Magic Lanthon

               

এম জিয়াউল হক সরকার

প্রকাশিত ১৩ নভেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

হুমায়ূনের চলচ্চিত্র : আধুনিকতার অন্তরালে মানুষের স্বরূপ সন্ধান

এম জিয়াউল হক সরকার


বড় বেদম ছুটছে দেখো সভ্যতা

সময় হাঁপিয়ে মরে পাল্লা দিতে

সূর্য ডুববে বলে কালপেঁচাটা

ওৎ পেতে বসে আছে টেক্কা দিতে।।

...ভাঙছে মানুষ নিজে গতির দাপটে

অসহায় ভালোবাসা নীল হয়ে ওঠে

খুরোর কলের টানে ভোরহীন ছোটা

সাপের মুখে যেতে মই বেয়ে ওঠা

খেরোর খাতা হাতে অসময় আসে

কালো কালো অক্ষরে হিসেব নিতে।

আধুনিকতার ইতিবৃত্তে অন্যতম প্রধান ঘটনা ব্যক্তির উত্থান-পতন, ক্রমবিকাশ ও ক্রমবিনাশ। পুঁজিবাদের সঙ্গে, পুঁজিবাদের শক্তি ও শোষণের চেহারার সঙ্গে বিজ্ঞানের কল্যাণ ও ধ্বংসের মূর্তি ধরা পড়ে ব্যক্তির আয়নায়। বাস্তব ও বিভ্রমের আলেখ্য নানান রূপে প্রকাশ পায় ব্যক্তির চরিত্রে। আসলে ব্যক্তি দ্বিধাবিভক্ত, দ্বৈতসত্তার এক অদ্ভুত ভাগাড়ে বাস করে। ব্যক্তি থেকে আসে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, সেখান থেকে আসে ব্যক্তিসর্বস্বতা। সমগ্র পশ্চিম এখন ব্যক্তিসর্বস্বতার চরম অসুখে ভুগছে; ভুগছে আমাদের দেশের মানুষও। বাস্তব আর অলীকের মধ্যে প্রতিনিয়ত চলাচল বাড়ছে। এই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও বিচ্ছিন্নতা আমাদের ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন, রাষ্ট্র, শিল্প-সংস্কৃতি সবকিছুকেই রুগ্ন, ফ্যাকাশে আর জিরজিরে করে দিয়েছে। পুঁজিবাদের অসহনীয় ঘেরাটোপে ব্যস্ততা, কর্ম-তৎপরতা, চিন্তা-দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ, উত্তেজনা, প্রতিযোগিতা আর প্রতিনিয়ত আত্মপরিচয় সঙ্কটে আমরা একটি ক্ষুদ্র পরিসরে নিজেকে বৃত্তবন্দি করে ফেলেছি।

পুঁজিবাদের এই ঘেরাটোপে আধুনিক দাবিদার মানুষগুলো আত্মসর্বস্ব চিন্তা ও চেতনার বিকাশ ঘটাতে গিয়ে মানুষের সম্মিলিতভাবে জীবনযাপনের যে-প্রায় চিরায়ত আচার তা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। সমাজের অধিকাংশ মানুষই মনে করে নিজের মনোবাঞ্ছা এককভাবে পরিপূর্ণ করা সম্ভব; সবাই মিলেমিশে নয়। আধুনিক সমাজের এসব সঙ্কট আসলে আধুনিক সভ্যতার সঙ্কট; যা কিনা নগর থেকে উৎপন্ন। এটা শুধু ব্যক্তিজীবন ও সামাজিক ক্ষেত্রেই নয়, মানুষের মনস্তাত্ত্বিক গড়নেরও পরিবর্তন আনে। আর এসবের সঙ্গে ক্ষমতা কাঠামোর সম্পর্ক নিবিড়।

যাপিত-জীবনে পুঁজি যখন সর্বগ্রাসী, ব্যক্তি যখন বিচ্ছিন্ন, আত্মমগ্ন, শহর-গ্রামে সর্বত্রই যখন বিস্ময়কর পালাবদল চলছে; ঠিক এমন এক সময় অর্থাৎ ৭০-এর দশকের দিকে বাংলা সাহিত্যে মধ্যবিত্তের মোড়ককে নতুনভাবে উন্মোচনের দিশা নিয়ে হুমায়ূন আহমেদ আত্মপ্রকাশ করেন। মূলত শুরুর দিকটা ছিলো মধ্যবিত্তের প্রাত্যহিক জীবনের মাধুর্য, ঐশ্বর্য, গ্লানি, বঞ্চনা, বিড়ম্বনা, স্বপ্ন-বিচিত্র বৈষয়িক ও বহুমুখী মানবিক সম্পর্কের এক আলেখ্য নিয়ে। যা রূপায়িত হয় তার নন্দিত নরকেশঙ্খনীল কারাগারে উপন্যাসে। তারপর উপন্যাস, গল্প, সায়েন্স ফিকশন, টিভি-নাটক ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের জীবনের গভীর মর্মবাণী, অনুভূতি, আশা-আকাঙ্ক্ষা, দুঃখ-সুখ, হতাশা, বেদনা ইত্যাদি নিজস্বভঙ্গি ও স্বতন্ত্র শৈলীর মাধ্যমে নানা চরিত্রে বিশিষ্টতা পায়। তবে সাহিত্য জগতের কালপরিক্রমায় উদ্দেশ্যহীন-ভবঘুরে হিমু, যুক্তিবাদী মিসির আলি, শুভ্র বা বাকের ভাইদের মতো তার সৃষ্ট চরিত্রগুলো কতোখানি অমর হয়ে থাকবে তা এখনও বলবার সময় হয়নি। ভবিষ্যতে সেটি হয়তো সাহিত্যের পাঠক-সমালোচক-বিশিষ্টজনরা বলবেন-তাই সেদিকে না যাই।

তবে এর বাইরেও শিল্প-সাহিত্যের অনেক শাখায়ই হুমায়ূনের বিচরণ লক্ষ করার মতো। কিন্তু সেই অর্থে তাকে সব্যসাচী বলা যায় না। তবে তিনি যেমন কবিতা না লিখলেও লিখেছেন গীতিকবিতা, তেমনই নাটক না লিখলেও লিখেছেন টিভি-নাটক। আবার সাহিত্যের মানুষগুলো যেমনটি চলচ্চিত্রপ্রেমীও হয়, হুমায়ূনের ক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনেও তার বিচরণ চোখে পড়ার মতো। তিনি মূলত ১৯৯৫-এ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র আগুনের পরশমণি দিয়ে নির্মাতা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। একে একে আটটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক।

সাহিত্য জগতে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে বিবেচিত হলেও হুমায়ূন আহমেদকে চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রে ওইরকম আন্তর্জাতিকমানের নির্মাতা বা একক কোনো তকমা দিয়ে বিশেষায়িত করা যায় না। তবে এতোটুকু বলা যেতে পারে, তার চলচ্চিত্রে স্বতন্ত্র একটি ধারা রয়েছে। তবে তিনি কতোটা ভালো বা মন্দ করেছেন তা সমালোচনার দাবি রাখে। যা হোক, তার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের বাইরে দুই দুয়ারী, আমার আছে জল কিংবা নয় নম্বর বিপদ সংকেত এই তিনটি মানুষের জীবনের স্পন্দন, অন্তর্দহন, নানা ঘাত-প্রতিঘাতগুলো বর্তমানের আধুনিকতা, সমাজ ও জীবনের নানা সঙ্কট, মনস্তাত্ত্বিক গড়ন ও টানাপোড়েনের পরিপ্রেক্ষিতে কীভাবে দেখেছেন তা বিশ্লেষণের চেষ্টাই নিচের উপস্থাপনা।


আধুনিকতা, সমাজ ও মানুষ

আদিম সাম্যবাদী সমাজ কিংবা তারও আগে যতোদূর পর্যন্ত মানব সভ্যতার ইতিহাস জানা যায়-মানুষ প্রতিনিয়ত নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাতের মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে। মানুষের মধ্যে এই উন্নত থেকে উন্নততর হয়ে উঠার তীব্র আকাঙ্ক্ষা সেই আদিকাল থেকেই। কখনও এটি লুপ্ত আবার কখনও তীব্র দৃষ্টিগোচরযোগ্য হয়ে উঠেছে। মানুষের মধ্যে ব্যক্তিগতভাবে এই আধুনিক হয়ে উঠার প্রবণতাই ছিলো সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে। কিন্তু আপামর সমাজের জন্য তার এ-ব্যক্তিকেন্দ্রিক উন্নত বা আধুনিক হয়ে উঠার মোহ মানবজাতির জন্য কতোখানি স্বার্থ-সহায়ক তা বিবেচনাযোগ্য। মার্কস দেখতে পান যে, সমাজ যত উন্নত হয়েছে মানুষ কর্তৃক মানুষের শোষণ নিপীড়ন চালানোর ঘটনাও অনুরূপভাবে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই মানুষের জীবনে উন্নয়ন ও আধুনিকতা সাময়িক কিছু যান্ত্রিক সুযোগ-সুবিধা উপস্থাপন করতে পারলেও তা সমাজের বৃহত্তর ও দীর্ঘমেয়াদি প্রশ্নে কখনই সহায়ক ভূমিকা অতীতেও নিতে পারেনি এবং ভবিষ্যতেও নিতে পারবে এমনটি না ভাবাই ভাল। তবে বর্তমানে এটি আরও স্পষ্ট যে, আধুনিক এ-মানুষগুলোর জীবনে নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে এবং এগুলো সমাধান করাও মৌলিক চাহিদার মতো প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পিছনে অন্যতম কারণ হিসেবে কাজ করছে ভোগের প্রতি মানুষের সুবিপুল মোহ।

যদিও এ-মোহ থেকে ব্যক্তিসত্তাকে বিচ্ছিন্ন করা যায় কি না-এমন প্রশ্নের কূলকিনারা করাও সহজ কাজ নয়। তবে একথা ঠিক, মানুষের মধ্যে ভোগের প্রতি চরম আকাঙ্ক্ষাই সমাজে শ্রেণি-শোষণ ও বৈষম্য তৈরির পথ ব্যাপকভাবে সুগম করেছে। এ-মোহ এমন সর্বগ্রাসী হয়ে উঠেছে যে, পৃথিবীর নানা দেশের বাসিন্দাদের মধ্যে বহু উদ্বেগজনক সামাজিক প্রবণতাও লক্ষণীয়। বর্তমান বিশ্বব্যবস্থার সবচেয়ে বড়ো বিপদ হচ্ছে দৈনন্দিন জীবনের মৌলিক চাহিদা-খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা ও জনস্বাস্থ্যের মতো ন্যূনতম চাহিদা কীভাবে পরিপূর্ণ করা যাবে সেদিকে নজর না দিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবে মুনাফাসর্বস্ব বিষয়গুলোর প্রতি নজর দেওয়া হয়েছে। বিংশ শতাব্দী জুড়ে গোটাবিশ্বে একটি বড়ো পরিবর্তনের ঢেউ লেগেছে। যা ব্যক্তি, সামাজিক সম্পর্ক, সামাজিক প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র, করপোরেশন ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে এনেছে ব্যাপক পরিবর্তন। ফলে রাষ্ট্র, শাসনতন্ত্র, প্রশাসনিকতা নতুনরূপে রূপায়িত হয়েছে। এমনকি বিশ্বাস, মূল্যবোধ, ধর্ম, যৌনতা, আচার, প্রথা ইত্যাদির ক্ষেত্রেও। এতে যেমনটি প্রভাব পড়েছে মনস্তাত্ত্বিকভাবে তেমনই ব্যক্তিত্বের বিকাশ ও চিন্তা-চেতনায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। এতে আলগা হয়েছে সামাজিক সম্পর্কের বন্ধনগুলো। কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ যেমন সাহিত্যে খেয়ালি, হাস্যরসাত্মক, ব্যঙ্গাত্মক রূপ দিয়েছেন, আবার কখনও যুক্তি-তর্কের মধ্য দিয়ে সমাজের এসব রূপ চিত্রণের চেষ্টাও করেছেন। ঠিক তেমনই প্রচেষ্টা ছিলো চলচ্চিত্রের বেলাতেও। তিনি যেমন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রচলিত গ্র্যান্ড-ন্যারেটিভ ইতিহাসের বাইরের ইতিহাস দেখাতে চেয়েছেন, অন্যান্য চলচ্চিত্রেও ঠিক সেরকম প্রয়াস লক্ষ করা গেছে। তার দুই দুয়ারী, আমার আছে জলনয় নম্বর বিপদ সংকেত-এর ক্ষেত্রেও সেরকম হাস্যরসাত্মক, ব্যঙ্গাত্মক, চমক বা বিয়োগান্তের মাধ্যমে আধুনিক সমাজকে দেখার এক নয়া চালচিত্র পাওয়া যায়।

নয় নম্বর বিপদ সংকেত-এ একজন বৃদ্ধ ও তার ছেলেমেয়েদের পারিবারিক বন্ধন, সম্পর্ক ও বিশ্বাস; আমার আছে জল-এ একটি পরিবারের ভ্রমণকে কেন্দ্র করে নারী-পুরুষের সম্পর্ক ও সমাজ-সভ্যতাকে বিবেচনার জায়গা এবং দুই দুয়ারীতে জীবন, বাস্তবতা ও শৃঙ্খলিত জীবনাচরণকে যেভাবে চিত্রায়িত করেছেন তা আলোচনা করা অনেকটাই অত্যাবশ্যক বলা যেতে পারে।


আধুনিক সমাজ : সত্যি সত্যিই নয় নম্বর বিপদ সংকেত

বিশাল বাংলো। অর্থ, বিত্ত, প্রাচুর্যে ভরপুর জীবন। হুকুমের গোলাম কয়েকজন পরিচারক-পরিচারিকা। প্রাকৃতিক পরিবেশে বাংলোটি দেখলে নিসর্গের মতোই মনে হয়। কিন্তু মনে সুখ নেই বাংলোর মালিকের। তার নিঃসঙ্গ, অস্থির মন সবসময় অদ্ভুত আর উদ্ভট রকমের বাড়াবাড়ি করে। বলছিলাম নয় নম্বর বিপদ সংকেত-এর বৃদ্ধ বাবাটির কথা। যার দুমেয়ে, এক ছেলে ও তিন নাতি-নাতনি থাকা সত্ত্বেও একাকী জীবনযাপন। যেমনটি দেখা যায় চলচ্চিত্রের প্রথম দৃশ্যে। বন্দুক হাতে দ্রুত পায়ে হেঁটে এসে চেয়ারে বসেন, ঘণ্টা বাজাতে থাকেন। ম্যানেজার আর গৃহভৃত্য মিজান দৌড়ে আসে। একটি মূর্তি দেখিয়ে তাদেরকে জিজ্ঞেস করেন, এই মূর্তি আর তার নিজের সঙ্গে পার্থক্যের কথা। এক পর্যায়ে তিনি বলেন, এই বুড়োটা আর আমার সাথে কোনো পার্থক্য নেই। বুড়োটা যেমন হতাশ আমিও তেমনই হতাশ। মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বন্দুকটা দিয়ে গুলি করে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের মতো আত্মহত্যা করি। আরও বলেন, আমার দুটো মেয়ে, তিনটি নাতি-নাতনি। তারা কেউ এখানে আসে না। স্বর্গপুরী বানিয়ে রেখেছি। এই বাড়িটিকে নৈঃশব্দের মৃত বাড়ি বলে মনে হয়। কোনো চিৎকার-চেঁচামেচি নেই, হইহুল্লো নেই।

আবার তিনি ছেলেমেয়ের সঙ্গে দুরালাপনেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া পান। যেমন-বড়ো মেয়ে রাত্রিকে ফোন করলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে জামাতা করিমের হাতে ফোন ধরিয়ে দেন। আর বড়ো মেয়ের ব্যস্ততার কারণ তিনি ফেসিয়াল থেরাপি নিয়েছেন। জামাতাও জ্বি, আচ্ছা ইত্যাদি বলে কথা চালিয়ে নেন। শেষ পর্যন্ত ম্যানেজারের পরামর্শে মৃত ব্যক্তির অভিনয় করতে বাধ্য হন বৃদ্ধ। পাঠক একটু ভাবুন, নিজের সন্তানদের দেখার জন্য মৃত্যুর অভিনয় করতে হচ্ছে। কোথায় চিরায়ত পারিবারিক বন্ধন, অনুভূতি!

একটু পিছনে ফিরে তাকাই। প্রথম মহাযুদ্ধের পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দাবি উঠেছিলো এমন এক সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার যা হবে মূলত সেবামূলক সমাজব্যবস্থা বা সার্ভিস সোসাইটি। কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে নয়া প্রযুক্তির অসম্ভব বিকাশের হাত ধরে মানুষের একাংশ অনুভব করতে শুরু করলো, সমাজ হতে হবে ভোগের চাহিদা পরিপূরণের উদ্দেশ্যসাধক। তাই সমাজের পরিষেবা প্রদানের পরিবর্তে সমাজ যাতে মানুষের ভোগের চাহিদা পরিতৃপ্ত করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে সমাজব্যবস্থায় কনজিউমার সোসাইটি গড়ে ওঠে। এই কনজিউমার সোসাইটি প্রথম যেটা করলো মানুষের মধ্যে অসহায়ত্ব জাগিয়ে তুললো; নিঃশর্তভাবে বাজারের কাছে আত্মসমর্পণ করার জন্য সৃষ্টি করলো মনোজাগতিক বাধ্যবাধকতা। দেখানো হলো, বাজার অর্থনীতির তথাকথিত শ্রেষ্ঠত্ব জাহির করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প নেই। এই কনজিউমার সোসাইটির অন্যতম প্রতিনিধি ওই বৃদ্ধ। যিনি নিজের পারিবারিক বন্ধন ও সম্পর্কগুলো গড়ে তুলেছিলেন অর্থের চাহিদার ওপরে। ফলে বাবা-মেয়ে কিংবা বাবা-ছেলের মধ্যে নির্মোহ ভালোবাসা গড়ে ওঠেনি। যেমনটি গড়ে ওঠেনি যৌথ পরিবার, আমরা জাতীয় চিন্তা-চেতনা। ফলে জীবনের সায়াহ্নে এসে তিনি কাছে পাননি তার ছেলেমেয়েদের।

বর্তমান সমাজে একদিকে যেমন অর্থের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে সম্পর্ক গড়ে উঠছে, অন্যদিকে জনপ্রিয় সংস্কৃতির নানা আয়োজনের মাধ্যমে পুঁজিবাদী বাজারি ব্যবস্থার সপক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক আধিপত্যের বিস্তার চলছে। ফলে মানুষের সৃজনশীল ও মানবিক সজীব কর্মতৎপরতা আটকে পড়ছে সাইবার, ডিজিটাল সংস্কৃতির ফাঁদে। তথ্যপ্রযুক্তির সর্বস্বতা মানবীয় সম্পর্কহীনতায় ঠেলে দিয়ে প্রতিনিয়ত মানুষের বি-মানবিকীকরণ ঘটাচ্ছে। পাঠক একটু খেয়াল করে লক্ষ করুন, বড়ো মেয়ের রূপচর্চা আর ছোট মেয়ের ব্যস্ততা পোষা কুকুরে। আবার একমাত্র ছেলে ব্যস্ত বই নিয়ে; সে জীবনে কখনও কোনো পরীক্ষায় সেকেন্ড হয়নি। বই ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো কিছুতে তার আগ্রহ নেই। এসব কিছুর ভিতরে আছে মানুষকে কোনো কিছুতে বুঁদ করে রাখা। কনজিউমার সোসাইটি যার যে-বিষয়ে আগ্রহ তাকে অতিমাত্রায় সেটার মধ্যে বুঁদ করে রাখতে চায়। যেমন-বড়ো মেয়েকে রূপচর্চা, ছোট মেয়েকে পোষা কুকুর আর ছেলেকে বইয়ের মধ্যে। যেগুলো কোনো না কোনোভাবে ব্যক্তিকে দেহ ও আত্মার ভোগে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। আর এমনভাবে বুঁদ করে রাখে, যা সমাজ-চৈতন্য তৈরির সুযোগ নস্যাৎ করে দেয়। যা অধিকাংশক্ষেত্রেই তার সামাজিক সত্তার চেয়ে ব্যক্তিসত্তা বা জৈবিকসত্তাকে প্রবল করে তোলে। আর তাই আমাদের মধ্যে ভোগ ও কামনার প্রতি এতো বেশি আসক্তি, এতো বেশি বাসনা দেখা দেয়। ফলে কর্তব্য ও সুযোগ-সুবিধার ভিত্তিতে যে-সামাজিক সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠিত ছিলো, পুঁজির আগ্রাসী রূপ তা ধ্বংস করে অর্থের সম্পর্কে পরিণত করে। এ-জন্য বৃদ্ধের ছেলেমেয়েরা বুঝতে পারে না, তার বাবা শুধু অর্থ-বিত্ত বা অর্থের সম্পর্কের মধ্যে স্বস্তি খুঁজে পাচ্ছেন না। বরং তার কাছে যৌথভাবে বসবাসই সুন্দরভাবে বাঁচার প্রধান নিয়ামক।

কিন্তু বর্তমানের মানুষগুলো সামগ্রিকভাবে চিন্তা না করে তার ব্যক্তিগত মুনাফার জন্য উৎপাদন করছে। ফলে তাকে বাজারের জন্য উৎপাদন করতে হয়, ব্যবহারের জন্য নয়। কারণ, বাজারের প্রতিযোগিতায় মেলে মুনাফা। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয়, ব্যক্তি সমস্ত কর্তব্য ও দায়িত্বের মাপকাঠি হিসেবে টাকাকে বিবেচনা করছে। সামাজিক সম্পর্কের এই শৈথিল্যের ফলে ব্যক্তি যে-কিসিমের স্বাধীনতা লাভ করছে তা রূপ নিয়েছে ভুয়া স্বাধীনতায়। যা পরিবারের মৌলিক বন্ধনগুলোকে দিন দিন আলগা করে দিচ্ছে। মানুষে মানুষে সম্পর্ক, সামাজিক রীতি-নীতি, আচার-আচরণ, বিবাহ, প্রথা ইত্যাদিতে আনছে পরিবর্তন। সবচেয়ে কাছের মানুষটির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আশা-আকাক্সক্ষা, অনুভূতিগুলো যেনো গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে।

রঞ্জনাদের আগমন : যূথবদ্ধ পরিবার ও বিশ্বাস-সম্পর্কের ধূম্রজাল 

মৃত্যুর অভিনয় করে হলেও বৃদ্ধ এক পর্যায়ে তার ছেলেমেয়েদের একত্রিত করতে সক্ষম হন। হয়তো বৃদ্ধ বাবা তার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি পেয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে থাকেন। ঠিক এমন এক সময় রঞ্জনার আগমন ঘটে। আগন্তুক রঞ্জনা নানা কায়দায় পারিবারিক বন্ধন ও আমরা কেন্দ্রিক চিন্তার সন্নিবেশ ঘটাতে থাকে। কিন্তু হঠাৎ সত্যজিতের আগন্তুক-এর মতো এই আগন্তুকের (রঞ্জনা) আগমনও সবাইকে বিস্মিত ও সন্দিহান করে তোলে। সিআইএ এজেন্টদের মতো রঞ্জনার মধ্যে তারা একজন চে, একজন কাস্ত্রো কিংবা একজন রাউলের ছায়া খুঁজতে থাকেন। বৃষ্টির ছন্দে রঞ্জনা নেচে-গেয়ে সবাইকে মুখরিত করলেও কর্পোরেট-সিভিল-মিলিটারি কেন্দ্রিক বিশ্বনেতাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় বৃদ্ধের দুই মেয়ে। নানামুখী সন্দেহের তালিকা তৈরি হতে থাকে। প্রথমত, রঞ্জনার কাছ থেকে পরিবারের সবাইকে বিচ্ছিন্ন করার প্রক্রিয়া চলে। কিন্তু ততোদিনে রঞ্জনা তার কাজ গুছিয়ে এনেছেন। বৃক্ষবাসী পড়ুয়া ছেলে বই ছাড়ে রঞ্জনার গান শোনার জন্যে। আবার মেয়ে রাত্রির ভয়ে জামাতা করিমের লুক্কায়িত নিজের ভালোলাগা বিষয়গুলো অর্থাৎ নাচ-গান পেখম মেলে রঞ্জনার আনাগোনায়। বাড়িতে যেনো আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। উগ্র মেজাজের বৃদ্ধ প্রথমে সহ্য করতে না পারলেও পরে রঞ্জনাকে থাকার আমন্ত্রণ জানায়। সম্পর্কগুলো নতুন করে মাত্রা পেতে থাকে। প্রচণ্ড রকম বৃত্তের মধ্য থেকে সম্পর্কগুলোতে যে-বহুরৈখিকতা তৈরি হয়েছিলো তা নির্মোহ ভালোবাসার এক কেন্দ্রের দিকে এগোতে থাকে। 

পাঠক লক্ষ করুন, আধুনিক সমাজে মানুষের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের ভূত এমনভাবে আসন গেড়ে বসে, ব্যক্তি পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন ও আত্মমগ্ন থাকাকে সংস্কৃতি হিসেবে বেছে নেয়। তাই রঞ্জনারা যূথবদ্ধতা, সামগ্রিক সুখের ঝাণ্ডা নিয়ে এলেও রাত্রি-লিনাদের কাছে ষড়যন্ত্র মনে হয়। এতে রঞ্জনারা হোঁচট খায় ঠিকই, কিন্তু কোনোভাবেই তাদের থেমে যাবার কারণ থাকে না। কারণ, রঞ্জনারা থামলে অনেক কিছুই থেমে যায়। সেই থেমে যাওয়া ওই বৃদ্ধকে আবার নিয়ে যায় নিঃসঙ্গতার অন্ধকারে; সন্তানকে বিচ্ছিন্ন করে বাবা-মা থেকে। আর রাত্রি-লিনারা ব্যক্তিবিচ্ছিন্ন হয়ে তাদের যাবতীয় ভোগ-বিলাস, চাহিদা পূরণের জন্য উন্মাদের মতো ছুটতে থাকে; সোজা হিসেবে না গিয়ে শান্তির রূপায়ণ খুঁজে ফিরে অন্য নীড়ে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি তারা শান্তি খুঁজে পায়?

নারী-পুরুষের সম্পর্ক : সভ্যসমাজের গোলকধাঁধায় শিল্পী ও সংস্কৃতি

নারী প্রপঞ্চটি নিয়ে একটু গোড়া থেকে শুরু করা যাক। আদিম যুগে যখন শ্রেণি-শোষণ, ব্যক্তিগত সম্পত্তি (ও রাষ্ট্র) ছিলো না, তখন নারী ছিলো না পুরুষের অধীনে। এমনকি সেই সময়ের যূথবদ্ধ সমাজে বয়স্ক নারী বা মার সম্মান ও কর্তৃত্ব ছিলো সবার চেয়ে বেশি। পুঁজির তথা ব্যক্তিগত সম্পদের উৎপত্তির সঙ্গে সেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটে, নারী পুরুষের পদানত হয়। ফ্রেডরিক এঙ্গেলস বলছেন, মায়ের সেই অধিকার উচ্ছেদ হবার ঘটনাটি ছিল নারীর বিশ্ব-ঐতিহাসিক পরাজয়। পুরুষ ঘরের মধ্যেও কর্তৃত্বের লাগামটি ধরলো, নারী পদানত হলো, দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ হলো, পুরুষের লালসার দাসীতে পরিণত হলো, শুধু সন্তান জন্মদানের যন্ত্রে পরিণত হলো।

এই অবদমিত বা দাসত্বের অবস্থার কখনও কোথাও কিছু হেরফের হলেও দাস-সামন্ত যুগে প্রায় একইরকম ছিলো। মূলত নয়া পুঁজির দৌরাত্ম্যেই অর্থনৈতিকভাবে নারী হয়ে গিয়েছিলো নিঃস্ব। ফলত নারী পুরুষের পুরোপুরি বশে চলে এসেছিলো। নয় নম্বর বিপদ সংকেত-এ নারীর বশে চলে যাওয়ার উপস্থাপন চোখে পড়ার মতো। শ্বশুরের মিথ্যে মৃত্যুর আয়োজনকে জামাতারা নিছক পাগলামি মনে করেন। দুই জামাতা আর ছোট মেয়ে এ-সমস্যা সমাধানকল্পে শলাপরামর্শ করতে থাকেন। শেষে সিদ্ধান্তে পৌঁছেন, বৃদ্ধের একজন সার্বক্ষণিক সঙ্গী দরকার। তাই শ্বশুরকে বিয়ে দিতে হবে। আর পাত্রী হিসেবে নির্বাচন করেন কাজের মেয়ে রহিমাকে। এতে ছোট মেয়ে লিনা আপত্তি জানান। এর কারণ অবশ্য অন্য কিছু নয়, কাজের মেয়েকে ছোট মা বলে সম্বোধনে তার যতো আপত্তি। বড়ো জামাতার যুক্তি, তাতে সমস্যা কী? রহিমা কাজের মেয়ে বলে তার ভালো বিয়ে হবে না!

এদিকে রহিমা দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে এসব কথা শোনে, আনন্দিত হয়। বাংলোর ম্যানেজারকে রহিমা জিজ্ঞেস করে, বড়ো সাহেবের জমির পরিমাণ কতো? বিয়ের কথার কানাঘুষা শুনেই এ-প্রশ্ন রহিমা করে অনেকখানি গৃহকর্ত্রীর ভঙ্গিমায়। একই ঢঙে চলে আরও নানান কথাবার্তা। এমনকি রহিমা যখন ঘরে ফিরে দেখে বৃদ্ধ তার নাতি-নাতনিকে নিয়ে খেলছে, সেও খেলায় অংশ নেয়। বৃদ্ধ অবাক হয়ে তার দিকে তাকালে রহিমা লজ্জাবনত হেসে বলে, কিছু না, আপনারা খেলেন। 

পাঠক লক্ষ করুন, সমসাময়িককালে সর্বত্রই নারী মুক্তির হাওয়া বইছে। আবার তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এ-কাজে অন্যতম ভূমিকা রাখছে গণমাধ্যমও। কেউ বলছেন, গণমাধ্যম নারী স্বাধীনতার ধারক-বাহক। আবার কেউ বলছেন, গণমাধ্যমই নারীকে পণ্য করছে; যা বাজারে আলু পটলের মতো বিক্রি হচ্ছে। সেটি ভিন্ন কথা। তবে এটি অনস্বীকার্য যে, অন্যতম একটি গণমাধ্যম হিসেবে চলচ্চিত্রের একটি বড়ো অংশ জুড়ে থাকে নারীর উপস্থাপন। অন্যান্য চরিত্রের মতো সমাজের বিভিন্ন স্তরের নারীর ভূমিকা চলচ্চিত্রে উঠে আসে। এই সিরিয়াস মাধ্যমটিতে হুমায়ূন এমনভাবে রহিমাকে উপস্থাপন করলেন-যেখানে রহিমা বিয়ের আলাপ শুনেই আত্মহারা। নানা স্বপ্নে বিভোর; দিশ-কূল পাচ্ছে না। ভুলেই গেছেন পাত্র অশীতিপর বৃদ্ধ!

পাঠক, সামন্ততান্ত্রিক সমাজের দিকে ফিরে তাকালেই এর রূপায়ণ খুঁজে পাবো। পুরুষ প্রাধান্যশীল সে-যুগে নারীর অবস্থান ছিলো ভয়াবহ। সামন্তপ্রভুরা একাধিক স্ত্রী থাকা সত্ত্বেও রক্ষিতা পালন করতো। শুধু সামন্তপ্রভুই নয়, সমাজের যেকোনো বিত্তশালী অর্থের করাঘাতে যেকোনো বয়সী নারীকে বিয়ে করতে পারতো। হুমায়ূন এখানে হাস্যরসাত্মকভাবে দর্শককে বিনোদন দিতে গিয়ে নারীকে কি সামন্তীয় কায়দায় উপস্থাপন করেননি? সিনেমাটিতে এই অংশটুকু এভাবে উপস্থাপন করাটা কাহিনীর জন্য কতোটাই-বা প্রয়োজন ছিলো? অবশ্য শেষ পর্যন্ত মিজানের সঙ্গেই রহিমার বিয়ে হয়। তবে হুমায়ূনের এই নির্মম ব্যঙ্গটুকু কিন্তু নারী অধস্তনতায় বাস্তব হয়ে থেকে যায়।

আমার আছে জল-এ দুর্ঘটনায় স্বামীর মৃত্যুর পর নিশাতকে নিয়ে তার মা চিন্তিত হয়ে পড়েন। প্রচলিত সমাজব্যবস্থায় স্বামী সম্পর্কিত ধারণাটি এমনভাবে নারীর মধ্যে চর্চা হয়-যাতে একজন বিত্তশালী, শিক্ষিত, ক্ষমতাবান পুরুষই তার একমাত্র আশ্রয়স্থল হয়ে ওঠে। কিন্তু নিয়তির নির্মমতা এই পতিকে কেড়ে নিয়ে নিশাতকে নিঃসঙ্গ করে দিয়েছে। তাই ভারাক্রান্ত মা এর একটা হিস্যা খুঁজতে থাকেন। আর অবকাশ যাপনে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে হলেও (মায়ের ইচ্ছায়) সুপাত্র সাব্বির আহমেদ তাদের সঙ্গী হয়।

অথচ এতোদিনের ভালোবাসার মানুষ জামিল ভাই নিশাতের কাছে নীরবেই থেকে যায়। জামিল মনে-প্রাণে নিশাতকে ভালোবাসলেও সেটি মূল্যায়নের প্রয়োজন পড়ে না-অনেকক্ষেত্রে প্রশ্নই আসে না। কারণ জামিল, টুনটুনির বাবা অথবা সাব্বির সাহেবের মতো যোগ্য নয়। জামিল তাই নিশাতের মনে বন্দি থাকলেও জীবনসঙ্গী হওয়ার বিষয়টি তার মায়ের কাছে ভয়ঙ্কর বিষয় হিসেবে ধরা দেয়। কারণ, তাদের মা যেভাবে একজন সরকারি কর্মকর্তার অধীন-এ নিজের সুরক্ষা খুঁজেছিলেন, ঠিক তেমনি মেয়েদের জন্যও সাব্বির আহমেদদের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। অন্যদিকে, দিলশান/দিলুও ভালোবাসে জামিলকে। এবারও মায়ের বাধা। অতঃপর দিলু জানতে পারে, নিশাতও ভালোবেসেছিলো জামিলকে-তখন ৭০ দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের মতো সে নিজের বেঁচে থাকার অনর্থকতায় আত্মহত্যা করে।

লক্ষণীয় বিষয়, জামিল এর আগে নিশাতকে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করতে যাওয়ার সময় পথিমধ্যে নিশাত ট্রেন থেকে নেমে বাড়ি ফিরে এসেছিলো। নিশাতের এই আচরণে কষ্ট পেয়ে জামিল কিন্তু তখন আত্মহত্যা করেনি; সে দিব্যি বেঁচেছিলো নিশাতহারা হয়ে! পুরুষ-জামিলকে না পেয়ে নারী-দিলশান ঠিকই মরে, উল্টোটা হলে পুরুষ জামিল আর মরে না। তার মানে কি, কাঙ্ক্ষিত পুরুষ না পেলে নারীর বাঁচার আর কোনো অবলম্বন নেই, আর পুরুষের বেলায় আছে? হুমায়ূনের মতো এতো আধুনিক নির্মাতাও কিন্তু পুরুষ প্রাধান্যশীলতার এই গ্যাঁড়াকল থেকে বেরোতে পারেননি। পরিচালক ও কাহিনীকার হিসেবে তিনি শেষ পর্যন্ত পুরুষই থেকেছেন।

সভ্যতা ও শহুরে মানুষের ডিসকোর্স

দিলশান শহরে বড়ো হওয়া ১৭ কিংবা ১৮ বছরের মেয়ে। শহুরে সভ্যতার বিশ্বাসবোধ, ধারণা, কল্পনাবিলাস, মানবিক অনুভূতিগুলো নিয়ে তার বসবাস। এখানে সহানুভূতি, সহমর্মিতা, দয়াশীলতা ইত্যাদি মানবিক বিষয়গুলো এমনভাবে গড়ে ওঠে যে, অনেকটা যান্ত্রিক কিংবা গ্রামীণ মানুষের মানবিকতা বা আতিথেয়তার চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম বা অন্যরকম। অনেকক্ষেত্রে স্বার্থকেন্দ্রিক। যদিও শহুরে সভ্যতার শুরুতে সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে সেটি ছিলো প্রগতিশীলতা। তবে এখন সেই জীবন একটা বদ্ধ খাঁচা। তবে পাখিরা সেই খাঁচার বৃত্তেই দুরন্ত ছুটে চলে। আর এই ছুটে চলা নাগরিক জীবনে টেনে আনে জনবিচ্ছিন্নতা, ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিকতা, আদর্শ বিবর্জিত নানা অপরাধ। শেষ পর্যন্ত এ-জীবনের রূপ হয়, বিষময় আর মরীচিকার পিছনে ছুটে চলার মতো।

দিলশানও এই খাঁচার বাইরের কোনো পাখি নয়। তাই দিলশানরা সহজেই কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না। আমার আছে জল-এ বনের মধ্যে বেড়াতে গিয়ে সাপ দেখে ভয় পেয়ে দৌড়াতে গিয়ে দিলশান দিক হারিয়ে ফেললে, সে দারস্থ হয় পাশের এক কাঠুরিয়ার। কাঠুরিয়া তাকে বাংলোতে পৌঁছিয়ে দেওয়ার কথা বললে গড়পড়তা শহুরে মানুষের মতো দিলশান তাকে দুষ্টুলোক ভাবে। জানিয়ে দেয়, সে তার সঙ্গে যাবে না। যাবেই বা কেনো? শহরে এরকম পরিস্থিতিতে অপরিচিত লোকের সঙ্গে যাওয়া মানে বিপদ ডেকে আনা। তাই দিলশান ভুল পথে একা হাঁটতে শুরু করে গভীর অরণ্যের দিকে। এবার শহুরে ভাষায় বন্য কাঠুরিয়া নিরুপায় হয়ে দিলশানের পথে বাধা দিয়ে টেনে, জোর-জবরদস্তি করে বাংলোর দিকে নিতে থাকে। দিলশানের চিৎকার, চেঁচামেচিতে সে কর্ণপাত করে না। বাংলোর সামনে গিয়ে কাঠুরিয়া বলে, এই যে-বাংলো! আপনি তো উল্টো দিকে যাইতেছিলেন। তখন দিলশানের ভুল ভাঙে, সে বিস্মিত হয়।

দিলশানের মতো অনেকের মনে গ্রাম্য-বন্য মানুষদের নিয়ে এক ধরনের ডিসকোর্স তৈরি হয়ে গেছে। এরা দরিদ্র, নোংরা, দুষ্টু, লোভী, অপরাধপ্রবণ ইত্যাদি। মোটকথা, গ্রামের মানুষ ভালো নয়। কারণ, তাদের পরিচিত গ্রামের মানুষগুলোর বেশিরভাগই ধরা দেয় গৃহকর্মী, শ্রমিক-মজুর, রিকশাওয়ালা হিসেবে। নিরন্ন, শোষিত এসব মানুষের মধ্যে কেউ কেউ কখনও কখনও মৌলিক তাড়না মেটাতে বিপথে পা বাড়ায়। আর তা-ই শহুরে মানুষের কাছে গ্রামের মানুষের প্রতীক হিসেবে দেখা দেয়, তারা সতর্ক হয়। নিজে সতর্ক হওয়ার পাশাপাশি তা বিলোই সন্তানদের ওপরও। এজন্যই দিলশানরা আস্থাহীনতায় ভোগে, বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে।

শ্রেণি-জীবন-বিশ্বাস : নিম্নবর্গের শিল্প যখন অসাধারণ কাব্য

গণমাধ্যমের সঙ্গে পুঁজির সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ। তাই গণমাধ্যম সবসময় চেয়েছে পুঁজি ও তার বিকাশ। তাই পুঁজিবাহী এলিটশ্রেণির সংস্কৃতিই গণমাধ্যমের মূল উপজীব্য হয়ে ওঠে। অথচ এর বাইরে নিম্নবর্গের যে-বৃহৎ অংশ রয়েছে, তাদের দৈনন্দিন জীবনাচরণ, চিন্তা-চেতনা, অনুভূতি গণমাধ্যমের আধেয় থেকে দিন দিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে। তার জায়গা দখল করেছে বিমূর্ত, কল্পনাবিলাস, বাস্তবজীবন বিবর্জিত নানা প্রপঞ্চ। জানা-অজানা, বেনামী কতো মানুষ কালে কালে লোকসংস্কৃতি চর্চা করেছেন, সমৃদ্ধ করেছেন সংস্কৃতি; কিন্তু তার হিসাব আর মেলেনি। তা বর্ণিত হয়েছে নিম্নবর্গের মানুষের লঘু-সংস্কৃতি রূপে।

তাইতো টুনটুনিকে খুঁজে পাওয়ার পর ঘরোয়া সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে নিম্নবর্গের মানুষগুলোর লঘু-সংস্কৃতির উপস্থাপন দেখে শহুরেরা বিস্মিত হয়। অনুষ্ঠানের শুরুতে ওসি কামরুলের ম্যাজিক দেখানোর কথা শুনে নিশাতের বাবা অবসরপ্রাপ্ত বড়ো পুলিশ অফিসার তাচ্ছিল্য করে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে যখন ওসি চমৎকার ম্যাজিক দেখান, ওই নিশাতের বাবাই তখন সবাইকে দাঁড়িয়ে সম্মান দেখাতে বলে। এরপর গৃহপরিচারক আলিম এসে পাতার বাঁশি ও মাজেদা বেগম ঝাড়ু নৃত্য দেখান; আর জামিল দেখান নানা ঢঙের অভিনয়। নিশাতের বাবাদের দৃষ্টিতে এ মানুষগুলো অকর্মা-শিল্পবিবর্জিত-অপদার্থ। কিন্তু যখন এ মানুষগুলোই তাদের নিজস্ব পরিসর পেয়ে অসাধারণ সব শিল্পকর্ম প্রদর্শন করে, তখন তা নিশাতের বাবা হয়ে পুরো উচ্চবর্গকে উপহাসে ফেলে। একই সঙ্গে শিল্প-সাহিত্য শুধু এলিটদের, সনাতনী এই ধারণাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখায়।

এখানে ব্রাজিলিয় দার্শনিক, শিক্ষাবিদ পাওলো ফ্রেইরির শিক্ষাদর্শন বা নিরক্ষর জনগোষ্ঠী নিয়ে ভাবনাটা অতিপ্রাসঙ্গিক। তার মতে, মানুষ প্রচলিতভাবে যতই অজ্ঞ হোক না কেন, সে তার জগৎকে বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টি দিয়ে দেখতে সক্ষম। ফ্রেইরি মনে করেন, অনক্ষর জনগোষ্ঠীর জন্য পড়তে ও লিখতে পারা যতখানি দরকার, তার চেয়ে বেশি দরকার বরং তাদের নিজেদের ইতিহাসটা জানা ও নিজেদের অনুকূলে ইতিহাস সৃষ্টি করা। সমাজের নিম্নবর্গের মানুষ তথা আলিম ও মাজেদারা হয়তো নিরক্ষর কিন্তু তারা নিজেদের জানতে, বুঝতে শিখেছিলো। তাই তারা জগতকে ঠিকই বিশ্লেষণাত্মক দৃষ্টি দিয়ে অনুধাবন করে নিজেদের স্বতন্ত্র জায়গা খুঁজে পেয়েছিলো। পাতার বাঁশি আর ঝাড়ু নৃত্য এরই ফল।

বর্তমানে সার্টিফিকেট শিক্ষাতন্ত্রেবুলি আওড়ানোকেই শিক্ষা হিসেবে ধরে নেওয়া হয়। প্রকৃতির সঙ্গে নিরন্তরভাবে মানবের রূপান্তর-তৎপরতার মধ্যেই তার যে-সংস্কৃতি প্রকাশ পায়, এটি তাদের কাছে অগুরুত্বপূর্ণ থাকে। কেননা তারা বিশাল নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মানুষের ওতপ্রোত অন্বয় ও বোঝাপড়ার সম্পর্ক গুরুত্ব দেয় না। নিশাতের বাবার ক্ষেত্রে এরকমই ঘটেছিলো। অথচ ইতিহাসে কালে কালে এই মানুষগুলোই সমাজ-সভ্যতার চাকা ঘুরিয়েছে। স্পার্টাকাস থেকে শুরু করে বৃটিশবিরোধী মঙ্গল পাণ্ডে কিংবা একাত্তরের নুরলদীনরা এর জীবন্ত উদাহরণ। এদেশের লালন, করিমদের জীবন-দর্শন আমাদের নিম্নবর্গের মাহাত্ম্যর কথা ক্ষণে ক্ষণে স্মরণ করিয়ে দেয়। হুমায়ূনের অন্তর্দৃষ্টি হয়তো সেটি ধরতে পেরেছিলো।

আধুনিকতার নামে নজরবন্দি : উন্নত সভ্যতা যখন স্বশাসনের হাতিয়ার

দুই দুয়ারী-তে স্কুলপড়ুয়া টগরের গল্পের বই পড়া আর আঁকা-আঁকি নিয়েই যতো আগ্রহ। কিন্তু এটি তার পরিবারের অনেকের কাছে অনর্থক কাজ। তার গল্পের বই পড়া, ছবি আঁকা দেখলে সবাই ধিক্কার দেয়, অত্যাচার করে। কারণ, সে স্কুলের পরীক্ষায় কম নম্বর পায়, সেখানে তার আগ্রহও কম। পরিবারের সবাই চিন্তিত। তাকে গোল্লায় যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে রাখা হয় গৃহশিক্ষক। প্রচলিত ধারায় গৃহশিক্ষক ইংরেজি বানান মুখস্থ করানোর চেষ্টা করেন। টগর সঠিকভাবে বলতে না পারলে ভয়ঙ্কর ক্ষিপ্ত হন তিনি। গল্পের বই ছিঁড়ে ফেলা হয়। পরিস্থিতি এমন হয়, ভয়ে টগর প্যান্ট নষ্ট করে ফেলে। এর মধ্য দিয়ে প্রচলিত সমাজ টগরের নিজস্ব সত্তা, শিল্পকে অস্বীকার করে। বাচ্চাদের ব্যাপারে অভিভাবকরা এভাবেই প্রচলিত শিক্ষা কাঠামোর বিকল্প কিছু ভাবতে পারেন না।

ধরুন বিদ্যালয় বা পাঠশালার কথা। যেখানে টগরকে মানুষ করার জন্য পাঠানো হয়। এটি মূলত ১৭ শতকে শিশুদের গোল্লায় যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে গড়ে উঠেছিলো। বিশেষ করে তাদের মনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। অর্থাৎ এক ধরনের ডিসিপ্লিনের মধ্যে রাখা। সেখানে আচরণ আশিষ্ট না হলে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে দেখা হতো। কারণ, বিদ্যালয়ের পরীক্ষা মানে নির্ধারিত জ্ঞান ছাত্র-ছাত্রীরা কতোটা অর্জন করেছে তার বিচার। ঠিক টগরকেও একই বিচারে অপরাধী করা হয়েছে। ফুকো যেটিকে বলেছেন, বিদ্যালয়ের ভিতরেই একটি ছোট আদালত আর সে আদালতে টগরের দণ্ড হলো কম নম্বর পাওয়া। আর এর শাস্তি হলো গৃহশিক্ষকের অমানুষসুলভ আচরণ। তার মানে এটি কারাগারের মতোই। আর অভিভাবকরা এটি করছেন নিজেদের ইচ্ছায়। এ-প্রসঙ্গে রুশোর উক্তিটিও তাৎপর্যপূর্ণ। রুশো বলছেন, মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায়, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত। কারণ, মানুষ মানুষের কাছেই পরাধীন। তাই টগরের মতো কোমল প্রাণগুলো স্বাধীনভাবে বিচরণ করতে চাইলে বাবা-মারা স্বপ্রণোদিতভাবে বন্দিশালা তৈরি করে দেয়।

আরেকটি বিষয় দেখুন, টগরের আঁকা সেই অনর্থক ছবিগুলো আরেক কারাগারের বাসিন্দা টগরের মানসিকরোগী ফুফুর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। তিনি ঘরের মধ্যে সেগুলো যত্ন সহকারে টাঙিয়ে রাখেন। প্রচলিত সমাজ তাকে পাগল বলে আখ্যায়িত করলেও তিনি ঠিকই টগরের গৃহশিক্ষকের বিরুদ্ধে চড়াও হন। ইংরেজি বানান না পারায় মাস্টারমশাই টগরকে শাস্তি দিলে তিনি এটা মেনে নিতে পারেননি; খুন করতে পর্যন্ত উদ্যত হন। নিজের দৃশ্যত বন্দিত্বের কাছে মেনে নিতে পারেননি টগরের অদৃশ্য বন্দিত্বকে। আবার টগরের বাবা তার আদরের বোনের পায়ের শিকল খুলে দিতে পারেননি। অথচ টগরের মা পাগল ননদকে আপদ বলে পাগলাগারদে রেখে না আসা পর্যন্ত বাড়ি ফিরবে না বলে সিদ্ধান্ত নেয়। এরকম উভয় সঙ্কটে টগরের বাবার ভিতর-বাহিরে যুদ্ধ চলে; সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব করেন। আধুনিক এই মানুষগুলো স্বশাসনে হাবুডুবু খায়। হুমায়ূনকে হয়তো এ-ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক নির্মমতা আঘাত করেছিলো। মানুষের এই বন্দিত্ব তিনি হয়তো মেনে নিতে পারেননি। তাই শিল্পী হুমায়ূন সমাজকে আঘাত করেছিলেন আরেক শিল্পমাধ্যম চলচ্চিত্র দিয়ে।

ম্যাজিক রিয়ালিজম ও মানব মনের ভিতর-বাহিরের খেলা

মন অর্থ চিত্ত, হৃদয়, অন্তর, মানস ইত্যাদি মর্মগ্রাহীশব্দ হতে পারে। তবে এটি আসলেই অন্তরের সৌন্দর্য বা অন্তর্মাধুর্য, মানসিক ঐশ্বর্য বা অন্তর সম্পদ বলে বিবেচিত। মানুষের মন যে কী জিনিস, তা বুঝতে হলে কোথায়-কতোদূর যেতে হবে, তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। কোথায় অতলে সন্ধান মিলবে, তা কে জানে? তবে অতলের সন্ধান না থাকলেও চেতন, প্রাক-চেতন, অবচেতন মনের খেলা যে-আছে তা অনস্বীকার্য। দুই দুয়ারীতে তরুদের গাড়িতে দুর্ঘটনার শিকার হয় সাদা ক্যাপ মাথায়, হাতে গিটার নিয়ে চলা এক যুবক। অদ্ভুত এই যুবক তার নাম, ঠিকানা কিছুই বলতে পারে না; কেবল ফ্যাল-ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। চিকিৎসার জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে বাসায় নিতে হয়। তাকে দ্রুত বিদায়ের চেষ্টা থাকলেও ঠিকানার অভাবে উপায় থাকে না। রহস্যময় কিন্তু অসহায় এই মানুষটির ওপর মেয়ে-মা অবচেতনভাবেই ক্ষিপ্ত, বিরক্ত। বাবা মানে গৃহকর্তা উপায়ন্ত না দেখে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন পর্যন্ত দেয়। তাতেও কাজ হয় না। তবে এই সময়ের মধ্যে টগর ও গৃহকর্মীদের সঙ্গে যুবকের সখ্যতা হতে থাকে। আর হুমায়ূনও ধীরে ধীরে ওই যুবকটির মধ্য দিয়ে ওই পরিবারের মানুষগুলোর মনের ভিতরের মানুষটাকে উন্মোচন করতে থাকেন।

আপাত একটি মানুষে থাকে একটি মন। কিন্তু এর ভিতরে কখনও দুটি সত্তা খেলা করে। অনেকটা কানামাছি খেলায় মানুষ ঘূর্ণিপাক খাওয়ার মতো। শফিক ও তরুর বিয়ের কথাই ধরুন। ঘনিষ্ঠ প্রেমে বিয়ের প্রশ্নে বাধা হয়ে দাঁড়ায় পারিবারিক মর্যাদা। কারণ, তরুর মা তরুকে বারবার বোঝানোর চেষ্টা করে-ছেলে যতোই যোগ্য হোক, একজন ভিক্ষুকের নাতির সঙ্গে বিয়ে হতে পারে না। তরুও আরেক সত্তা দিয়ে মায়ের কথা মেনে নেয়। শফিককে প্রত্যাখ্যান করে। কিন্তু তরুর মনে স্বস্তি আর আসে না। অন্য আরেকটি সত্তা জাগলে, চলে দুই সত্তার যুদ্ধ। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে যৌক্তিক সত্তাটি টিকে যায়। ছোট বোনকে নিয়ে একই ধরনের যুদ্ধ চলে টগরের বাবার মধ্যেও। শেষ পর্যন্ত তিনিও বোনকে মুক্ত করে দেন। এ-মুক্তি শুধু মানসিক-রোগী টগরের ফুপুর নয়, টগরের বাবারও-সব বাধা পেরিয়ে মুক্তির নিশানা ওড়ানোর মতো। সবসময় যে-কেবল মুক্তি আসে এমন নয়, চলে অবদমনও। যেনো ঘুড়ি ওড়ে-সারাক্ষণ, সারাদিন; তবে নাটাই কোথায় যেনো বাঁধা। একইভাবে নানা টানাপোড়েনের মধ্যেও ভিতরের মানুষটির জোরে গৃহকর্মী মোবারক শেষ পর্যন্ত বিয়ে করেন প্রেমিকা কুদরতি বেগমকেই। মনের এই খেলা ও রহস্যের উন্মোচনকে অনেকটাই ম্যাজিকের মতোই মনে হয়। যার প্রাতিষ্ঠানিক নাম দেওয়া হয়েছে ম্যাজিক রিয়ালিজম

তত্ত্বীয়ভাবে ম্যাজিক রিয়ালিজম নিয়ে নানা কথাবার্তাও আছে। রোর মৌলিক ধারণা অনুযায়ী ম্যাজিক রিয়ালিজম হলো উত্তর-এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার সমার্থক। তবে এটাকে অনেকেই কুহকী মনে করেন। কারণ হলো উত্তর-এক্সপ্রেশনিস্ট চিত্রকলার সমস্ত ছবির উদ্দেশ্য ছিলো দৈনন্দিন জীবনের রহস্যজনক উপাদানগুলো মেলে ধরা। অর্থাৎ রোজকার জীবনের চমকের সামনে মানুষের বিস্ময়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ করা।১০ এই বিস্ময়কর অভিব্যক্তিগুলো ধরতে পারলে আমাদের জীবন অনেক সহজ হয়ে যায়। দুই দুয়ারীর শেষাংশে পাগল বোনের মুক্তি, তরুর শফিকের কাছে ফিরে যাওয়া এবং গৃহকর্মীদের মিলন সবই মনের রহস্যের উন্মোচন। আর এই মানুষগুলো মনের ভিতরের দিকটা উন্মোচন করতে পেরেছিলো বলেই হয়তো খুঁজে পেয়েছে জীবনের প্রশান্তি। হুমায়ূন শেষ পর্যন্ত হয়তো সবার মধ্যে এই প্রশান্তিই ফিরে আনতে চেয়েছিলেন।

সৃষ্টির উষালগ্ন থেকে মানুষ নানা দ্বন্দ্ব-সংঘাত ও চিন্তাশ্রমের মাধ্যমে নিজেকে বিকশিত করেছে। কিন্তু এই বিকাশ যখন নিয়ন্ত্রণাধীন থাকেনি, তখন ফ্রাঙ্কেনস্টাইনরূপে ধ্বংস করেছে নিজেকেই। আর এভাবেই একটি সভ্যতা বা সমাজ ব্যবস্থার সৃষ্টি, তারপর বিকাশ, পরে ধ্বংস। তবে এসব কেবল জন্ম-বিকাশ-ধ্বংসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি; জন্ম হয়েছে আরেক সভ্যতা, সমাজের। এরই ধারাবাহিকতায় কি তাহলে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা বা তথাকথিত আধুনিক সভ্যতার দীনতা চলছে? হুমায়ূন কি তার চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এসবের ইঙ্গিতই দিয়েছেন?

লেখক : এম জিয়াউল হক সরকার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী। পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ফ্রিল্যান্স লেখালেখি করেন।

ziamcj@gmail.com

 

তথ্যসূত্র

১. লোপা মিত্রের গান।

২. বন্দ্যোপাধ্যায়, শিবাজী (১৯৯৮ : ১৭ ); ভূমিকা পর্ব; সংস্কৃতির ভাঙ্গা সেতু; আখতারুজ্জামান ইলিয়াস; মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।

৩. বিশ্বায়ন, আধুনিকতা ও পশ্চিমবঙ্গ বইয়ের ২৩ পৃষ্ঠার আধুনিকতা, সমাজ ও মানুষ প্রবন্ধ থেকে নেওয়া হয়েছে। প্রবন্ধটির কপি লেখকের কাছে থাকলেও ভুলবশত তিনি তথ্যসূত্র টুকে রাখতে ভুলে গেছেন। কেউ চাইলে লেখক এটি সরবরাহ করতে রাজি আছেন।

৪. ফ্রেডরিক এঙ্গেলস, উদ্ধৃত; রনো, হায়দার আকবর খান (২০১১ : ৪৭); নারীমুক্তি, নারী আন্দোলন ও মাকর্সবাদীরা; কমরেড; সম্পাদনা-হায়দার আকবর খান রনো; বর্ষ-২, সংখ্যা-২, ঢাকা।

৫. সংস্কৃতিবিদ্যার একটি কেন্দ্রীয় প্রত্যয় হচ্ছে ডিসকোর্স। ভাষার ধারণা, প্রথাগত ভাষাতত্ত্ব যেভাবে দাঁড়িয়েছে ডিসকোর্সের আলোচনা তা একেবারেই বদলে দিয়েছে। সাধারণভাবে মনে করা হয়, কোনো বিষয় নিয়ে পরস্পর সম্পর্কিত লেখা বা উক্তির সমাহার হলো ডিসকোর্স। কিন্তু মিশেল ফুকো এর অর্থ একদম বদলে দিয়েছেন। ফুকোর মতে ডিসকোর্স হলো-একটি বিষয় সম্পর্কে নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ভাষার ব্যবহার ও চর্চার মাধ্যমে উৎপন্ন জ্ঞানের রিপ্রেজেন্টেশন। ফুকো মনে করেন, ডিসকোর্স হলো কোনো বিষয়ের নির্মাণ। এটি বিষয়বস্তুকে উৎপন্ন ও সংজ্ঞায়িত করে। কীভাবে কোনো ধারণা চর্চার অন্তর্ভুক্ত হয় এবং তা অন্যের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করে এই বিষয়গুলোকে ডিসকোর্স প্রভাবিত করে।

৬. পাওলো ফ্রেইরি, উদ্ধৃত; আহমদ, যেহীন (মাঘ-১৪১৮ : ৯); প্রচেতনীকরণ ও পাওলো ফ্রেইরি; মাসিক উত্তরাধিকার; সম্পাদনা-শামসুজ্জামান খান; বর্ষ-২৯, সংখ্যা-১০, বাংলা একাডেমী, ঢাকা।

৭. প্রাগুক্ত; আহমদ, যেহীন (মাঘ-১৪১৮ : ৯)।

৮. বন্দ্যোপাধ্যায়, সন্দীপ (২০০৭ : ২৪৭ ); পাঠশালা, কারাগার : ফুকো; মিশেল ফুকো পাঠ ও বিবেচনা; সম্পাদনা-পারভেজ হোসেন; মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।

৯. রুশো, উদ্ধৃত; গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল (১৩৯৮ বাংলা : ৬); ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ; আনন্দ পাবলিকেশন, কলকাতা।

১০. মুখোপাধ্যায়, সৌগত (২০১০ : ৫২৪); ম্যাজিক রিয়ালিজম; বুদ্ধিজীবীর নোটবই; সম্পাদনা-সুধীর চৌধুরী; নবযুগ প্রকাশনী, ঢাকা।

 

 

 

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন