Magic Lanthon

               

মৃণাল সেন

প্রকাশিত ২৬ আগস্ট ২০২৩ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

সিনেমা, একটা উঠতি প্রপঞ্চ

মৃণাল সেন

সিনেমার শুরুতে শব্দ ছিলো না, ছিলো ভিজ্যুয়াল। দীর্ঘ একটা সময় অতিবাহিত হওয়ার পর ভিজ্যুয়ার নিজে যখন রূপালি পর্দায় শব্দের অভাব বোধ করলো ঠিক তখনই শব্দের আগমন। শব্দ ভিজ্যুয়ালকে নেতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করে না বরং উভয়ই স্থায়িত্বের সঙ্গে একই জমিনে একসাথে বসবাস করতে চায়। শব্দ আসার পর চলচ্চিত্র খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে অডিও-ভিজ্যুয়াল আর্টে পরিণত হয়। যদিও নথি সংরক্ষণকারীরা শব্দ এবং ভিজ্যুয়ালের প্রবীণত্ব ও নন্দনতাত্ত্বিক অগ্রাধিকার নিয়ে বিতর্কে লিপ্ত হন। এই বিতর্ক দীর্ঘদিনের। কিন্তু আসল ব্যাপার হলো, আধুনিক সিনেমা যতোটা শ্রবণনির্ভর (Aural) ততোটাই দৃশ্যনির্ভর (Visual)।

সিনেমা একটা উঠতি প্রপঞ্চ, যাকে আসলে তার নিজস্ব মেথোডোলজি ও টেকনিকাল পারফরমেন্স দিয়েই বিচার করতে হবে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা ও এর ক্রমবর্ধমান মাত্রাগত রূপান্তর/পরিবর্তনের ওপর ভর করে সিনেমাও প্রতিনিয়ত তার আকার ও ফর্ম পরিবর্তন করে চলেছে। আজ অবধি বিচিত্র/বৈচিত্রময় প্রকাশভঙ্গি/অভিব্যক্তির কারণে সিনেমা তার অসামান্য ইতিহাস অবিশ্বাস্য গতিতে ক্রমবর্ধমান প্রক্রিয়ায় প্রচার করছে। সেই সঙ্গে বিস্তার ঘটিয়েছে তার কাজের পরিধিও। কাজেই সিনমোর ক্ষেত্রে শেষ কথা বলে কিছু নাই। হয়তো আগামী বহু বছর থাকবেও না।

সম্প্রতি কলকাতায় নির্বাক যুগের আমেরিকান সিনেমা এই বিষয়ের ওপর একটা সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়েছে। অনুষ্ঠানটির আয়োজক ছিলো [USIS : United States Information Service]। এবং অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিভিন্ন ফিল্ম সোসাইটির আগ্রহী ব্যক্তিবর্গ ও অসংখ্য গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। নির্বাক যুগের চলচ্চিত্র মহারথীদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন ছিলো সেমিনারের গুরুত্বপূর্ণ একটা কর্মসূচি। তো তাদেরকে সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে। তখন একজন অতি-উৎসাহী বুদ্ধিজীবী গোছের লোক বলে বসলেন, নির্বাক যুগে চ্যাপলিন তার সময়ের সেরা নির্মাতা ছিলেন। আমি তৎক্ষণাৎ দাঁড়িয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলাম তিনি তাহলে চ্যাপলিনের Monsieur Verdoux (1947) সিনেমাটার ইমেজ ও সাউন্ডট্র্যাককে কীভাবে বিবেচনা করবেন, যেটা সারা বিশ্বের সিনেমা ইতিহাসে অন্যতম এবং উল্লেখযোগ্য একটা সিনেমা হিসেবে বিবেচিত হয়? উনার উত্তর আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। কিংবা উনি যে উত্তর দিয়েছিলেন সেটা পরিতৃপ্ত হবার মতোও ছিলো না।

আমার কাছে এমন কিছু অসংশোধনযোগ্য প্রবণতাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে যার বশবর্তী হয়ে আমরা যারপরনাই কোনো বিষয়কে টেনে উপরে তুলি আবার নিচেও নামাই। এটা আমাদের জাতীয় অসুখ।আমি জিজ্ঞেস করতে চাই, কেনো একজনকে নাকচ করে আরেকজনকে দাঁড়াতে হবে? কেনো তাদের দৃষ্টিভঙ্গিকে সম্মান করে সেটাকে সামনে রেখে বিষয়বস্তুর দিকে তাকানো হয় না? আমরা কেনো অবজেক্টিভ হয়ে উঠতে পারছি না? আমি এখানে সব ধরনের নস্টালজিক চিন্তা/ঘোরের বিরুদ্ধে জোড়ালো প্রতিবাদ/কারণ দর্শানোর চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করেছি সিনমোকে একটা উঠতি প্রপঞ্চ হিসেবে হাজির করতে। একারণেই আমি সবসময়ই সিনেমার নতুনত্ব/সিনেমার নতুন চেহারা অনুসন্ধান করি। এবং আধুনিক সিনেমাতে সেটা পরিষ্কারভাবে লক্ষণীয়। আধুনিক সিনেমা হয়ে উঠেছে নতুনত্বের ধারক।

তাহলে নতুনত্বই কি আধুনিক সিনেমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ? অবশ্যই না। উদ্দেশ্য ছাড়া নতুনত্ব আসলে অর্থহীন। নৈতিক জায়গা থেকে কাজটা না করা হলে সেটা সবচেয়ে বেশি হাস্যকর, ভয়াবহ এবং একধরনের জুলুম বলেই মনে হবে। সকল শিল্পের মতো সিনেমাও মানুষের সৃষ্টি। মানুষের জন্য,  মানুষের ব্যাপারে কথা বলে সিনেমা। সিনরমা আসলে একটা সামাজিক কর্মকাণ্ডের মতো,  যে দিক থেকেই তাকানো হেক না কেনো সিনেমা মূলত কল্যাণকামী বা পরহিতব্রতী। সক্রিয়/কার্যকর যোগাযোগের যতো উপকরণ রয়েছে সিনেমা তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক উপকরণ/মাধ্যম বলে মনে হয় আমার। একদিক থেকে একজন নির্মাতা মাধ্যমটির প্রতি ভালোবাসা অনুভব করে ও বুঝতে পারে যে এটা কোনো স্থির মাধ্যম নয় বা সবসময় গতিশীল একটা মাধ্যম।

অন্যদিকে তিনি তার পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলির দিকেও নজর ও সাড়া প্রদান করেন। একজন নির্মাতার কাজ তার নিাের সময়টাকে বুঝতে পারা ও বুঝতে পারার মাধ্যমে একটা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করা। এবং অনবরত তার বিশ্বাসকে খুঁজে বেড়ানো। একবার তার খোঁজ পেয়ে গেলে একজন নির্মাতা সেটা তার দর্শকদের সামনে হাজির না করে থাকতেই পরবেন না। কোন উপায়ে তিনি তার স্বর দর্শকের সামনে উপস্থাপন করবেন সেটা একেবারেই নির্মাতার ব্যক্তি-মানুষের ওপর নির্ভর করে। উপায় অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে কারো মধ্যে একধরনের গভীর বিযুক্ততা খেয়াল করা যায়, আবার কেউ কেউ এই উপায় অনুসন্ধানের ব্যাপারে তীব্রভাবে যুক্ত থাকেন। যুক্ততা কিংবা বিযুক্ততা যাই বলি না কেনো একজন নির্মাতার কাজ সে যে মাধ্যমে কাজ করছেন তার সর্বোত্তম ও কার্যকর ব্যবহার,  আর তার মাধ্যমে একজন ভালো যোগাযোগ স্থাপনকারী হয়ে ওঠা।

নির্মাতা যদি এটা করতে পারেন তাহলে তিনি তার লক্ষ্য ভেদ করতে পারবেন, আর যদি কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতে না পারেন তাহলে তিনি ব্যর্থ হবেন এটা নিশ্চিত। যে নির্মাতা কার্যকর যোগাযোগ স্থাপন করতে না পেরেও বলেন ব্যর্থ হননি, তিনি আসলে ভয়ংকর ও ডাহা মিথ্যা কথা বলেন। আমি বেশ কয়েকবার ব্যর্থ হয়েছি। বার বার ব্যর্থ হয়েও নিজের মধ্যে সাহস জুগিয়ে নতুন করে শুরু করেছি। দিলখোলা মন নিয়ে আমি আমার নিজের ব্যর্থতা, সেইসঙ্গে দর্মকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে না পারার কারণ অনুসন্ধান করেছি। আমি দর্শকের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও এই যোগাযোগ প্রক্রিয়ার মধ্যে যে বিরাট 'ফাক' থেকে যায় সেটাকে দেখতে পেরেছিলাম আমার অনবরত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এবং এখনও আমি সেই প্রচেষ্টা জারি রেখেছি। এর জন্য আমি একটা বহুল ব্যবহৃত শব্দ ব্যবহার করবো : 'এক্সপেরিমেন্ট'। (দুর্ভাগ্যবশত সিনেমা-ব্যবসার প্রয়োজনে 'এক্সপেরিমেন্ট' শব্দটাকে এতো বেশি বিকৃত করে ফেলা হয়েছে যে শব্দটা শোনা মাত্রই এমন কিছু অদ্ভুত সিনেমা মাথায় চলে আসে যেগুলো গণমানুষের কাছ থেকে লক্ষ-যোজন দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।)

 

 সিনেমা বর্তমানে যে অবস্থায় আছে সেখান থেকে ক্রমাগত তার আকার ও ফর্ম পরিবর্তন হচ্ছে। এর ফলে সিনেমা নিয়ে সবসময়ই পরীক্ষা-নিরীক্ষার সীমাহীন সুযোগও তৈরি হয়েছে। অল্প কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া ভারতের খুব কম সংখ্যক নির্মাতাই তাদের পূর্ববর্তী নির্মাতাদের অর্জন ও দেখার দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে দাঁড়িয়ে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন/করতে পেরেছেন। সিনেমা নিয়ে আমাদের এমন সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা হওয়া দরকার যা এর কর্ম পরিসরের বিস্তার ঘটাবে, সিনেমার নতুন ধারা আবিরভাব ঘটাবে ও তা যথাযথভাবে আইডেন্টিফাই/চিহ্নিত করবে। সর্বোপরি, সিনেমা মাধ্যমটিকে সমাজ পরিবর্তনের তীক্ষ্ণ/ ধারালো হাতিয়ার হিসেবে গড়ে তুলবে।

২০-এর দশকের শেষ কিংবা ৩০-এর দশকের শুরুর দিকে রামিয়ার নির্মাতা ও নন্দনতাত্ত্বিক সের্গেই আইজেনস্টাইন কার্ল মার্কসের দ্য ক্যাপিটাল চলচ্চিত্রায়নের ভাবনা ভেবেছিলেন। জিগা ভের্তভ তার বহুল  জনপ্রিয় ও পরিচিত 'কিনো-আই' তত্ত্বের মাধ্যমে চলচরচিত্রের অভিশপ্ত নায়ক-নায়িকাদের রূপালি পর্দায় উপস্থাপন করেন ও তাদের ওপর নৃশংস আক্রমন ঘটান। অথচ এগুলো সবটাই ছিলো কল্প-নির্ভর। অবাস্তব। এর অনেক পরে জ্যঁ -লুক গদার তার ধ্যান-ধারণাগুলোকে তাত্ত্বিক ভিত্তি দেওয়ার জন্য দুই সদস্য বিশিষ্ট সিনেমার ইউনিট গঠন করেন, যার নাম রাখা হয় 'জিগা ভের্তভ গ্রুপ'। এছাড়া আর্জেন্টাইন নির্মাতা ফার্নান্দো সোলানাস সিনেমাকে পরোপুরি নির্দেশনামূলক করে তোলেন। সমান্তরালে গবেষণা ও মার্ক্সিস্ট পার্টির প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা সিনেমায় ব্যবহার করতে থাকেন। রোচা সহিংসতার নন্দনতত্ত্ব তুলে ধরেন তার সিনেমায়। মার্কার তার ধারণাকে সিনেমার মাধ্যমে গণমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান। সিনেমাধ্যম নিয়ে করতে থাকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা।

দীর্ঘ একটা সময় আমার পার হয়েছে সিনেমার সঙ্গে বসবাস করে। এই দীর্ঘ সময়ে আমি নানা অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার মধ্যদিয়ে গেছি___আমার মধ্যে নিছক হতাশা কাজ করেছে, নানান ধরনের কার্যক্রম, যেমন সমসাময়িক রাজনৈতিক বিতর্ক নিয়ে ছোটো ছোটো পুস্তিকা রচনা থেকে শুরু করে গল্প লেখা, প্রজ্ঞাপনের উপসংহার লেখা, মূল ধারা যে 'গল্প বলার ঢঙ' সেখান থেকে বিচ্যুতি, জীবনের ছোটো ছোটো সুক্ষ্ম ঘটনাগুলকে উপেক্ষা করা_ প্রতিনিয়ত এরকম হাজারো অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে আমাকে যেতে হয়েছে। এসবই আমার চিন্তাভাবনায় প্রভাব ফেলেছে, এটা আমি নির্দ্বিধায় স্বীকার করি। এটাই আমার যেমন অভিজ্ঞতা লাভের জায়গা (সিনেমা) তেমনই পরীক্ষা-নিরীক্ষারও ক্ষেত্র। আর এটাই সেই জায়গা যেখানে আমি আমার নিজেকে আবিষ্কারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

যতোদুর মনে পড়ে গতবছর বার্লিনে আমি একজন আফ্রিকান নারী নির্মাতার সিনেমা দেখেছিলাম। সিনেমাটাতে একজন অ্যাঙ্গোলানের [আফ্রিকা মহাদেশের একটা দেশ অ্যাঙ্গোলো ও তার নাগরিকদের বলা হয় অ্যাঙ্গোলান] দৃশ্য ছিলো। একজন অ্যাঙ্গোলান যুবক, যিনি তার যোগ্যতানুসারে একটা সম্মানজনক জীবন যাপন করতে চান।  ঔপনিবেশিকরা এই কারণেই তাকে জেলে আটকে রাখে। যুক এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও এই আটকে রাখাকে প্রত্যাখ্যান করেন। যার জন্য তাকে জেলখানাকেই পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়। কী ভয়ানক একটা দৃশ্য!

সিনেমা শেষ করে থিয়েটার থেকে বাইরে বেরিয়ে একজন ব্রিটিশ চলচ্চিত্র সমালোচকের সঙ্গে আমার মোলাকাত হলো। তার মতে,  সিনেমাটাতে পর্যাপ্ত গভীরতা নাই। অথচ সিনেমাটাকে আমার জীবনের খুব কাছাকাছি মনে হয়েছে। এি জায়গা থেকেি আমি সিনেমাটাকে দেখেছি। আমার এখনো মনে আছে, তারা এতো ভদ্রতা, সভ্যতা নিয়ে কথা কপচায়,  একারণেই আমার মুখ ফসকে একটা কথা বের হয়ে গেছে___ইংলিশ চ্যানেলের ওপার থেকে আসা ওই গুণী সমালোচককে বললাম: আপনি বোধ হয় জানেন না আপনার পূর্বপুরুষরা আমাদের সবকিছু লুট করেছে, গভীরতা বলতে আপনি বোধ হয় সিনেমাটাতে এটাই মিস করেছেন, তাই না?

Views on Cinema; Cinema, A Growing Phenomenon: Page: 7-9.

 

অনুবাদ : মাহমুদুল হাসান

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন