Magic Lanthon

               

আবু সাইয়ীদ

প্রকাশিত ১৭ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

‘চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয়তায় নির্মাতার দায়’

আবু সাইয়ীদ


ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-২

স্থান                            : ১২৩, রবীন্দ্র কলাভবন

                                   রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

সময়                           : ৫ ডিসেম্বর ২০১২

                                   বিকেল চারটা

 

সঞ্চালক-১ : সম্মাননীয় উপস্থিতি, অনুগ্রহ করে আপনাদের ফোনগুলো সাইলেন্ট করুন।

সঞ্চালক-২ :দূরে বহুদূরে/স্বপ্নলোকে উজ্জয়িনীপুরে কবির মতো আমরা স্বপ্নলোকে নয়, যেতে চাই বাস্তবতার পিঠে চড়ে। এ-স্বপ্নটাকেই সঙ্গে করে আমাদের যাত্রার শুরু।

সঞ্চালক-১ : আজ ৫ ডিসেম্বর ২০১২, ২১ অগ্রহায়ণ ১৪১৯। অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় আমি রায়হানুল রানা।

সঞ্চালক-২ : আমি হালিমা খুশি। সম্মাননীয় উপস্থিতি, আপনারা হয়তো বলবেন-এতো বিষয় থাকতে চলচ্চিত্র বিষয়ক জার্নাল হিসেবে ম্যাজিক লণ্ঠন কেনো? আমাদের লক্ষ্য-চলচ্চিত্রের ভালো দর্শক ও ভালো লেখক তৈরি করা। আর চলচ্চিত্র মানে তো শুধু কিছু মানুষের করে যাওয়া অভিনয় নয়; এর সঙ্গে মিশে আছে পুরো সমাজ ব্যবস্থার চিত্র। তবে, এখানে টেলিভিশন, রেডিও এবং নিউ-মিডিয়ার বিভিন্ন বিষয় নিয়েও আলোচনা করা হয়। জার্নালটি ষাণ্মাসিকভাবে প্রকাশ হয়।

সঞ্চালক-১ : জার্নালটিকে আমার বা আমাদের করে না রেখে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি আগ্রহী শিক্ষক ও সাবেক শিক্ষার্থীরাও রয়েছেন।

সঞ্চালক-২ : জার্নালটিকে মধ্যমণি করে আমরা করে থাকি নানা কর্মকাণ্ড। যার অংশ হিসেবে রয়েছে পাঠচক্র, সেমিনার এবং নিয়মিত চলচ্চিত্র প্রদর্শনী। আমরা স্বপ্ন দেখি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমা নির্মাণের; এরই অংশ হিসেবে স্বপ্নযাত্রার এ-পথে আমাদের ইচ্ছে ছিলো চলচ্চিত্র সম্পর্কিত কোনো বিশিষ্ট ব্যক্তির অভিজ্ঞতাপূর্ণ কথা শোনার। আর সে-থেকেই আজকের এই আয়োজন।

সঞ্চালক-১ : সম্মাননীয় উপস্থিতি। ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-২ এর কথা-উপস্থাপনার বিষয়-চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয়তায় নির্মাতার দায়। কথা উপস্থাপন করবেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা আবু সাইয়ীদ।

সঞ্চালক-২ : এবারে আমি সম্মাননীয় অতিথিকে মঞ্চে আসন গ্রহণ করবার জন্য অনুরোধ করছি। (অতিথির আসন গ্রহণ এবং দর্শকদের হাততালি) ধন্যবাদ সম্মাননীয় অতিথি। সম্মাননীয় অতিথিকে ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-২ শুভেচ্ছা-স্মারক দিয়ে বরণ করে নেবেন ম্যাজিক লণ্ঠন-এর সম্পাদক কাজী মামুন হায়দার রানা। জনাব কাজী মামুন হায়দার রানাকে শুভেচ্ছা-স্মারকটি দিয়ে সম্মাননীয় অতিথিকে বরণ করে নেবার জন্য অনুরোধ করছি (স্মারক দিয়ে বরণ এবং দর্শকদের হাততালি)। ধন্যবাদ সম্মাননীয় অতিথি এবং সম্পাদককে।


আবু সাইয়ীদের হাতে শুভেচ্ছা স্মারক তুলে দিচ্ছেন সম্পাদক


সঞ্চালক-১ : এবার ম্যাজিক লণ্ঠন পরিবারের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছা বক্তব্য দিবেন ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-২ আয়োজক কমিটির আহ্বায়ক এম জিয়াউল হক সরকার। জনাব এম জিয়াউল হক সরকারকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করছি।

এম জিয়াউল হক সরকার : সম্মাননীয় উপস্থিতি। সবাইকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। গতবার আমরা ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালার আয়োজন করেছিলাম। আমাদের ইচ্ছে ছিলো ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-১, ২, ৩ এ-রকম করে ধারাবাহিকভাবে চলতে থাকবে। ঠিক এরই ধারাবাহিকতায় আজকে ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-২ এর আয়োজন। বিশেষ ব্যস্ততার মধ্যেও সম্মাননীয় অতিথি প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা আবু সাইয়ীদ আমাদের মাঝে এসেছেন। এ-জন্য বিশেষ করে তাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। ম্যাজিক লণ্ঠন শুধু আমাদের একটি জার্নাল নয়; এখানে আমরা সেমিনার, পাঠচক্র, সিনেমা দেখা, আর সিনেমা নিয়ে অনেক কথা বলাসহ নানা লেনদেন করে থাকি। সেখান থেকে চলচ্চিত্র সম্পর্কে আমাদের যে-বোঝাপড়া; সেখান থেকে আমরা যদি একটু চিন্তা করি-সেটা হলো এ-দেশের চলচ্চিত্রের অবস্থা খুব বেশি ভালো নয়। এটা মূলধারার চলচ্চিত্রে বর্তমান অবস্থা কিংবা রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক মন কিংবা চলচ্চিত্রের সেন্সর বোর্ড কিংবা আমাদের দর্শক-শ্রোতার রুচির মান; সবকিছু মিলেই এ-দেশের চলচ্চিত্র সিনেমার অনুকূলে নয়। এর আগেও ছিলো না। কিন্তু, গত ২০ বছর ধরে এ-দেশে মূলধারার সিনেমার পাশাপাশি শর্টফিল্ম কিংবা ইন্ডিপেন্ডন্ট ফিল্ম কিংবা আরও অনেক ধারার বেশকিছু সিনেমার কাজ দেখতে পাই। সেগুলো যে এ-দেশের সিনেমাকে বিশেষ কোনো জায়গায় নিয়ে গেছে কিংবা সিনেমাকে সবার জন্য গড়ে তুলেছে; তেমনটি বলা যাচ্ছে না।

আসলে এক সময় সিনেমাটা এ-রকম ছিলো যে-আমরা মা-বাবা, ভাই-বোন সবাই মিলে সিনেমা হলে যেতাম। সিনেমাটা ছিলো আমাদের জন্য একটা প্রার্থনালয়ের মতো, একটা দেবালয়ের মতো। কিন্তু হঠাৎ করে সিনেমা আস্তে আস্তে এমন একটা সঙ্কটের মধ্যে ঢুকে পড়লো যে, আজ সিনেমা হলগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, সিনেমা হলগুলো উচ্ছেদ হচ্ছে, সেখানে শপিং কমপ্লেক্স হচ্ছে। সিনেমাটা আর আগের জায়গায় নেই। তাহলে কি আমাদের সিনেমা পথ হারিয়েছে? সারা বিশ্বের যে-পরিবর্তন; সারা বিশ্বের সিনেমার ক্ষেত্রে যেমন : ইরানে, কিউবাতে, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে এমনকি আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও সিনেমার পরিবর্তনগুলো দেখতে পাচ্ছি-তারা আন্তর্জাতিকমানের সিনেমা তৈরি করছে। সেখানে তাদের সবকিছুই, বলতে গেলে দর্শকদের চাহিদা-রুচির যে-রকম পরিবর্তন ঘটেছে ঠিক তেমনিভাবে একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এসেছে। কিন্তু আমাদের দেশের সিনেমায় আমরা তেমন কোনো পরিবর্তন লক্ষ করতে পারছি না। এখন এই জায়গাটায় দাঁড়িয়ে আমরা শুধু আমাদের দেশের এক শ্রেণির মানুষদের দায়ী করতে পারি না। সেখানে যেমন দর্শকদের কথা আছে, সে-রকম নির্মাতার কথা আছে, প্রযোজকের কথা আছে এবং পরিবেশকেরও কথা আছে।

একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা তারও কিন্তু কিছুটা দায় থেকে যায়, সিনেমাটাকে সংস্কৃতির অংশ হিসেবে বা এর বিকাশের একটা জায়গায় নিয়ে যেতে কিংবা আন্তর্জাতিকমানের করতে তারও নিজস্ব কিছু একটা দায়বদ্ধতা থাকে। সেখান থেকেই আসলে আমরা সিনেমাতে কী চাই? কেনো চাই? কীভাবে চাই? বা দর্শকদেরকে একটা জায়গায় নিয়ে যাওয়ার জন্য, তাদের রুচির মানটা পরিবর্তনের জন্য কী ধরনের ভূমিকা থাকতে পারে; কোন্ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে আমরা যেতে পারি। সেখানে একজন নির্মাতা; সচেতনভাবে তার কিছু ভূমিকার অবশ্যই একটা জায়গা থাকে। সেখান থেকে একজন নির্মাতা; কীভাবে তিনি একটা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে, একটা প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাবেন; সেটা যেমন একটা জায়গা থেকে তিনি করবেন ঠিক তেমনিভাবে একজন শ্রোতা কিংবা একজন দর্শক তিনি বুঝতেই পারবেন না যে-সিনেমার পরিবর্তনটা কীভাবে হচ্ছে। এবং তিনি ভাববেন যে, আসলে সিনেমাতে আমরা যা চাচ্ছি তাই পাচ্ছি, সিনেমাটা আমাদের মতো করে হচ্ছে।

আমাদের যে-আশা, আমাদের যে-আকাঙ্ক্ষা সেগুলোও প্রতিফলিত হচ্ছে সিনেমায়। এটা শুধু যদি এ-রকম হয় যে, সিনেমার যে-কোনো একটি অংশ হিসেবে কিংবা একটি ধারা নিয়ে যেমন-আমাদের দেশে যেটা হলো বিকল্প ধারা। একটা ধারার মধ্য দিয়ে আমরা সিনেমার পরিবর্তন করবো, তাহলে এটা অনেক কষ্টকর হবে। কারণ, আমরা দেখেছি যে-সিনেমাটাকে যদি আমরা সেই জায়গাতে দেখতে চাই; যেমন দেবালয়ের মতো ছিলো, প্রার্থনালয়ের মতো ছিলো। সেখানে কিন্তু সবার জন্য সিনেমা ছিলো। সেটা যেমন আমরা দেখতে পেতাম, আমাদের ছোটরাও দেখতে পেতো। সেটা আমাদের দেশে জহির রায়হানও সে-রকম অনেক সিনেমা করেছিলো। তাহলে সেই জায়গায় যদি আমরা ফিরে যেতে চাই; তাহলে আমাদের যারা নির্মাতা তাদেরকে সুচারুভাবে, একটা পরিকল্পিতভাবে, নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে আমাদের সিনেমাটাকে সেখানে নিয়ে যেতে হবে। নিশ্চয় আমাদের দেশে যারা চলচ্চিত্রনির্মাতা আছেন, এগুলো ভাবছেন এবং তারা সেভাবে আমাদের সিনেমাকে আন্তর্জাতিকমানের করার জন্য কিংবা সাংস্কৃতিক বিকাশের জন্য কিংবা সবার জন্য সিনেমা করার জন্য তারা চিন্তা-ভাবনা করছেন। আমরা আজকে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রনির্মাতা আবু সাইয়ীদের কাছ থেকে আসলে আমাদের যে-আকাঙ্ক্ষার জায়গাগুলো কিংবা সিনেমার যে-জায়গাটা আমাদের দরকার কিংবা আমরা যেটা চাচ্ছি অবশ্যই আমরা তা বুঝতে পারবো এবং জানতে পারবো। আমাদের কথা হবে...ধন্যবাদ সবাইকে। (দর্শকদের হাততালি)।

সঞ্চালক-২ : ধন্যবাদ জিয়াউল হক। সম্মাননীয় উপস্থিতি, আমাদের আজকের এই আয়োজনকে আমরা দুটো পর্বে ভাগ করেছি। প্রথম পর্বে থাকছে সম্মাননীয় অতিথির কথামালা এবং দ্বিতীয় পর্বে থাকছে প্রশ্নোত্তর। আমরা লিখিত আকারে প্রশ্ন নেবো। আমাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্যরা আপনাদের কাছে যাবেন এবং লিখিত প্রশ্নটি সংগ্রহ করবেন।

সঞ্চালক-১ : তাহলে আর দেরি নয়; এখন আমরা সরাসরি চলে যাচ্ছি আবু সাইয়ীদের কাছে। এবারে জনাব আবু সাইয়ীদ আমাদের সামনে উপস্থাপন করবেন তার কথামালা।

আবু সাইয়ীদ : উপস্থিত সুধীমণ্ডলী। আমার খুবই ভালো লাগছে যে, এ-রকম একটি অনুষ্ঠানে আমি উপস্থিত হতে পেরেছি। ম্যাজিক লণ্ঠন পত্রিকাটি সম্বন্ধে আমার তেমন কোনো ধারণা ছিলো না। কিন্তু গত দুই-তিন মাস আগে যখন আমি এই পত্রিকাটি পেলাম; পুরোপুরি পড়তে পারিনি, কিন্তু বিচ্ছিন্নভাবে পড়ে আমি সত্যিই অভিভূত হয়েছি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ-রকম একটি কর্মকাণ্ড বিশেষ করে এই পত্রিকা এবং এই পত্রিকার লেখা, লেখার যে-দৃষ্টিভঙ্গি, লেখার যে-মান সেটা সত্যিই আমাকে অনেক আপ্লুত করেছে। হয়তো সংযোগের বা যে-কারণেই হোক না কেনো আমি এই পত্রিকাটি নিয়ে কিছু জানতাম না। যেমন গত পরশুদিন মফিদুল হক; উনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিলো, উনাকে বললাম উনিও জানেন না যে এ-রকম একটি পত্রিকা আছে।  আমি উনাকে বলছিলাম যে, বেশ ভালো একটি পত্রিকা রাজশাহী থেকে বের হয়। এই মুহূর্তে হয়তো আমি বিস্তারিত বলতে পারবো না নির্দিষ্ট কোনো লেখা সম্পর্কে। তবে যা বলতে পারবো, তা হলো-কোনো একটি লেখা আমি পড়ছি, সে-লেখার ধরন বিশেষ করে, যেভাবে বিশ্লেষণ করার একটা প্রবণতা লেখাগুলোর মধ্যে আছে; আমি ধরেই নিয়েছিলাম কোনো একজন শিক্ষক বা একজন ভালো গবেষক লেখাটা লিখেছেন। কিন্তু পড়া শেষে যখন আমি লেখকের পরিচিতিটা পাচ্ছি, তখন দেখছি লেখক একজন ছাত্র, তখন সেটা আমাকে আরও বেশি বিস্মিত করেছে (দর্শকদের হাততালি)। আমার কাছে মনে হয় দ্বিতীয় বর্ষ কিংবা তৃতীয় বর্ষের যে ছাত্র ওরা যা করছে, ওই-বয়সে আমিই বোধহয় চলচ্চিত্র; বিশেষ করে একটি চলচ্চিত্রকে বা একজন নির্মাতার সামগ্রিক কর্মকাণ্ডকে সামাজিক, রাজনৈতিক এবং দার্শনিকভাবে ব্যাখ্যা করার যে-একটা চেষ্টা; সেটা আমার মধ্যে ছিলো না। সে-কারণেই আমি খুবই একটা অস্বস্তির মধ্যে ছিলাম, এমন শ্রোতার মাঝে আমাকে কিছু বলতে হবে এই ভেবে। ব্যক্তিগতভাবে আমার বেড়ে ওঠা একেবারেই মফস্বল জেলায়-বগুড়াতে। এই ব্যর্থতা স্বীকার করতে আমার কোনো অসুবিধা নেই যে, আমি এইভাবে একটি পরিমণ্ডলের মধ্য দিয়ে বড়ো হইনি; যেখানে একটা মানুষের অনেক বিষয়ে জানা বোঝাপড়ার ব্যাপার থাকে। বিশেষ করে এমন আমার ধারণার মধ্যেই ছিলো না যে, একজনকে অনেক বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে বড়ো হতে হয়। যখন জানলাম, তখন আসলে সময়টা এতোটাই পেরিয়ে গেছে যে, তখন আর নিজেকে সংশোধনের সুযোগ নাই। সে-কারণেই আমার যেটুকু কর্মকাণ্ড; ভালো-মন্দ যাই হোক, তার যে-সীমাবদ্ধতা, তার যে-শৈল্পিক প্রকাশে অদক্ষতা, সেটা হয়তো আমার আন্ডার্স্ট্যান্ডিংয়েরই দুর্বলতা। কিন্তু একটা বোধ বা অনুভূতি, ভিতরে একটা কিছু করার আবেগ বা প্রবণতা আমার মধ্যে ছিলো বলেই হয়তো কিছুটা ধারাবাহিকভাবে কয়েকটা কাজ করতে পেরেছি।


কথা উপস্থাপনায় আবু সাইয়ীদ


যাই হোক, খুবই ভালো লাগছে যে, আপনারা আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এবং সেই সঙ্গে একবারেই অচেনা একটি গ্রুপ এবং মামুন ভাইয়ের সঙ্গে আমার জানাশোনা ছিলো না। নিউটন ভাইয়ের কিছু লেখার সঙ্গে হয়তো জড়িত ছিলাম এটুকুই, আর অন্যরা তো একেবারেই আমার অপরিচিত।

তো এবার আজকের এই কথামালার যে-বিষয়টা সেটা নিয়ে একটু আলোচনা করি; যদিও আমি বলেই নিচ্ছি যে, আমি কখনই খুব ভালো বলতে পারতাম না এবং এখনও পারি না। তো যেহেতু এই কথামালায় একটা সুবিধাজনক দিক আছে যে, প্রশ্নপর্ব এবং সবাই এখানে অংশ নেবে; সুতরাং সেটাই একটু ভরসা। সবাই মিলেমিশে এই কথামালাটা কোথাও দাঁড় করানো যায় কি না। আমি এই বিষয়টা নির্ধারণ করার একটা মূল কারণ; প্রথম দিকে যখন আমি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করি, বিশেষ করে ৮০র দশক বা ৯০র দশকেও আমাদেরকে খুব বেশি প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হতো না যে, আমাদের ছবির দর্শক এতো কম কেনো বা যে-ছবির দর্শক এতো কম, সে-ছবি নির্মাণ করাটা কতোটুকু যৌক্তিক। কিন্তু ইদানিংকালে প্রায়ই এ-প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে। এটা হয়তো আজকের বাস্তবতা, বিশেষ করে সমস্ত কিছুকে পণ্য করে দেখার একটা প্রবণতা থেকেই হয়তো এমনটা হয়ে আসছে। আমাকে জার্নালিস্টরা প্রায়ই একই প্রশ্ন করেন, কেনো হলে আমার বা এ-ধরনের ছবি চলছে না বা ছবি প্রদর্শনের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না? এমনকি আমার ছবিগুলোকে এখন পর্যন্ত, যে-ছবিটি হয়তো শ্রেষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে, কোনো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে শ্রেষ্ঠ ফিল্মের অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছে-যা একটা ফিচার ফিল্মের অ্যাওয়ার্ড, তারপরও এই ছবিকে অনেকে মনে করছে শর্টফিল্ম। তো বিভিন্ন সময় এই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে আমার এই দর্শক এবং একজন নির্মাতার দায় বিষয়ে আমার কিছু ভাবনা আজকের কথামালায় উপস্থাপন করতে চাই। কেনো এই ছবিগুলোর দর্শক খুবই কমতি; বিশেষ করে আমাদের ধারার। বিশেষ করে সেখানে আমার বা অন্য একজন নির্মাতার দায় কতোটুকু? বা আমাদের সামগ্রিক যা পরিস্থিতি যেমন-ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম, এমনকি দর্শকেরও দায় কতোটুকু? যদিও চলচ্চিত্রের, এটা সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাই বলি না কেনো; যতোগুলি শিল্পমাধ্যম এখন পৃথিবীতে আছে চলচ্চিত্রের দর্শকের কাছে যাওয়ার যে-ক্ষমতার বিষয়টা এটি আর কোনো শিল্পমাধ্যমের নেই। আমি এটাকে সৌভাগ্যও মনে করবো এবং একই সঙ্গে দুর্ভাগ্যও মনে করবো।

যদি আমরা এখানে একটা উদাহরণ দিই আমাদের বাচ্চু ভাই, মানে নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু উনি দুটি চলচ্চিত্র বানিয়েছেন। এর আগে একাত্তরের যীশু এবং সম্প্রতি গেরিলা। আমার ধারণা তার দুটি ছবির যে-কোনো একটি যতো দর্শক দেখেছে তার নির্দেশিত থিয়েটার তার সবগুলো যোগ করলেও হয়তো অতো দর্শক দেখেনি। এটা চলচ্চিত্র, এ-কারণেই এটা সম্ভব হয়েছে। এছাড়া অন্য শিল্পমাধ্যমও তা পেইন্টিংস, কিছু পপুলার গ্রন্থ বাদ দিলে অধিকাংশ সাহিত্যের ক্ষেত্রেই একই কথা প্রযোজ্য। সেটি ছোটগল্পেই হোক বা উপন্যাসেই হোক, বিপুল সংখ্যক দর্শক-পাঠকের কাছে যেতে পারে না; যেটা পারে চলচ্চিত্র। এটাকে আমি সৌভাগ্য বলবো যে, একটি শিল্পমাধ্যম অনেকের কাছে যাচ্ছে। কিন্তু এটা একইভাবে দুর্ভাগ্য যে, দর্শকের কাছে যাওয়ার প্রবণতা থেকেই এই শিল্পটা যতোটা না শিল্প, যতোটা আর্টের জায়গায় থাকছে, তার থেকে অনেক বেশি ইন্ডাস্ট্রি বা একটা প্রোডাক্টে রূপান্তরিত হচ্ছে। যেটা আমাদের চলচ্চিত্রের শিল্পমানকে রক্ষা এবং শিল্প হিসেবে এই নিজস্বতা বজায়ে ব্যর্থ হচ্ছে।

সর্বত্রই আমাদের বোধহয় একটা লক্ষ্য থাকে যে, চলচ্চিত্র আমাদের দর্শক-শ্রোতার কাছে যাক, এটা সবারই কাম্য থাকবে। কিন্তু তার অঙ্গহানি ঘটিয়ে অর্থাৎ শিল্পমানের কোনো কম্প্রোমাইজ বা যে-কোনো ভাবে যেনোতেনো প্রকারে দর্শককে টানতে হবে! দর্শক খাবে এই অজুহাতে চলচ্চিত্রের নির্মাণ বা এর প্রদর্শনের জন্য যে যে উপকরণ দরকার যা মোটেও দৃষ্টিনন্দন নয়, সেটা যদি ইম্পোজ করা হয়, তাহলে কিন্তু স্বাভাবিক একজন শিল্পীর যে-কমিটমেন্ট থাকে বা তার যদি শৈল্পিক বা সামাজিক বা অন্য কোনো দায়বদ্ধতার কাছে পৌঁছতে হবে। একটি শিল্পকর্ম দর্শকের কাছে পৌঁছুক, পাঠকের কাছে যাক বা শ্রোতার কাছে যাক-এটা সবারই কাম্য থাকবে। কিন্তু সে তার অঙ্গহানি ঘটিয়ে অর্থাৎ শিল্পমানের কোনো কম্প্রোমাইজ বা কোনো প্রকারে দর্শককে টানতে হবে! এই জন্য সেইভাবে এটির নির্মাণ বা এর প্রদর্শনের জন্য যে যে উপকরণ দরকার, সেটা যদি ইম্পোজ করা হয়, তাহলে কিন্তু তার স্বাভাবিক যে-একজন শিল্পীর যদি কমিটমেন্ট থাকে তার যদি শৈল্পিক বা সামাজিক বা অন্য কোনো দায়বদ্ধতা থাকে সেটা অবশ্যই ব্যাহত হয়; সেটা আমি মনে করি। হয়তো অনেকেই একমত হবেন না; হয়তো আবার অনেকেই রক্ষণশীল মনে করবেন, আমি এই এতো ব্যাপক দর্শকপ্রিয়তার পক্ষে নই, কারণ এই দর্শকপ্রিয়তার দোহাই দিয়ে চলচ্চিত্রকে পণ্য করে তোলা হচ্ছে, এর বাইরে আর কিছু নয়।

আমরা যদি বিভাজন করি যে, ৭০র দশকে বা তারও আগের ৫০ দশকের, ৬০ দশকের যে-চলচ্চিত্রগুলো; পরবর্তী পর্যায়ে ৭০র, ৮০, ৯০ এভাবে আপনি একটা জিনিস লক্ষ করেন, আগের সময় নিয়ে বলা হয়-আমরা সবাই স্বর্ণালি যুগে ছিলাম, আমরা সবাই পারিবারিকভাবে ছবি দেখতাম; সবাই মিলে। ফিল্ম আমাদের কালচারের মধ্যে ছিলো। এটা যেমন সত্যই ধরে নেয়া যায় কিন্তু তারপরও আমরা সেই ছবির ভাবনাগুলো, গল্পগুলোকে, সেই উপস্থাপনগুলোকে বিবেচনায় আনি তবে কিছু চলচ্চিত্র বাদ দিলে, যেমন জহির রায়হানের দুই-তিনটা ছবি যেমন কখনো আসেনি, কাঁচের দেয়াল, কিংবা সূর্যস্নান বা নদী ও নারী, ওইসব চলচ্চিত্রের মান আসলে কোথায় ছিলো! সেটা যদি আমি সাহিত্যের সঙ্গে তুলনা করি সেটা তো নীহাররঞ্জন, নিমাই ওইরকমই একটা উপসন্যাসেরই বা ওইসব চলচ্চিত্র ওই মানেরই একটি প্রেমের গল্প। গৎবাঁধা কাহিনী বিন্যাস বা মানে, শুধুমাত্র একটি ঘটনা ঘটলে গল্প শেষ হয়। যেমন হয়তো নায়ক একটা সিঁড়ি দিয়ে নামছে, আবার নায়িকা হয়তো পাশের সিঁড়ি দিয়ে উঠে যাচ্ছে-শুধু এইটুকুই; এই মিলনটুকুই না ঘটিয়ে অন্য এক নাটকীয়তা তৈরি করে অযৌক্তিকভাবে একটা দিকে নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা; আমাদের চলচ্চিত্র বরাবর এই সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়েই বা এই গণ্ডিবদ্ধতার মধ্য দিয়েই এগিয়ে গেছে।

পরবর্তী পর্যায়ে এই একঘেঁয়েমিতা কাটানোর জন্য। তারপরে পর্যায়ক্রমে কোনো ভাবনা, বিষয়বস্তু বা অন্য কোনো দিক থেকে এটার কোনো উত্তরণের চেষ্টা না করে কিছু-কিছু নির্মাতা অশ্লীলতা বা বিশেষ করে ভায়োলেন্স-এর আশ্রয় নেয়; চলচ্চিত্রটাকে একটু ভয়াবহভাবে প্রকাশ বা নির্মাণ করতে থাকে। যারই ফলে ৯০র পরবর্তীতে বিশেষ করে বাণিজ্যিক ছবির ক্ষেত্রে সঙ্কট খুবই প্রকট হয়েছে। এইসব ছবি একটা নতুন শ্রেণির দর্শক পেলেও, যারা আদৌ চলচ্চিত্রের দর্শক কি না সন্দেহ আছে; মূল দর্শক-শ্রেণি আস্তে আস্তে ছবি বিমুখ হয়েছে।

যদিও আমার চলচ্চিত্র নির্মাণের জায়গাটা এইসব ছবির বাইরে। তবে আমি মনে করি, বাণিজ্যিক ধারার যে-চলচ্চিত্রটা, এটা এন্টারটেইনমেন্ট-এর জন্য হতেই পারে-যা সাহিত্যেও হতে পারে; হোক তা বটতলার সাহিত্য। তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে চলচ্চিত্রটাকে প্রথমত একটি অ্যা...আর্ট-ফর্ম হিসেবেই দেখতে চাই। যদিও নিজের নির্মাণ কাজে সেই প্রমাণ রাখতে পারিনি। যখন একটি শিল্প একটি আর্ট-ফর্ম, তখন কিন্তু এই শিল্পটা দর্শকের কাছে যাবার জন্য শুধুমাত্র যে-নির্মাতার দায় থাকে তা আমি মনে করি না; আমার কাছে দর্শকের দায়টাও খুবই জরুরি। আমরা যদি বিবেচনা করি-ক্লাসিক্যাল মিউজিকের কথা, আমরা যদি ভাবি কোনো চিত্রকলার কথা, এর অন্তর্নিহিত মেসেজটা প্রকাশের, এটা অনুভবের জন্য অবশ্যই শ্রোতা বা দর্শকের নিজস্ব শিল্পবোধ বা শিল্পভাবনার প্রয়োজন হয়। আবার কবিতায়-ও একই ব্যাপার। এখন যদি আমরা রবীন্দ্রনাথের কোনো কবিতা চিন্তা করি, ধরেন এক গাঁয়।


আমরা দুজন একটি গাঁয়ে থাকি

সেই আমাদের একটি মাত্র সুখ

তাদের গাঁয়ে গায় যে দোয়েল পাখিটা

তাহার গানে আমার নাচে বুক।

এটা যতো শ্রেণির পাঠককে কমিউনিকেট করতে পারবে। পাশাপাশি আমি যদি,

রূপ নারানের কুলে জেগে উঠিলাম;

জানিলাম এ-জগৎ

স্বপ্ন নয় রক্তের অক্ষরে দেখিলাম আপনারও রূপ;

চিনিলাম অপরের আঘাতে আঘাতে বেদনায় বেদনায়

সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম

সে কখনও করে না বঞ্চনা।


এ-ক্ষেত্রে কবিমনের যে-ভাবনা, সেই যে-তার অন্তর্নিহিত শিল্পবোধের প্রকাশ; তখনই একজন পাঠককে আন্দোলিত করবে যখন সেই পাঠকের মধ্যে সমতুল্য বা কখনও কখনও তারও অধিক ভাবনা বা চেতনা তার মধ্যে বিদ্যমান থাকবে। তাছাড়া কিন্তু কবি, কবিতা এবং পাঠকের মধ্যে সংযোগ ঘটানো কখনই সম্ভব হবে না। বিশেষ করে শিল্পের যেহেতু বিভিন্ন রকম আঙ্গিকগত এবং যেহেতু শিল্পের একটি সামাজিক দায়বদ্ধতা বা চেতনা বা দার্শনিক দায়বদ্ধতার ব্যাপার বিচার-বিশ্লেষণ থাকে, সেহেতু এই চিন্তা-চেতনা, ভাবনা, অনুভূতির ঐক্যটা খুবই জরুরি। এখানে একটা কবিতা পড়া হলো দূরে বহুদূরে/স্বপ্নলোকে উজ্জিয়নীপুরে। এখন এই যে, এই মিথিক্যাল বিষয়গুলো নিয়ে যদি কোনো পাঠকের মধ্যে একটা ন্যূনতম ধারণা না থাকে, তাহলে কিন্তু কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে একটা বড়ো অন্তরায় তৈরি হবে। হয়তো মনে হতে পারে, একজন দর্শক বা পাঠককেও কি তাহলে অতোটা শিল্পবোধসম্পন্ন মানুষ হতে হবে কি না? আসলে আমি মনে করি, দুজন দুজনের পরস্পর, পারস্পরিক একটা যোগাযোগ স্থাপিত হতে হবে। কবি, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার সৃষ্টি করতে পারেন, কিন্তু পাঠক বা দর্শক তা পারেন না; কিন্তু বোধ ও অনুভূতির জায়গায় দুইজন সমতুল্য। যেমন আমার একটা ছবি রূপান্তর, ছবিটি হয়তো সুনির্মিত নয়, অনেক দুর্বলতা আছে তারপরেও বাংলাদেশে এই ছবির প্রতিক্রিয়া তারও অধিক কিছু ছিলো। এই ফিল্ম যখন বাংলাদেশে রিলিজ হয়, তখন অধিকাংশ দর্শক ঠিক নিতে পারেনি। অনেকে আমাকে ফোন করে অন্য ধরনের মন্তব্য করেছে, যা কখনই আমার ক্ষেত্রে হয়নি। যেটা নিরন্তর দেখেই হোক, শঙ্খনাদ দেখেই হোক বা কীত্তনখোলা দেখে হোক বা তার আগের শর্টফিল্ম দেখে হোক। এক বাক্যে অধিকাংশ দর্শকের এই ছবিটি ভালো লাগেনি। অথচ এই ছবিটি যখন ভারতে প্রদর্শিত হয়, ভারতের প্রত্যেকটি শহরে যতোগুলো উল্লেখযোগ্য ফেস্টিভ্যাল আছে সবগুলোতেই প্রদর্শিত হয়। কখনও কখনও বিশেষ প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়। যেমন : পন্ডিচেরি; ওখানে কোনো ফেস্টিভ্যাল নাই, সেখানকার কিছু দর্শক গোয়াতে ছবিটি দেখে তারা আমাকে বললো তারা তাদের সোসাইটির জন্য একটা স্পেশাল স্ক্রিনিং করতে চায়। এমনকি পুনে ফিল্ম ইন্সটিটিউটে আমি তার পরের বছর গেলাম, ওখানে নিরন্তর ছবির স্ক্রিনিং-এ। সেখানে একটা ছেলে বললো, সে-ছবিটা দেখে গোয়াতে সারারাত ঘুমাতে পারেনি। আমি রূপান্তর ছবির পরিচালক জেনে আমাকে বিশেষ সম্মান দিলো।  

তো যাই হোক, এটার মূল কারণটা হচ্ছে যে-মিথ নিয়ে কাজ করা হয়েছে, সেই মিথ ভারতিয় দর্শকদের জানা আছে কিন্তু আমাদের দর্শকদের নাই। তো এখন যদি আমরা আমাদের চলচ্চিত্র ভাবনায় মান্ধাতা আমলের ভাবনাকেই আগলে রাখতে চাই-আমাদের চলচ্চিত্র মানেই একটা প্রেমের গল্প, এখানে চার-পাঁচটা গান থাকবে, একটা ভিলেন থাকবে, সেটা কখনওবা নায়কের বাবা হোক বা কখনও নায়িকার বাবা হোক-বা নায়িকার বন্ধু, যেভাবেই হোক না কেনো, তার একটা নাটকীয় উত্থান-পতন থাকবে। পাশে একজন পার্শ্ব নায়ক-নায়িকা থাকবে বা কিছু মারামারি বা কিছু এ-রকম দৃশ্য থাকবে। যদি অতি পুরাতন একটা ফর্মুলার মধ্যে আমাদের চলচ্চিত্র থেকে যায় এবং এটা যদি নির্মাতা এবং দর্শক দুজনের মানসিকতার মধ্যেই থেকে যায়, তাহলে আমার ধারণা যে, আমরা আমাদের চলচ্চিত্র একটি শৈল্পিক মান বা আলাদা একটি বৈশিষ্ট্য নিয়ে  দাঁড়াতে পারবো না। আমাদের নির্মাতাদের, আমাদের ভাবনা জগতে একটা ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে, পাশাপাশি দর্শকের মধ্যে এবং আপনারা যারা পৃষ্ঠপোষক আছেন, তাদের মধ্যেও এই পরিবর্তনটা খুবই জরুরি বলে আমি মনে করি। দুটি পরিবর্তনই সমান্তরাল ভাবে জরুরি।

যে-কারণে তাইওয়ানের চলচ্চিত্রের বিরাট পরিবর্তন হয়, সেটা আজ থেকে বোধহয় ২০-২৫ বছর আগে, ওখানকার গভর্নমেন্ট ১০ জন তরুণকে বেছে নিয়েছিলো। বেছে নিয়ে তারা তাদেরকে বিভিন্নভাবে চলচ্চিত্রবিষয়ক প্রশিক্ষণ এবং সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতার মধ্য দিয়ে এবং দর্শকের কাছে যেনো চলচ্চিত্রগুলো ভালোভাবে প্রদর্শিত হয়, দর্শকের মধ্যে যেনো নতুন চলচ্চিত্র ধারণা দেওয়া যায় সেখান থেকেই একটি উদ্যোগের পদ্ধতি, একটি পঞ্চ বা বেশ কয়েক বছরের পরিকল্পনার মধ্য দিয়ে তারা এগিয়ে যায়। তারই ফলে আমরা এখন ওখানে হোসিয়েন এবং আরও কয়েকজন চলচ্চিত্রনির্মাতাকে পাই। তাইওয়ানি চলচ্চিত্র বর্তমান বিশ্ব-চলচ্চিত্রে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। পর্যায়ক্রমে কিন্তু এখন কোরিয়া, মালয়েশিয়া; মালয়েশিয়ার চলচ্চিত্র সংস্থা কিন্তু আমাদের চাইতেও নবীন। কারণ ওদের কিন্তু ৩৫ মিমি ল্যাবও আছে বলে আমার জানা নাই। যেহেতু ওরা সাম্প্রতিককালে ছবি শুরু করেছে, তো এই সময় শুরু করার কারণে ওরা সরাসরি ডিজিটাল মাধ্যমেই চলে গেছে। কারণ ওরা হয়তো এটা দেখেছে যে, ৩৫ মিমি আল্টিমেটলি হয়তো থাকবে না। তাই এইভাবে তাদের ইন্ডাস্ট্রি ডেভেলপড করানোর চিন্তাও করে নাই।

তো সার্বিকভাবে আমি যেটা মনে করি যে-আমাদের চলচ্চিত্রের নতুন ধ্যান-ধারণা এবং নতুন দর্শক, নতুন চলচ্চিত্র একটি গোষ্ঠী আমাদের দরকার। বিশেষ করে এখন খুবই আশার ব্যাপার যে, এর মধ্যেই নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে একটি শর্টফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়ে গেলো। গতবছরও হলো। এবার অবশ্য আমি আমার ব্যস্ততার জন্য জুরিতে থাকতে পারিনি। কিন্তু ওদের সেমিনারে ছিলাম, গতবারও ছিলাম। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি নিয়ে আমার খুব অন্যরকম ধারণা ছিলো। এখানে সব ধনাঢ্য ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা বা তারা একটু অন্যভাবে নিজেদের ডেভেলপ করছে। কিন্তু তাদের মধ্যেও যে-একটা ভাবনা চিন্তা এগিয়ে যাচ্ছে এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ও যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে-আমি খুবই আশাবাদী যে, হয়তো নতুন চলচ্চিত্র আমরা পাবো।

আমাদের নতুন চলচ্চিত্রকে সন্ধান করার যে-আপ্রাণ চেষ্টা সেটা হয়তো খুব দ্রুতই সফল হবে না, কিন্তু একদিন হবে। তো আমাদের সবসময় আশার কথা বলতে হয়, এইটি খুবই স্বাভাবিক। যদিও সার্বিক পরিস্থিতি অতোটা আশার না, পথ এতোটা সহজও না। সামগ্রিক ভাবনাটাকে পরিবর্তন ঘটিয়ে সামগ্রিক এতোদিনের যে-চলচ্চিত্রভাবনা তার মধ্যে একটা আমূল পরিবর্তন ঘটানো, এটা মোটেও সহজ ব্যাপার না। যেমনটা সহজ হচ্ছে না আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও। আজকে ফেইসবুকে দেখা যায়, পলিটিক্যাল ভিউ অপশনে ম্যাক্সিমাম ছেলেমেয়েরই কথা হচ্ছে-আই হেইট পলিটিক্স বা এ-রকম একটা কিছু। যেটা খুবই দুঃখজনক। তা এ-রকম হবার কথা ছিলো না। একটা দেশের রাজনীতি, সামাজ, সংস্কৃতি খুবই পাশাপাশি চলে। একটার সঙ্গে আরেকটা খুবই ওতপ্রোতভাবে জড়িত।

কেউ দর্শকের কাছ থেকে চলচ্চিত্রকে দূরে রাখতে চায় না; আমি অবশ্যই দর্শকের কাছে যেতে চাই। তবে আমার ভাবনাটা হচ্ছে, আমি দর্শকের কাছে, ঠিক দর্শকের কাছে না-আমার চলচ্চিত্রের কাছে দর্শককে আনতে চাই। আমি যদি আমার চলচ্চিত্রের কাছে দর্শককে আনতে পারি, আমি মনে করি সেটিই আমার সাফল্য।

কিন্তু আমি যদি আমার চলচ্চিত্রকে পুঁজি ফেরতের নামে, তথাকথিত এন্টারটেইনমেন্টের নামে যেনোতেনোভাবে শর্টকাটে, বাঁকা বা ভুল পথে দর্শকের কাছে যাই, তাহলে আমি মনে করি-এটা আমার এক ধরনের পরাজয়। আমার তো মাঝে মাঝে কিছু হিন্দি ছবির নাচ-গান দেখলে মনে হয়, এটা মোটেও একটি সুস্থ চলচ্চিত্রের উপকরণ না। অথচ এমন সব অঙ্গভঙ্গির মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটাকে উপস্থাপন করা হয়, এই সমস্ত চিত্রনায়িকাকে আমার কখনও কখনও পতিতার মতোই একটি ভূমিকা পালন করছে বলে মনে হয়। পর্দায় তাদের মুখের আচরণ, অভিব্যক্তি, দর্শকের উদ্দেশে যেভাবে তাদের টিপ্পনি, তাতে এবং শুধুমাত্র মানুষের ভিতরে যে-নারীর শারীরিক ইয়ের ব্যাপারে যে-আগ্রহটা; সেটাকে পুঁজি করে। অর্থাৎ ভায়োলেন্সকে বা মানুষের ভিতরে যে-একটা পশুত্বকে লালন করে, সেটাকে পুঁজি করে আমি দর্শকের কাছে আমার চলচ্চিত্রটাকে নিয়ে যাবো, এই প্রবণতা সামাজিক এবং শৈল্পিক, দুই দিক থেকেই এটাকে ক্রাইম বলে আমি মনে করি।

তো যাই হোক, এইটুকুই হচ্ছে আমার ক্ষুদ্রতম পরিসরের চিন্তা। এখন আমি আশা করছি, আপনাদের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে হয়তো আমরা আরেকটু সামনে যেতে পারবো আর কি। আমার ভাবনার সঙ্গে অনেকেই খুব দ্বিমত পোষণ করবেন। এবং সেটাই অবশ্য খুব স্বাভাবিক।

সঞ্চালক-২ : আমরা ম্যাজিক লণ্ঠন কথামালা-২ এর প্রশ্নোত্তর পর্বে চলে যাচ্ছি। আমি দায়িত্বরতদের প্রশ্নকর্তার কাছে গিয়ে প্রশ্নটি সংগ্রহ করার জন্য অনুরোধ করছি। তবে, এখানে একটি কথা বলে নিই-প্রশ্নকর্তা অবশ্যই তার পরিচয়টি দেবেন। 

(প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু। আবু সাইয়ীদ নিজেই দর্শকদের কাছ থেকে আসা বিভিন্ন প্রশ্ন-সম্বলিত চিরকুটগুলো পড়ে তার উত্তর দিতে শুরু করেন।)

সাইয়ীদ : একজন প্রশ্ন করেছেন, আপনার পথ চলতে কি কখনও হতাশায় ভুগতে হয়নি? আসলে আমি চাচ্ছিলাম যে, মানে-আজকের বিষয়টি নিয়ে যদি কারো কোনো ধরনের জিজ্ঞাসা থেকে থাকে; বিশেষ করে এই যে-আজকের যে-বিষয় চলচ্চিত্রের দর্শকপ্রিয়তায় নির্মাতার দায়। যেটা হয়তো মনে হতে পারে-একজন নির্মাতা হিসেবে আমার দায়টা এড়িয়ে যাবার চেষ্টা এখানে আছে। কিন্তু আমি কিন্তু সেই জায়গা থেকে না, অন্যভাবে আলোচনাটা করতে চেয়েছিলাম। যাই হোক, তো এখানে উত্তরটা হচ্ছে যে, কখনও হতাশায় ভুগতে হয়নি...মানে (দর্শকদের উদ্দেশে) যিনি এটি লিখেছেন তাকে বলছি। নামটা বলবেন কি? কে লিখেছেন? মানে এই হতাশার দিকটি ঠিক কোন্ দিক থেকে? মানে কর্মের দিক থেকে নাকি সবদিক থেকে? (সবদিক থেকে, প্রশ্নকারীর উত্তর) দেখুন, সবদিক থেকে হয়তো এই হতাশাটা থাকবেই। না থাকবার কোনো কারণও নেই। সেটা হচ্ছে যে-দুই দিক থেকেই হয়। একটা হচ্ছে যে-আমার নির্মাণের দিক থেকে যদি বলি, যেমন-আমার চলচ্চিত্র অপেক্ষাকৃত কম দর্শকের কাছে গেছে। এটার অন্যতম একটা কারণ, আমি যখন কোনো ছবি তৈরি করি তখন আমি যে-স্বপ্ন নিয়ে, চিন্তা নিয়ে, ভাবনা নিয়ে ছবিটা তৈরির উদ্যোগটা নিই-এটা আমার একটা সাইকোলজিক্যাল প্রবলেমই হয়তো বলতে পারেন আপনারা। নির্মাণের পর আমি খুব একটা সন্তুষ্ট থাকতে পারি না। সন্তুষ্ট থাকতে পারি না বলে, তখন দেখানোর জন্য যে-উদ্দামটা সেটা অনেকটা কমে যায়। যে-কারণে আমি খুব স্ব-উদ্যোগে আমার ছবিগুলো কখনও দেখানো বা কাউকে দেখাতে বলা-এটা আমি পারি না। এটা আমার একটু সমস্যা হয়, আবার অনেকেরই এই সমস্যাটা হয়তো নাই। আমার সমস্যাটা না থাকলেই ভালো হতো।

আর যদি হতাশার কথা বলেন, ব্যক্তিপর্যায়ে সেটা আসলে সার্বিকভাবে একটা হতাশা আমার আছে, সেটা রাজনৈতিক, সামাজিক। কিন্তু আমি একজন চলচ্চিত্রনির্মাতার দায়টা শুধু চলচ্চিত্রনির্মাতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। আমি মনে করি, আমি কেনো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে আসলাম; তার প্রথম কারণটা হয়তো চলচ্চিত্রই। কারণ ওই সময়ে আমার মধ্যে সাহিত্য বা অন্য মাধ্যমের প্রতি একটা আগ্রহ ছিলো। কিন্তু আমার কাছে মনে হলো-চলচ্চিত্র খুবই একটা নাজুক অবস্থায় আছে। আমি বরং চলচ্চিত্রে যদি একটা ভালো কিছু করতে পারি, সেটা হয়তো চলচ্চিত্রের জন্য কিছু করা হবে। সেটাও কিন্তু ঠিক। কিন্তু তারপরেও একটা কমিটমেন্ট, সামাজিক, রাজনৈতিক এবং শিল্পের প্রতি কমিটমেন্টের জায়গাটা কিন্তু আমার মধ্যে কাজ করে। সেটা যেমন আমি পালন করতে পারি না, আমার পারিপার্শিক অবস্থা সেটার অনেক বেশি প্রতিকূলে; সেই কারণে হয়তো একটা হতাশা সবসময় কাজ করে। কিন্তু হতাশা কাজ করার ফলেও আমি থেমে যাওয়ার মধ্যে নেই। খুব স্লো, কিন্তু আমি এগিয়ে যাওয়ার পক্ষে। আমাকে কিন্তু এখনও অনেক বেশি সংগ্রাম করে যেতে হচ্ছে এবং এটা আমি যেতেও চাই।

সাইয়ীদ (প্রশ্ন হাতে নিয়ে) : আচ্ছা একজন প্রশ্ন করেছেন মি. সোহরাব হোসেন, আহ্বায়ক, সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট। একজন নির্মাতা যেমন দর্শককে বিকশিত করে তেমনি দর্শকও একজন নির্মাতাকে বিকশিত করে অর্থাৎ দর্শকের ফিডব্যাক থেকে নির্মাতা আরও সামনে এগিয়ে যায়। দর্শকের মানকে বিকশিত করার জন্য একজন নির্মাতার দায় কতোটুকু? এ-ক্ষেত্রে সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবকাঠামোগত আয়োজনে কী কী থাকা দরকার?

মানে আমি আসলে এই কথাটিই বলতে চাচ্ছিলাম যে, দুইজন দুইজনের সঙ্গে খুবই জড়িত। একজন নির্মাতার যেমন একটা দায় আছে দর্শককে বিকশিত করার, তেমনি দর্শকেরও দায় আছে নির্মাতাকে বিকশিত করার। আর অবকাঠামোগত আয়োজন কী কী থাকা দরকার? সে-ক্ষেত্রে আসলে অনেক কিছুই দরকার হয়, যেমন রাষ্ট্রীয়ভাবে একটা পৃষ্ঠপোষকতার দরকার হয়, সেটা আমি এর আগে তাইওয়ানের কথা বললাম, যেমনটা ইরানে ঘটছে, যেমনটা মালয়েশিয়ায় ঘটছে। আমি ঠিক কোরিয়ার কথাটা বলতে পারবো না, ওদের ডেভলপমেন্টটা। ভারতেও চলচ্চিত্রের বিকাশের ক্ষেত্রে ওদের সরকারের একটা বড়ো ভূমিকা আছে। এছাড়া প্রদর্শনের ক্ষেত্রে যদি ভালো প্রদর্শনের ব্যবস্থা যেখানে আমরা ক্রমান্বয়ে পিছিয়ে পড়ছি; সেখানে আমাদের খুবই নাজুক অবস্থা।

এছাড়া কারিগরি মান, এটা খুবই লজ্জার ব্যাপার যে-আমাদের সবগুলো চলচ্চিত্র, বিকল্প ধারা বলুন বা স্বনির্ভর ধারায় বলুন, সবই কিন্তু মাদ্রাজ বা অন্য কোথাও থেকে পরিস্ফুটিত হচ্ছে বা মুদ্রিত হচ্ছে। টেকনিক্যাল কাজটার আমরা ওখান থেকে সাপোর্ট নিচ্ছি। এটা আমাদের দেশে করতে পারলে আমরা খুবই খুশি হতাম। তো আমরা সেই রকম অবকাঠামো বা সেই রকম কারিগরি সুবিধাটা আমাদের দেশে বিকশিত করতে পারিনি; যা আমাদের একটা বড়ো দুর্বল দিক। তারপরও এখন যে-ডিজিটাল ফরম্যাটটা আসছে, তাতে হয়তো এই সঙ্কটটা একটু দূর হতে পারে অদূর ভবিষ্যতে। কারণ এটি খুব বড়ো আয়োজনের ব্যাপার না।

এরপরও আমার কাছে মনে হয় কী যে, টেকনিক্যাল ব্যাপারটা গুরুত্বপূর্ণ, আর্থিক ব্যাপারটাও গুরুত্বপূর্ণ, প্রদর্শনীর ব্যাপারটাও গুরুত্বপূর্ণ। তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আমাদের নিজস্ব চিন্তা-চেতনা, আমাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ভাবনা। এটি কিন্তু ব্যক্তি পর্যায় এবং সাংগঠনিক পর্যায়। দুটো দায়ই সমান। মানে সমাজ পরিবর্তিত হলে আমি পরিবর্তিত হবো এ-রকম ভাবারও কোনো কারণ নাই। আবার আমি একা পরিবর্তন হলেই সমাজ পরিবর্তন হবে তা না। দুটো পারস্পরিকভাবে, মানে পাশাপাশি সমান্তরালভাবে এগিয়ে যাবে, এটাই আমি মনে করি।

সাইয়ীদ : আতিক। শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা। প্রশ্ন করেছেন, চলচ্চিত্র-শিল্পমান বলতে আপনি কোন্ কোন্ বিষয়গুলো উল্লেখ করতে চান বিস্তারিত বলবেন?

এখন এই বিষয়টা, শিল্পমান বলতে কোন্ বিষয়গুলোকে উল্লেখ করতে চান-এটা একটু গুরুতর প্রশ্ন। এটা একটু গুরুতর প্রশ্ন এই কারণে যে, এটা অনেক ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির বিরোধ থাকতে পারে। তো আমার ভাবনাটা যদি আমি বলি, আমি মনে করি চলচ্চিত্র হচ্ছে একটি শিল্পমাধ্যম, এর প্রথম দায়টা থাকবে শিল্পের কাছে। চলচ্চিত্র শিল্প হতে হবে। এই শিল্প মানে আপনি যদি চলচ্চিত্রের ধারাবাহিকতাটা, ইতিহাসটা দেখেন সেই চলচ্চিত্র সৃষ্টির পর থেকে; তার মানে যে-আপনি তিনটা-চারটা জোন ভাগ করে নিতে পারেন। সোভিয়েত ইউনিয়নে একটি, ইতালি বা এর আশেপাশে, আমেরিকা এবং ভারতবর্ষ, বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন শিল্প ভাষার জন্ম নেয়। তো শিল্পের ক্ষেত্রে আমরা যদি চলচ্চিত্রকে একটি যৌগিক শিল্পমাধ্যম মনে করি, এখানে ফটোগ্রাফি আছে, শব্দ আছে, অভিনয় আছে, রূপসজ্জা ইত্যাদি। চলচ্চিত্রটি অবশ্যই আমি মনে করবো বিষয়বস্তুগত দিক থেকে এটি যতোটা সম্ভব, যে-দেশে তৈরি হচ্ছে, সেই দেশের মাটি এবং মানুষের সঙ্গে সম্পর্কিত হবে। আপনারা একটা জিনিস লক্ষ করবেন-বাণিজ্যিক, অধিকাংশ বাণিজ্যিক ছবির সঙ্গে মানুষ এবং মাটির সম্পর্ক চূড়ান্ত পর্যায়ে থাকে না, একটা ফ্যান্টাসির মধ্য দিয়ে তৈরি হয়।    

আমার মতামত হচ্ছে, মানুষ এবং মাটির সঙ্গে একটা সম্পর্ক থাকা উচিত; সেইভাবেই সিনেমার গল্প কাঠামো এবং বিষয়বস্তু নির্ধারণ করা। আর ফটোগ্রাফি বা এর চলনের দিক থেকে, সাদৃশ্যের দিক থেকে, আমি মনে করি এর একটি রিদম তৈরি হবে। এটি আসলে অনেক বেশি অনুভূতি নির্ভর। আপনি গান শুনছেন, ধরুন ক্লাসিক্যাল মিউজিক; ক্লাসিক্যাল মিউজিকের মধ্যে যদি ধ্রুপদ, তারপরে হচ্ছে ঠুমরি, খেয়াল, টপ্পা এর মধ্যে একটা খুব চলনের পার্থক্য আছে। আবার এই ক্লাসিক্যাল মিউজিকের পরে যদি গজল বা এর মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। তারপর এই আধুনিক গান এখনকার হিন্দি গান, ব্যান্ড সঙ্গীত, হ্যাঁ এর মধ্যেই কিন্তু। তো সে-ক্ষেত্রে চলচ্চিত্রের চলনটা আমি মনে করি একটু, আমার অনুভূতিতে, আমার সঙ্গীত, আমার দেশিয় সংস্কৃতি বা ক্লাসিক্যাল মিউজিকের সঙ্গে তুলনা করলে সেটা পাশ্চাত্য এবং ভারতবর্ষীয় সেই চলনের সঙ্গে একটা মিল থাকুক সেটা আমি ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করি। তার বাইরেও হতে পারে।

অভিনয়ের ক্ষেত্রে আমি মনে করি চলচ্চিত্রে অভিনয়টি অনেক বেশি বাস্তবতার কাছাকাছি। অভিনয় তো অভিনয়ই। একদম তো মানুষের মতো করে কথা বলবে না। একটু তো পার্থক্য থাকবেই। কিন্তু অনেক বেশি ও যতোবেশি ওই চরিত্রের কাছাকাছি যেতে পারে। আমাদের দেশের চলচ্চিত্র অভিনয়টা দেখলে আপনি খুব সহজেই বুঝবেন যে-এটি কোনো চলচ্চিত্র অভিনয় না। এর বিপরীত এক চিন্তা করুন, তাহলে সেটা আমার মনে হয় স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আবহসঙ্গীতের ক্ষেত্রেও তার পরিমিতি ব্যবহার এবং তার মধ্যে কোনো আধিক্য না-থাকুক-আমি মনে করি একটি চলচ্চিত্রের শিল্পমান রক্ষা করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। শিল্প নির্দেশনার ক্ষেত্রে আমি ঘটনার স্থান, পারিপার্শ্বিকতা সেটা যতোদূর সম্ভব তার কাছাকাছি বা হুবহু হোক, সেটি আমি মনে করি। এই সার্বিকভাবে বিবেচনা করে, একটি চলচ্চিত্র কল্পনা করে, যে-শিল্পমান বোঝায় সেটি হচ্ছে আমার ভাবনার জায়গা। তবে আমি আবারও বলছি যে, আমার কাছে বিষয়বস্তু এবং চূড়ান্তপর্যায়ে চলচ্চিত্রটি দেখার পরে আমার কাছে কোন্ ম্যাসেজ বা কোন্ অ্যাসেন্সটা আমার কাছে ধরা পড়লো সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

সাইয়ীদ : আচ্ছা, আরেকজন প্রশ্ন করেছেন, রুবেল পারভেজ। দর্শকপ্রিয়তা দিতে পারলেই কি নির্মাতার দায়মুক্তি ঘটে?

না, সেটা তো ঘটে না, আমি মনে করি। সেটাই তো আমি বলার চেষ্টা করলাম। দর্শকপ্রিয়তা দিতে পারলেই দায়মুক্তি ঘটার কোনো কারণ নাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে আমাদের এখানে অধিকাংশ মানে আমি বলি ৯৯ দশমিক ৯ শতাংশ দর্শকপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলোর ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র যে-একটি শিল্পমাধ্যম, চলচ্চিত্রের যে-নিজস্ব একটি ভাষা আছে তার পরিপন্থি। সে-কারণেই আমার বক্তব্য হচ্ছে, চলচ্চিত্র নিয়ে দর্শকের কাছে যাওয়াটা যতোটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রটির চলচ্চিত্র হয়ে ওঠা, ভালো চলচ্চিত্র হওয়া। দর্শক পছন্দ করছে, দর্শক মাদকদ্রব্যও পছন্দ করে, কিছু জনসাধারণ দুর্নীতিও পছন্দ করে; জনসাধারণ অনেক কিছু পছন্দ করে, ইভটিজিং পছন্দ করে, একটু মাস্তান হওয়া পছন্দ করে বা নিজের আধিপত্য বিস্তার পছন্দ করে; তো সেই ধরনের কিছু চলচ্চিত্র তারা পছন্দ করবে। আমার মনে হয়, অনেক চলচ্চিত্র এই সমস্ত পরিবেশ বা এই সমস্ত বাজে অনুষঙ্গগুলোকে উৎসাহিত করে। আমাদের সামাজিক যে-অবক্ষয় দর্শক অনুযায়ী যেভাবে ঘটছে চলচ্চিত্রের অবক্ষয়টা ঠিক সেভাবে ঘটছে। হয়তো আমাদের সামাজিক অবক্ষয়টা আমাদের চলচ্চিত্রের অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করছে অথবা আমাদের চলচ্চিত্রের অবক্ষয়টা আমাদের সামাজিক অবক্ষয়কে ত্বরান্বিত করছে। যদিও চলচ্চিত্র অতো শক্তিশালী মাধ্যম না, যে-সমাজে প্যারালালি অবস্থান করবে বা অনেক বেশি প্রভাবিত করবে। কিন্তু অনেক অনুষঙ্গের মধ্যে চলচ্চিত্র একটি অনুষঙ্গ হতে পারে বা টেলিভিশন একটি অনুষঙ্গ হতে পারে; যেটা সমাজকে ক্রমাবনতির দিকে কিংবা ক্রমান্নোতির দিকে নিয়ে যেতে পারে।

সাইয়ীদ : আচ্ছা ইনি লিখেছেন ফারুক ইমন। আপনি কি মনে করছেন, আপনার চিন্তায়, আপনি দর্শককে নিয়ে আসবেন? আপনার রূপান্তর চলচ্চিত্রটি আমি দেখেছি। আমার সঙ্গে এক প্রকার যোগাযোগ হয়েছে। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি, সিনেমা বিষয়ে আগ্রহ আছে। তাই হয়তো হয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, যে-দেশের ৬০ ভাগ মানুষ প্রায় নিরক্ষর, সেখানে চলচ্চিত্র থেকে কেনো আপনি তাদের বঞ্চিত করবেন। তাদের জন্য সিনেমাটা কীরূপ হবে, আপনার মানে চলচ্চিত্রকারের দায়টা কী?

একটি চলচ্চিত্র কিন্তু কখনই ১০০ ভাগ লোকের কাছে যেতে পারবে না। এটা সম্ভব না। হ্যাঁ, উৎকৃষ্টমানের চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যেও কিন্তু অনেক ডিবেট থাকবে। তা না হলে আপনি একবার ঋত্বিক কুমার ঘটক একবার বার্গম্যানকে জোচ্চর বলেছিলেন বা অমুক দার্শনিক অমুক দার্শনিককে নাকচ করে দিলো। তাই না? দুই জনেই কিন্তু অনেক মেধাবী। অ্যাঁ, অনেক শিল্পী অমুক শিল্পীকে নাকচ করে দিলো। সুতরাং খুব উৎকৃষ্টকর্মও কিন্তু সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে। এখন আপামর জনসাধারণের ক্ষেত্রে যে-কথাটা বলা হচ্ছে, সে-ক্ষেত্রে আপামর জনসাধারণ যদি অনেক বেশি চলচ্চিত্রের কাছে যেতো বা অনেক বেশি রসটা আস্বাদন করতে পারতো, এটাতো খুবই ভালো খবর হতো। কিন্তু একটা বিষয় কী যে, তাদের পক্ষে তো পিকাসোর ছবিগুলো দেখা সম্ভব হচ্ছে না বা অনেকের বই পড়া সম্ভব হচ্ছে না, অনেক মিউজিকের কাছে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। চলচ্চিত্রকেই কেনো সবার কাছে যেতে হবে?

তবে যেহেতু চলচ্চিত্রের এটা বড়ো ক্ষমতা, এটি সবার কাছে যেতে পারে। তবে সে-ক্ষেত্রে আমি মনে করি, শৈল্পিক বিবেচনায় উচ্চমার্গীয় কর্মই শুধুমাত্র হতে থাকবে, সেটাই হতে পারলে খুবই ভালো হতো, দর্শকরা সেখানে চলে আসতো। কিন্তু পাশাপাশি এ-রকম কিছু হতেই পারে, যা নির্ভেজাল বিনোদনের কাজ। কিন্তু আমার আপত্তিটা হচ্ছে নির্ভেজাল বিনোদনের নামে আস্তে আস্তে যদি এটার অবনতি ঘটতে থাকে; অর্থাৎ আপনি দেখবেন এক সময় নায়ক-নায়িকা গান গাইতো, নাচতো; ঠিক ওটা নাচ ছিলো না, হাতটা উঁচু করতো এ-রকম ইত্যাদি ইত্যাদি। এরপরে হয়তো দেখা গেলো যে, হঠাৎ করে ক্যাবারে একটি ড্যান্স শুরু হয়ে গেলো। এরপর নায়ক-নায়িকারাই নাচানাচি শুরু করলো। তারপর পোশাকটা ছোট হতে থাকলো। মানে অন্য সময় ঠিক আছে, কিন্তু এই যে, দর্শক-সাধারণ মানুষের কাছে যেতে হবে। সুতরাং আমাকে এইভাবে সাজাতে হবে। এই কারণে আমাকে গল্পটার মধ্যে একটা বীভৎসতা আনতে হবে, রক্তের বন্যা বয়ে দিতে হবে।

অ্যাঁ, মানুষের-মানে তার মধ্যে এই যে-খুনোখুনি, এটাকে সহনীয় করে তুলতে হবে। এইভাবে আমি সাধারণের কাছে যেতে চাই না। এটা আল্টিমেটলি আমাদের টোটাল সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য বিরাট ক্ষতিকর। আমি তো আবারও মনে করি, আমাদের মানবিক গুণাবলির ই টা কমে যাচ্ছে। তার পিছনে এই সমস্ত মিডিয়া একটা বড়ো রকম ভূমিকা বলবো না, সবাই যে-খুব উদ্দেশ্যমূলকভাবে করে তাও না। এরা অতোটা মেধাবীও না বা কোনো নীল নকশা, তাও না। অবচেতন মনেও অনেক সময় করে বা কিছু পুঁজি বা কিছু ইনকামের জন্যও করে। কিন্তু এর একটা প্রভাব আছে। সুতরাং দর্শকের কাছে থাকতে হবে। এটা সত্য কিন্তু কীভাবে থাকতে হবে, সেটা একটা চমৎকার একটা গ্রহণযোগ্য আঙ্গিক বা গ্রহণযোগ্য বিষয়বস্তু, কনটেন্ট। এটাকে আমি সেন্সর বলবো না, কিন্তু সেলফ সেন্সর বলবো, যিনি করবেন তার মধ্যেই থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।

সাইয়ীদ : আরেকজন প্রশ্ন করেছেন, নাম যারিফ অয়ন। চলচ্চিত্র মাধ্যমটিতো ব্যয়বহুল। সে-ক্ষেত্রে বাণিজ্যিক ছবির ধারা ভেঙে নতুন ধারা নির্মাণের জন্য আর্থিক দিকটা কী হতে পারে?

দেখুন, ইরানের সব ছবি আমরা দেখিনি, হ্যাঁ। কিন্তু আমরা যতোগুলো ছবি দেখলাম তাতে কিন্তু এই সমস্ত বিষয়গুলো দরকার হয়নি। যা আমরা যদি এইরকম আবহ তৈরি করতে পারতাম, চলচ্চিত্রটা হচ্ছে এইরকম। আমি যখন বা আপনি যখন সূর্যদীঘল বাড়ী দেখছেন বা আপনি যখন পথের পাঁচালী দেখছেন বা আপনি যখন ইয়ের, তারকোভস্কির কোনো ছবি আপনিতো সেটাতে আনন্দই পাচ্ছেন। সেটাতো আপনার মধ্যে বিনোদনই দিচ্ছে। সেইখান থেকেতো আপনি রস আস্বাদন করতে পারছেন। তা আরেকজন হয়তো পাচ্ছে না, তো অতোটা না যেটা এর আগে বললাম।

হ্যাঁ, মোটামুটিভাবে যদি একটু যে-গ্রহণযোগ্যতার মধ্য দিয়ে চলচ্চিত্রটাকে সবার মধ্যে গ্রহণযোগ্য করে বলা যায় এটিই আমাদের চলচ্চিত্র। তাহলে বাণিজ্যের কোনো সমস্যা হওয়ার কথা না। কিন্তু বাণিজ্যের নাম দিয়ে এই যে-দর্শককে খাওয়াতে হবে সেই কারণে যেভাবে যা করছে তা কিন্তু টিকলো না, শেষ পর্যন্ত কিন্তু বিপর্যয়ই হলো। কিন্তু এটা যদি বুদ্ধিদীপ্তভাবে, বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে এগিয়ে চলতো, তাহলে বাণিজ্যটাও রক্ষা হতো এবং চলচ্চিত্র শিল্পটাও রক্ষা হতো। পাশাপাশি আমাদেরকে এই যে-উদ্যোগটা ফিল্ম সোসাইটির উদ্যোগ, এই যে-আপনাদের উদ্যোগ ভিন্নভাবে, সেখান থেকে দর্শকদের মধ্যে চলচ্চিত্র বোধটাকে আরও বিকশিত করা যেতো।

সাইয়ীদ : এটা হচ্ছে সাইফ, নাট্যকলা বিভাগ। আচ্ছা, জগতের দশ দিকে মন ছুটতেই পারে। সবার মনকে বাঁধবার দায়িত্ব না নিয়ে মনকে অনুপ্রাণিত করার মতো সিনেমা নির্মাণ করতে চাই। নিজেকে কীভাবে তৈরি করা উচিত?

মানে মনকে? অ্যাঁ, আমি একটু, আরেকটু বিশ্লেষণ চাচ্ছি।

সাইফ (দাঁড়িয়ে) : বলতে চাচ্ছি যে, ভালো খারাপ সবকিছুই হবে। কিন্তু আমার ভালোটা এতো ভালো করবো যে, ওরা আমার থেকে  শিখবে, ওরা খারাপ করছে।

সাইয়ীদ : না, এখন আপনি শুধু চলচ্চিত্র নির্মাণ করলেই যে-হবে তা না। আপনার মধ্যে যদি আপনার একটা ধারা থাকে, আপনার মধ্যে যদি নিজস্ব চলচ্চিত্র ভাবনা-সেটা আঙ্গিকগত, বিষয়বস্তুগত উভয়দিক থেকেই থাকে, সেটা হতেই পারে। কিন্তু সবাই আপনার দিকে ছুটবে, আপনি কি দর্শকের কথা বলছেন, না আরও অন্য নির্মাতাদের কথা বলছেন?

সাইফ : দর্শক বা আরও যারা আছে।

সাইয়ীদ : মানে আরও যারা ইয়ে আছেন। আসলে হয় কী, এটা আপনি যে-কথাটা বলছেন এটা অনেক বড়ো কথা তো। আমি আল্টিমেটলি, একজন দিকনির্দেশক বা আমি একজন আদর্শ হিসেবে নিজেকে ঠিক করবো। আমার মনে হয়, এখানে নিজের দায়টা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এখানে আমি যে-কথাটা বলবো বা আপনার শিক্ষকরা যে-কথাটা বলবেন বা বই থেকে আপনি সেটা পড়বেন, সেটা থেকে কিন্তু আপনি একটা ধারণা নেবেন মাত্র। সেখান থেকে কিন্তু সিদ্ধান্তটা আপনাকেই নিতে হবে। আপনি যদি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাটা অর্জন করেন, আমি যা বললাম আপনি শুনে রাখলেন, আপনার টিচার যা বললো আপনি শুনে রাখলেন, কিন্তু এখান থেকে বাছাই করার দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। এবং সেটার মধ্য দিয়েই আপনি নিজেকে তৈরি করতে পারেন। তাহলেই আমার মনে হয় সম্ভব।

আপনি একটা ধারা তৈরি করতে পারেন। কিন্তু আমার কথা এটা আপনার খুব একটা কাজে আসবে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে যেটা মনে করি, আমি অতোটা ই-না যে, আমার অনুসারী হবে অনেকেই। এই ক্ষমতাটা আমার নাই বা সেই চমকটাও আমার মধ্যে নাই। আপনি দেখবেন যারা খুব মহৎ, ধর্মীয় দিক থেকেই বলেন, কবিতার দিক থেকেই বলেন, তারা কিন্তু খুব বেশি প্রভাবিত ছিলেন তা না। তাদের নিজেকে নিজের সৃষ্টি করতে হয়েছে। আপনি নিজেকে নিয়েই ভাবেন কীভাবে এটা হতে পারে।

সাইয়ীদ : আচ্ছা, এখানে মোহাম্মদ আলী মানিক বলছেন, তাহলে একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা কোন্ ধরনের দর্শকের ওপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন?

এখানে আমার একটু বক্তব্যটা হচ্ছে কী, আমি মনে করি, একজন কবির যেমন উচিত না কোন্ শ্রেণির পাঠকের জন্য উনি কবিতা লিখবেন এটা ভাবা। হতে পারে, কখনও হতে পারে না-তা নয়। একটা রাজনৈতিক আন্দোলন হচ্ছে, উনি ওই আন্দোলনকে উদ্দীপ্ত করতে একটা কবিতা লিখতেই পারেন। কিন্তু কবিতা লেখা হচ্ছে তার অনুভূতি দিয়ে। চলচ্চিত্রের একজন স্বাধীন ভাবনার স্বাধীন শিল্পী নিজের মতো করে কাজ করবেন, দর্শকের কথা যখনই ভাবতে হবে তখনই আমার মনে হয় বা অন্যকিছু যখন ভাবতে হবে, তখনই কম্প্রোমাইজটা চলে আসে। আমি টাকার কথা ভাবতে গেলে তখন কম্প্রোমাইজটা চলে আসবে। আমার সামাজিকতার কথা ভাবলে যেমন কম্প্রোমাইজটা চলে আসবে। এটা নির্ভর করবে একান্তই ওই নির্মাতার ওপরে।

কেউ যদি মনে করেন, আমি একজন পপুলার নির্মাতা হবো। সেটা আসলে তার ক্যারিয়ারের বিষয়। আমি আমাকে কীভাবে দেখতে চাই। আমার সামাজিক অবস্থানটা বা চলচ্চিত্রে আমার অবস্থানটা কী! কিন্তু আমি একজন নির্মাতা, তখন আমার মনে হয়, উনি সমস্ত কিছুরই বাহিরে। কারণ, এখানে অনেকেই আছেন যারা লেখালেখি করেন। যখন একজন লেখেন তখন তো উনি বোধ হয় সমস্ত পৃথিবীকে নিয়েই লিখছেন না। তার মধ্যে তো অন্য একটা কোনো কিছু ক্রিয়া করে। এখন এটা মেটাফিজিক্যাল কোনো একটা বিষয় কি না জানি না। যদি সত্যিই ওই রকম কিছু বিষয় থেকে থাকে তাহলে একটা লেখকের সঙ্গেই আসলে এটার যোগাযোগটা বেশি। কারণ, ওই মুহূর্তের অনুভূতিটাতো পারিপার্শ্বিকতা না।

মোট কথা, আমি নিজেকে কোথায় দেখতে চাই, নিজের সাফল্য কীভাবে পেতে চাই। আমাকে অনেকে দেখলে আমার অটোগ্রাফ নেবে বা নিজের জনপ্রিয়তা বা আমি অমুক ফেস্টিভ্যালে যাবো, তখন বোঝাপড়ার বিষয়টা মনে হয় তৈরি হবে। আর কোন্ ধরনের দর্শকের জন্য কাজ করবেন এটা একান্তই আপনার। আপনি কোন্ ধরনের দর্শক নির্মাণ করতে চান।

সাইয়ীদ : (আরেকটি প্রশ্ন হাতে নিয়ে) দর্শক চলচ্চিত্র না দেখলে বা হল বিমুখ বলে হল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, নির্মাতারা তখন বাধ্য হয়ে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সিনেমার ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার করছে। এতে করে কি চলচ্চিত্র তার শিল্পের জায়গায় থাকতে পারবে?

এটা অবশ্য ঠিক যে, চলচ্চিত্র বা অমুক হল বন্ধ হয়ে যাওয়া; তবে এই শিল্পের ক্ষেত্রে, এই শিল্পকে যদি আর্ট বলি তবে এর সঙ্গে কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে খুব একটা সম্পর্ক নাই। কারণটা হচ্ছে যে, আমরা যদি আগের ছবিগুলো দেখি-জহির রায়হানের কখনও আসেনি ছবিটা কিন্তু তেমন একটা চলেনি। তার সবচেয়ে ভালো ছবির মধ্যে একটা বলা চলে এটি। সূর্যদীঘল বাড়ী চলেনি, হলে যায়নি ওই অর্থে, নাটোরে রিলিজ পেতো। তারপরে পরবর্তী পর্যায়ে অনেক ছবির ক্ষেত্রে এ-রকম ঘটনা ঘটেছে। সুতরাং শিল্পের ক্ষেত্রে খুবই দুর্ভাগ্যজনক।

শুধু মানে বাংলাদেশে না, ওই ওটা, কী বলে কর্ণটকের একজন চলচ্চিত্রনির্মাতা আছেন আপনারা তার নাম জানতে পারেন গ্রিস কাসালা, কেরালার একজন খুব বড়ো ডিরেক্টর উনিও এর আগে কথা হলো উনার একটা ছবির মাত্র দুটো প্রিন্ট। একটা সাবটাইটেল করা দেশের বাইরের জন্য। আরেকটা প্রিন্ট করে রিলিজ করার চেষ্টা করছেন, তাও সুবিধা করতে পারছেন না। তো সুতরাং সেদিক থেকে মানে দুর্ভাগ্য যে-দর্শক হলের কাছে বা দর্শকের কাছে এক ধরনের শক্ড বা যাই বলেন না কেনো আর্ট ফিল্মগুলো যেতে পারছে না। আর কমার্শিয়াল শিল্পের ক্ষেত্রে বললে তখন অবশ্যই এটা অন্যভাবে চিন্তা করতে হবে। তো সেই ধারাটা থাকলে ভালো কি না-থাকলে ভালো-সেটা একটা বড়ো আলোচনার বিষয়। আর একটা হচ্ছে, যেভাবে আছে সেভাবে থাকার পক্ষে আমি না, তাতে যদি হল বন্ধ হয়ে যায় যাক। পৃথিবীতে অনেক মাধ্যম হয়তো আসতে পারতো, আসেনি। টমাস আলভা এডিসন বা লুমিয়ার ব্রাদার্স এরা যদি কোনোভাবে জন্ম না নিতো হয়তো ফিল্মই আসতো না। হয়তো এমনও হতে পারে যে, হিংটিংছট নামে একটা মাধ্যম আসার কথা ছিলো পৃথিবীতে; কিন্তু ঘটনাক্রমে আসেনি। সুতরাং এটা হতেই পারে। এখন আসেনি, আবার আসবে।

পারভেজ : (প্রশ্নকারী দাঁড়িয়ে) স্যার! প্রশ্ন আমি করেছিলাম। আমি আরেকটু বলতে চাই।

সাইয়ীদ : হ্যাঁ বলো।

পারভেজ : আপনি শিল্পের বিষয়টা তাগিদ দিচ্ছেন, সে-ক্ষেত্রে যদি ওই রকম হল বন্ধ হয়ে যায় সেটা যদি ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার করে, আপনাকে হয়তোবা তাদের সঙ্গে একটা নিগোসিয়েশনে যেতে হতে পারে। ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার নামে সেটাতো পণ্য হয়ে যাচ্ছে। আপনি এই বাণিজ্যিক ধারার সিনেমাকে পণ্য বলছেন, তাহলে সেটাও তো পণ্য হয়ে যাচ্ছে। ওই জায়গায় শিল্পের চেয়ে...

সাইয়ীদ : আমি বুঝতে পারছি, আমি একটু বলি, আমার ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে। আমার প্রযোজিত তিনটে ছবির কথা বলি বাঁশি, রূপান্তর এবং অপেক্ষা; হলে চলেই না, দুই সপ্তাহ তিন সপ্তাহ চালানোই খুব দায়।  রাজশাহীতেও এসেছিলো অপেক্ষা। হলের থেকে তো টাকা পাওয়া দূরের কথা, পরে হল মালিককে আমার দেওয়া উচিত ছিলো। যাই হোক উনি নেননি। এই অবস্থা। কিন্তু কোনো ছবিই আমার ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার করিনি। আমি ওদের বিশ্বাস করি না। আমি আমার মতো করে দর্শককে হয়তো প্রজেক্টর এনে দেখাতেও পারবো না। কিন্তু তেমন একটা কম্প্রোমাইজ করি না। আরও পাঁচ বছর, দুবছর যাবে, আমাকে যেনো কম্প্রোমাইজ না করতে হয়। এখন এই বয়সে এসেতো বাস্তবতার মুখোমুখি হয়ে গেছি; টেলিভিশন প্রোডাকশন করতে হবে জীবিকার জন্য অথবা বিজ্ঞাপনে যেতে হবে অথবা অনেক কিছু শর্ত মেনে সিনেমা করতে হবে। সেটা যেনো না করতে হয়।

আমি সাম্প্রতিককালে মার্চ থেকে খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন করতে ব্যবসায় নিজেকে নিয়োজিত রাখছি। সেটা ফুড প্রোডাকশন। যেটা বগুড়াতে ফ্যাক্টরি, আমি প্রেসারে আছি। ১৬ তারিখ থেকে প্রোডাকশনে যাবো। কারণ, আমার কাছে চলচ্চিত্র পবিত্র জায়গা। ফিল্ম হচ্ছে আমার স্বপ্নের, আমার পবিত্র জায়গা। আমি এইখানে ভালো ছবি হয়তো করতে পারছি না। সেই কোয়ালিটি হয়তো আমার নাই। তবে এটাকে আমি কোনোক্রমেই সচেতনভাবে কলুষিত করতে চাই না। তাতে আমি না খেয়ে থাকলেও। প্রয়োজনে আমি অন্যদিকে চলে যাবো। আমি যদি ওই তিনটা ছবির ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার করতাম অ্যাট লিস্ট পাঁচ থেকে ১০ লাখ টাকা বেশি পেতাম। কিন্তু আমি যেটা চাই না, আমি সেটাতে যাই না। এটা আসলে সবার নিজের জায়গা থেকে খুব দৃঢ় হতে হয়।

পারভেজ : অনেকে তো যাচ্ছে।

সাইয়ীদ : এখন অনেকে যাচ্ছে ঠিক আছে। এখন সেটাকে ভাবতে হবে অনেকে যাচ্ছেন বলেই তো এ-অবস্থা আমাদের। আমার অনেক কিছুই, মানে ঘটনা ঘটছে বলেই ধরেন আমার তো খুব যে-সাকসেস আছে, তা না। কিন্তু তারপরেও আমার কম নাই। ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে, ইন্টারন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড পাওয়ার ক্ষেত্রে। তারপরও আমি কন্টিনিউ করতে পারছি না। আবার আমার চাইতে অনেক কম সাফল্যেও অনেক কিছু করতে পারছে অনেকেই। তাদের ঢাকায় ফ্ল্যাট আছে, অনেক কিছু আছে। আমার কিন্তু কিচ্ছু নাই ঢাকায়। একটা গাড়ি থাকা ছাড়া। গাড়িটা রাখতেও হয় একটাই কারণে যে-ঢাকাতে খুব প্রবলেম হয়, এটা ছাড়া। আমি গ্রামে আমার কিছু সঞ্চয় দিয়ে একটা কালচারাল সেন্টার করবো। ঠিক আছে, এটা আসলে একটা মানুষের মাইন্ডসেট আমি কী করবো?

কোনো অধ্যাপক চাইলে লাখ লাখ টাকা ইনকাম করতে পারেন। কোনো অধ্যাপক এখনও রিকশায় চড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এটা তার ওপর নির্ভর করবে। সেক্রিফাইস, এখন বলতে পারেন এতো লোক সেক্রিফাইস করলো, এখন তো সেক্রিফাইস করার প্রবণতা কম, বর্তমানে তো আরও কম। ভবিষ্যতে কী হবে? কিন্তু এর মধ্য দিয়েই যেতে হবে, যার যার জায়গা থেকে। আমি এখনও ব্যক্তি সেক্রিফাইসের পক্ষে। রাষ্ট্রীয়ভাবে বা সামাজিকভাবে পরিবর্তন হবে তারপরে আমি সেই পরিবর্তনে অংশ নেবো, সেটা আমাদের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। যারা কমার্শিয়াল ছবি বানায় তাদের গুণগত পরিবর্তনটা করাতে হবে। তাদের ছবিগুলোর কী অবস্থা, সেই মান্ধাতা আমলের। তাদের অভিনয়গুলো এখনও দেখেন, তাদের টার্মগুলো দেখেন, চিত্রায়ণ দেখেন। সেটা তো আমার জায়গা না।

শরৎচন্দ্র, এখানে হুমায়ূন আহমেদও উপন্যাস লিখতেন একরকম; তারপরে হাসান আজিজুল হক, উনি ছোট গল্প লিখতেন। যার যার মতো করে লিখতেন। শরৎচন্দ্রের ক্ষেত্রে এক ধরনের ছিলো, রবীন্দ্রনাথের লেখার ধরন একরকম ছিলো। তাই আমারটা আমার। আমার ছবি সবাই দেখছে, সেটা আমার চেয়ে বেশি কেউ খুশি হবে না। আমি পরিচালক হিসেবে বেশি খুশি হবো, প্রযোজক হিসেবেও। কিন্তু আমার অসুবিধাটা হচ্ছে, যে-শর্তগুলো মানলে ছবি দর্শকরা দেখবে সেই শর্তটা মানা আমার পক্ষে সম্ভব না। ওই শর্ত আমি অনেক জায়গায় মানতে পারি না। মানলে হয়তো আমি আরও দু-চারটা ছবি করতে পারতাম। কিন্তু আমি সেটা চাই না।

সাইয়ীদ : প্রশ্নটি করেছেন ব্যবস্থাপনা বিভাগের হৃদয়। বেদের মেয়ে জোছনা এতো জনপ্রিয় হলো কেনো? কীভাবে এতো দর্শকপ্রিয়তা পেলো?

না, এটা আসলে পুরনো ব্যাপার, সে-জন্যেই তো অনেক দর্শকপ্রিয় হয়েছে। এ-কিন্তু হঠাৎ ঘটনাও বলা চলে। কারণ, এই ছবির প্রযোজক এবং পরিচালক পরে আরও অনেক অনেক ছবি তৈরি করেছে। কিন্তু এই দর্শকপ্রিয়তাটা পায়নি। কোথায় যে-একটা মিলে যাওয়ার ব্যাপারটা ঘটে গেছে। এই ছবির মধ্যে এমন কোনো জিনিসও ছিলো না বা এমন কোনো নতুন টেকনোলজি বা স্টোরি ঘটনা বা অন্য কোনো দিক থেকে সম্পূর্ণ আলাদা বা খুবই পরিকল্পনা করে, তা কিন্তু হয়নি। প্রথমে এই ছবি দেখানোর জন্য খুব কম টাকার অফার করা হয়েছিলো। বগুড়াতে ৬০ হাজার টাকা দিতে চেয়েছিলো, পরে তারাই তিন লাখ না চার লাখ টাকায় নিয়েছে। এটা ঘটে গেছে। এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা। এটার সঙ্গে আর কোনো ঘটনার তুলনা চলবে কি না সন্দেহ। এখনও দুই একটা চলচ্চিত্র এমন হয়। এই তো আর কোনো।

কাজী মামুন হায়দার : স্যার (সেলিম রেজা নিউটনকে দেখিয়ে) কথা বলবেন একটু।

সেলিম রেজা নিউটন : প্রশ্ন না, আমি কিছু পর্যবেক্ষণের কথা বলবো। যে-গুলো আপনার কথার সূত্র ধরে এসেছে। আজ যে-কথা হলো আমাদের চলচ্চিত্র আলোচনায় তো বটেই, অন্যান্য এলাকাতেও ঘুরে ফিরেই আসে। আমি ঠিক প্রশ্ন না করলাম, ঠিক উত্তর চাচ্ছি, তাও না। আপনি যা বলবেন, সেটা আমাদের সবাইকে আলোকিত করবে। আমি একটু এলোমেলো করে মোবাইলে লিখেছিলাম। মোবাইল থেকে মুছে গেলো। আমি শুধু ছোট ছোট করে কমেন্ট করবো। একটু এলোমেলোভাবে। ঘুরে ফিরে শিল্প আর অ-শিল্প এ-রকম মুখোমুখি দুইটা বাইনারি ক্যাটাগরি আমাদের সামনে এসে হাজির হয়। একদিকে শিল্প আরেক দিকে অ-শিল্প। মানুষ কি শিল্পবোধহীন হয়? শিল্পবোধহীন মানুষ। এ-রকম যদি হয়-কিছু লোক শিল্পসম্পন্ন থাকে আর কিছু  লোক শিল্পবোধহীন হয়, তাহলে তো কিছু লোক উন্নত, কিছু লোক অনুন্নত। তাহলে তো ফ্যাসিবাদ জায়েজ হয়। অনুন্নত লোকদের এতো বেশি থাকার দরকার কী? মানুষের কোনো কাজে আসে না। শিল্প তাহলে কী? আসলে এই প্রশ্নটাও ঘুরেফিরে আসতে চায়। মানে আমরা সারাক্ষণই শিল্পের কথা বলছি, সাইয়ীদ ভাইয়ের কথা বলছি না শুধু।

আমার কাছে রবীন্দ্রনাথের পরে, মানে এ-ক্ষেত্রে কিন্তু উনি কাজ এবং আনন্দ এই বইটা দিয়ে সাহিত্যকে বোঝাচ্ছেন। তো উনি বলছিলেন যে, যেটা আনন্দ, ভালো, যেটা ভালো লাগে সেগুলোই হচ্ছে শিল্প-সাহিত্য। আর যেটা করতে হবে, কর্তব্য; যেটা না করলে অন্যদের সমস্যা হবে, সেটা হচ্ছে কাজ।

সেটা আনন্দ, গল্পও না, সাহিত্যও না। আমি নিজে যখন নিজের ওপরে কাজ চাপাই তা আনন্দই লাগে। না, কিন্তু ওইখানে যে-অর্থেই থাকুক, কাজের কথা বলছিলেন, আমি সেটাকে মেলাই ইন্ডাস্ট্রিয়াল। কাজ নামক ধারণাটাই একটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল ধারণা। এটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল গ্রুপের ধারণা। এই অর্থে কাজের ধারণা আগে ছিলো না। শিল্প তাহলে যেটা অকারণ। অকারণ কৌতূহলের কাজ জড়িত কোনো তাৎপর্য। কৌতূহল তাৎপর্য কোনো বিশেষ কারণসিদ্ধতা, প্রশ্নসন্ধিৎসা, অনুসন্ধিৎসা, কৌতূহল এগুলো হুদাই মানুষের মনের মধ্যে আসে। এগুলো দিয়েই আমার ধারণা শিল্পের যোগাযোগ। তার মানে যেটা সাইয়ীদ ভাইয়ের আলোচনার আগাগোড়ায় ছিলো। খুব ভালো লাগলো আমার তার আলোচনার মূল সুরটা; মূল সুরটা খুব পরিষ্কার, খুবই স্পষ্ট। আমার কাছে খুবই স্পষ্ট এবং সেটা আমার জন্য খুবই আনন্দদায়ক ছিলো। সেটা আমি এভাবে বুঝলাম যে, এ-ভাষায় সাইয়ীদ ভাই একা কথা বলেননি। কিন্তু আমি এভাবেই বুঝলাম জিনিসটা যে, শিল্পের জন্যই আসলে শিল্প। পুরনো একটি স্লোগান আছে। তা এটা আমাদের মাঝখানে ১৯২০, ৩০, ৪০, ৫০, ৬০, ৭০, ৮০র দশক ধরে ৮০ পর্যন্ত, অ্যাট লিস্ট শিল্পকে তার দায়িত্ব পালন করতে হবে। এটা সমাজের জন্য হতে হবে এটা এর পিছে কিছু কোচকাছা থাকতে হবে। তা-তাছাড়া বুর্জোয়া-টুর্জোয়া হেনতেন, কিন্তু অ্যাকচ্যুয়ালি শিল্প শিল্পের জন্যই। শিল্প শিল্পের জন্যই এই স্লোগানটা আবার আমাদের ভয় পাওয়ায়ে দেয় অনেককে। এটা এ-জন্য যে, এটাকে অনেকে লিবারাল একটা অ্যাপ্রোচ মনে করে।


প্রশ্নোত্তরপর্বে অধ্যাপক সেলিম রেজা নিউটন


আমি এটুকু মনে করায়ে দিতে চাই, এটা অ্যাকচ্যুয়ালি একটা অ্যানার্কিক অ্যাপ্রোচ। সেই এইটটি সেঞ্চুরির আমাদের সেই কবি, খুব বিখ্যাত এক আইরিশ কবি, নাম মনে করতে পারছি না। তারই পয়েন্ট করা কথা এটা, আর্ট করা বাক্য। তার মানে শিল্প তার নিজের জন্যই হয়। যদি ফুল ফোটে, তাহলে ফুলের গন্ধ ছড়ায়। মানুষ শুনতে পায়, শুঁকতে পায়, টের পায়। আরেকটা কি যে, শিল্পের ঘাড়ে যদি কাজ চাপায় যেটা সাইয়ীদ ভাই বলছিলো বলেই আমি বক্তব্যের সঙ্গে যোগ করছি। আমাদের কখনই এই শিল্পের ঘাড়ে কাজ চাপিয়ে বা কোনো কমিউনিকেশনের ঘাড়ে কাজ চাপায়া...। আ-আমি তো কথা শুনতে পাচ্ছি।

সাইয়ীদ : কি অন্যরা শুনতে পাচ্ছে না?

নিউটন : আচ্ছা, শিল্প বা যে-কোনো যোগাযোগের ঘাড়ে যদি আমরা কাজ চাপাই, এটা-এটা আবার ইন্ডাস্ট্রিয়াল মার্কেটেবল, এটা ইন্ডাস্ট্রিয়াল মার্কেটেবল, ন্যাচারাল মার্কেটেবল। তখন হয় কী, তার কাছ থেকে আমি কিছু ফল আশা করি। এটার ফলে এটা ঘটবে, কিছু ইমপ্যাক্ট আমাদের যোগাযোগ সাহিত্যে, যোগাযোগ কর্মকাণ্ডে, যোগাযোগ শাস্ত্রের, এই ইমপ্যাক্ট নিয়ে, যোগাযোগের যাবতীয় ধরনের, ম্যাস কমিউনিকেশনের ইমপ্যাক্ট নিয়ে প্রচুর প্যাচাল-ক্যাচাল রয়েছে। এগুলোতে মোট যেটা জানা গেলো সেটা হলো, আমরা কখনই কোনো এজেন্সির মাধ্যমে ইমপ্যাক্ট মিজারড করতে পারি না, মাপতে পারি না-কী ইমপ্যাক্ট করছে। এটা কমন সেন্সতো বলে ইমপ্যাক্ট আমরা মাপতে পারি না। পুরনো লোকেরা তারা এই আর্টিকেল অনেক আগেই জেনেছে; আমাদের সোশ্যাল সাইনটিস্ট অ্যাপ্রোচ ছাড়াই। সেটা ধরুন গীতা কর্মযোগ। যে-কাজ হলো, সে-কাজ করে যাওয়া। যেটা নিজের মনে হয়, সেটা করে যাওয়া। এর ফল কী ঘটবে-সেটা আশা না করা, প্রত্যাশা না করা। সেটা যা ফল ঘটার সেটা তো ঘটবেই। সেটা যে-আমরা বুঝে ফেলতে পারবো, মাপ করতে পারবো, পরিমাপ করে জানতে পারবো তা কখনই হয় না।

আরেকটা বিষয় প্রায় আসে-নতুন চলচ্চিত্র, নতুন ধারার চলচ্চিত্র। এটা অন্য ফিল্ডেও আসে, নতুন ধারার রাজনীতি, নতুন ধারার সাহিত্য, নতুন ধারার প্রবৃদ্ধি-এসব ক্ষেত্রে এই জিনিসটা হয়। মানে সবসময় একটা নতুন কিছু আসতে হবে। এই ধারণাটাও খেয়াল করি, এটা-এটা আমাদের কালচারাল ইন্ডাস্ট্রি এবং অন্যান্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল মার্কেটের ডিমান্ড। একই প্রোডাক্ট মার্কেটে বেশিদিন চলে না; মানুষ ক্লান্ত হয়ে যায়। প্রোডাক্টকে কোনো না কোনোভাবে নতুন নতুন ধরনের ব্যাপার দিতে হয়। এটা একটা বোগাস আইডিয়া, আসলে পুরাতন বলে কোনো কিছু আছে? পুরাতনটা কী জিনিস? চির নতুন, চির পুরাতন এটা তো পুরাতন কথা। নতুন কথাও থাকতে পারে। যদি সেটাকে ইমপ্যাক্ট করে জানানো যায়।

আর ফাইলটার সঙ্গে ডিফারই করবো আমি-অশ্লীলতা, পতিতা নারীর ক্ষেত্রে বিশেষ করে হিন্দি সিনেমার নাচে। এমনকি বাংলা সিনেমায়ও, হিন্দি সিনেমার জুনিয়র পার্টনার বা হিন্দি সিনেমার মাইনর পার্টনার হিসেবে নাচানো। ক্রাইম, এটাকে সাইয়ীদ ভাই ক্রাইমই বলে ফেললেন। এই জায়গাটাতো খটকাতেই পড়ে যেতে হচ্ছে। সঙ্গে মাদক, পর্নো, মাস্তানি এগুলোর সঙ্গে বিপরীত দিক থেকে শিল্পকে দেখা। অশ্লীলতার বিপরীতে মাদক বা পর্নো, মাস্তানি; ক্রাইম এর বিপরীতে পতিতার বিপরীতে উচ্চতা বা উচ্চ অবস্থিতাকেও। এই ধারণাগুলো খুব বাইনারি ধারণা। এটা সাদা বনাম কালো, ইয়েস বনাম নো, জিরো বনাম ওয়ান বা কম্পিউটারের ভাষায় এ-রকম হয়। বাস্তব এ-রকম না, আসলে বাস্তব এ-রকম না। আর আমি প্রচুর দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই। আমি যখন খুব অল্প বয়সেই হিন্দি সিনেমার নাচের, বাংলা সিনেমার নায়িকাদের, হংকং এর সিনেমার যৌনদৃশ্যের পাল্লায় পড়ে গিয়েছিলাম। তখন আমি খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে যাই যে-এরা কী বলতে চায়, কী বলতে চায়, কী বলতে চায়? এরা কিছু বলতে চায়, আমার কাছে মনে হচ্ছিলো। সেটা হিন্দি সিনেমার নাচের বেলায় এসে আরও এমন একটা রূপ ধারণ করলো, যেটা আনঅ্যাভোয়েডঅ্যাবল কোশ্চেন ছিলো; এটা এতো পাওয়ারফুলি প্রেজেন্টেড, এতো পাওয়ারফুলি যে-এর একটা উত্তর পেতে হবে। এটা কিছুতেই আমাকে ছাড়লো না। এখনও যে-আমি এর উত্তর জানি তা না। কিন্তু আমার একটা দিক থেকে অন্তত মনে হয়, আমরা খেয়াল করি না ।

আমাদের তন্ত্র সাহিত্য ভারতবর্ষের সবচেয়ে পুরনো সাহিত্য। এমনকি বেদের চাইতে পুরনো। দাবিটা আমার কাছে ন্যায্যই মনে হয়। এখন সেগুলো নিয়ে কথা বলার সুযোগ নাই। তন্ত্র সাহিত্য সেই প্রাচীনতম আমলেই খেয়াল করছে যে-যৌনতাকে, যৌনতাকে আমরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করবো। সমাজে এবং নরনারীর ক্ষেত্রে যে-কোনো যৌন প্রসঙ্গ, এক্সপ্রেশন এটাকে আমরা নিষিদ্ধ, পাপ হিসেবে ঘোষণা করছি। শাস্ত্রীয় ধর্ম যেটা মানে, যেটা শাসক-শ্রেণির ধর্ম, যেটা যাজকদের ধর্ম। ধর্ম বাই বর্ন-যাজকদের না, শাস্ত্রীয় না, শাসকদের না। কিন্তু পরে এটা শাসকদের এবং যাজকদের পাল্লায় পড়ে চার্চ এবং মোল্লা, পুরোহিত, ঠাকুর, ব্রাহ্মণ এবং রাজাদের যৌথ প্রযোজনায় নির্মিত হয়-যেটাকে আমরা ধর্ম বলে চিনি। কিন্তু ওটা আসলে শাস্ত্রীয় ধর্ম, মানে শাস্ত্রধর্ম। তো যাবতীয় শাস্ত্রধর্ম। তারা কিন্তু নারী, নরকের দাস। যৌনতা হচ্ছে পাপ এইভাবে একদম দ্বিধা-দ্বন্দ্বহীনভাবে চিহ্নিত করছে। এটা আমাদের মনের মধ্যে প্রচ- প্রভাব ফেলেছে, এটা একটা খুব স্ট্রং সোশ্যাল ট্রেনিংয়ের মধ্য দিয়ে, একটা খুব ভয়ঙ্কর মাত্রার সামাজিক নিয়ন্ত্রণ এবং অবদমনের মধ্য দিয়ে আমরা বড়ো হয়ে উঠি। যৌনতাকে পাপ বলে মনে করতে থাকি। কিন্তু তন্ত্র মনে করে, আমিও মনে করি, নিজের আক্কেল থেকে মনে করি আগে, পরে তন্ত্রের সঙ্গে মিললো। এমতাবস্থায় যৌনতা আসলে আমাদের জননের সঙ্গে জড়িত, জন্মের সঙ্গে জড়িত, এটা প্রজননের সঙ্গে জড়িত। সমস্ত প্রজাতির ক্ষেত্রে বংশবিস্তার, পৃথিবীতে টিকে থাকা, অস্তিত্বমান থাকা এর সঙ্গে যৌনতা জড়িত। এতো ভাইটাল এটা, এটাকেই তন্ত্র ভাইটাল ফোর্স মনে করে। যৌন শক্তিকে প্রাণশক্তি বলে।

প্রজনন শক্তিকে বলে প্রাণশক্তি, বীজ, মানুষের বীজাণু। তো এই যে-এটা গত কয়েক হাজার বছর ধরে ব্যান্ড (নিষিদ্ধ) হয়ে থাকলো। খাজরাহোতে ব্যান্ড ছিলো না, পুরনো অনেক কিছুতেই এটা ব্যান্ড ছিলো না। কামসূত্রেও এটা ব্যান্ড ছিলো না। কিন্তু এটা যে-ব্যান্ড হয়ে গেলো, একেবারে নিষিদ্ধ হয়ে গেলো এবং পাপ হয়ে গেলো। এইটা কীভাবে আত্মপ্রকাশ করবে ও নিজের থেকে আবার এতো এতো শক্তিশালী প্রাণশক্তি যে-আমাকেও ছাড়ে না। সবচেয়ে বড়ো হুজুর, মুজুর, পুরুত ঠাকুরকেও জায়গামতো কাত করে ফেলে দেয়, অ্যাঁ। ৩০ বছর, ৪০ বছর ধরে যোগ সাধনা করে পরার খোঁচায় পিছলা খায়, মাথা ফেটে যায়; এতো পাওয়ারফুল ব্যাপার। কিন্তু সেটা অনুচিত নয় এবং নিষিদ্ধ প্রসঙ্গ। ও-তো আত্মপ্রকাশ করবেই ও আছেই। ইট ইজ অলঅয়েজ দেয়ার, ভিয়ার। তো আত্মপ্রকাশের যখন আপনি কোনো পথ রাখেন না, তখন তা ওই দুই নম্বরি রাস্তা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে; চিপাচাপা দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। যেটাকে আমি কোট-আনকোট দুই নম্বরি এবং কোট-আনকোট চিপাচাপা বললাম। এটা একটা সাবভারসিভ অ্যাক্টিভিটিস বা গেরিলা অ্যাক্টিভিটিস। যারা বানাচ্ছেন তারাও জানেন না হয়তো, আমার তাই মনে হয়। প্রকৃতি প্রজননকে এতো পাওয়ারফুলি সেট করেছে আমাদের ইটবিল্ড ফেকালিজম এর মধ্যে।

আমাদের অনেকে খুব ভালো করে জানে না, মস্তিষ্ক চলে কীভাবে? আমাদের এই মুহূর্তে কী চাই? আসলে আমরা খুব ভালো করে জানি না। এটা তো মানতে আমাদের গরিমায় লাগে। এটা নিতান্তই সাধারণ সত্য। তো আমি হিন্দি ছবিকে, যাবতীয় ম্যাস মিডিয়াতে যৌনতার অভিপ্রকাশকে, এইরকম একটা জায়গা থেকে দেখি। একমাত্র এই জায়গা থেকে দেখি তা না। তবে এটা একটা বিবেচনা করার মতো জায়গা। আরও নিশ্চয় অনেক ব্যাপার আছে এর মধ্যে। আমি এখনও স্যাটিসফাইড না, আরও উত্তর দরকার আমার। এই যে-এরই সঙ্গে যুক্ত প্রসঙ্গ, তাহলে কি সাধারণ মানুষ পর্নো পছন্দ করে? সাধারণ মানুষ কি ছোট পোশাকধারী? তারা কি ছোট পোশাকের নায়ক-নায়িকা দেখতে পছন্দ করে? এই সাধারণ মানুষের ঘাড়ের ওপর যে-চাপাচ্ছি, জেনারেলি এটা কেমন ব্যাপার আসলে? সাধারণ মানুষ কি ভায়োলেন্স পছন্দ করে? খুন-খারাবি, প্রচুর রক্ত পছন্দ করে? না, একেবারেই না। ছোটবেলা থেকেই দেখছি-রক্ত দেখলেই সুস্থ মানুষ মাথা ঘুরে পড়ে যায়। হ্যাঁ, শক্তিশালী কোনো লোক, কারো মাথা ফেটে গেলে সে-ঘাবড়ে যায়, আপসেট হয়ে যায়। এটাকে পছন্দ করে না। কিন্তু সিনেমার বেলায় মানুষ এটা গিলছে। এটার অন্য কোনো ধরনের কারণ-টারণ খুঁজতে হবে। এগুলো লক্ষণ; মিডিয়ার নিজের লক্ষণ।

এই অভিপ্রকাশগুলো লক্ষণ, এইগুলো রোগ না। এইগুলো কারণ না, এগুলো লক্ষণ। কারণ খুঁজতে হবে আমাদেরকে, রোগটা খুঁজতে হবে। রোগটা আপাতত অনেকখানি শনাক্ত করাই যায় সহজভাবে। সেটা হলো পুঁজি। পুঁজি শব্দটা বাংলায় খুব মজাই। এটা পুঁজ থেকে এসেছে। পুঁজ মানে বাড়তি জিনিস, যেটা উদ্বৃত্ত। মার্কসও দেখিয়েছে উদ্বৃত্ত শব্দ থেকেই পুঁজি আসে। পুঁজটা শরীরের উদ্বৃত্ত, এটা অ্যাবসেস। অ্যাবসেসের সঙ্গেও শব্দসূত্রে ইংরেজিতেও নানাভাবে পুঁজি এবং মুনাফার যোগাযোগ আছে। কলিম খান তার আলোচনায় দেখিয়েছেন অনেকবার। সমস্যাটা পুঁজির; তখন পুঁজি মানে কী? আবার আমরা মার্কসের কাছে শিখলাম পুঁজি মানে হলো মৃত-শ্রম; মৃত-শ্রম, টেকনোলজি এবং সম্পত্তি। এটা অতীতের লোকদের কাছ থেকে আবার জোর করে কেড়ে নেওয়া বা বেআইনিসূত্রে আমার হাতে এসে হাজির হওয়া।

এই যে-অতীতের মানুষের শ্রম আমি আত্মসাৎ করছি, টেকনোলজি আকারে, নলেজ আকারে, সম্পত্তি আকারে-এটাই হচ্ছে পুঁজি, আদি অ্যাকিউমুলেশনাল। তো এই পুঁজি, মৃত-শ্রম যখন জীবিত-শ্রমের ওপর আধিপত্য করে, যেটার নাম পুঁজিবাদ। আর জীবিত-শ্রম মানে জীবিত-মানুষ। তখন সমাজে নানান ধরনের রোগব্যাধি দেখা দেয়। এ-সমস্ত রোগব্যাধির লক্ষণগুলো নিয়ে আমি বিচলিত হই, রোগব্যাধিগুলো পর্যন্ত তাকাই না ঠিক।

আরেকটা বিষয়ে বলি, শেষে আবার সাইয়ীদ ভাই বলেছেন চমৎকারভাবে, কবি-সাহিত্যিকরা যখন লেখেন তখন তাদের উপর কী যেনো একটা ভর করে। হ্যাঁ, উনি একটু ইউফেস্টিক্যালি মানে একটু নরম করে ভদ্রভাষায় বললেন মেটাফিজিক্যাল, একটা কোনো ব্যাপার-ট্যাপার ঘটে হয়তো। এই দ্বিধাটাকে আমি নিতে পারলাম না। যেভাবেই হোক, মানুষতো মেটাফিজিক্যাল প্রাণী। মানুষ কবিতা লেখার সময়ও মেটাফিজিক্যাল, মানুষ সঙ্গম করার সময়ও মেটাফিজিক্যাল। মানুষ স্পিরিচ্যুয়াল প্রাণী, মেটাফিজিক্যাল প্রাণী। এটা ফিজিক্যাল না শুধু, এর ফিজিক্যাল অ্যাসপেক্টগুলো খুবই স্থূল এবং ফিজিক্যাল অ্যাসপেক্টগুলোই আমাদের অত্যন্ত অজানা। মেটাফিজিক্যাল ব্যাপারগুলোকে সাহস করে, তাকে স্বীকার করে, তার সামনে দাঁড়াতে পারার যে-মুহূর্ত; মানে, নিজের সামনে নিজে দাঁড়ানোর যে-একান্ত নির্জন মুহূর্ত, ওটিই হলো শিল্পের মুহূর্ত, ওটাই শিল্প সৃষ্টির প্রাক-মুহূর্ত।

শিল্পবোধ, তাহলে দেখেন গর্ব কেনো করি। এটা একটা বাইনারি ম্যাস ক্যাটাগরি। শিল্পবোধ মানে ট্রেনিং। আপনাকে সিনেমার বেলায় কতোগুলো পরিচালকের নাম জানতে হবে। কতোগুলো টেকনিক্যাল ল্যাংগুয়েজ জানতে হবে, জারগন জানতে হবে। এগুলোর ভাষায় যদি কথা বলতে পারেন, তাহলেই বোঝা যাবে আপনি চলচ্চিত্রবিষয়ক শিল্পবোধসম্পন্ন একটা মানুষ। কবিতার বেলায়ও একই কথাগুলো প্রযোজ্য। কতোগুলো টার্মস, কতোগুলো নাম, নেইম্স জানতে হবে। এটি একটি বাইনারি ক্যাটাগরি, ট্রেনিং এবং বিশিষ্ট ক্যাটাগরি। শিল্প তা না। এটা একান্তই আসমানি। নিতান্তই গায়েবি, নিতান্তই মেটাফিজিক্যাল, নিতান্তই অজানা, নিতান্তই-একান্তই নিজের মতো করে একেবারে একা আবিষ্কার করা। যে-কথা সাইয়ীদ ভাই আজকে আলোচনার আগাগোড়ায় বলতে থাকলেন। সেটা আমি শুরুতে বলেছি, দুর্দান্তভাবে। তো এই যে-নির্জনতা, একাকীত্ব, এই যে-হেরা গুহায় বারো বছর বসে থাকা, এই যে-হিমালয়ের গুহার মধ্যে চল্লিশ বছর পার করে দেওয়া, এটা যে-কতোজন পারে! সংসারে বসেও হতে পারে এটা। আমাদের ইয়ে, এই যে-ইয়ে সিলেটের, না কিশোরগঞ্জের ওই দিককার যে-আমাদের ওই দিককার যে-ফোকগান গায়, জালাল খাঁ। জালাল খাঁ কি সিলেটের? না, সিলেট না।

সাইয়ীদ : না, নেত্রকোনার।

নিউটন : নেত্রকোনার। জালালের গানেও আছে সংসারের মধ্যে থেকে, মদ না খেয়ে মাতাল হয়ে থাকা যায়। এই যে-মাতাল হয়ে থাকা। এই মাতালত্ব, সরাব, পেয়ালা, সাগী এর সঙ্গে অশ্লীলতা, অপরাধ, ক্রাইম এগুলো যায় না। এগুলোর সঙ্গে আর্টের যোগাযোগ আছে। আমি এই মুহূর্তে একটা বইয়ের কাজ শেষ করলাম। এমএন রায় এবং অ্যানার্কি; নয়া মানবতাবাদ ও নৈরাজ্য। সেদিন মলাটে এক ছেলের, ছেলে বলছি, ২৮ বছর বয়সে মারা গেছে। সেটাও মারা গেছে ৮৮ সালে। এতো দিনে ভূত হয়ে গেছে। তার নাম বাসকুইট। ওর বাপ মনে হয় হাইতিয়ান। হাইতির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী-টন্ত্রী ছিলেন, মিনিস্ট্রি অব ইন্টিরিয়র। মা পোয়েট্রেরিকান ব্ল্যাক, জাত ব্ল্যাক, বড়ো হয়েছে আমেরিকাতে। আমেরিকার স্ট্রিট আর্টিস্ট হিসেবে বড়ো হয়েছে। সে-বিখ্যাত হয়ে উঠেছে গ্রাফিক্সের জন্য, মানে দেয়ালে চিকা মারার জন্য; আমরা সেটাকে চিকামারা বলি, দেয়ালে স্প্রে দিয়ে ছবি আঁকার জন্য। এমন জায়গায় সে-যায় অচিরেই অতি অল্প বয়সের মধ্যে যে-বড়ো বড়ো শিল্প-পত্রিকায় বড়ো বড়ো মেইনস্ট্রিম পত্রিকায় তাকে নিয়ে কাভার স্টোরি হতে থাকে। আর সে-চানাচুর, কলা ফুটপাতে বেচে বেচে জীবনধারণ করতে থাকে। এবং ড্রাগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সে-মারা যায় ভায়োলেন্টলি। হেরোইন এবং কোকেন এক সঙ্গে খাওয়ার যে-একটা ইনোভেশন, একটা, একটা এক্সপেরিমেন্ট করতে গিয়ে; দীর্ঘদিন ধরেই তিনি এক্সপেরিমেন্ট-টা করছিলেন।

জ্যা জ জিন মিশেল বাসকেট, পোয়েট্রিকান ভাষায়। এটাকে স্প্যানিসে দেখলাম বাসকুয়াত বলে, এটাকে বাসকিয়াতও বলে। তো এই ছেলেটাকে আপনি কী বলবেন! হেরোইন, কোকেন মিশায়ে খেতে খেতে গুবলেট হয়ে যায়; সে-হচ্ছে নিউ এক্সপ্রেশনিস্ট আর্টের আজকের যুগের, নিউ এক্সপ্রেশনিস্ট আর্টের গুরু। সে-মারা যাবার পর তার একটা ছবি বিক্রি হয় ১৫ মিলিয়ন ডলারে। শিল্প নিয়ে গণ-ক্যাটাগরির আলাপ না করে, সাইয়ীদ ভাইয়ের পথ ধরেই আমি হাঁটতে চাই। সেটা হচ্ছে নিজের জায়গা, নিজের সঙ্গে নিজের মুখোমুখি দাঁড়ানোর জায়গা। সাইয়ীদ ভাইয়ের দুর্দান্ত আলোচনার জন্য আমি খুবই ধন্যবাদ জানাচ্ছি এবং শুরুতেই বলেছিলাম বাহুল্যবিহীন, আমি বাহুল্য স্প্রে করলাম, এজন্য নিরুপায়। সবাইকে ধন্যবাদ। (দর্শক-শ্রোতাদের হাততালি)

সাইয়ীদ : যা হোক চমৎকার আলোচনা করলেন নিউটন ভাই। যদিও এর আগে যখন আতিক এসেছিলো সেখানেও বোধহয় একটা অংশ ছিলো নিউটন ভাইয়ের; উনি বোধহয় তখন মঞ্চে এসেই বলেছিলেন এ-রকম একটা বিষয়, বোধহয় ওইভাবেই ছিলো। আমার পরে মনে হলো, কারণ উনি যা বললেন সেটাও একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা। তা আর কোনো প্র্রশ্ন নেই, শুধুমাত্র দুই-তিনটা জায়গায় দ্বিমত। তো অবশ্যই এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ দ্বিমত। যৌনতা বা অশ্লীলতার এই যে-বিষয়টা। কিন্তু হ্যাঁ, এটা কিন্তু নিউটন ভাইয়ের কথার মধ্য দিয়ে এসেছে। দুই নম্বরি রাস্তায় এটি প্রকাশ করা এবং এটা মানুষের খুবই সহজাত প্রবৃত্তি বা এটা আটকে রাখার দিকে তথাকথিত নৈতিকতার কারণেই হোক, সামাজিকতার কারণেই হোক, আবার অন্যদিকে মানুষের এই প্রবণতাকে অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। আমিও কিন্তু ওই একটা কথাই বলতে চাচ্ছিলাম। যদি যৌনতা নিয়ে কর্ম হোক, সেটার কোনো অসুবিধা নেই। যৌনতা নিয়ে, কিন্তু এই যে যাত্রায়, আজকে যেমন যাত্রা শিল্পটা কীভাবে ধ্বংস হলো, যাত্রা এক সময় একটি পালা, একটি পূর্ণাঙ্গ নাটক, পূর্ণাঙ্গ গল্প, পূর্ণাঙ্গ ঘটনা এটি হতো। একটা পর্যায়ে কী যে-হলো ওই দর্শকের ক্ষেত্রে; আমি মানি প্রত্যেকটা মানুষই শিল্পবোধসম্পন্ন। একজন শিশু থেকে বেড়ে ওঠা এবং যেহেতু নিউটন ভাইয়ের শিশু আছে নিশ্চয়ই তার বেড়ে ওঠার মধ্য দিয়ে একটা মানুষের শিল্পের বিকাশটা উনি বুঝতে পারেন।

হ্যাঁ, কিন্তু আমি সেটা বলছি যে, যাত্রার সময় যে-ঘটনাটা ঘটলো, কোথায় গিয়ে দর্শকের মনোরঞ্জনের জন্য দুই অঙ্কের অবকাশে, পাঁচ অঙ্কের অবকাশে, একটি করে নৃত্য শুরু হলো আর কী। একটা পর্যায়ে ক্রমে গিয়ে প্রতি অঙ্কের পর পর এই নাচ শুরু হলো, যার সঙ্গে ওই পালার কোনো সম্পর্ক নেই। কখনও হিন্দি, কখনও চটুল গান বা কখনও বিশেষভাবে রচিত গানগুলো দিয়ে শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে, এখন পর্যায় নাকি এ-রকম দাঁড়িয়েছে যে, পালা শুরু হলে দর্শক হইচই শুরু করে, নাচ হলেই খুশি হয়। তা আমাদের এই অঞ্চলের চলচ্চিত্রে এই যে-নাচের যে-ব্যবহারটা, গানের যে-ব্যবহারটা, এটা চলচ্চিত্রের ক্ষতি করছে। আস্তে আস্তে কোথায় গিয়েছে গানের আইটেমগুলো। গান নিয়ে এতো ঘটনা আইটেম সঙে, অমুক অতিথি, অমুক গেস্ট-আর্টিস্ট, এটা আসছে, সেটা আসছে, কোনো সিকোয়েন্সের মধ্যে কিন্তু এক্সপেক্টটা সীমাবদ্ধ থাকছে না।

আল্টিমেটলি ওই বিতর্ক একটা বড়ো বিতর্ক। হ্যাঁ, যৌনতা বা মেটাফিজিক্যাল বা ইত্যাদি ইত্যাদি এটা আলোচনা আসলে তো দীর্ঘ ব্যাপার। আর এ-ব্যাপারে আমি খুব দক্ষ মানুষও না। সাম্প্রতিককালে, ইদানিং হঠাৎ করে, এ-বিষয়ে আমি প্রথমেই বলেছি, আমার একটা পর্যায় গেছে একবারেই শূন্য। পড়াশোনা যে-মানুষের জন্য জরুরি এটা আমি জানতামই না। যখন জানলাম তখন আর পড়াশোনার কোনো বয়স, পড়াশোনার জন্য উপযুক্ত সময় নাই। এ-রকমও ঘটনা ঘটেছে। এটা আসলে এটা লেখা জরুরি কি না জানি না। যে-মাঝখানে বছর দেড়-দুয়েক আগে, কয়েক মাস একটু দর্শন পড়ার মধ্যে একটা হঠাৎ আগ্রহ তৈরি হলো। কয়েক মাস আমি কোনো কাজ করতাম না, শুধু পড়তাম। তাতেই গিয়ে দাঁড়ালো কী যে-একদিন আমার ছেলে, মানে আমি তিন তলায় থাকি ভাড়া, দোতলায় আমার আব্বা-আম্মা থাকে। তো ও অনেকটা মুরগির মাংস নিয়ে এসেছে। তো আমার স্ত্রী ফোন করেছে মা এতো মুরগির মাংস দিলেন, ও (ছেলে অনিন্দ্য) এসে বললো, বাবার হাতে তো টাকা-পয়সা নেই, মাংস কিনতে পারছে না, তুমি  আমাকে একটু মাংস দাও। ও কিন্তু প্রতিদিনেই মাংস খায়, কোনো না কোনো বাড়ি থেকে আসে; আমার ছোট বোনের বাড়ি থেকে। আক্ষরিক অর্থে ওই দুই মাস কোনো মাংস কেনার সামর্থ্য আমার ছিলো না। কারণ যেহেতু আমি এতো বেশি সমস্ত কাজকর্ম বাদ দিয়ে পড়াশোনার মধ্যে পড়ে আছি, আমি দেখলাম যে-এটা আমার পক্ষে, খুব মানে এই সময় এসে এটা করার কোনো মানে হয় না।

যাই হোক, আমি নিউটন ভাইয়ের ওই জ্ঞানের ইয়ের মধ্যে আমি নিজেকে ইয়ে করতে চাইনি। কিন্তু আমার দৃষ্টিভঙ্গিটা ছিলো, কোথায় গিয়ে এই যে-মানুষের এই প্রবৃত্তি বা এই প্রবণতা বা সত্য, এই শাশ্বত সত্যটাকে কেউ পুঁজি করার চেষ্টা করছে, ব্যবসা করার চেষ্টা করছে-এখানেই হচ্ছে আমার আপত্তি। মানুষের মধ্যে একটা হিংস্রতা থাকে। হ্যাঁ, এখন ধরেন কিছুদিন আগেই একটা কোরবানি, ফেইসবুকেই বোধহয় দেখলাম, একটা পশু হত্যার মধ্য দিয়ে আমরা পশুত্বই করছি আর কি! তারপরও প্রাণীকে হত্যা করছি কি না জানি না, সেটা অন্য প্রসঙ্গ। তো যেটা হয়, মানুষের মধ্যেও কোথায় গিয়ে একটা হিংস্রতা, একটা প্রতিহিংসা অন্তর্নিহিত একটা প্রাণী হিসেবে থাকে। এখন এটা অবদমন করা উচিত কি অনুচিত, কতোটা স্বাধীনতা থাকা উচিত কি অনুচিত সেটা একটা বির্তকের বিষয়।

যেমন একটা বিষয় আমার কাছে মনে হয়েছে, নিউটন ভাই দেখি সাবজেক্ট দর্শনের বিষয় এনেছেন। আমরা যদি বিভিন্ন ঐতিহাসিক চলন দেখি, অনেক উত্থান-পতন, মত-ভিন্নমত দেখতে পাব। সোফিস্টরা, অনেকটা বহুত্ব, নৈতিকতা দিয়ে কিছুকে আবদ্ধ না করা ইত্যাদি ব্যাখ্যা-ট্যাখ্যা ছিলো। পাশাপাশি প্লেটো-এরিস্টটলদের আবদ্ধ করার একটা প্রবণতা ছিলো। তখন কিন্তু জনগণকে শাসন করার জন্য প্লেটো-এরিস্টটলদের ভাবনাধারা রাষ্ট্রযন্ত্রের জন্য সহায়ক ছিলো। মানুষকে যতো আটকে রাখা যায়, বিভিন্ন রকম সামাজিক নিয়ম কানুনে ততোই যেনো বশে রাখা যায়। হয়তো সেই সময়ের বাস্তবতায় তা জরুরিও হতে পারে। আজকের রিয়ালিটিতে আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে-যতো বেশি মানুষকে অনৈতিক করা যাবে, যতো বেশি মানুষের মধ্যে বিভেদ করা যাবে, যতো বেশি দার্শনিক তত্ত্ব আসবে, যতো বেশি আপেক্ষিকতা শব্দটি ইস্টাবলিশ হবে; ততো বেশি যারা শোষক শ্রেণি-সেটা একজন শিল্পপতিই হোক বা সেটা একজন করপোরেটওয়ালারাই হোক বা রাজনীতিবিদ, তাদের জন্য সুবিধা হবে। আমার কাছে মনে হচ্ছে এ-সমস্ত কর্মকাণ্ডগুলো মানুষকে যতো বেশি বিভ্রান্ত করা যায়, এই ফিল্ম বা মিডিয়ার মধ্য দিয়ে বা অন্যকিছু দিয়ে, মানুষকে যতো বেশি বিভেদের মধ্যে নিয়ে যাওয়া যায়, ততোই বোধহয় এ-কাজে সুবিধা হয়। সেখানেই এই অনুষঙ্গগুলো একটা ভূমিকা পালন করে।

কাজী মামুন হায়দার : স্যার বোধহয় আরেকটু বলতে চাচ্ছেন। 

নিউটন : আপনি যদি অনুমতি দেন। আলোচনা পণ্ড হয়ে যায় কি না, বুঝতে পারছি না। (কথা উপস্থাপক ও দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশ করে) খুব বিব্রত করছি কি? আমি নিজেও বিব্রতবোধ করছি।

সাইয়ীদ : না না, আমি বিব্রত হচ্ছি না।

নিউটন : আপনাকে তো পাই না বা এ-রকম কাউকে বলার সুযোগ তো পাই না। আচ্ছা খুব ফ্রাংকলি, ফ্রেন্ডলি, আমি আপনার মূল টোনের সঙ্গেই আছি, একেবারেই পুরোপুরি। আপনি বললেন, যৌনতা ব্যাপারটা একসেপ্ট করলেন, একসেপ্ট না করারই বা কী আছে! যৌনতা ব্যাপারটা অন্যভাবে প্রকাশ হয়। আপনি বলছেন, এটাকেই কেউ পুঁজি করে, তা করবেই তো, করবে না কেনো, একে পুঁজি করতে হিম্মত লাগে, অনেক সাহস লাগে। আমি ইতিবাচক দিক থেকে কি এটাকে দেখার চেষ্টা করতে পারি না? দেখতেই হবে এটা বলছি না।

সাইয়ীদ : না না, এর চেয়েতো অনেক বেশি হিম্মত লাগে, আমি যখন একটা লোকের জায়গা আমার নামে দলিল করে নিলাম যা উনি বিক্রি করেননি। এটাতে আরও বেশি হিম্মত লাগে।

নিউটন : হ্যাঁ লাগতে পারে।

সাইয়ীদ : তাই না? একজন স্মাগলার, মনে করেন এয়ারপোর্টে তার ইয়ের মধ্যে ওই লাগেজের মধ্যে ভরি ভরি সোনা নিয়ে আসছে। আমরা এতো দুর্বল চিত্তের মানুষ হঠাৎ যদি কোনো বাইরে থেকে একটা ক্যামেরা বা লেন্স নিয়ে আসি, এটাতে ঝামেলা হবে কি না ভাবতে থাকি। আর ওরা তো এটা নিয়ে (সোনা) আসে, তাতে আরও বেশি হিম্মত লাগে না? একজন পলিটিশিয়ান এই দুই দিন আগেও তারা জেল-টেল খেটে কী কী হয়ে গেছে দুর্নীতির দায়ে। এখন দেখেন দুর্নীতি দ্বিগুণ হারে করছে। কতো সাহসের দরকার না, ও কিন্তু নিশ্চিত পরবর্তী পর্যায়ে ঝামেলা হবে-তা এটাতে হিম্মত লাগে না?

নিউটন : নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই; কেনো নয়!

সাইয়ীদ : একই সঙ্গে জড়িত সমস্ত হিম্মতওয়ালা, হিম্মতওয়ালিরাতো একই জায়গায় থাকে।

নিউটন : এগজ্যাক্টলি, আমি সেই জায়গাটাতেই বলছি। দেখেন, আমি কী বলছি সেটা হলো যে-পলিটিশিয়ানদের জন্য হিম্মত লাগে না। এটা একটু খেয়াল করতে হবে। পলিটিশিয়ানদের জন্য একটা সিস্টেমেটিক সাপোর্ট স্ট্রাকচার আছে। একটা সেফটিনেট আছে। তারা জানে তাদেরকে বাঁচাবে। যারা প্রফেশনাল স্মাগলার, তাদের একটা প্রফেশনাল সেফটিনেট আছে, তারা জানে তারা উদ্ধার পাবে। তারা জানে তারা ধরা পড়লেও সমস্যা নেই। হ্যাঁ, যে-কোনো কাজ করতেই হিম্মত লাগে, আর হিম্মত কোথায় কম, কোথায় বেশি লাগে-আমি সেটা বলছি না। যাবতীয় হিম্মতকে আমি পছন্দ করি। আলমগীর নামে একটা ছেলে ১৮ বছর বয়স তখন তার, চট্টগ্রামের মেয়র মহিউদ্দিনের প্রতিদ্বন্দ্বী মেয়র প্রার্থী, কে ছিলো জানি, বিএনপির?

সাইয়ীদ : এবার?

দেবাশীষ : মীর নাসির।

সাইয়ীদ : মীর নাসির।

নিউটন : মীর নাসির, মীর নাসিরের এলজি ক্যারি করছিলো সে। মীর নাসিরের জন্য, তার বাহিনীর জন্য সে-এলজি ক্যারি করছিলো। প্রতি ব্যাগের মধ্যে পাঁচ-ছয়টা করে এলজি ছিলো। একটা ব্যাগ ক্যারি করলে সারটেইন এমাউন্ট মানি পাওয়া যেতো। আলমগীর ধরা পড়লো, ধরা পড়ে। ও একেবারেই ছোট চ্যালা যেহেতু, ওর সেফটিনেট কাজ করলো না। তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলো, সে-জেলখানায় আমার (২০০৭ সালের ২৩ আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি বিক্ষোভের ঘটনায় অংশ নেওয়ার জন্য তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রোষে একটি মামলায় সেলিম রেজা নিউটনকে কারাগারে থাকতে হয়েছিলো-স.) ফালতু হিসেবে কাজ করলো। হি ইজ এ ওয়ান্ডারফুল গাই। ১৮ বছর বয়স থেকে তার ১২ বছর পার হয়ে গেছে জেলখানায়, সে-এখনও যে-পরিমাণ শারীরিক শক্তি এবং সাহসের অধিকারী! জেলখানায় বি ক্লাস কয়েদি বলে একটা কথা আছে; বাংলাদেশের সব জেলখানায়। বি ক্লাস কয়েদি মানে এদের মতো ভয়ঙ্কর, উচ্ছৃঙ্খল, ভয়াবহ প্রাণী আর পৃথিবীতে নাই। কী রকম ভয়াবহ প্রাণী আমি আপনাদেরকে বলি যে, খাবার ঠিকমতো দেওয়া হয়নি বলে সে-কারাগারের একজন কর্মকর্তাকে ধরে ফেললো। ধরে ওখানে সেলের মধ্যে আটকে রাখলো। তাকে পানিসমেন্ট হিসেবে পরে ধরে চার-পাঁচজন মিলে পিটাচ্ছে আর সে-ন্যাঙটো হয়ে নাচছে, তিরিঙ-বিরিঙ করে গান করছে। হি ডাজ নট কেয়ার। দ্যাট ইজ লিবার্টি অব ম্যানকাইন্ড। দ্য ফায়ার অব লিবার্টি এক্সাইড এভরিম্যান। সে-কেনো আমাদের মতো আঙিনা ফ্যাশন দ্বারা এতো বেশি প্রশমিত হয়নি, এতো বেশি প্রশিক্ষিত হয়নি। যে-কারণে একটা ক্যামেরার লেন্স আনতে আমাদের বুক কাঁপে।

আমরা মনে করি, আমাদের মধ্যে পাপ-পুণ্যের আইনি ধারণা খুব প্রতিষ্ঠিত। পাপ-পুণ্যের আইনি ধারণা শাস্ত্রধর্ম থেকে এসেছে। এটা একই রকমের প্রতিশোধ-স্পৃহা থেকে এসেছে। কেউ খুন করলে তাকে পাল্টা খুন করে ফেলতে হবে বিচারকের মাধ্যমে, সরকারের মাধ্যমে, এটা তো আইনের মূলভিত্তি। কাজেই যাবতীয় হিম্মত ইমপোর্টেন্ট। স্মাগলিং ভেরি মাচ ইমপোর্টেন্ট। স্মাগলিং সেই জিনিস-এই দাউদরা, ডনরা, গডফাদাররা হলো সেই জিনিস, যারা মডার্ন স্টেটকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। যারা মডার্ন স্টেট মিশনারিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে। দাউদ বা ডন বা আর যাদের নাম আছে বা ইতালিয় মাফিয়া যে-গ্রুপ, তারা কিন্তু ক্রাইমের দিক থেকে রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে খুব এগিয়ে নাই। রাষ্ট্রগুলোর ক্রাইমের কাছে এরা নস্যি।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই-এর যে-ক্রাইম, গোয়েন্দা নামক বীরের যে-ক্রাইম, আবু গারিবের যে-ক্রাইম, সে-ক্রাইমের তুলনায় এ-সমস্ত বিরাট বিরাট দস্যুরা নিতান্তই নস্যি। কাজেই আপনি ঠিক জায়গাতেই ধরেছেন। কিন্তু জায়গাটা এ-রকম যে, ক্রাইম এবং ভালো কাজের পার্থক্যটা এতো সহজ না, এটা এতো সাদা এবং কালো না। আমি ক্রাইমকে ক্রাইম হিসেবে দেখি না। আমি জেলখানাতে প্রথম তিনদিন থাকলাম সেলের মধ্যে। আমার খুব সামান্য অভিজ্ঞতা। জেলের কথা বলছি, ক্রাইমের কথা এসেছে অবধারিতভাবে। সেখানে এই যে-আমাদের বাগমারায়, এই যে-বাংলাভাইয়ের সেকেন্ড ইন কমান্ড, ভদ্রলোকের নাম যেনো কী, মাহাতাব, মাহাতাব খাঁ। কী নাম ওর, মাহাতাবের পুরো নাম যেনো কী? মাহাতাব খামারু, মাহাতাব খামারু। তিন-চার দিন পরে দুই দিনের মাথায়, আমরা তিন দিন সেলে ছিলাম। পরে তো আমাদেরকে প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হলো, রাষ্ট্রের জামাই হিসেবে (দর্শকদের হাসি)। তো হলো যে-মাহতাব খামারুর সঙ্গে আট-নয় ঘণ্টা খুব একান্তে সময় কাটলো। খুবই একান্তে, হাত ধরে, বুকে বুক মিলিয়ে এবং তাকে আমি আমার চাইতে আলাদা কোনো মানুষ দেখলাম না। আমার চাইতে অনুন্নত তো না-ই, আমার চাইতে উন্নত মানুষ কি না আমার সে-রকমই সন্দেহ হতে থাকলো। শুনতে যেমনই লাগুক আমি স্ট্রেইট বলছি, আমি, দুলাল দা এবং মাহাতাব খামারু তিনজনে গলাগলি করে ঘণ্টাখানেক হাউমাউ করে কেঁদেছি। মাহাতাব খামারুর যে-হিস্ট্রি, রাষ্ট্রের দ্বারা ডিপ্রেসড হওয়া, সে-হিস্ট্রি যদি আপনি শোনেন, এটা বলার প্রতিভা আমার নাই। তার কয়েক মাসের মধ্যে তার কয়েক মাসের বাচ্চাকে নিয়ে, তার স্ত্রীসহকারে সারা বাংলাদেশ চেজ করা হয়েছে। বাচ্চাটাকে জিম্মি করে র‌্যাব করেছে টু, টু, টু ক্যাপচার মাহাতাব খামারু। দ্যাট ইজ স্টেট। আপনি জানেন সেন্ট অগাস্টিন বলেছিলেন, আমাদের নোম চমস্কি পরে সেখান থেকে গল্পটা তুলে আনলেন, পাইরেট অ্যান্ড ইমপাইরেট যে-সেই পাইরেট তাকে ধরে এনেছে আলেকজান্ডার। আলেকজান্ডার বলছে, তুমি কেনো দস্যুতা করো। আপনার তো জানা কাহিনী (সাইয়ীদ ভাইকে উদ্দেশ করে)। দস্যু বলছে, তুমিতো আমার চেয়ে বড়ো দস্যু। তুমি তোমার বিশাল দস্যুবাহিনী নিয়ে দুনিয়া লুটপাট করো। আমিতো একা একা চার-পাঁচজন লোক নিয়ে অল্পকিছু লুট করি। তো তোমার সঙ্গে আমার তফাৎ কী? এইটা হচ্ছে দস্যুর সঙ্গে সম্রাটের তফাৎ। দস্যুর দাপট, সম্রাটের সন্ত্রাস।

যাত্রার বেলায় যেমন বললেন, এ-রকম নাচটা ঢুকিয়ে দিচ্ছে, আইটেম সঙ্ হিন্দি গানে ঢুকছে। আমি এটাকে পজেটিভলি দেখার সুযোগ আছে বলে মনে করি। যৌনতাকে হাজির করার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ পৃথিবীতে খুব কম আছে। যৌনতা নিয়ে কথা বলার মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজ খুব কম আছে। স্মাগলিং-কিলিং, এর তুলনায় ছোট কাজ; এর তুলনায় অনেক কম মুশকিলের কাজ, কম ঝুঁকিপূর্ণ।

সাইয়ীদ : এ-প্রসঙ্গে একটু বলি।

নিউটন : জি, প্লিজ।

সাইয়ীদ : তো সে-ক্ষেত্রে যেমন ধরেন যে, মানে পতিতালয় বা মগবাজারের কিছু হোটেল। আপনি কোনটাকে বেশি গুরুত্ব দেন? একটা জাস্ট পর্দায় বা একটু রাখ-ঢাক করে যৌনতার উপস্থাপন বা সরাসরি যৌনকর্মের যে-ক্ষেত্রটা।

নিউটন : আমি কোনো মতামত দিই না। আমি কোনো রায় দিই না। আমি কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাই না। আমি আপনাকে বলেছি (সাইয়ীদ এর হাসি) আমি বুঝতে চাই, প্রশ্ন থ্রো করতে চাই। উত্তরের চাইতে প্রশ্ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সাইয়ীদ : না ঠিক আছে।

নিউটন : এতো প্রশ্নের কোনো একটা উত্তর নাই। সমস্ত প্রশ্নের কোনো একটা সঠিক উত্তর নাই এবং তুলনামূলক তথ্য নাই। হ্যাঁ, যাকে পতিতা বলছি সেটা, এগুলো আমার জন্য এখানে তোলা আরামদায়ক হচ্ছে না। রিস্ক হচ্ছে।

সাইয়ীদ : এটি এই কারণে গুরুত্বপূর্ণ যে, আপনি দেখেন রাখ-ঢাক করে যৌনতা উপস্থাপন যদি হিন্দি ছবিতে হয়...

নিউটন : বিবাহেও হয়।

সাইয়ীদ: বিবাহের প্রসঙ্গটা বাদে।

নিউটন : আইনসিদ্ধ বিবাহে, সম্মত বিবাহেও রাখ-ঢাক যৌনতা হয়। অনেক বেশি করে হয়।

সাইয়ীদ : এই প্রসঙ্গটা ব্যক্তি জীবনে, আপাতত বাদই দিলাম। এটা একটা হচ্ছে...। তারপরে ধরেন যে, আমি সরাসরি যৌনতা অবলম্বন করার জন্য পর্নো ছবি দেখতে পাচ্ছি। আর সরাসরি যৌনতায় অংশগ্রহণের জন্য আমি পতিতালয়ে যেতে পারছি। আমি যদি এই সামাজিকতার বাইরে মানে এই তিনটা জায়গায়; এইটার ক্ষেত্রে আপনার কী মনে হয়, কোনটাকে এপ্রিশিয়েট করা উচিত বেশি?

নিউটন : না, ঔচিত্যবোধ দ্বারা আমি পরিচালিত হই না। আমার ঔচিত্যবোধ, আপনার ঔচিত্যবোধ একরকম না।

সাইয়ীদ : আমি আপনাকে...

নিউটন : আমার ঔচিত্যবোধ এবং যে-মেয়েটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আপনার একটি সিনেমার সেই মেয়েটার মতো। সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, সে-অন্যরকম জীবনযাপন করে পয়সা আয় করবে। তার ঔচিত্যবোধ আর আমার ঔচিত্যবোধ এক না।

সাইয়ীদ : আচ্ছা। আমরা কিন্তু মেয়েদের বা নারীর জায়গা থেকে না, কারণ যা কিছু আলোচনা হচ্ছে এটা কিন্তু পুরুষের জায়গা থেকে।

নিউটন : হ্যাঁ।

সাইয়ীদ : কারণ এই যে-নারীদেরকে যেভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে, এটা কিন্তু পুরুষদের জন্যই করা হচ্ছে। মগবাজারের যে-হোটেলগুলো আছে সেটাও পুরুষদের জন্য। আর যে-ফিল্মগুলো হচ্ছে সেটা উভয়ের জন্য। থ্রি-এক্স বা ফাইভ-এক্স এগুলো উভয়ের জন্য। কিন্তু আমার কথা হচ্ছে, আমি একটি কথা মনে করি যে-ঠিক আছে, যার যার ক্ষেত্র তো আছে। এখন আমি একজন, আমি একটা পলিটিক্যাল প্লাটফরমে গিয়ে যদি বক্তব্য রাখতে চাই তাহলে সেটা অবশ্যই যে-কথা বলা হবে, তা অবশ্যই রাজনৈতিক হতে হবে। আমি যদি একটি থিয়েটারের কোনো ইয়েতে গিয়ে, একজন পলিটিশিয়ান হই, আমি যখন ওখানে যাবো তখন কিন্তু আমার থিয়েটারেই রূপ হওয়া উচিত। আমি থিয়েটারের কোনো কর্মশালা বা কোনো ইয়েতে আমি পলিটিশিয়ান হিসেবে আমার পলিটিক্সটা ইমপোজ করবো সেটা না। সেই ক্ষেত্রেই আমার কথাটা, ঠিক আছে যৌনতার জন্য বা ইয়ে হতে পারে। কিন্তু সেটা এইভাবে কেনো? এই যে-আপনি যে-বললেন যেটা সাধারণত ভুল, দুই নম্বরি রাস্তা। আমার আপত্তিটা হচ্ছে দুই নম্বরি রাস্তা দিয়ে কেনো? এক নম্বর রাস্তাটায় হাঁটলেই তো হয়ে যায়।

নিউটন : আপনি শুরু করেন।

সাইয়ীদ : এটাতো কেবল আমারই কাজ না।

নিউটন : যে অন্য দিক দিয়ে হাঁটছে, যে দিক দিয়ে হাঁটা উচিত, সেদিক দিয়ে আমাদের হাঁটলেই হলো।

সাইয়ীদ : সেটা আমি পারি না তো। প্রবলেমটা হয়ে গেছে আমিতো সেটা পারবো না। আপনি যদি মানে এই ডিরেকশন দেওয়ার অভিজ্ঞতাতো আমার নাই (হাসি)। যাদের ওই ডিরেকশন দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে তাদের বলা ভালো।

নিউটন : আমাদের নাই বলে, অন্যের যদি অর্ধেকও থাকে সেটাকে আমরা ব্লেম করতে পারি না।

সাইয়ীদ : সেটা ব্লেম করবো না তো।

নিউটন : আপনি সিদ্ধান্তে পৌঁছে গেছেন।

সাইয়ীদ : আমিতো বলছি, আমি তো একবারও বলিনি, যে ব্লু-ফিল্মগুলো হচ্ছে-এটাই হচ্ছে আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য দায়। আমি তো এটা বলিনি।

নিউটন : একটা সিদ্ধান্তে  কিছুক্ষণ আগে পৌঁছে গেছেন।

সাইয়ীদ : আমি তো বলিনি যে-এই চলচ্চিত্র যেগুলো ইয়েতে আসছে, এই যে-বিভিন্ন রকম প্রস্টিটিউট, পতিতালয় হচ্ছে, এগুলো আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য না। আমি বলছি যে-চলচ্চিত্রের মধ্যে এই যে-অপ্রয়োজনীয় কিছু অনুষঙ্গ বা বাড়াবাড়ি যেগুলো হচ্ছে সেটিই আসলে চলচ্চিত্রের জন্য দায়।

নিউটন : এই যে-আপনি রায় দিতে পারছেন এটি অপ্রয়োজনীয়, এটি বাড়াবাড়ি। আপনি কিছুক্ষণ আগে পরিষ্কার একটা রায় দিয়েছেন, এই ধরনের অ্যাক্টিভিটিস আমাদের চলচ্চিত্রের জন্য ক্ষতিকর।

সাইয়ীদ : আপনি যদিও সাদা-কালোর কথাটা বলছেন।

নিউটন : আপনি কিন্তু একেবারে ক্ষতিকর বলে পরিষ্কার মন্তব্য করছেন।

সাইয়ীদ : আপনি বলছেন ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট বলে কোনো কথা নাই। হ্যাঁ বা না-র মধ্য দিয়ে। সেটা হয়তো সত্য। আমি হয়তো কোনো কোনো বা অধিকাংশ ক্ষেত্রে আপনার সঙ্গে একমত হবো।

নিউটন : আমিও।

সাইয়ীদ : তারপরেও, তারপরেও আমাকে অবশ্যই কোনো না কোনো রায় দিতেই হবে। বিকজ আমি কিছু কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।

নিউটন : আপনার নিজের জন্য?

সাইয়ীদ : হতে পারে। শুধু আমি আমার জন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছি বা আমি আমার কথাতো বলতেই পারি। আমার সিদ্ধান্ত তো আমি জানাবোই। কেনো ৩০ বছরের পরেও গিয়ে আমার দোদুল্যমানতা থাকবে, এতো ডিটেইল বা সার্বক্ষণিক লেবেল-এ। আমি এটা বিশ্বাস করি না। আমি একটা কথা আমার কাছে এখনও মনে হয়, যেটা আমি একটু আগে বলেছি এবং আমি মনে করি এই যে-তথাকথিত বহুত্ব এবং উত্তরাধুনিকতা এটা আসলে আমার কাছে কেনো জানি মনে হয়, এই ধরনের কথাবার্তাগুলো আল্টিমেটলি এখনকার প্রক্রিয়াকে যা তা বেশি প্রলঙ করে। সিদ্ধান্ত নিবো না, যা আছে তাই ঠিক। ওটাই ঠিক ও খুন করলো ওরও নিশ্চয় একটা যুক্তি আছে। ও মারা গেলো ওরও একটা যুক্তি আছে। ওর বাবা দুঃখ কম পেলো, ওর বাবা বেশি দুঃখ পেলো, ওরও একটা যুক্তি আছে। হ্যাঁ, বিচারক রায় দিলো তারও যৌক্তিকতা আছে। আসামি পক্ষের যে-আইনজীবী তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে আসলো, বাট টাকা দিয়ে একটা রায় বিপক্ষে নিলো তারও একটা যুক্তি আছে। আমি এইভাবে দেখতে রাজি না।

নিউটন : আমিও দেখি না। আমি উত্তরাধুনিক না। আমি বিষয়টা বুঝি না বা বুঝতে চাইও না।

সাইয়ীদ : ঠিক আছে এটা উত্তরাধুনিকতা সম্পর্কিত কথা না। আমার কথা হচ্ছে এই বিষয়গুলো মনে হয় এভাবে না। ওইখানেও যৌনতা, এখানেও যৌনতা, যৌনতাকে এইভাবে দেখা। এখন যে-ভদ্রলোক যৌনতা নিয়ে বেশি লিখছে তার যৌনতাই হচ্ছে অ্যাবনরমাল। যৌনতা, এখন সেটা নিয়েও তো একটা প্রশ্ন আসতে পারে।

নিউটন : কেনো যৌনতাটা অ্যাবনরমাল, সেটা আমি এবং আপনি আমাদের নিজেদের জন্য ঠিক করতে পারি। কিন্তু অন্যের জন্য ঠিক করতে পারি না।

সাইয়ীদ : এখন হচ্ছে কী, ওইটা অ্যাবনরমাল। পারসোনালাইজ অ্যাবনরমাল আছেই যেহেতু (হাসি)।

নিউটন : নোমলসি এর যে-ধারণা বা এর যে-পলিটিক্যাল আইডিয়া, নোমলসি মানে কোডস অব কনডাক্টস। আপনি এগুলো করবেন এগুলো নরমাল বাকিগুলো অ্যাবনরমাল। এটি একটি ডেনজারাস আইডিয়া। এটা অন্যকে, আপনাকে একটি কুত্তা মেরে ফেলার আগে, একটা বেত নিই বিফর ইউ কিল হিম-এই যে-তাকে অ্যাবনরমাল বলতে পারলে মেরে ফেলা যায়।

সাইয়ীদ : ঠিক আছে, ঠিক আছে। সে-ক্ষেত্রে কিন্তু একটা সমস্যা থেকেই যাচ্ছে। এখন ধরেন খুন করার প্রবণতা এটাকে আমি অ্যাবনরমাল নাও বলতে পারি। কারণ, ওই একইভাবে কিন্তু এটা আমি মনে করতে পারি খুন করার প্রবণতাটা আমাকে অ্যাবনরমাল ভাবতেই হবে। এইটুকু সিদ্ধান্ত আমাকে নিতেও হবে কেননা এটি নরমাল না।

নিউটন : খুন করার যে-প্রবণতাটা হচ্ছে; আমি নানান কারণে গত ১০-১২ বছর ধরে এই আইনের শাসন, ক্রাইম এগুলো নিয়ে লেগে আছি খানিকটা আমার মতো করে। ক্রিমিনলজি বলছে এবং ক্রিমিনলস্যোশিওলজিও বলছে প্রচুর রিসার্চ বলছে, একেবারে খুন করার প্রবণতাসম্পন্ন মানুষ এটা লাখে একটাও নাই, লাখে একটাও নাই। খুন করার প্রবণতাসম্পন্ন মানুষ যাদেরকে পাই আমরা, যাদের টেন্ডেন্সি হচ্ছে খুন করা। ওই যে-টুইন টাওয়ারে বিমান দুটি ঢুকিয়ে দেওয়ার পরে আমাদের এক আমেরিকান স্কলার বলছিলেন যে, এটাতো বাই বর্ন এ-রকম না যে-বিমান চালাতে গেলে উঁচা বিল্ডিং দেখলেই মনে হয় ঢুকাইয়া দিই, এ-রকম প্রবণতাসম্পন্ন মানুষ; তা না। দে আর ভেরি নরমাল পিপল লাইক ইউ অ্যান্ড মি। তাদের এ-রকম প্রবণতা ছিলো না যে উঁচা বিল্ডিং দেখলে ঢুকায়া দিই। একটা টেন্ডেন্সি নিয়ে তারা জন্মগ্রহণ করে না।

খুন করার স্যোশিওলজিক্যাল কারণ হচ্ছে, খুন করার পলিটিক্যাল ইকোনোমিক কারণ আছে, খুন করার এই সমস্ত কারণ সহজেই উদ্ঘাটন করা যায়। যিনি খুন করছেন তিনি এমন কোনো মানুষ না, যিনি খুন করার জন্য জন্মগ্রহণ করেছেন। তিনি ছোটবেলা থেকে খুন করতে করতে বড়োও হয়নি। এমনকি কচু গাছ কাটতে কাটতেও বড়ো হয়নি বেশিরভাগ খুনি। বেশিরভাগ খুন হয় যেগুলোর পানিসমেন্ট হয়। বেশিরভাগ খুন হয় একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে। আমি একদম মানে প্রচুর কেস স্টাডি থেকে বলছি। আমি আপনাকে এগুলো সাপ্লাইও করতে পারবো। আচ্ছা, আমি আর এই পয়েন্ট না বাড়িয়ে থেমে যাই। থেমে যাওয়ার আগে দুই-তিনটা পয়েন্ট বলে নিই।

আমি কিন্তু আপনাকে কন্ট্রাস করছি কোথাও কোথাও। তবে পুরোটার সঙ্গে আমি একমতই আছি। সেটা হলো, একটু অন্যদিক দিয়েও তাকানোর সুযোগ থাকে কি না। আমার জায়গাগুলো ইয়ে যা বলছি ওটাই যে-ঠিক, বাকিগুলো ঠিক না, এ-রকম জায়গায় আমি একেবারেই নাই। আচ্ছা, ব্যবসা জিনিসটার কথাও আপনি বললেন যা আমরা সবসময়ই বলি। ব্যবসায়ীদের কিন্তু ইতিবাচক দিক আছে। ব্যবসায়ীরা হচ্ছে সেই ধরনের প্রাণী, সমাজের ওই বর্গটা যারা আদিকাল থেকে মানুষের মধ্যে লেনদেন ঘটিয়েছে; কমিউনিকেশন ঘটিয়েছে। একেবারে অচেনা অচেনা জায়গায় এবং অচেনা অচেনা কমিউনিটিকে পরস্পরের সংস্পর্শে এনেছে।

ম্যাক্সওয়েবারের বিরাট স্যোশিওলজিক্যাল কাজ আছে প্রটেস্ট্যান্ট ইথিক্স অ্যান্ড দ্য... (দ্য প্রটেস্ট্যান্ট ইথিক্স অ্যান্ড দ্য স্পিরিট অব ক্যাপিটালিজম) আমার এগজ্যাক্টলি বইয়ের নাম মনে নাই, স্প্রেড অব ক্যাপিটালিজম। মানে পুঁজিবাদের প্রসারের সঙ্গে প্রটেন্ট্যান্ট অ্যান্ড ইথিক্স এর সম্পর্ক দেখিয়ে উনি গবেষণা করে দেখিয়েছিলেন যে, কতোগুলো ব্যবসায়িক ইথিক্স সেগুলোই ওয়েস্টে ধর্মের মোড়কে হাজির হয়ে ক্যাপিটালিজমের প্রসার আমেরিকাতে ঘটায় যে-মাত্রায়, ইংল্যান্ডে সে-মাত্রায় ঘটাতে পারে না। পারটিকুলারলি আমেরিকাতে ঘটাতে পারে, এটা প্রটেস্ট্যান্ট ইথিক্স এর জন্য। ইংল্যান্ডের ভুটনের (গঠন) যে ক্যাথলিক স্ট্রাকচার, যে ক্যাথলিক বুনন সেটা বাধা হয়ে দাঁড়ায় পুঁজিবাদের বিকাশের পক্ষে। তারপরে আমি এমএন রায়-কে দেখলাম উনি মোহাম্মদ নিয়ে আলোচনা করলেন; হিস্টোরিক্যাল রোল অব ইসলাম।

সেখানে উনি বলছেন, আমরা খেয়াল করি না ইসলাম হচ্ছে ব্যবসায়ীদের ধর্ম। বেসিক্যালি মোহাম্মদ নিজে টপ এলিট বিজনেস, একটা ফ্যামিলি হাউস থেকে আসা লোক ও বিজনেস প্রতিনিধি। ইসলাম প্রথমে গ্রহণ করেছিলো দাসরা ও ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীদের জন্য একটা লেভেল প্লেয়িং গ্রাউন্ড দরকার, যেখানে উঠতে বসতে অমুক গোত্র তমুক গোত্র, অমুক রাজা তমুক রাজা, ট্যাক্স বসাবে না পণ্যের ওপর, বাধা সৃষ্টি করবে না পণ্য চলাচলের ওপর। এই ব্যবসায়ীদের এই দিকগুলা আমরা কীভাবে...করি না। আমি কিন্তু ব্যবসায়ীদের গুণাগুণ করছি না। আমার বদনাম আছে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ব্লাইন্ড কথাবার্তা বলার জন্য, যেগুলো পরবর্তী সময়ে অনেককে আমি দেখেছি আমাকে ব্লাইন্ডলি ফলো করতে। এইতো, আর হলো কোনটা ক্ষতিকর আর কোনটা ক্ষতিকর না, তা চট করে সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব কঠিন। সমাজের জন্য, মানুষের জন্য, আমার নিজের জন্য, পড়াশোনার জন্য খুব কঠিন। আমরা যদি খুব লঙ্ টার্মের কথা ভাবি, এক হাজার বছর ধরে কী ঘটতে পারে যদি চিন্তা করতে পারতাম তাহলে আমাদের ধারণাটা অন্য ধরনের হতো। ১০০ বছর আগে যেটাকে মানুষ সমাজের জন্য ক্ষতিকর মনে করেছিলো সেটা ক্ষতিকর বলে আজ পর্যন্ত প্রমাণিত হয়নি। এ-রকম ঘটনা আছে।

সাইয়ীদ : যেমন...

নিউটন : যেমন নারী শিক্ষা। ১০০ বছর আগে গোটা বাংলা সমাজের ১০০ জনের মধ্যে ১০০ জনই মনে করতো পুরো সমাজ পাপে ছেয়ে যাচ্ছে। হিন্দি সিনেমার কালচারের কারণে, ঐশ্বরিয়া রায়ের নাচের মুদ্রার কারণে, আপনি দেখবেন যে-রাস্তাঘাটে মেয়েদের চলাফেরার ভঙ্গি বদলে গেছে। পার্টিকুলার শুধু ঐশ্বরিয়ার জন্য বলছি না, আমি মেটাফোরে বলছি; হ্যাঁ, কালচার বদলে গেছে। এই কালচার বদলে যাওয়ার একটা বেসিক মিনিং হচ্ছে লিবার্টি, কনফিডেন্স; ছেলেদের মধ্যেও ঘটছে এইটা। আজকালকার টিনএজার ছেলেমেয়েদের পারস্পরিক লেনদেনের নেচার, প্যাটার্ন আপনার আমার ছোটবেলার থেকে এতো আলাদা যে-আমাদের পক্ষে মেজার করা কঠিন। আমাদের পুরনো মন চট করে বলবে-সর্বনাশ কী জানি একটা ঘটে যাবে! হ্যাঁ, কিন্তু আমি এতো নিশ্চিত না যে-কোনটা সর্বনাশ এবং...শেষ।

সাইয়ীদ : এখন আচ্ছা ঠিক আছে। তারপর ধরেন করাপশন, তারপরে হচ্ছে এই যে-কতোগুলো বিষয় উৎকোচ বা এই যা যা এই বিষয়গুলোতো ধরেন শত বছরেরই। এগুলো কী পাল্টে যাচ্ছে বা লিগ্যাল, মানে এ-রকম বিষয়ে চলে আসতেছে?

নিউটন :  অ্যাঁ, দেখেন বলি, যেটা পাল্টাচ্ছে না সেটা হচ্ছে যে, মানুষ এমন একটা প্রাণী, যে-প্রাণীটার ইমবিল্ড একটা মূল্যবোধ, একটা মূল্যপ্রথা আছে, একটা ভ্যালুস সিস্টেম আছে; হ্যাঁ, সেই ভালো এবং মন্দ নির্ধারণ করে। দেখেন জিটার্ন, ইটার্ন সব গোত্র, সব জায়গাতেই প্রত্যেকটা মানুষ, খুনি পর্যন্ত তার খুনের পক্ষে কিছু যুক্তি খাড়া করতে না পারলে পাগল হয়ে যায়, সে সহ্য করতে পারে না, সে দুঃস্বপ্ন দেখে। বার বার করে হাত ধোয়, মনে করে হাতে রক্ত লেগে আছে। তাকে একটা ভালো এবং মন্দের সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু মুশকিলটা হচ্ছে কোনটা ভালো এবং কোনটা খারাপ, এটা সম্পর্কে ইটারনাল কোনো মানদণ্ড নেই। কিন্তু এটা ইটারনাল যে, ভালো এবং মন্দ বলে কিছু একটা আছে। এটা আপনারটা আপনি ডিসাইড করবেন, আমারটা আমি ডিসাইড করবো।

সাইয়ীদ : কিন্তু আপনিতো বললেন নারী শিক্ষাটা ভালো।

নিউটন : নারী শিক্ষাটা আজকের দিনে দেখেন অন্তত আমি যে-নারীদেরকে চিনি আমার বোনকে, আমার স্কুল টিচার মাকে, আমার কন্যাকে এবং আমার আরেক টিচার স্ত্রীকে আমি দেখছি তারা বলছেন...

সাইয়ীদ : এবার একটু দাঁড়ান। আমি একটু বলি, আমি ৩০ বছরের চিত্র একটু বলি, এই গত কয়েকদিন আগে আনুমানিক দেড়টা-দুটার দিকে বগুড়া শহরে যখন ঢুকি, বগুড়া শাহ সুলতান কলেজের সামনে স্কুল ছুটি হয়, কলেজ ছুটি হয়, তখন প্রচুর নারী ছিলো, পুরুষ ছিলো। যাহোক ছেলেমেয়েরা ছিলো। ৮০ ভাগ মেয়েদের আমি বোরকা পরা দেখলাম এবং ফ্ল্যাশব্যাকে যাওয়ার চেষ্টা করলাম। আমি তিনটা ক্লাস পেয়েছি আজিজুল হক কলেজে। আমি যখন ফার্স্ট ইয়ারে তখন সেকেন্ড ইয়ারকে পেলাম, যখন সেকেন্ড ইয়ার তখন আমার ইয়ারকে পেলাম এবং তারপর আরেকটা ফার্স্ট ইয়ারকে পেলাম। তা আমাদের কেউ কি বোরকা পরা ছিলো? আমার মনে পড়েনি।

নিউটন : আমাদের কেউ বলতে?

সাইয়ীদ : বোরকা পরা ছিলো কি না আমার সময়, আমি যখন ক্লাসে আমার সময় আজ থেকে দুই যুগ আগে।

নিউটন : আচ্ছা, আচ্ছা... 

সাইয়ীদ : এটাকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন; এটা কি এগিয়ে যাচ্ছে, এটা কি ঐশ্বরিয়ার কাছ থেকে শেখা?

নিউটন : আমি সবকিছুই ব্যাখ্যা করতে পারি বলে দাবি করছি না। কিন্তু আপনাকে এ-জন্য বলছি। যেমন ধরেন আলজেরিয়াতে; আলজেরিয়া ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিলো, এই সেদিনও। যখন আলজেরিয়া ফ্রান্সের উপনিবেশের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে সেই লড়াইয়ের একটা অংশ ছিলো বোরকা পরা। বোরকা পরাটাই হচ্ছে উপনিবেশিক শাসকদের সঙ্গে তার আইডেন্টিটিকে আলাদা করার একটা উপায়।

সাইয়ীদ : তাহলে ঠিক আছে, আপনি যখন ঐশ্বরিয়ার নাচ দেখে মেয়েদের চলনের একটা বা কোমরের বাঁকের একটা চেঞ্জ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন; আপনি নিশ্চিত থাকেন সে-বাড়িতে গিয়ে ঐশ্বরিয়াকেই দেখে, বোরকা খোলার আগে অথবা বোরকা খোলার পরপরই। ঠিক আছে?

নিউটন : তাতে সমস্যা কী?

সাইয়ীদ : এখন আরেকটা আমি বিষয় বলি, আপনি এর সঙ্গে কি একটা প্রোডাক্টের সম্পর্ক দেখতে পান না? আজকে পত্রিকার অনেক পাতা আছে বিভিন্ন রকমের...

নিউটন : সেটাতো দেখছি।

সাইয়ীদ : আজকে কী মনে হয় না যে-আমাদের মধ্যে এই যে-এই সমস্ত পোশাক, এই সমস্ত রূপচর্চা, এই সমস্ত সাজসজ্জা, এই সমস্তের মধ্যে, এই নারীদের মধ্যে একটা অন্য রকম হওয়ার প্রবণতা-সেটার সঙ্গে একটা দুর্নীতির সম্পর্ক নাই? যেমন ধরেন যে-আপনি একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, আমি বেকার। আপনি আপনার মেয়েকে পাঁচ হাজার টাকা দামের একটা ঈদের জামা দিলেন, আমার মেয়ে দেখছে যে (নিউটন হাসতে হাসতে, আমি কিন্তু পারি না সায়ীদ ভাই) কোনো একটা পত্রিকার পাতায় এটা ছিলো, এই ছবিটা। কোনো একটা নায়িকা, ঐশ্বরিয়াই হোক বা আমাদের বাংলাদেশের হোক উপরে ছিলো। আপনাকে বলি আপনি কিনে দেন। কিন্তু আমি যেহেতু বেকার, আমার পক্ষে ওটা কিনে দেওয়া সম্ভব না। কিন্তু তারপরও মেয়ের আবদার রক্ষার জন্য যে-কোনোভাবেই হোক, আমার ছোট্ট একটা দুর্নীতি করার সুযোগ আছে। সেখান থেকে আমি তাকে তিন হাজার টাকা দামের ঐশ্বরিয়ারটা পারিনি, আরও যারা ছোট-খাটো আছে কী কী নাম, তাদেরটা আমি দিয়েছি। সেটা কী আপনার মনে হয় না একবারও। ঐশ্বরিয়া রায়ের নাচ দেখে একটা তরুণী মডার্ন হয়ে গেলো!

নিউটন : আচ্ছা দেখেন, এতো স্ট্রেইট কোজিশন বলিনি আমি। মানে কজ অ্যান্ড ইফেক্ট। এখানে ঐশ্বরিয়া কজ এবং লিবার্টি ইফেক্ট। এ-রকম স্ট্রেট কজিশন দিয়ে বলিনি। এ-রকম স্ট্রেইট কজিশন দিয়ে পৃথিবীতে কিছু এক্সপেক্ট করা কঠিন। হ্যাঁ, এটা খুব কঠিন। আপনি যদি স্ট্রেইট বলেন, শুধু পুঁজির জন্য, এ-কথাটা সঠিক নয়। ফিল্মে ধস নেমেছে, যাত্রা উঠে গেছে, এটা এতো স্ট্রেইট বলা যাবে না। আপনি খেয়াল করলে দেখবেন।

সাইয়ীদ : স্ট্রেইট বলছি না, আপনিই স্ট্রেইট বলে ফেলছেন। আমি যদি স্ট্রেইট বলি, আমি বরাবরই স্ট্রেইট বলি, আমি একজন রক্ষণশীল। আমি মিউজিক, আমি সঙ্গীতের ক্ষেত্রে রক্ষণশীল।

নিউটন : মানে কী? রক্ষণশীল মানে কী?

সাইয়ীদ : (হাসতে হাসতে) আমি রক্ষণশীল।

নিউটন : আমরাওতো রক্ষণশীল, আমরা সবাই রক্ষণশীল।

সাইয়ীদ : আমি, সঙ্গীতের বিকাশমান ধারার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে পারিনি। এখনও আমি লুঙ্গি পরে ঘুমাই, হাফপ্যান্টে আসতে পারি নাই। (দর্শকদের হাততালি)

নিউটন : এটাতো দোষের কিছু নয়। হাফপ্যান্ট পরা আর লুঙ্গি পরা এগুলো কিছুই না আসলে। এগুলো সবইতো পরা।

সাইয়ীদ : সবচেয়ে ভালো খবর হচ্ছে যে-এই আলোচনা আমার খুবই ভালো লাগলো। যেহেতু ব্যবসায়িক কারণে এখন মাঝে মাঝেই বগুড়ায় থাকতে হবে। এবং যেহেতু খাদ্যদ্রব্যের অনেক অফিস, মাঝে মাঝেই যাওয়া-আসা করতে হবে, ট্যাক্সের কমিশনারের অফিস রাজশাহীতে, বিএসটিআই-এর অফিস রাজশাহীতে এবং আবার আসা হবে ও আমরা আবার কথা বলতে পারবো (দর্শকদের সজোরে হাততালি)। আপনাদের সবাইকে অনেক অনেক ধন্যবাদ।

সঞ্চালক-১ :চলচ্চিত্রে দর্শকপ্রিয়তায় নির্মাতার দায় শিরোনামে কথা উপস্থাপনার জন্য ধন্যবাদ আবু সাইয়ীদকে। ধন্যবাদ উপস্থিত সবাইকে।

 

 



আবু সাইয়ীদ

aangik_c@yahoo.com

 

দায় স্বীকার : বিশাল এই কথামালাটি রেকর্ডিং থেকে প্রতিলিপি করতে সহায়তা করেছেন দেবাশীষ কে. রায়, জাকারিয়া ইসলাম, রুবেল পারভেজ, তৈয়ব তরুণ, হালিমা খুশি, রায়হানুল রানা, কাওসার বকুল। আর পুরো লেখা তৈরিতে সমন্বয়কারীর দায়িত্ব পালন করেছেন ইমরান হোসেন মিলন।


বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৩ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের চতুর্থ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।


এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন