Magic Lanthon

               

ম্যাজিক লণ্ঠন ডেস্ক

প্রকাশিত ১০ অক্টোবর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

জাহরা সেহগাল : এক শতাব্দীর গল্প

ম্যাজিক লণ্ঠন ডেস্ক


ভারতীয় উপমহাদেশ সিনেমার শতবর্ষ উদযাপন করেছে ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে।  তবে জেহরা সেহগাল তার এক বছর আগেই ২০১২ খ্রিস্টাব্দে নিজের জীবনের শতবর্ষ পূর্ণ করেছেন। ফলে শিল্পের দৌড়ে ভারতীয় চলচ্চিত্রের থেকে এক বছর এগিয়ে তিনি।

নতুন প্রজন্মের চলচ্চিত্র দর্শকরা হয়তো জেহরা মমতাজ সেহগালকে ব্যান্ড ইট লাইক বেকহ্যাম, সায়া, বীর জারা, সানুরিয়া এবং অমিতাভ বচ্চনের লন্ডনভিত্তিক চলচ্চিত্র চেনি কুম-এ দেখেছেন। কিন্তু পুরনো ভক্তরা জানেন জেহরা গত আশি বছর ধরে লাইমলাইটে রয়েছেন। তিনি একাধারে কাজ করছেন থিয়েটার, চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশনে।

তিনি প্রায়ই নতুন প্রজন্মকে বলে থাকেন, ‘তোমরা এখন আমাকে দেখো যখন আমি বৃদ্ধ এবং কুৎসিত।  আমি যখন যুবতী ও সুন্দরী ছিলাম তখন যদি তোমরা আমাকে দেখতে পারতে।!'

জাহরা ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে পাকিস্তানের সাহারানপুরের এক জমিদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার প্রাথমিক শিক্ষার পর, তাকে কুইন মেরি কলেজে পড়ার জন্য লাহোরে পাঠানো হয়, যেখানে শুধুমাত্র উচ্চবিত্তের মেয়েরাই পড়তে পারতো। কুইন মেরি কলেজের পরে, তিনি উচ্চ শিক্ষার জন্য ইউরোপে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। তখন গাড়িতে করে ইরান এবং তারপর সিরিয়া হয়ে মিশরে যান। যেখানে তিনি আলেকজান্দ্রিয়া বন্দর থেকে একটি জাহাজে চড়ে ইউরোপে পাড়ি জমান।

জার্মানিতে তিনি তিন বছর আধুনিক নৃত্যের প্রশিক্ষণ নেন।  সেখানে তিনি বিখ্যাত ভারতীয় নৃত্যশিল্পী উদয় শঙ্করের সাথে দেখা করেন, যিনি ইউরোপের বিভিন্ন শহরে তার ব্যালে শিব-পার্বিত পরিবেশন করছিলেন।

জাহরা এই নৃত্যে এতোটাই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি উদয় শঙ্করের দলে যোগ দেন এবং জাপান, মিশর, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেন।

উদয় শঙ্কর ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে ভারতে ফিরে গেলে, জাহরাও তার সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে চাকরি নেন এবং তরুণদের নাচ শেখাতে শুরু করেন। এখানেই তার সঙ্গে পরিচয় হয় তরুণ নৃত্যশিল্পী ও চিত্রশিল্পী কামেশ্বর সেহগালের সঙ্গে।  প্রথমে বন্ধুত্ব তারপর বিয়ের পরিকল্পনা করেন তারা।  কিন্তু নিজেদের পরিবার বিরোধিতা করে। পরে জাহরার পরিবার রাজি হলে ১৪ আগস্ট ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে তারা বিয়ে করেন। তাদের বিয়েতে পন্ডিত জওহরলাল নেহেরুরও উপস্থিত থাকার কথা থাকলে বিয়ের কয়েকদিন আগে আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ার কারণে তার দলের অনেককে গ্রেফতার করা হলেও তিনিও ভারত ত্যাগ করে পালিয়ে যান।

স্বামী কামেশ্বর সেহগালের সঙ্গে জাহরা

উদয় শঙ্করের সাংস্কৃতিক কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেলে, জাহরা এবং কামেশ্বর লাহোরে চলে যান। তারপর সেখানেই তারা নাচের স্কুল খোলেন। কিন্তু কিছু সময় পর, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হলে তারা তারা দুজনেই মুম্বাই (তৎকালী বোম্বে) চলে যান।   সেসময় মুম্বাইয়ে জেহরার নিজের বোন এজরা ভাট পৃথ্বী থিয়েটারে কাজ করতেন।

জাহরা পৃথ্বী থিয়েটারে চাকরিও পেয়েছিলেন এবং থিয়েটার দলের সাথে ভারতের সমস্ত বড়ো শহর ভ্রমণ করেছিলেন।  এসময় জাহরা ‘ধরতি কে লাল’ ও ‘নিচা নগর’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেন।

এই দুটি চলচ্চিত্রই ছিলো বামপন্থী বুদ্ধিজীবী ও নেতাকর্মীদের শ্রমের ফসল। জেহরার স্বামী চলচ্চিত্রে শিল্প নির্দেশক হিসেবে কাজ শুরু করেন এবং জেহরা কোরিওগ্রাফির দায়িত্ব নেন।

সেই সময়ে বিখ্যাত পরিচালক হিসেবে চলচ্চিত্রজগতে তার ভাগ্য গড়ে তুলেছিলেন। জাহরা সেহগাল তার প্রথম চলচ্চিত্র ‘বাজি’র কোরিওগ্রাফি করেছিলেন, তারপরে রাজ কাপুর জাহরার সাথে তার চলচ্চিত্র ‘আওয়ারা’তে বিখ্যাত স্বপ্নের দৃশ্যের নৃত্য ‘ঘর আয়া মীরা পরদেশী’র কোরিওগ্রাফ করেছিলেন।

জাহরার স্বামী ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দে মারা যান।  ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে তিনি বৃত্তি নিয়ে লন্ডনে চলে যান এবং সেখানে মাইন্ড ইওর ল্যাঙ্গুয়েজ, জুয়েল ইন দ্য ক্রাউন, তন্দুরি নাইটস ইত্যাদির মতো অনেক টেলিভিশন প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। এর পাশাপাশি তিনি অনেক ব্রিটিশ চলচ্চিত্রেও অভিনয় করেছেন।

১৯৯০ এর দশকে, জাহরা তার স্বদেশে ফিরে আসেন। ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি তার বোন এজরা ভাটের সাথে পাকিস্তানের অজোকা থিয়েটারের সুপরিচিত মঞ্চ নাটক ‘এক থি নানি’-এ উপস্থিত হন।  নাটকটি সেই বোনদের সত্যিকারের গল্প যারা ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ভারত ভাগের সময় বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন এবং ৪০ বছর পরে আবার একত্রিত হয়েছিলো।

এজরা ভাট ২০১০ খ্রিস্টাব্দে ৯৩ বছর বয়সে মারা গেলে বোনের জুটি ভেঙে যায়।

১০০ বছর বয়সেও, জেহরা সেহগাল ছিলেন চরম জীবনী শক্তির অধিকারী।  মঞ্চ নাটক শেষে তিনি প্রায়শই হাফিজ জলন্ধ্রীর বিখ্যাত কবিতা ‘অভি তো মে জওয়ান হুঁ’ আবৃত্তি করে দর্শকদের বিনোদন দিতেন।

পেয়েছেন সঙ্গীত ও নাটকে অসংখ্য পুরস্কার।  এছাড়া পদ্মশ্রী, পদ্মভূষণ এবং কালিদাস সামানের মতো মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারও রয়েছে তার ঝুলিতে।

২০১৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ জুলাই না ফেরার দেশে পাড়ি জমান জাহরা মমতাজ সেহগাল।

 

সূত্র : বিবিসি উর্দু। অনুবাদ : ইব্রাহীম খলিল।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন