসব কী বলো? এটা হরিণের বাচ্চা, সাধনা করেছি, ঈশ্বর আমাকে দিয়েছেন। বন থেকে এনেছি। বাটপার বলে, কাকা ভুল করছেন, এটা কুকুরের বাচ্চা। এবার দ্বিতীয় বাটপারের সঙ্গে দেখা। সে বলে, নমস্কার কাকা। কুকুরের বাচ্চা নিয়ে যাচ্ছেন কাঁধে? কাকিমা দেখলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। ঠাকুর বলেন, মানে কী, কুকুরের বাচ্চা কোথায় পেলে? বাটপার বলে, আরে আপনার কাঁধে তো কুকুরের বাচ্চা। ঠাকুর বলেন, কী বলো তুমি? আমি এটা বন থেকে এনেছি; ঈশ্বর আমাকে দিয়েছেন। বাটপার বলে, না না কাকা, চোখে আপনি কম দেখেন তো, কুকুরের বাচ্চা হরিণের বাচ্চা মনে করে নিয়ে এসেছেন।

এবার তৃতীয় বাটপারের সঙ্গে দেখা। সে বলে, কাকা কুকুরের বাচ্চা কোথা থেকে নিয়ে এলেন? ঠাকুর বলেন, আরে কী বলে সবাই, এটা নাকি কুকুরের বাচ্চা! দেখো, আমি ওখানে সাধনা করেছি; ঈশ্বর আমার কোলে হরিণের বাচ্চাটা দিয়েছেন। বাটপার বলে, কাকা আপনি তো জানেন না। হরিণের বাচ্চা জন্মের মাত্র দুই ঘণ্টা পরে দৌড়াতে পারে, বাঘও ধরতে পারে না। হরিণের বাচ্চা কী মানুষের কাছে এসে ধরা দেয় কাকা? আপনি কী নিয়ে যাচ্ছেন? আপনি ভুল করছেন কাকা। কাকিমা দেখুক। ঠাকুর তখন ভাবলো, ঘটনা কী? তিন জন বলছে, তাহলে কি ভুল দেখছি? চোখে কম দেখি? তাহলে ফেলেই দেই, অযথা কোথা থেকে কুকুরের বাচ্চা টেনে নিয়ে যাচ্ছি। তারপর ঠাকুর তা ফেলে দিলো।

বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রে এমন ঘটেছে। এই হরিণের বাচ্চাকে কিছু লোক কুকুরের বাচ্চা আজ থেকে বলা শুরু করেনি। সেই মাহাবুবা চৌধুরী; যিনি সুচিত্রার সাংবাদিক ছিলেন। কোনো সিনেমা তার কাছে ভালো লাগতো না। সব সিনেমার সমালোচনা করতেন, বিরূপ সমালোচনা। লাস্টে লিখতেন¾ছি! ছি! এগুলো দেখা উচিত না। এগুলো বন্ধ করে দেওয়া উচিত। এগুলো সেন্সর করা উচিত। সেই যে শিক্ষিত সমাজে একটা অনীহা, অচ্ছুত করে দেওয়া হলো বাংলা সিনেমাকে। এছাড়া আমাদের দেশের কিছু বুদ্ধিজীবী বাংলা সিনেমাকে বিভিন্ন সেমিনারে এমনভাবে বিধৃত করেছে, অচ্ছুত করে দিয়েছে, ফলে সিনেমা সাধারণ দর্শক থেকে দূরে চলে গেছে। ভালো সিনেমা হওয়া সত্ত্বেও দর্শক আর সেটা দেখছে না।

কীভাবে ভালো সিনেমা হবে? ভালো সিনেমা বলতে কী বোঝায়? ভালো সিনেমার মধ্যে কী আছে? তার চেয়ে আপনি আমাদের স্বতন্ত্র সিনেমা নির্মাণের আঙ্গিককে মনে মনে স্বীকার করে নেন ভালো লাগবে। তাহলে সিনেমা দেখতে ভালো লাগবে। তারপর সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখবেন, সমালোচনা করবেন। এটা হয়তো ঠিক, সিনেমা খারাপ হচ্ছে। আপনারা যদি সিনেমাহলে যান, তাহলে সিনেমা খারাপ হবে না।

আল নুরাইন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ : একা একা চলচ্চিত্র দেখলেই তা ধ্বংসের মুখে পৌঁছাবে¾এমনটা আপনি কেনো মনে করেন? মানুষ তো বইও একা একাই পড়ে, তাই না?

কাজী হায়াৎ : হ্যাঁ, আমি সিনেমা ধ্বংসের কথা বলছি না। সিনেমা শিল্প ধ্বংসের কথা বলছি। শিল্প মানে ইন্ডাস্ট্রি; যে ইন্ডাস্ট্রিতে ১২শো সিনেমাহল ছিলো। যে ইন্ডাস্ট্রিতে ৮০ থেকে ৯০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হতো। সেই ইন্ডাস্ট্রির কথা বলছি। এখনো যেখানে ৫০ থেকে ৬০ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হচ্ছে। সেই ইন্ডাস্ট্রির কথা বলছি। সিনেমা ধ্বংস হবে কেনো? সিনেমা অবশ্যই ধ্বংস হবে না। কখনোই না। সিনেমা নির্মাণ হবে, সবাই দেখবে। আমি আপনাদের একটা তথ্য দেই, বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় ১৭ কোটি মানুষের মধ্যে পাঁচ থেকে ছয় কোটি লোক সিনেমা দেখে। আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হলো, এর মধ্যে দুই থেকে আড়াই লক্ষ লোক সিনেমাহলে গিয়ে সিনেমা দেখে (দর্শকের হাততালি)। তাহলে সিনেমা তো দেখছেই। তবে আমার ইন্ডাস্ট্রি, সিনেমাহলগুলো ধ্বংস হচ্ছে।

তানজিনা রহমান, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ : তরুণ নির্মাতাদের ওপর চলচ্চিত্র নিয়ে আপনার ভরসা কতোটুকু?

কাজী হায়াৎ : অনেক ভরসা। আসলেই অনেক ভরসা। এরাই হয়তো হাল ধরবে। কিন্তু একটু কষ্ট হয়। তারা প্রথমে ঢুকেই সত্যজিৎ রায় হওয়ার চিন্তা করে। কেউ কাজী জহির হওয়ার চিন্তা করে না। কেউ জহির রায়হান হওয়ার চিন্তা করে না। কেউ কাজী হায়াৎ হওয়ার কথা চিন্তা করে না। আমি সত্যজিৎ রায় হবো, পৃথিবীর বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার হবো। হ্যাঁ, ভালো। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের ছবির বাণিজ্য না হলে সত্যজিৎ রায়ও হতো না। সত্যজিৎ রায়ও ব্যবসাসফল ছবি বানিয়েছিলেন। সত্যজিৎ রায়ের একটি দারুণ ব্যবসাসফল ছবি হলো, সেটা দারুণ সুপার সুপারহিট মুভি, হীরক রাজার দেশে

ব্যবসার সঙ্গে সিনেমার সম্পর্ক রয়েছে। ব্যবসা মাইনাস করে সিনেমা বানিয়ে খ্যাতি পেয়ে কতোটুকু কি করা যাবে জানি না; তবে আমি যেটা জানি সেটা হলো, আমার জীবনে পাঁচটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে গিয়েছি। পাঁচটি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের মধ্যে দুটিতে পুরস্কৃত হয়েছি (দর্শকের হাততালি)। বাকি তিনটিতে আমার ছবি প্রদর্শিত হয়েছে। দুঃখের বিষয় হলো, এর পরবর্তী সময়ে আমাকে অনেকে ডেকেছে, আমি যাই নাই। কেনো? বাইরে আমার সিনেমা দেখতে একটা লোকও আসে না। এখন যারা বিভিন্ন ফেস্টিভালে যায়, পুরস্কার নিয়ে আসে; আপনারা তাদের বলবেন, তোমার ছবি যখন প্রদর্শিত হয় তখন হলে লোক সংখ্যা কতো ছিলো?

খুবই ভয়াবহ অবস্থা! আমেরিকায় আমার ছবি ইতিহাস-এর বাণিজ্যিকভাবে একটি শো করতে চেয়েছিলাম, করেওছিলাম। মাত্র চার জন দর্শক ছিলো বাঙালি। বড়ো পেপারে বড়ো করে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে বলেছিলাম। ভেবেছিলাম হলভর্তি লোক হবে। না, আসেনি। ওদের অনেক কাজ। দিনটি শনিবার রেখেছিলাম। শনিবার ছুটির দিন। অনেক কাজ। বাঙালিরাও ওখানে চাকর। তারা সবাই চাকর। তারা সবাই কাজের লোক, ঘরদোর গোছাতে হয়। তাদের সিনেমা দেখার সময় নেই। ঘরে বসে ডিভিডিতে তারা সিনেমা দেখে। যাক অনেক কথা বললাম।

হাবিব, ফাইনান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগ : আমাদের দেশের তৈরি অধিকাংশ সিনেমার কাহিনি বিদেশি ভাষার, বিশেষ করে তামিল বা হিন্দি সিনেমা থেকে সরাসরি বা আংশিক কপি করা। কবে আমরা এ থেকে মুক্তি পাবো?

কাজী হায়াৎ : আমি জানি না। কারণ, আমি করি না। আমি মনে করি সবকিছুতে স্বাধীনতা আছে। প্রত্যেকেরই স্বাধীনতা আছে। কে, কোথায়, কী, কোন ভাষায়, কোন কাহিনি নিয়ে সিনেমা বানাবে, সে স্বাধীনতা তার। তার পাস-ফেল ঠিক করবে সেন্সর বোর্ড। ধন্যবাদ।

দীপ্ত উদাস, বাংলা বিভাগ : হলে সিনেমা দেখার লোক হচ্ছে না। এর জন্য চলচ্চিত্রনির্মাতারা কতোটা দায়ী?

কাজী হায়াৎ : হ্যাঁ! দায়ভার আমাদের যতটুকু আছে, দর্শকেরও তার চেয়ে কম না। বলতে পারো, আপনারা মানসম্মত চলচ্চিত্র নির্মাণ করছেন না। আমি একটা কথা বলি, একজন মন্ত্রী আমার বাসায় গেলেন। আমি তাকে যেভাবে আপ্যায়ন করবো, তার ড্রাইভার গেলে কি সেভাবে আপ্যায়ন করবো? কেউ করবে না। যেভাবে সিনেমাহলে এখন দর্শক আছে, তাদের আপ্যায়নের জন্যই নির্মাতারা এখন ব্যস্ত। তাদের আপ্যায়ন করার জন্য সিনেমাহলওয়ালারাও ব্যস্ত। যারা উপস্থিত আছেন আর কি। আপনি গেলে, আপনি উপস্থিত হলে আপনাকে আপ্যায়ন করবো আমরা। আপনি যাতে বিনোদন পাবেন, সেই ব্যবস্থা করা হবে।

আমি তখন দেখবো ভালো ভালো দর্শক উপস্থিত হচ্ছে। ঠিক আছে, এদের আপ্যায়ন করাতে হবে। সিনেমাহলেও ১০ বার স্প্রে করতে হবে। আমার দাঙ্গা ছবির সময় চারÑপাঁচ জন হলমালিক এসে খুব কমপ্লেইন করলো। ভাই আপনার ছবি চালাইতে গিয়ে তো খুব বিপদে পড়ছি। কী বিপদ? ডি সি আসে, এস পি ফোন করে। ওই ম্যাজিস্ট্রেট ফোন করে, তাদের জন্য সিনেমাহল খালি রাখতে হয়। তাদের জন্য স্প্রে মারতে হয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হয়। এখন অতিথি যে ধরনের, আপ্যায়ন তো সে ধরনেরই হবে। আপনি সিনেমাহলে গেলে আমি তো সে ধরনের আপ্যায়ন করবো। সিনেমাহল মালিকও সে কথাই বলে। আপনি ১০ দিন হলে গেলে দেখবেন, ঠিকই স্প্রে মারছে। এখন হলমালিক স্প্রে কিনে এনেছে, সুন্দর ঘ্রাণের স্প্রে; ন্যাপথালিন কিনে রেখেছে বাথরুমে। আপনি যাচ্ছেন না, তাই দেখছেন না।

রফিক সানি, বাংলা বিভাগ : কোনো উল্লেখযোগ্য সিনেমার নাম শোনামাত্রই আমরা ইন্টারনেটের মাধ্যমে সেটা দেখে নিতে পারছি। সেটা আমাদের অনেক শিক্ষাও দিচ্ছে। ব্যাপারটা আপনি কীভাবে দেখবেন?

কাজী হায়াৎ : এই যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে আমার সিনেমা দেখছেন¾এটাই তো ক্রাইম করছেন। আপনি সিনেমা দেখছেন, আমি টাকা পাচ্ছি না। এই ডিজিটাল প্রযুক্তি আমার ইন্ডাস্ট্রিকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। হ্যাঁ, এখন সিনেমাহলে সিনেমা দেখতে পাবেন ডিজিটালে, কিন্তু আমার সিনেমা দেখতে পাবেন না। কারণ পাঁচশো টাকা খরচ করে মোবাইলফোনে আমাদের সোহেল রানার ছেলে ছবি বানিয়েছে, সেটা ইন্টারনেট খুললে দেখতে পাবেন, সেটা আপনাদের ভালো লাগবে কি লাগবে না, আপনারা ভালো জানেন। তো এইভাবেই চলছে; হয়তো কেউ একসময় ভালোলাগার সিনেমা তৈরি করে ফেলবে।

মো. আলী হুসাইন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ : চলচ্চিত্র সম্পর্কে খুব ভালো বুঝি না। ডিজিটাল চলচ্চিত্র বলতে এখন আমরা অনেকেই বুঝি ঝকঝকে চলচ্চিত্র। সেক্ষেত্রে অনন্ত জলিলের চলচ্চিত্র তথাকথিত ডিজিটাল চলচ্চিত্র। তার বেশকিছু চলচ্চিত্র আমি দেখেছি। তার চলচ্চিত্র সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাচ্ছিলাম।

কাজী হায়াৎ : অনন্ত জলিল ইজ অ্যা স্টার। এ কথা আমাদের স্বীকার করে নিতে হবে। তার অনেক দর্শক আছে। সে বিতর্কিত হোক, তবুও তাকে পছন্দ করে। তাকে নিয়ে অনেকে হাসিঠাট্টা করে। দ্যাটস সিম্পল। তবুও তার ছবি দেখতে যায়। দেখতে যায় এই কারণে যে, অনেক কিছু থাকে দেখার মতো। লুক ভালো, অর্থাৎ দেখতে ভালো। লাফ দিয়ে আকাশ থেকে পড়ছে। উড়ে গিয়ে লাথি মারছে। টেকনিকালি খুব হিট। সে একটি ছবিতে খরচ করে আট থেকে ১০ কোটি টাকা। ব্যবসা হয় ৬০ থেকে ৭০ লক্ষ টাকা। সবটাই লোকসান। তবুও তার আগ্রহ। লোকে তো দেখছে। ফেইসবুকে তো সাড়া পেয়েছি। এটিই তার আগ্রহ। তার অনেক টাকা। সে অনেক টাকার মালিক। সে প্রতি মাসে দানখয়রাতই করে কমপক্ষে এক কোটি, দেড় কোটি টাকার মতো। তাকে আল্লাহ টাকা দিয়েছে, আপনি কী করবেন? সে খরচ করেছে, তার টাকা আছে (দর্শকের হাততালি)।

তার জনপ্রিয়তা আছে, অনন্ত জলিল এখানে আসলে অনেক লোকের ভিড় হতো। সে এটা করার জন্যই খরচ করছে। কিছু করার নেই। যাই হোক, তার ভালো লাগছে। সে বোম্বে থেকে ক্যামেরাম্যান আনছে ৫০ লক্ষ টাকা দিয়ে। ব্যাংকক চলে যাচ্ছে নানান কারেকশন করতে। একটা মারামারির দৃশ্য করতে ব্যাংকক চলে যাচ্ছে। কোথায় না যাচ্ছে? একটি সিনেমা বানাতে ১০ থেকে ১৫ কোটি, ২০ কোটি টাকাও খরচ করছে। তাতে তার কিছু এসে যায় না। কিছু করার নেই। এটিই হলো অনন্ত জলিল।

শরীফুল হক পিয়াস, অর্থনীতি বিভাগ : আপনি আলোচনার কোথাও ডিজিটাল চলচ্চিত্রের মান সম্পর্কে কিছু বলেননি। ডিজিটাল চলচ্চিত্র যদি ভালো হয়, তাহলে কি তা দর্শককে প্রেক্ষাগৃহে আকর্ষণ করতে পারবে না? আমি মনে করি, শুধু মানসম্মত সিনেমার কারণে হল চলছে না।

কাজী হায়াৎ : মান তো আমি নিজে নির্ধারণ করতে পারবো না। এটা সামগ্রিকভাবে নির্ধারণ করতে হয়। মান বলতে আপনি ঠিক কী বোঝেন আমি জানি না। মান কি গল্পে, মান কি অভিনয়ে, মান কি নান্দনিকতায়, মান কি নির্মাণশৈলীতে, মান কি আধুনিক প্রযুক্তিতে? অনেক দূর থেকে মারছে, চার থেকে পাঁচটা ওয়াল ভেঙে বেরিয়ে যাচ্ছে, এটাই কি মান? কোনটা মান নির্ধারণ করছে, জানি না। আমি বলবো সবগুলো বিনির্মাণ। এতো মান রক্ষা করে আমাদের শ্রেণি তো ক্যাপিটালে নিয়ে যাচ্ছে। মাননির্ভর চলচ্চিত্র একেবারে অসম্ভব। এটা অনন্ত জলিলের কাছে আশা করবেন। কারণ তার টাকার কোনো চিন্তা নেই। সে ১০-১৫ কোটি টাকা খরচ করে একটি সিনেমায়।

শিহাব কায়সার প্রীতম, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ : আপনি বললেন, চলচ্চিত্র ডিজিটাল হওয়ার পর থেকে আমাদের ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ডিজিটাল চলচ্চিত্র চালু হওয়ার আগে থেকেই তো মানুষ হল-বিমুখ হয়েছে। আসলে ইন্ডাস্ট্রির দুর্দশার কারণ কি চলচ্চিত্রের ডিজিটাল ফরমেট? নাকি আমাদের চলচ্চিত্রের দুর্বল গল্প, দুর্বল নির্মাণ, একঘেয়ে গল্পকাঠামো, নতুনত্বের অভাব?

কাজী হায়াৎ : নতুনত্বের অভাব, গল্পের ফরমেট¾অভিযোগগুলো চলচ্চিত্রের ওপর সবকালেই ছিলো। আমি যেদিন থেকে এসেছি চলচ্চিত্রে, আজ থেকে ৪০ বছর আগে, তখনো এই অভিযোগগুলো ছিলো। আমি কলকাতার একটি ফিল্ম ফেস্টিভালে গিয়েছিলাম। আমাদের দেশের কয়েকটি চলচ্চিত্র ছিলো সেখানে, রাজ্জাক ছিলেন। তো একটি সমালোচনা ইংরেজিতে পড়েছিলাম। কলকাতার একটি পত্রিকায় একটি লেখা বেরিয়েছিলো। সেখানে চলচ্চিত্র সম্পর্কে অনেককিছু বলা হয়েছিলো¾অধিকাংশ ছবির নায়ক একটি বেঁটে-খাটো ছেলে, নাকের চামড়া ওঠা একটি লোক, অর্থাৎ রাজ্জাককে কোট করে। সেই সেকেলে অভিনয়, সেই আগের যুগের যাত্রার ঢঙে অভিনয়, এগুলো বাজে গল্প, বাজে চলচ্চিত্র। সবমিলিয়ে ছবিগুলো শুট করা হয়েছে কেবল স্টুডিওতে। অর্থাৎ, এগুলো স্টুডিওর গল্প।

এটি তো তখন থেকেই, যেটিকে আমরা স্বর্ণযুগ বলি। সেই স্বর্ণযুগের সিনেমাতেও তাদের চোখে কলঙ্ক ছিলো। আসলে হয়েছে কি, সকালে বলছিলাম, একজন সেলিব্রেটিকে অনেক সময় অনেক কথা শুনতে হয়। দিলীপ কুমার আমাদের দেশে এসেছিলেন, তো ভারত থেকে দিলিপ কুমার এসেছেন দেখতে যাবো। নায়ক ওয়াসিম বললেন, তিনি যাবেন না। তার কথা, আরে রাখেন দিলিপ কুমার! দিলিপ কুমারের থেকে আমি কম নাকি? এটি তার একটি আদর্শ। হি ইজ নট লেসদেন। তার সবই আছে, কমনসেন্স নেই।

আমি মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভালে গিয়েছিলাম। অপর্ণা সেনও যাচ্ছিলেন। আমি আমার বন্ধু ফারুককে বললাম, দোস্ত অপর্ণা সেন এসেছে, চল কথা বলে আসি। আরে রাখ তোর অপর্ণা, ও তোকে চিনবে? আমি বললাম, আরে না চিনলে না চিনুক। ও বললো, আরে রাখ, যাইতে হবে না। একদিন শুনলাম, বুলেটিন, স্পেশাল বুলেটিন, মস্কোতে ‘মিঠুন’স কামিং টুমরো’। অর্থাৎ, হি ইজ সুপারস্টার, আমাদের বাংলাদেশের মানুষ। আমি বললাম, মিঠুন পরের দিন আসছে। ওকে বললাম, দোস্ত, মিঠুন আসছে। ও বললো, আরে গাধা, মিঠুন আসছে মানে? আমরা এখানে মিঠুনের জন্য আসছি নাকি?

অনেকে সেলিব্রেটিদের আঘাত করে, ছোটো করে নিজে একটা আত্মতৃপ্তি লাভ করে। বাংলা সিনেমাকে গালি দিয়ে অনেকের অনেক আত্মতৃপ্তি আছে। বাংলা সিনেমা! পশ্চিম বাংলার সিনেমার চেয়ে এককালে আমাদের সিনেমা অনেক উন্নত ছিলো। বাংলাদেশের গল্প নিয়ে পশ্চিম বাংলায় সিনেমা হতো, আমাদেরকে কপিরাইটের টাকা দিয়ে। তারা সাত ভাই চম্পা, খান আতার কাছ থেকে দুই লক্ষ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে ছবি বানিয়েছে। আমাদের সিনেমা দুর্বল না, আপনারা দুর্বল করে ফেলেছেন। ওই যে হরিণকে যেভাবে বলেছেন কুকুরের বাচ্চা। বলতে বলতে কুকুরের বাচ্চাই হয়ে গেলো।

মো. নাসিমুজ্জামান সরকার, বাংলা বিভাগ : কোনো ব্যক্তির সিনেমা তৈরির প্রবল ইচ্ছা। তার সিনেমা দেখার সুযোগ আছে, সিনেমা বিষয়ে পুস্তক পড়ার সুযোগ আছে, কিন্তু পর্যাপ্ত পুঁজি নেই। তার কী করা উচিত?

কাজী হায়াৎ : তার একটি সুন্দর মোবাইলফোন কিনে চিত্র ধারণ করা উচিত। কিছুদিন আগে দেখেছিলাম, ৬০ হাজার টাকা দামের মোবাইলফোনে ফোর-কে রেজ্যুলেশনের ক্যামেরা আছে। সেই ক্যামেরা দিয়ে সে চিত্র ধারণ করতে পারবে। বোধ হয় স্যামসাংয়ের ফোনটা। সে ওই একটা মোবাইল কিনে, সেই ক্যামেরা দিয়ে ইচ্ছামতো পাত্র-পাত্রী নিয়ে সিনেমা তৈরি করবে; পুঁজি লাগবে না। পরে কয়েকজন বন্ধু চাঁদা দিয়ে এক লক্ষ টাকা তুলে ছবি নির্মাণ করবে।

পলাশ, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ : আপনার সিনেমা তৈরির অনুপ্রেরণা কী ছিলো? আমরা যারা নতুন, সিনেমা বানাতে চাই, তারা কী করবো?

কাজী হায়াৎ : আমি নিজের অজান্তেই প্রথম সিনেমা তৈরিতে অনুপ্রাণিত হই। তখন সিনেমার একটা জৌলুস ছিলো, সেই জৌলুসের প্রতি একটা প্রচণ্ড দুর্বলতা ছিলো। আজো বোধ হয়, সেই জৌলুস সিনেমা হারায়নি। শাকিব খানকে দেখলে, অনন্ত জলিলকে দেখলে, আমাকে দেখলে যখন ভিড় হয়, তখন আমি নিশ্চয়ই বলবো সিনেমা জৌলুস হারায়নি। এটাই তো একটা বিরাট অনুপ্রেরণা। সিনেমার জৌলুস এখনো আছে। সিনেমা স্টার বানাতে পারে। এক রাতে একটা মানুষ স্টার হয়ে যেতে পারে। ডিপজল তার দৃষ্টান্ত। একটা টেরর, একটা রংবাজ ইন ওয়ান ফিল্ম, তেজী আমার ছবি, এক রাতে সে স্টার হয়ে গেলো। সারা বাংলাদেশের মানুষ ডিপজলকে চিনলো। পরবর্তী সময়ে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। একশোটা ছবি করেছে তিন লক্ষ টাকা করে। টাকা নিয়ে মানুষ বসে থাকতো। এটিই তো সিনেমার জৌলুস।

যারা নতুন সিনেমা বানাবে, তার জন্য মেধা, পরিকল্পনা লাগবে। আমি তো আর বলে দিতে পারবো না কতো সময়ের সিনেমা হবে। কারণ কবিতা এক লাইনের হতে পারে, ১০ লাইনেরও হতে পারে। আবার কবিতা নিয়ে বিরাট বইও হতে পারে। কী সিনেমা বানাবেন? শর্ট ফিল্ম, লঙ ফিল্ম¾কী ফিল্ম বানাবেন আপনি? তবে আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, সিনেমা তৈরিতে মেধা লাগে। হিন্দিতে বলতে হয়, ইয়ে আপনা দেমাগকি খেল। নিজস্ব মেধা দিয়ে খেলা। এটাই বলবো, আর কিছু না।

ফারুক ইমন, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা : আমি যদি অভিযোগ করি, আপনার সিনেমা দেখে সন্ত্রাস কমার পরিবর্তে সন্ত্রাস বেড়েছে। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আপনার বক্তব্য কী?

কাজী হায়াৎ : হতে পারে, তবে আমি সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করিনি। সন্ত্রাসকে নিরুৎসাহিত করেছি। সন্ত্রাসকে শাস্তি দিয়েছি। আমার প্রত্যেকটি ছবিতে এবং শুধু আমার নয়, মূলধারার প্রত্যেকটি ছবি টিকে থাকে কিছু নীতিকথা, একটি গল্প, বড়োলোক-ছোটোলোকের দ্বন্দ্ব অথবা এক পক্ষ আরেক পক্ষের দ্বন্দ্ব এগুলো দিয়ে। আমি বলবো কোনো চলচ্চিত্র সন্ত্রাসকে উৎসাহিত করে না। মন্দকে উপস্থাপন করা হয় তাকে শাস্তি দেওয়ার জন্য। মানে মন্দ করলে তার শাস্তি এটা। এখন এটা দেখে কেউ যদি মন্দ করে, তাহলে আমার তো কিছু করার নেই। সে শাস্তি পাচ্ছে নিশ্চয়ই। সমাজে কোনো অন্যায়কারী কি শাস্তি না পেয়ে থাকে? সমাজকে তার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।

আরিফ মাহমুদ, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ : স্যার, আপনার জন্মস্থান কোথায়? এবং আপনি আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রমত্তা পদ্মা নদী প্রভৃতি নিয়ে সিনেমা তৈরি করবেন কি?

কাজী হায়াৎ : জীবনে আর কী করতে পারবো, আমি জানি না। তবে এটা সুস্পষ্ট, বিদায় বন্ধু বিদায়। অনেক হলো, বয়স ৬৭ বছর। এবার অপেক্ষার পালা, কিডনির অবস্থা ভালো নয়, উচ্চ রক্তচাপ। দেখে যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো অনেক কিছু। যাওয়ার ইচ্ছা ছিলো পদ্মা সেতুর উপর দিয়ে। পারবো কিনা, জানি না। প্রচণ্ড ইচ্ছা। পদ্মা নিয়ে সিনেমা¾এটা অনেকেই করেছে। যাই হোক, আজকেও সকালে এখানে ছেলেদের বলেছিলাম, অনেক কিছুই করার ইচ্ছা আছে। হবে, যদি সময় পাই। বিদায় বন্ধু, বিদায়। আজই চলে যাবো এই শহর ছেড়ে। অনেক কিছু বললাম। কেউ কষ্ট পেয়ে থাকলে আমাকে ক্ষমা করে দেবেন। ধন্যবাদ। অনেক কিছুই দেখলাম, অনেক অভিজ্ঞতা হলো। আপনারা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন, আমি আপনাদের কাছে চির কৃতজ্ঞ। ঈশ্বর আমাকে অনেক কিছু দিয়েছেন; প্রাপ্তি অনেক। আমার না পাওয়ার জায়গাটি খুবই ছোটো। আপনাদের সবাইকে ধন্যবাদ (দর্শকের হাততালি)।

কাজী মামুন হায়দার : একটু বসেন। আসলে একটু দুঃখ প্রকাশ করে নিচ্ছি, সময় স্বল্পতার কারণে সবার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারলাম না। তার পরও আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে করা সবগুলো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। এ আলোচনাটি ট্রান্সক্রিপ্ট করা হবে এবং আমাদের সামনের সংখ্যায় ছাপানো হবে। এটা অলরেডি প্রায় আড়াই ঘণ্টার মতো হয়ে গেছে। আমি আবারও সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি যে, আমরা চেষ্টা করেছি, বিষয় রিলেটেড সব প্রশ্ন কাজী হায়াতের সামনে উপস্থাপনের। আপনারা বিষয়টি হয়তো বুঝতে পেরেছেন। আমাদের সামনে শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা উপস্থিত রয়েছেন। আমরা আসলে তাদেরকে কথা বলতে দিতে পারলাম না। তারা কথা বললে আরো ভালো লাগতো। কিন্তু সেটা আর পারছি না। যাই হোক, সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আর কাজী হায়াতকেও অনেক ধন্যবাদ। এতো ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি আমাদের এখানে এসে সময় দিয়েছেন। ম্যাজিক লণ্ঠন-এর পক্ষ থেকে তাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি (দর্শকের হাততালি)।

দায়স্বীকার : দীর্ঘ এই কথামালাটি রেকর্ডিং থেকে প্রতিলিপি করেছেন মোহাম্মদ আলী মানিক, প্রদীপ দাস, মাহামুদ সেতু, তাওছিয়া তাজমিম ও ইব্রাহীম খলিল। আর লেখাটি তৈরিতে সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেছেন মোহাম্মদ আলী মানিক।

 


বি. দ্র. প্রবন্ধটি ২০১৫ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত ম্যাজিক লণ্ঠনের ৯ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ হয়।


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন