Magic Lanthon

               

সেলিম আহ্‌মেদ ও রাজীব আহ্‌সান

প্রকাশিত ০৮ ডিসেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

'সকালবেলা মাটি কাটতে যাই, রাত্রে আসার সময় টাকা নিয়ে চলে আসি'

সেলিম আহ্‌মেদ ও রাজীব আহ্‌সান


যারা শহীদ হয়েছেন তারা বোধহয় বেঁচে গেছেন। কারণ আমরা যা দেখছি তা তো আর তাদের দেখতে হয়নি-মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে এমনই মূল্যায়ন রাইসুল ইসলাম আসাদের। ৭১-এ সম্মুখযুদ্ধে অংশ নেওয়া এই মানুষটির মঞ্চ,বেতার,টেলিভিশন ও চলচ্চিত্রে সরব উপস্থিতি ছিলো দীর্ঘসময়। সেই ১৯৭২ সালে মঞ্চে কাজ করার মধ্যে দিয়ে অভিনয় জীবনের শুরু। ১৯৭৩ সালেই প্রথম কাজ করেন চলচ্চিত্র আবার তোরা মানুষ হ-তে। সেই বছরই বন্ধুরা নিজেরা মিলে ঢাকা থিয়েটার গঠন করেন। আসাদুজ্জামান মোহাম্মদ রাইসুল ইসলাম আসাদের জন্ম ১৫ জুলাই ১৯৫২,ঢাকায়। ১৯৯৩ সালে পদ্মা নদীর মাঝিতে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। টেলিভিশন-নাটক এখানে নগর-এ অভিনয় করে ব্যাপক খ্যাতি পান। তার অভিনীত উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে ঘুড্ডি (১৯৮০),সুরুজ মিয়া (১৯৮৫),নদীর নাম মধুমতি (১৯৯৪),দুখাই (১৯৯৭),লাল দরজা (১৯৯৭),কীত্তনখোলা (২০০০),লালসালু (২০০২),লালন (২০০৪),দূরত্ব (২০০৬),মনের মানুষ (২০১০),আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১)। ২০১০ সালে আলো ছায়া নামে একটি ধারাবাহিক নাটক পরিচালনাও করেন আসাদ। ম্যাজিক লণ্ঠন-এর পক্ষ থেকে রাইসুল ইসলাম আসাদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলেছেন সেলিম আহ্‌মেদ ও রাজীব আহ্‌সান।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আসাদ ভাই,আমরা আসলে জানতে চাচ্ছি যে,২০১৩-এর এটা জুন মাস;শেষ ছবিটা আপনার কোন্‌টা,মানে আপনার অভিনীত?

রাইসুল ইসলাম আসাদ : শেষ অভিনীত ছবি মৃত্তিকা মায়া। গাজী রাকায়েত অনুদান পেয়েছে সরকার থেকে,সেটা অবশ্য শেষও করেছে। ছবিটার প্রিন্ট অলরেডি চলে এসেছে এবং আজকেই বোধ হয় মৃত্তিকা মায়া দেখলো মন্ত্রী মহোদয়।তারপরে বোধহয় ফাইনাল সেন্সরে জমা দেওয়া হবে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এই ছবিটায় আপনার অভিনীত অংশটা মানে চরিত্রটা আপনার কেমন লাগছিলো করতে?

আসাদ : আসলে হয়েছে কী,ছবিতে যখন কাজ শুরু করেছিলাম ১৯৭২ সালে। আর ছবি শুরু করেছি ১৯৭৩ সালে। তারপর থেকে এই পথ পরিক্রমায় আপ্লুত হয়ে পড়ি-এ রকম না। প্রথম-প্রথম যেটা হতো একটা কাজ করে,মানে কে কী বলছে,না বলছে,কে কিভাবে দেখছে, কে বললো, কী বললো-এ রকম একটা বিশাল ব্যাপার হতো আর কী। আর এখন কাজ করার পরে আসলে নিজেই নিজের ক্রিটিক হয়ে গেছি। মনে হয়,এই জায়গাটা এ রকম হলো কেনো, এই জায়গাটা এ রকম না করলেও পারতাম,এই ডেলিভারিগুলো যদি দিতে পারতাম। মানে বিভিন্ন রকমভাবে নিজেকে নিজে এখনো শোধরানোর চেষ্টা করছি। ওই যে খ্যাতি স্থায়ী হওয়ার যে ব্যাপারটা,তুমি দেখোনা,আমার মনে হয় স্যাটিসফেকশন হয়ে যাওয়া মানে ফেইল করা।

যে কেউ যদি অভিনয় ধরেন কখনো যদি তিনি স্যাটিসফাই হয়ে যান,তাহলে তারপর আর তার কাজ করা উচিত নয়,অভিনয় করা উচিত নয়; অন্য কাজ করবে। স্যাটিসফেকশনের যে ব্যাপারটা,এর মধ্যে কোনো কোনো জায়গা হয়তো একটু ভালো লাগে,কখনো আবার পুরোটা ভালো লাগে না। এমনি আমার অভিনয়,আমি ও অন্যরা দেখবে এবং মনে করেন আপনার প্রিয় অভিনেতা কে,আপনার প্রিয় অভিনেত্রী কে? আমার ওই রকম কোনো প্রিয় অভিনেতা বা প্রিয় অভিনেত্রী নেই। কোনো একটা অভিনেতার কোনো একটা কাজ বা কোনো একটা চরিত্র বা চরিত্রের অংক ভালো লেগে যায়। পরের ছবিতেই দেখা গেলো,তার ওই কাজটা আর ভালো লাগলো না। প্রিয় অভিনেতার সব কাজই যে ভালো লাগবে-এটা তো আমি খুঁজে পাই না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : কিন্তু এটাতো হয়,যেমন আপনি যখন পদ্মা নদীর মাঝিতে যে চরিত্র করেছেন,কুবেরের চরিত্র।আবার এইটা কি কখনো আপনার সমস্যা তৈরি করে না যে,আপনি ঘুড্ডিতে একটা দায়িত্বজ্ঞানহীন যুবকের চরিত্রে অভিনয় করছেন-এগুলো কি মানসিক সমস্যা তৈরি করে? না এই রকম হয়-এই চরিত্রটা, মানে আমাকে টানছে না খুব একটা বা এটা...

আসাদ : প্রথমত,আমি যেটা মনে করি,আমরা এই কর্মকাণ্ডটি যারা করি,তারা একশত ভাগ মানসিক সুস্থ মানুষ না। আর মানসিক শতভাগ সুস্থ মানুষের পক্ষে আমার মনে হয়,অভিনয় করা সম্ভব না।কারণ একজন একশ ভাগ সুস্থ মানুষের পক্ষে আর একটা চরিত্রে নিজেকে দাঁড় করানো,নিজেকে সেই চরিত্রে নেওয়া অসম্ভব প্রায়।এর ভিতরে কিছু একটা অসুস্থতা বলো,অ্যাবনরমালিটি বলো বা অন্যকিছু একটা আছে।একশত ভাগ সুস্থ মানুষের তো অভিনয় করা সম্ভব না-এটা আমি এতোদিনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছি।যারাই অভিনয় করে,কনটিনিউ করে যায়,কেউ হয়তো একটা দুইটা করলো আর করলো না-তারা বোধ হয় সুস্থ মানুষ।নিজে নিজে বুঝতে পারে,সেজন্য হয়তো তারা আর অভিনয় করে না-এটা একটা ব্যাপার। আর একটা আছে,অনেকে একটা-দুইটা অভিনয় করেই হয়তো আর পছন্দ করে না,এই জন্য অভিনয় ছেড়ে দেয়। এই জন্য যেটা বলি যে,এক আমি যেমন, আমিইতো ধরো কতো, ৪০ বছর ধরে কাজ-কাম নিয়মিতভাবে করছি।বিভিন্ন রকম চরিত্রে অভিনয় করেছি। মঞ্চে, টেলিভিশনে তারপরে বাংলাদেশ বেতারে,চলচ্চিত্রে-সব জায়গায়।আমি সব মাধ্যমে কাজ করেছি। তাতে করে যখন যে কাজটা করি,তখন সেই কাজটাকে কিভাবে; মানে ওকে করবো, এইটা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করি,যেকোনো চরিত্রই হোক না কেনো।সব চরিত্র তো আর করি না, যেটা পছন্দ হয় না বা ভালো লাগে না সেরকম কিছু বা যেটা মনে হয় আমি পারবো না,ভালো লাগার কথা না বা মন্দ লাগার কথা না,আমার মনে হয় এটা আমি করতে পারবো না বা আমার দ্বারা এটা সম্ভব না।

একটা চরিত্র করতে গিয়ে এমনও হয়েছে-আমি মনে হয় পারবো না, করবো না, জোর করে করেছি।কিন্তু সেই চরিত্রটা দেখে অনেকের কাছে ভালো লেগেছে-এ রকমও হয়েছে।আর একটা জিনিস হয়েছে কী,শিল্প যেটা,শিল্প কিন্তু করা যায় না,হয়ে যায়।ভালো ছবি করার চেষ্টা হতে পারে,ভালো অভিনয় করার চেষ্টা হতে পারে-কোনোটা হবে কোনোটা হবে না।আমি ভালো চেষ্টা করলেই যে ওটা ভালো হয়ে যাবে,কেউ ভালো ছবি তৈরি করতে চায়,ভালো করবেই বলে যদি শুরু করে,তাহলে ভালো নাও হতে পারে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : মানে আপনি এই রকম স্মৃতি কাতরতায় ভোগেন কি না যে,যখন আপনি পদ্মা নদীর মাঝি করছেন;একটা দল,সেই পুরো দলের যে একটা মানসিক যোগাযোগ,এখন কি আপনার মনে হয় ওইটা আদৌ পাচ্ছেন না বা ওইটা আপনি মিস করেন? এ রকম হয় যে, এখনকার ইউনিটে গেলে আপনার...

আসাদ : এখনতো ছবি করাই হয় না,ওই মনের মানুষ করেছিলাম। তারপরে এই করলাম মৃত্তিকা মায়ামনের মানুষ ২০১০-এ,আর এটা করলাম ২০১২-তে। তাতে করে ছবি তো আর খুব একটা করা হয় না। যে বয়সে চলে এসেছি, যে অবয়ব আমার এখন, তাতে করে তো আর সবরকম চরিত্র করা সম্ভব না। আমার করার মতো চরিত্র যদি কেউ মানে ডিরেক্ট করতে চায়,তখন সম্ভব। এটা খুব একটা আমাদের দেশে হয় না। তো সেজন্য এখন ম্যাক্সিমাম টেলিভিশন মিডিয়ার জন্য কাজ করি,সেখানে ব্যাপারটা তো একটা এক ঘণ্টার নাটক দুই দিনে শুটিং হয়।সেইখানে একটা ইউনিটের দানা বাঁধার যে ব্যাপারটা,একজনের সঙ্গে একজনের যে ক্যারেক্টার বা চরিত্রে আমরা অভিনয় করছি,প্রত্যেকের সঙ্গে প্রত্যেকের যে মানসিক লেনদেন চরিত্রের জন্য...ব্যাপারটাই তো নাই।

সেটা মঞ্চে সম্ভব, যদি রিহার্সেলটা হয়। ফিল্মে যেটা হতো, একটা চলচ্চিত্র হয়তো একবছর ধরে শুটিং হচ্ছে ভাগে ভাগে, কিন্তু এটার ভিতরে একটা ইউনিট বা কো-অ্যাক্টর, অ্যাকট্রেস, ডিরেক্টর, অ্যাসিসট্যান্ট-ডিরেক্টর, ক্যামেরাম্যান, টেকনিশিয়ান এদের মধ্যে একটা অদ্ভুত রকমের সম্পর্ক তৈরি হয়।একটা ভিশন প্রয়োজন হয়।এখন যে আমরা বাংলাদেশের বিভিন্ন সারির মিডিয়ার জন্য,বিভিন্ন চ্যানেলের জন্য,যেসব কাজ করি-এটা আমরা বোধহয় ডেইলি লেবার হয়ে গেছি।ডেইলি লেবার-এর মতো সকাল বেলা মাটি কাটতে যাই,রাত্রে আসার সময় টাকাটা নিয়ে চলে আসি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এই যে অস্থিরতা,এই অস্থিরতাটা আসলে শিল্প-সংস্কৃতিকে কিছু দিবে না,মানে আমি বলছি যে,এটা শুধু একধরনের বাণিজ্যিকীকরণ হয়ে যাচ্ছে?

আসাদ : ঠিক,পুরো ব্যাপারটাই হলো বাণিজ্যিকীকরণ।চ্যানেলগুলো বাণিজ্য করছে,আমরা অভিনেতা-অভিনেত্রী,পরিচালক বা যে সমস্ত প্রোডাকশন হাউজ আছে-সকলের অর্থ উপার্জন মুখ্য উদ্দেশ্য হয়ে গেছে।আর বাণিজ্য ছাড়া শিল্প করতে গেলে যেসময় দরকার,তার জন্য যে অর্থ দরকার,সেই অর্থ এখন আসলে কোনোভাবেই কোনো চ্যানেল বা কেউ অনুদান দিতে পারছে না বা দিচ্ছে না। যে পরিমাণ টাকা দিয়ে কাজগুলো করতে হয়,সে টাকা দিয়ে একটু ভাবনা-চিন্তা করে সময় নিয়ে কোনো কাজ করার মতো অর্থনৈতিক সামর্থ্য বা সাপোর্ট যেটা বলে-সেটা আমরা ভাবতে পারছি না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : বাইরে যেমন হচ্ছে যে,এইচবিওর মতো প্রতিষ্ঠান;সে যখন একটা সিরিয়াল করছে ওইটাকে একটা এপিক-এর জায়গায় নিয়ে যেতে চাচ্ছে বা ওইখানে আমরা আবার দেখি যে,ওরা ফিরে আসছে একটা বড়ো কাজে বা বড়ো একটা কিছু করছে।আপনি কী মনে করেন,এই রকম কিছু হলে এই দেশে আবার এই ব্যাপারটা তৈরি হবে কি?

আসাদ : আমি তা জানি না।মানে আমিও প্রশ্ন করি,কিন্তু উত্তরণের পথ কী-আমি জানি না। প্রথম একটা জিনিস মনে রাখতে হবে আপনাকে,৫৬ হাজার বর্গমাইলে আমরা ১৫,১৬,১৪ কোটি;একেকজন একেকটা বলে,এতো কোটি লোক বাস করি।আমার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় যে,গড়ে প্রতি কিলোমিটারে বোধহয় বারোশ জন মানুষ।এটা প্রথম আমাদের মাথায় রাখতে হবে,এর ভিতরে এখন পর্যন্ত ৭০-৭৫ ভাগ লোক ঠিকমতো লিখতে-পড়তে জানে না। সেরকম একটা দেশে এ ধরনের কর্মকাণ্ডগুলো কিভাবে হবে;এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ কী? আমি অনেক চিন্তা-ভাবনা করি,অনেক সময় করার চেষ্টা করি,এর কোনো উত্তর আমি খুঁজে পাইনি।আর এই জনগোষ্ঠীর মানুষজন-আমি সত্যি কথা বলতে কী,এদেরকে পরিষ্কারভাবে এখনো আমি বুঝি না।আগে একটা সময় ওদের বুঝতাম,এখন আর বুঝি না।

কোনো মানুষের দিকে তাকিয়ে বা কোনো মানুষের সঙ্গে কথা বলেও আমি বোধহয় তাদেরকে ঠিক মতো বুঝতে পারি না।এ রকম একটা অবস্থা আমার মনে হয়।কে কী করছে,কেনো করছে,কিসের জন্য করছে।কারণ,একটা সময় আমাদের চলচ্চিত্র জগতে আমরা দেখেছি যে, উলঙ্গ হওয়াকে কী বলে-কাটপিস্‌।জঘন্য জঘন্য অশ্লীল,অশ্লীলতার ছবিগুলো।আমি কিছু পরিচালককে,আমারই সিনিয়র বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম,আচ্ছা এই রকম কি ভাবনা মাথায় আসে না যে,আমার ছেলে বা মেয়ে যারা কলেজে পড়ছে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে-তারা তাদের বন্ধুদের বলবে,আমার বাবার ছবি রিলিজ হয়েছে;চলো দেখে আসি।তারা যখন ছবিটা দেখবে,তারা যা দেখবে তার বাপ তৈরি করেছে,তখন ওইটাতো স্বাভাবিক ব্যাপার-এ রকমইতো হবে,ওইটাই শিখবে তারা।তো তার সন্তান কী শিখবে সেটা কি একবারও চিন্তা করে না,কী দেখবে,কী জানবে,কী বুঝবে এই ভাবনাটা কি মাথায় আসে না?

তো দুই-একজনকে বলা হলো, তারা গালাগালি করেছে আমাকে-বেশি ভাবি,বেশি চিন্তা করি।আর দুই-একজন বলেছে,এতো ভাবতে হবে না,এতো চিন্তা করতে হবে না।অর্থাৎ,আমরা যদি আমাদের নিজেদের সন্তানদের ভালো-মন্দের দিক চিন্তাও না করি,অন্যের সন্তান অন্য মানুষ;অন্যের কথা বাদই দিলাম,নিজের পরিবার,নিজের সন্তানের কথাও বোধহয় আমরা এখন ভাবি না,চিন্তা করি না।শুধু আমারটাই চিন্তা করি এবং অর্থের চিন্তা করি।এই অবস্থার ভিতর দিয়ে মনে হয় আমরা দৌড়াচ্ছি,রান করছি।

ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি যখন মঞ্চে অভিনয় করতেন,তখন তো আপনি যে নাটকটা করছেন না,আপনার পরিচিত অন্য আরেকটা দল নাটকটা করছে,সেই নাটকটা তো আপনি দেখেছেন।এখন আমরা হয়তো একদমই অবাক হবো না,যদি শুনি,আপনি যে নাটকে অভিনয় করেন সেটিও দেখেন না।...তার মানে কি বিনোদনের জায়গাটা শেষ হয়ে গেলো? নাকি আমরা অস্থির হয়ে গেলাম?

আসাদ : আমরা ঠিক জানি না।আমাদের এখানে মনে করো,দেখো না-ওরা কী দেখছে? দেশের বাইরের বিভিন্ন চ্যানেল দেখছে, দেশের বাইরের বিভিন্ন নাটক দেখছে,দেশের বাইরের বিভিন্ন অনুষ্ঠান দেখছে। আমাদের দেশের গানের অনুষ্ঠানগুলো,এই যে বিভিন্ন রিয়েলিটি শো যেগুলো হয়,ক্লোজআপ ওয়ান এ ধরনের।তার চাইতে বেশি পপুলার মনে হয়,ওখানে পশ্চিমবঙ্গে বা হিন্দি যে সমস্তগুলো হয় বিভিন্ন চ্যানেলগুলোতে।আমি যেখানেই যাই,যাদের ওখানেই যাই,যাদের সঙ্গে কথা বলি-ওগুলো নিয়েই বেশি আলোচনা করে,বেশি কথা বলে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এই যেমন আমরা শুনতে পাই,এদেশের অনেকে,একটা বড়ো শ্রেণির দর্শক নাকি ভারতিয় সিরিয়াল দেখে।আমাদের সিরিয়াল দ্যাখে না মানে এইটা কি যে,আমরা টানতে পারছি না? আমাদের গল্প হচ্ছে না,নাকি আমরা বিনোদনের মাত্রাটাই আসলে বুঝি না?

আসাদ : অ্যা...বুঝি না কেনো।আমাদের লোক দেখতো না-বলছো?

ম্যাজিক লণ্ঠন : একসময় দেখতো।

আসাদ : আমাদের নাটক,আমরা পশ্চিমবঙ্গে যখন যেতাম তখন কলকাতায় দূরদর্শন ছিলো না।আমরা যখন কলকাতায় যেতাম তখন অন্যান্যরা,বাংলাদেশের আশেপাশে যে স্টেটগুলো আছে...সেখানে আমরা অনেক পপুলার ছিলাম।তারা পাগল হয়ে যেতো আমাদেরকে দেখে। তারা বহু কষ্ট করে দেখতো। এখন সেখানকার ক্যাবল অপারেটররা আমাদের এগুলো চালায় না।ওখানে ওদেরকে একটা ফি দিতে হয়,আমাদের চ্যানেলগুলো বোধহয় সেটা দিবে না। কারণ,এদের বক্তব্য হচ্ছে,ওখানে আমাদের তো মার্কেট নাই।আমরা যে পণ্যের বিজ্ঞাপন দিবো-সে পণ্যের মার্কেট নাই।এ রকম অনেক কথা অনেকেই বলে।আমি এতো কিছু বুঝি না,ব্যবসা-বাণিজ্যের এতো কিছু বুঝিনি কোনোদিন,এখনো বুঝি না।তবে জানি,আমাদের দেশের লোকও দেখতো,ওখানকার লোকও দেখতো;তাহলে কেনো দেখতো?

প্রথমত,আগে আমাদের এখানে একটা সময় ছিলো বাংলাদেশ টেলিভিশন-এ এক ঘণ্টার নাটক ছিলো।এক ঘণ্টার নাটক মানে হচ্ছে ৮০ মিনিটের নাটক।তারপর নাটক হতো ৯০ মিনিট থেকে ১২০,১২৫,১৩০ মিনিটের মানে টেলিফিল্ম টাইপ।তারপরে সিরিয়াল শুরু হলো। সিরিয়ালও কী-সিরিয়ালও হচ্ছে এক ঘণ্টার,মাসে দুইটা যেতো ১৫ দিন অন্তর।দুই সপ্তাহ পরে-এই সপ্তাহে যেতো,পরের সপ্তাহে অন্য একটা নাটক,তারপরের সপ্তাহে আবারো-এটাও এক ঘণ্টার।এখন যখন চ্যানেলে শুরু হলো,এখানে হলো ৩০ মিনিটের চাঙ্ক।ঠিক আছে ২৬,২৫,২৪,১৮,১৯ মিনিট হয়,তার বাইরে বাদবাকি বিজ্ঞাপন।এখন সিরিয়াল হচ্ছে কোনোটা ১২ মিনিট,কোনোটা ১৪ মিনিট,কোনোটা ১৭ মিনিট।

ম্যাজিক লণ্ঠন : মানে গল্পও তো বলা যাচ্ছে না।

আসাদ : আমার মনে হয় কী,তিনটা চারটা সিন হয় কি না!তার মধ্যে আবার এক-একটা সিন শেষ হচ্ছে,বিজ্ঞাপন;আবার অনেক সময় শেষ হচ্ছে না,তাও বিজ্ঞাপন।কোথায় বিজ্ঞাপন যাবে (হাসি)এবং কেনো যাবে এবং সে বিজ্ঞাপনে কী চলছে!এটা একটা বেঈমানি করছে-এ রকম।তারপরে আমরা যারা অভিনয় করছি,যে সময়ের ভিতরে আমরা এক-একটা সিরিয়ালের এক-একটা পর্ব,যে টাইমের মধ্যে শুট্‌ করছি,এ অবস্থায় তাতে কতোটা কী হচ্ছে? কী অভিনয় করছি,কী অ্যানাদার কাজ দেখাচ্ছি,কী আলোর খেলা দেখাচ্ছি,কী করছি? আমার কাছে মনে হয়,এগুলো কেনো চলছে,যারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে-তারাই বা কেনো?

কোনো দর্শক যদি নাটক না দেখে,মানে যারা বিজ্ঞাপন যেভাবে দিচ্ছে-তাদের এটা দিতেই হবে।কারণ তাদের একটা অংশই থাকে বিজ্ঞাপনের জন্য-এই জন্যই হয়তো দিচ্ছে, না দিলে পরে এটার হয়তো,তাদের ট্যাঙ্-ফ্যাঙ্ ব্যাপার আছে...এ রকম কিছু বিষয়াদি আছে। সবমিলিয়ে আমার কাছে মনে হচ্ছে,একটা জগাখিচুড়ি অবস্থায় আমাদের এই মিডিয়া বা চ্যানেলগুলো চলছে।বিজ্ঞাপনের পর বিজ্ঞাপন চলেই যাচ্ছে,একই বিজ্ঞাপন;মানে একটা বিরতিতেই দেখা গেছে এক বিজ্ঞাপন ছয় বার দেখাচ্ছে,পাঁচবার দেখাচ্ছে।কী,হচ্ছে কী! অন্যান্য দেশে,শুধু ভারতের কথা বলবো না,পৃথিবীর অন্যান্য দেশে,তারা যে ডেইলি সোপ করে,একটা অভিনেতা বা অভিনেত্রী যারা প্রথম ক্যারেক্টারে অভিনয় করে,তারা ওই একটাতেই কাজ করে বছরের পর বছর ধরে।আর আমাদের এখানে আমি রাইসুল ইসলাম আসাদ-একই দিনে একই সঙ্গে,একই টাইমে দুই-তিন চ্যানেলে আমার নাটক যায়।তো দর্শক কোন্‌টা রেখে কোন্‌টা দেখবে?

ম্যাজিক লণ্ঠন : এটা একধরনের বিস্ফোরণ আসলে;ওই বিস্ফোরণটা বোধহয় অনেক বেশি চ্যানেল হওয়ার কারণে। আমাদের আগে যে আকুতিটা ছিলো বিটিভির সময়ে,আমরা একটা নাটকের জন্য একসপ্তাহ অপেক্ষা করতাম;ওই মমত্ববোধটাও ছিলো।সুতরাং পরিচালক,কলাকুশলী থেকে আরম্ভ করে সবাই একধরনের মমতা দিয়ে জিনিসটা তৈরি করতো।এখনতো দেখবারও সময় নেই,বানাবারও আসলে সময় নেই।

আসাদ : কিছুই নেই।সময় মানে কোনো কিছুই নাই বোধহয় আর। যাক,চলুক...এইসব।

ম্যাজিক লণ্ঠন : মঞ্চকে যেখানে রেখে আসলেন,এখন কী মনে হয় মঞ্চটা দেখলে-এতো বছর পরে?

আসাদ : একটা জিনিস ভালো লাগে।সবচেয়ে বড়ো কথা,আমরা প্রথমেতো মহিলা সমিতির বাহিরে...বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে,তারপরে ফাইনালি মহিলা সমিতিতেই নাটক শুরু করলাম।তারপরে আসলো গাইড হাউজ।তো খুব ইচ্ছা ছিলো,কষ্টে অন্ধ ঘরের ভিতরে গুদামের মতো অবস্থায় আমাদের পথচলা।আচ্ছা যাই হোক,এসি হয়ে গেলো,একটু আরাম পেলাম।তারপরে এখন শিল্পকলার মতো একটা জায়গা হয়ে গেছে,যেখানে নিয়মিত নাটক হচ্ছে;দুটো-তিনটা হল।সেটা একটা আমি মনে করি,বিরাট প্রাপ্তি আমাদের।প্রচুর দল,প্রচুর নাটক হচ্ছে-ভালোও হচ্ছে,খারাপও হচ্ছে।আগে ছিলো কম দল;নাটক ভালো করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা থাকতো। অনেক অফুরন্ত সময় ছিলো আমাদের হাতে।দীর্ঘসময় রিহার্সেল করে তারপর একটা নাটক মঞ্চে নামাতাম।এমনও হয়েছে,অনেক দিন নাটক রিহার্সেল করেও মনঃপূত না হওয়ায় বা মনের মতো হয়নি বলে সেখান থেকে আমরা মঞ্চে নামাইনি।

এখন সে জিনিসগুলো বদলে গেছে।সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সারা পৃথিবীর সবকিছুই চেঞ্জ হয়ে গেছে।কিন্তু আমার কাছে এখন মনে হয়,যে পরিমাণ নাট্যকর্মী আছে এবং যেভাবে তারা কাজ করছে ভালো-মন্দ মিলিয়ে,সেটা চলমান এবং চলতে থাকবে।এইটায় যা দেখতে পাচ্ছি এবং এটা দেখতে দেখতে যে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে পারবো-এটাই অনেক তৃপ্তি দেবে আমাকে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ১৯৭৩-এ যখন আপনি ছবি করা শুরু করলেন তারপরেও মঞ্চে অভিনয় করেছেন। আপনি তো আর কিছু করলেন না,মানে অন্য কোনো পেশাজীবী হলেন না;ভয় লাগেনি?

আসাদ : এইটা কখনোই ভাবি নাই বা ভয় পাইনি কখনো।মানে,আমার কাছে এটাকেই কাজ মনে হয়েছে।মানে,এইটা করতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি।আমি জীবনে কখনো অভিনেতা হতে চাইনি,অভিনয় করতে চাইনি।তারপরে ঘটনাচক্রে,মানে ঘটনাচক্রে সবাই মিলে জোর-জবরদস্তি করে অভিনয়ে নামিয়ে দিলো।তারপরে কাজটা ভালো লাগা এবং পরে দায়িত্ববোধ।দায়িত্বে পড়ে গেছি,তো এর বাইরে কোনোকিছু যে মাঝে চেষ্টা করিনি-তা না।ব্যবসা-বাণিজ্য করার চেষ্টা করেছি,হয়নি।সবাইকে দিয়ে আসলে সবকিছু হয় না।

ম্যাজিক লণ্ঠন : কিন্তু আগে,আগেতো অর্থ-কড়ির ব্যাপার ছিলো না,আপনি যখন শুরু করলেন। তখন তো...

আসাদ : না না,তখন তো আমি মঞ্চে নাটক করি।টাকা পয়সার ব্যাপার নেই।বাংলাদেশ বেতার-এ যখন শুরু করি,২০ টাকা পেতাম একটা নাটকের জন্য।

ম্যাজিক লণ্ঠন : হ্যাঁ।মানে ওইটা দিয়ে তো আর...

আসাদ : না,টেলিভিশনে অভিনয় করতাম তো।বাংলাদেশ টেলিভিশনে যখন অভিনয় করি,তখন ৫২ টাকা দিতো একটা নাটকে অভিনয় করলে।এটা বাড়তে বাড়তে ৩২০০ টাকা,৩৩০০ টাকা পর্যন্ত হয়েছিলো।

ম্যাজিক লণ্ঠন : সেটা তো আপনার জীবিকার জন্য যথেষ্ট না...

আসাদ : তারপরেও চলেছি,বিয়ে করেছি। আমার স্ত্রী চাকরি করতো, স্ত্রী খাইয়েছে, পরিয়েছে। আর আমি আরামছে ঘুরে বেড়িয়েছি, শিল্প করার জন্য জীবনপাত করেছি। কিঞ্চিৎ ভাগ্যবান পুরুষ আমি,ভাগ্যবান মানুষ আমি।এই সবমিলিয়ে ভয় পাইনি কোনোদিন।

ম্যাজিক লণ্ঠন : ক্ষোভ নাই?

আসাদ : না না।আমার যেটা মনে হয়,সবচেয়ে প্লাস, সবচেয়ে প্রাপ্তি আমার।আমার কিন্তু মাইনাস কিছু নেই।আমার পুরোটাই প্লাস।আমি যদি পিছন দিকে তাকাই তাহলে,আমি যে পরিবারে জন্মেছি-বিশাল ধনী পরিবারে না,খুবই গরিব পরিবারে।এতোগুলা ভাই-বোন মানুষ হওয়া,লেখাপড়া করা।লেখাপড়া শেষ করেছি ঢাকায়।বাংলাদেশের সবচাইতে বড়ো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করতে পেরেছি,এটা একটা বিশাল জিনিস আমি মনে করি।তারপরে কাজ করতে-করতে আমি এই যে দেশে-বিদেশে যাই, মাঝে মাঝে আমি কিছুদিন থাকার পরে টিকতে পারি না,ভালো লাগে না;চলে আসি।ধরেন,এখনো মানুষ,এখানে যেভাবে আমাকে সম্মান দেয়;সে আমার কর্ম-জগতের মানুষ থেকে আরম্ভ করে সাধারণ জনগণ।তাদের যে ভালোবাসা,ভালোলাগার মাধ্যমে;অসুস্থ ছিলাম অনেকদিন এবং সেই সময় আমার যা প্রাপ্তি।দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে যেভাবে আমি,মানে লোকজনের ভালোবাসা এবং তাদের কী বলবো!

সবকিছু মিলিয়ে যেটা জানতাম না,তাহলো-মানুষ আমাকে এতো ভালোবাসে,এতো পছন্দ করে-এগুলো ওই অসুস্থতার পরে,পরবর্তীকালে জানতে পেরেছি।এটুকু আসলে অনেক পাওয়া। আমি আসলে আমার,কী বলবো যে প্রাপ্তি অনেক।অনেক।আমি কখনোই ভাবিনি যে,আমি রাইসুল ইসলাম আসাদ বাংলাদেশের একজন অভিনেতা হিসেবে এতো বছর পার করবো।অভিনেতা হওয়ার স্বপ্নও কখনো দেখিনি।সেজন্য আমার কোনো মাইনাস নাই।মাইনাস থাকে কখন-আমি যদি আগে থেকে ঠিক করি যে,এখানে আমি পৌঁছাবো;তারপরে আমি পৌঁছাতে না পারি,তখন বললো যে,না হলো না।সেরকম কোনো ব্যাপার নেই।

মাঝখানে স্ক্রিপ্ট লিখেছি,কোনোদিন যেটা কল্পনা করিনি-তিন-চারটা স্ক্রিপ্ট লিখে ফেলেছি। স্ক্রিপ্টগুলো ভালো চলেছে।তো এইখানে যা করেছি,এখন মনে হয় যে,না;প্রথমত হচ্ছে যে,অনেক সময় লাগে,অনেক বুদ্ধির ব্যাপার,অনেক কষ্টের ব্যাপার;তারপরে স্ক্রিপ্ট লিখবো এক রকম,বলবে-এটাকে বদলে দাও,এটাকে চেঞ্জ করে দাও।প্রতিদিন এই রিরাইট করা সম্ভব না আমার কাছে।অনেক কিছুই আছে।হয় কী,একটা নতুন কিছু ভাবলাম-সেটাকে প্রথমে তো কেউ করতে চায় না।ওই পুরনো-না না,এটাকে ওইভাবে করে দাও।আবার দেখা গেলো,কিছুদিন পরে আমি যেটা লেখেছিলাম,যে ভাবনাটা হয়তো দশ বছর পরের,সেই ভাবনাটি নিয়ে কেউ একটা কাজ করলো;সেটা খুব ভালো হলো।তখন কিন্তু,এই রকম একটা লিখে দাও,আমি কিন্তু দশ বছর আগেই করতে চেয়েছিলাম।তখন আপনারা নেননি,তখন স্মরণ করে দেই।এখন আপনারাই বলছেন ওইটা করতে।তো আপনারা যেভাবে বলছেন,ঠিকই আছে ভাবনাতে।আমার কী দোষ? আমি একটু এগিয়ে আছি,আমি যেটা ভাববো,যেটা করতে যাবো-সেটা করবার মতো বা সেটাকে সাহায্য বা উপলব্ধি করবার মতো কিছু থাকতে হবে;না হয়,এই চলছে,চলবে...

ম্যাজিক লণ্ঠন : আপনি,আপনি কি আমাদের সমস্ত কর্মকাণ্ডে ভয় পান যে,এটা আসলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে বা...

আসাদ : না,আমি ভয় পাই না।আমি ভয় পাই না।আমার যেটা মনে হয় যে,মাঝে মাঝে কষ্ট লাগে,যে জগতটায় আমরা এখন যেভাবে চলছি,এভাবে না চলে অন্যভাবে হলেও পারতাম।এখন মনে কর,একটা লোক চাকরি করছে,আবার সে অভিনয় করে,সে ২৫-৩০ হাজার টাকা,৩৫ হাজার টাকা বেতনে চাকরি করে।এবং অভিনয় করে,টেলিভিশনে করছে। এখন মিডিয়াটা এতো বড়ো হয়ে গেছে, এতো চ্যানেল হয়ে গেছে যে, সে ব্যস্ততার কারণে সে চাকরি রাখবে,না অভিনয় করবে? এ করবে,তা করবে? চাকরিটা ছেড়ে দিচ্ছে।কারণ,এখানে আরো অনেক বেশি টাকা পাচ্ছে।এখানে ব্যাপারটা,অনেক বেশি টাকা পাবার জায়গায় আমরা পৌঁছে গেছি।ও যখন চাকরিটা করতো আর অভিনয় করতো,তখন চাকরিটাতে তো মনোযোগ দিতেই হতো।আর অভিনয়টাতেও অনেক মনোযোগ দিতে পারতো।কিন্তু এখন এ হাইজাম্প করে টাকা পাওয়ার কারণে তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ব্যাপারটাকে বদলে ফেলেছে।এখন গাড়ি দরকার,এখন ফ্ল্যাট দরকার।তাতে করে বিভিন্ন রকম লোন হয়ে যাচ্ছে,মাস গেলেই এতো টাকা লোন শোধ করতে হবে।এতোদিন মাসে কাজ করতেই হবে,সেটা সাপ হোক,ব্যাঙ হোক আর যাই হোক!এতোদিন কাজ করতে না পারলে কিংবা এতো টাকা না হলে আমি তো আমার এই জায়গায় পৌঁছতে পারবো না।ওইটা খারাপ লাগে।কাজটার প্রতি ভালোবাসা,ভালোলাগা বা কাজটার প্রতি যে সিনসিয়ারিটি,সেটা ছোটো হয়ে গেছে এখন।হায় হায়!এই মাসে তো মাত্র ১২ দিন কাজ আছে,আর ১২ দিন বা আর ১০ দিন না হলে কী হবে! এই ধরনের একটা অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এখন যখন কাজ করতে যান, কখনো মনে হয় না কোনো একটা তরুণ-তরুণীকে দেখলে যে, ও ভালো করতে পারতো বা ওর ইচ্ছা ছিলো এ রকম, নাকি কী মনে হয়?

আসাদ : একেবারে তরুণ-তরুণী যারা,তাদেরকে-না বুঝতে পারি না।হ্যাঁ,বুঝতে পারি না। ওদের যে ভাবনা-চিন্তা,ওরা আমাদের সামনে বোধহয় খোলা মন নিয়ে কথাও বলে না। আমি ওদেরকে ঠিক পরিষ্কার বুঝতে পারি না।আর আমরা যে বয়সে এসে পৌঁছেছি,এ বয়সের কারণে অনেক কথাবার্তা ওদের সঙ্গে আলোচনাও করতে পারি না।জিজ্ঞেস করতে পারি না,বিব্রতবোধ করি।অনেকের সঙ্গে খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়।অনেক-অনেক রেসপেক্ট করে,সম্মান দেয়।যাদের সঙ্গে একটু খোলামেলা হই,ব্যক্তিগত পর্যায়ে কথা বলতে পারি,তাদেরকে অনেক সময় বলিও।তারা তখন অকপটে অনেক কিছু বলে,অনেক কিছু স্বীকার করে যে,কেনো,কী কারণে,কী অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে,মানে ওদের ভেতর একটা অদ্ভুত কম্পিটিশন আছে।

সেই কম্পিটিশনটা মানে আমাদের সময়ে যে কম্পিটিশন ছিলো।আমরা যখন মঞ্চে অভিনয় করতাম,একই মঞ্চে আমি,আফজাল,পীযূষ,ফরিদী,সুবর্ণা,শিমুল,জহিরউদ্দিন পিয়ার।আমরা একসঙ্গে একই মঞ্চে অভিনয় করেছি আল মনসুর,হাবিবুল হাসান।তো আমাদের ভেতরে কম্পিটিশন ছিলো।কিন্তু সেই কম্পিটিশনটা কী? মানে আমরা সবাই ভালো অভিনয় করবো,ওর চেয়ে আমি ভালো অভিনয় করবো।কিন্তু ওরটা খারাপ করে দিয়ে আমি ভালো করবো-সেটা না।কিন্তু আমাদের মিডিয়াতে আমি দেখেছি,নাম বলবো না।খুব নামকরা চিত্র অভিনেতা-অভিনেত্রী অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত,যারা অন্য একটা ইয়েতে,মানে অন্যের অভিনয় খারাপ করে দিয়ে,একটা কেউ ভালো শট্‌ দিচ্ছে,হঠাৎ মাঝখান থেকে ওদের ওই শট্‌টা কেটে দেয়,অভিনয়টাকে কেটে দেয়-এ রকমও দেখেছি আমি।যে দুইজন আর্টিস্টের অভিনয় হচ্ছে,তো এর যে অভিনয়টুকু ভালো হয়ে যাচ্ছে-এর মাঝখান থেকে কেটে দেয়।

ম্যাজিক লণ্ঠন : মানে একটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা?

আসাদ : এ রকম একটা অবস্থা সবার ক্ষেত্রে নয়,কিছু কিছু লোকের এই জিনিসটা আমি দেখেছি।আমায় এইটা খুব পীড়া দেয়,খুব কষ্ট দেয়।আমরা হেল্প করতাম আরেকজন যাতে ভালো অভিনয় করতে পারে।এটা সবার জন্য না।খুব গুটিকয়েকের ক্ষেত্রে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : শেষ কথা একটা বলেন,শেষ কথাটা হলো যে,ব্যাপারটা এ রকম কোনো আশার বাণী না।কিন্তু বিষয়টা হলো যে,আপনি যে সুস্থতাটা দেখতে চান ওইটা কী রকম,ওইটার চেহারাটা কী রকম?

আসাদ : অ্যাকচুয়ালি সেটা হচ্ছে যে,লোকজন যাতে,নাটক দেখার দর্শক যাতে ফিরে আসে। আমাদের চলচ্চিত্রের দর্শক চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার পরে ইন্ডাস্ট্রিটার কী অবস্থা হয়ে গেছে,আমরা নিজেরাই কি উপলব্ধি করতে পারছি? আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে, এই মিডিয়াটাও;ওটাও যেমন ভেঙেছে-এই মিডিয়াটাও ওরকম একটা অবস্থার দিকে চলে যাচ্ছে।

ম্যাজিক লণ্ঠন : এর সতর্কতা দরকার?

আসাদ : হ্যাঁ।এখনো সময়,মানে এটাই হাই-টাইম।আমার মনে হয়,এখন যারা চিন্তা-ভাবনা না করে চ্যানেল চালাচ্ছে,চ্যানেল মালিক যারা,যারা বিজ্ঞাপন দিচ্ছে,সবকিছু মিলিয়ে যারা অভিনয় করছে,যারা বানাচ্ছে,পরিকল্পনা করছে,সবকিছুর প্রযোজক যারা...তো এখন এটা থেকে পরিত্রাণ না করতে চাইলে পরে একদম মুখ থুবড়ে পড়বে।একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থায় পড়ে যাবে।সেটা যাতে হয়,আমার মনে হয় সবাইকেই তা জানানো দরকার।

আরেকটা হচ্ছে,খুব বেশি কিছু করার দরকার বলে তো মনে হয় না।প্রথম কথা হচ্ছে,আমাদের এই গরিব দেশ-এটাতো গরিব দেশ,এখন আস্তে আস্তে ভালোর দিকে যাচ্ছে,অর্থনীতি ধীরে ধীরে ভালোর দিকে যাচ্ছে।এখন,আমার ইনকাম ছিলো মনে করো পাঁচ হাজার টাকা,আমি পাঁচ লাখ টাকা মাসে ইনকামের চিন্তায় যদি প্ল্যান করার চেষ্টা করি তাহলে তো সমস্যা হয়ে যাবে।এই জায়গাটা,এটা শুধু আমাদের ক্ষেত্রে না,এটা আমার শুধু এই অভিনয়-জগৎ বা এই মিডিয়া-জগৎ না,সর্বক্ষেত্রেই বোধহয় ব্যপারটা দাঁড়িয়ে গেছে।একটু বোধহয় ভাবা উচিত-আমরা কোন্‌ দেশের অধিবাসী;কোন্‌ দেশের জনগোষ্ঠীকে আমরা বিলঙ করি।আমাদের দেশের মানুষগুলো কী অবস্থায় আছে?

শুধু আমি,আমি-আমি না ভেবে,আমরা একটু ভাবি যদি,তাহলে আমার মনে হয়-এটা খুব বেশি কঠিন কিছু হয় না।বেশি সময়েরও ব্যাপার না।কিন্তু আবার সুন্দরভাবে চলে আসতে পারে,হাইজাম্প না নিলেই হয়।আমি অন্ধকারে নেমে,প্রায় সেন্ডেল পায়ে দিয়ে বা সেন্ডেল হারিয়ে ঢাকা শহরে ঢুকে,তারপরে অভিনয় শুরু করে দুই-তিন বছরের ভেতরে বাড়ি-গাড়ির চিন্তাটা না করলেই তো পারি!

 

সেলিম আহ্‌মেদ স্নাতক করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট থেকে ভাস্কর্যে। দীর্ঘসময় হস্তশিল্প, ফ্যাশন ও গ্রাফিক্সের সঙ্গে তার বসবাস।বর্তমানে তৈরি হচ্ছেন চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য। রাজীব আহ্‌সান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাতত্ত্ব বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। বর্তমানে হাসান আজিজুল হকের গল্প, সাক্ষাৎকার নিয়ে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্যস্ত আছেন।

razibaahsan@gmail.com

selim24march@yahoo.com

বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৩ সালের জানুয়ারির ম্যাজিক লণ্ঠনের ৫ম সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।  

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন