Magic Lanthon

               

তাহ্‌সিন আহমেদ

প্রকাশিত ২০ নভেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

গোল্ড রাশ : ব্যক্তি-মানুষ ও সমাজের স্বরুপ  সন্ধানে

তাহ্‌সিন আহমেদ


শিল্পী বনাম সমাজ-এই দুইয়ের দ্বন্দ্বে তৈরি হয় শিল্প। একজন শিল্পী সমাজের মানুষের সঙ্গে সেতুবন্ধন গড়ে তুলতে চায়, যাতে তার আপন প্রকাশ গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠে; এর সঙ্গে যুক্ত হয় শিল্পীর নিজস্ব চিন্তা-চেতনা ও ধ্যান-ধারণা। কিন্তু আজকের এই বাজারি সমাজের অনুশাসন গ্রাস করে নিতে চায় শিল্পীর এই সত্তাকে। তাই একজন শিল্পীকে লড়াই করে যেতে হয় ক্রমাগতভাবে নিজ ব্যক্তিসত্তা এবং সমাজের সঙ্গে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি যখন তার কড়াল গ্রাসে পৃথিবীকে মুষ্টিবদ্ধ করছিলো, বাজারি সমাজ যখন পরিণত হতে শুরু করেছে, প্রায় সেই সময়ে চলচ্চিত্র নামের নবতম শিল্প-মাধ্যমটির আবির্ভাব। আর আবির্ভাবের শুরুতে এই মাধ্যমটি ভৌত কাঠামো ‘সত্য’ নির্মাণ এবং বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেয়। এই কারণে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও শাসক সমাজ এই মাধ্যমটির আবির্ভাব সুনজরে নিয়েছিলো। নিজেদের মতো করে বাস্তব নির্মাণে এর চেয়ে আর ভালো কিছু তাদের কাছে ছিলো না।

তাই তারা প্রথমেই মাধ্যমটির নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে ব্যবহার শুরু করলো নিজেদের মতো করে। কিন্তু বাধ সাধলো শিল্পীরা। কেনো মেনে নেবেন তারা এই নিয়ন্ত্রণ? তারা স্রষ্টা, আর স্রষ্টা চান নিজের মতো করে সৃষ্টি করতে। এর ফলে শুরু হয় নিয়ন্ত্রণ এবং সৃষ্টির স্বাধীনতা-এই দুইয়ের দ্বন্দ্ব; আর এর মধ্য দিয়েই এগিয়ে যায় চলচ্চিত্রের ইতিহাস।

এই ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, অনেক শিল্পী বাধ্য হয়ে সরাসরি এই অবস্থার মধ্য দিয়ে কাজ করে গেছেন। আবার অনেকেই সেই প্রচলিত কাঠামো থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিবাদ করেছেন; স্বাধীনভাবে নির্মাণ করতে চেয়েছেন চলচ্চিত্র, কিন্তু তারা পেরে উঠতে পারেননি। শেষ পর্যন্ত তাদের শিল্প-সৃষ্টিই বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ অন্যান্য শিল্পের চেয়ে এই শিল্প-মাধ্যমটির একটি মূল পার্থক্যের জায়গা হলো, অর্থনৈতিক ও পরিবেশনের দিকটি। এর প্রোডাকশনে যেমন অর্থ জড়িত, আবার পরিবেশনের সঙ্গে শাসকের অনুমতি জড়িত। একজন  চলচ্চিত্র-শিল্পী অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হলে হয়তো চলচ্চিত্র তৈরি করতে পারেন। কিন্তু পরিবেশনের সময় রাষ্ট্রের অনুমতি প্রয়োজন পড়ে। আর একজন শিল্পী তার সৃষ্টিকে সাধারণ মানুষের দ্বারে পৌঁছে দিতে না পারলে সৃষ্টির মূল্য থাকে না।

চলচ্চিত্রে এমন চিন্তাধারার একদল  চলচ্চিত্র-শিল্পী ছিলেন যারা প্রচলিত অবস্থার মধ্যে থেকে বের হননি, বরঞ্চ নিজের শিল্পকে ব্যবহার করে ভাঙ্গার চেষ্টা করেছেন প্রচলিত ব্যবস্থাকে। সমাজ পরিবর্তনে শিল্পকে এমনভাবে ব্যবহার করেছেন যে রাষ্ট্র কাঠামো কখনও বুঝতে পারেনি, আসলে তারা সমাজ পরিবর্তনের চেষ্টা করেছেন। যে-মানুষগুলো এই চেষ্টা করেছেন তাদের মধ্যে চ্যাপলিন একজন। যাকে কখনই প্রচলিত সমাজ-কাঠামোকে লাথি দিয়ে এর বাইরে এসে কাজ করতে দেখা যায়নি; বরঞ্চ তার মধ্যে থেকে দরকষাকষি করতে দেখা গেছে। কারণ তিনি বুঝেছিলেন সমাজ বিচ্যুত হয়ে কোনো আন্দোলন করা যায় না। এই চিন্তা-চেতনার অনুবর্তী হয়ে তিনি সৃষ্টি করে গিয়েছিলেন চলচ্চিত্র, আর তার মধ্য দিয়ে পরিচিত হয়ে রয়েছেন বিশ্বে।

১.

১৯১৪ সালে মেকিং লিভিং দিয়ে চলচ্চিত্র-জীবন শুরু করেন চ্যাপলিন। চলচ্চিত্র-জীবনের শুরু থেকে ১৯২৩ সাল পর্যন্ত নির্মিত চলচ্চিত্রে মূকাভিনয় দিয়ে মানুষকে হাসিয়ে বিমোহিত করলেন চ্যাপলিন। মার্কিন দর্শক নিজেদের হাস্যকর এবং সরল অসহায় রূপ দেখলো এই সময়ের চলচ্চিত্রগুলোতে। কোনো ঘটনাকে দেখার ক্ষেত্রে তার শিশুসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি যেমন মানুষকে একদিকে বিমোহিত করলো, পাশাপাশি নেশাও তৈরি করলো তার চলচ্চিত্রের প্রতি। এই সময়ে নিউইয়র্কের ক্রিস্টাল হলে তার চলচ্চিত্র ছাড়া কারও চলচ্চিত্র প্রদর্শিত হতো না। কিন্তু শুধু মানুষকে হাসিয়ে আর  কতোদিন; জীবনতো শুধু হাসি আর আনন্দের নয়, জীবনে আছে দুঃখ, কান্না, বেদনা, প্রতিবাদ আরও কতো কী! ১৯২৪ সাল। গতানুগতিক ধারার বাইরে এসে মানুষের হিংসা, ক্ষোভ, লোভ এই বিষয়গুলোকে নিয়ে চ্যাপলিন তৈরি করলেন গোল্ডরাশ। তিনি নিজে এই চলচ্চিত্র প্রসঙ্গে বলেন, ‘গোল্ডরাশ ছবির মাধ্যমে আমি স্মরণীয় হয়ে থাকতে চাই।’ আছেনও বটে; এখন পর্যন্ত পৃথিবীর প্রথম দশটি চলচ্চিত্রের মধ্যে একটি ধরা হয় গোল্ডরাশ-কে।

১৮৯৮ সালে আলাস্কা, ইউকন ও চিলকুটের পাশে একটি বরফের মরুভূমিতে সোনা পাওয়া যাচ্ছে-এমন একটি গুজবের ঘটনাকে নিয়ে চ্যাপলিন নির্মাণ করেছিলেন গোল্ডরাশ-এর কাহিনী। বরফের মরুভূমিতে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কিছু মানুষ নিজের জীবন বাঁচাতে নিজেদের সঙ্গীর মাংস, কুকুরের মাংস, এমনকি জুতা সিদ্ধ করে খেয়েছিলো। গোল্ডরাশ নামের সেই চলচ্চিত্রটির দার্শনিক ভিত্তি ছিলো অন্তরালে লুকিয়ে থাকা একজন  ব্যক্তি-মানুষের ভিতরের সমস্যা; যেমন লোভ, হিংসা, ভালোবাসা, ক্ষুধার মতো পরিবর্তনীয় বিষয়গুলো। সেখানকার অবস্থান, পরিস্থিতি, পরিপ্রেক্ষিত-এই তিনে মিলে একটি সময়ে ওই মানুষের স্বরুপ কেমন হতে পারে তা সেলুলয়েডে বন্দি করেছিলেন চ্যাপলিন। আমার এই আলোচনা মূলত গোল্ডরাশ-কে নিয়ে এগোবে, সঙ্গে থাকবে চ্যাপলিনকে বোঝার চেষ্টা। পাঠক তার আগে চ্যাপলিনের অন্যান্য চলচ্চিত্রের দিকে একটু চোখ ফিরিয়ে আসি।

১৯৩৬ সালে মডার্ন টাইমস-এ পুঁজিবাদী ব্যবস্থার বৈষম্য, যান্ত্রিকতা, একাকিত্ব, অমানবিকতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর অসন্তোষের বিস্ফোরণ ঘটালেন। সমাজের বিরুদ্ধে এই ক্ষোভ আর  অসন্তোষতো আর  একদিনের নয়, সেই ছেলেবেলা থেকে যার শুরু। পাগলাগারদে বন্দি মা আর  অনাথ দুই ভাই কখনও অন্নের জন্য খেয়েছেন হোটেল থেকে ফেলে দেওয়া পঁচা খাবার। আবার কখনও মানুষকে কুকুর-বিড়ালের ডাক শুনিয়ে মিটিয়েছেন পেটের ক্ষুধা। এমনি কষ্টের স্মৃতি নিয়ে বেড়ে উঠেছিলেন চ্যাপলিন।

মডার্ন টাইমস নির্মাণের চার বছর পর ১৯৪০ সালে নির্মাণ করলেন গ্রেট ডিকটেটর। হিটলার, মুসোলিনীসহ ফ্যাসিবাদিরা যখন ধ্বংস করতে যাচ্ছিলো মানবসমাজকে; তখনই ফ্যাসিবাদের বিপক্ষে গিয়ে এর মাধ্যমে মানবতার জয়গান গাইলেন। আর এই চলচ্চিত্র নির্মাণের সাত বছর না যেতেই ১৯৪৭ সালে অস্ত্রসজ্জিত খুনি রাষ্ট্রের সঙ্গে মঁসিয়ে ভার্দুকে লড়াই করিয়ে ‘ভেঙ্গে’ দিতে চাইলেন পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। একজন মানুষের সমাজ থেকে প্রত্যক্ষ জ্ঞান না থাকলে এতো গভীরতায় গিয়ে শিল্প তৈরি করা সম্ভব নয়। আইজেনস্টাইন তার এই দুরদর্শিতা সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তার (চ্যাপলিনের)চোখ কী দেখে? এই দুই অসাধারণ চোখ কী দেখছে? যে চোখ আধুনিক কালের অনায়াস লঘুময়তার রূপের আড়ালে দান্তের গভীর নরক দর্শনকে বা গয়ার ছন্নছাড়া চমৎকারিত্বকে প্রত্যক্ষ করতে পারে।’

২.

অনেক মানুষের মতো স্বর্ণের সন্ধানে বরফের মরুভূমিতে ছুটে চলেছে এক ভবঘুরে। সেখানে বরফ-ঝড় শুরু হলে এক বাড়িতে আশ্রয়কে কেন্দ্র করে ভবঘুরের পরিচয় হয় ব্ল্যাক লারসন ও জিম মাক্‌কে’র সঙ্গে। লটারিতে দাগী আসামী ব্ল্যাক লারসনের দায়িত্ব পড়ে খাবার জোগাড়ের। ক্ষুধার্ত ভবঘুরের আর পেট মানে না, শেষ পর্যন্ত জুতা রান্না করে ক্ষুধা মেটায় দুইজন। ব্লাক লারসন খাবার না নিয়ে ফিরে এলে পরের দিন বিদায় নেয় মাক্‌কে ও ভবঘুরে। পথিমধ্যে স্বর্ণখনির দলিল নিয়ে দেখতে পায় লারসনকে। তা নিয়ে মারামারি শুরু হলে মাথায় আঘাত পেয়ে অচেতন হয়ে পড়ে জিম। কিছুদূর না যেতেই লারসন বরফের পাহাড় ভেঙ্গে মারা যায়। ওইদিকে স্বর্ণ খনি খুঁজতে গিয়ে পথ ভুলে লোকালয়ে গিয়ে ভবঘুরেটি প্রেমে পড়ে গায়িকা জর্জিয়া’র। সেখানে নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যায় কাহিনী। একদিন আঘাতপ্রাপ্ত ‘পাগল’ জিম মাক্‌কে’র সঙ্গে ভবঘুরের দেখা হলে সে স্মৃতিশক্তি ফিরে পায়। তারা আবার স্বর্ণ অভিযানে বের হয়, অবশেষে অভিযান সফল হয়। এরপর ভবঘুরে (ধনী) তার প্রেমিকাকে খুঁজে না পেয়ে সারাদিন মনোকষ্টে ভোগে। শেষ পর্যন্ত কাকতালীয়ভাবে একটি জাহাজে ধনী ভবঘুরের সঙ্গে জর্জিয়া’র দেখা হয়। এভাবেই শেষ হয় চলচ্চিত্রটি।

চলচ্চিত্রটির এই কাহিনী কেবল ওই সময়ের, ওই মানুষগুলোর কিংবা ওই স্থানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। ওই মানুষগুলোর মতো অগণিত ভাগ্যপরিবর্তনকামী মানুষ এই ‘সুন্দর পৃথিবীতে’ আজও   বিরাজমান। শুধু তাই নয়, জ্যামিতিক হারে পরিবর্তিত হয়ে বেড়েছে তাদের সংখ্যা, সময়, স্থানিক সীমানার ব্যাপ্তি। তথ্য-প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে,আজ  আমরা নিজেদেরকে ‘সভ্য’ বলছি। কিন্তু সেই সমাজের চেয়ে আজকের সমাজের চেহারা আরও  ভয়াবহ হয়েছে! আজও  একদল  মানুষ সৌভাগ্যের আশায় ছুটতে গিয়ে সম্পদের অদৃশ্য চোরাবালিতে আটকা পড়ছে। নিঃস্ব হয়ে কেউ ফিরে আসছে, আবার কারও থেমে যাচ্ছে জীবনের উজান। আজ  থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে নির্মিত দ্য গোল্ড রাশ-এর কাহিনী যেনো চিরন্তন-বর্তমানকালেরই পাঠ।

চ্যাপলিনের এই চলচ্চিত্রটিকে যেমন একটি দার্শনিক ভিত্তিতে দেখা যায়, আবার সেই সময়ে সামাজিক অবস্থার প্রতীকী রূপ হিসেবেও দেখার একটি জায়গা রয়েছে। একটি টেক্সট্‌কে যেহেতু অনেকভাবে দেখা যায়, তাই নতুন একটি জায়গা থেকে চলচ্চিত্রটি দেখার চেষ্টা করা যাক। সে-ক্ষেত্রে আমরা চলচ্চিত্রটির বিভিন্ন সিক্যুয়েন্স ও শট ধরে সমাজের রূপ উন্মোচনের চেষ্টা করবো।

৩.

গোল্ডরাশ-এর প্রথম দৃশ্যতেই হাজার হাজার মানুষ ছুটে চলতে দেখি স্বর্ণের সন্ধানে। পরের শটে এক ভবঘুরে চলতে থাকে বরফের মরুভূমিতে। পিছনে ভাল্লুক, কিন্তু সেই দিকে কোনো খেয়াল নেই; মোহের মধ্য দিয়ে পথ চলতে থাকে ভবঘুরেটি। কোথায় সম্পদ, শুরু হয় জীবনসংগ্রাম; প্রথমেই বরফ-ঝড়ের মধ্যে জীবন বাঁচাতে নাস্তানাবুদ হয়ে পড়তে হয় ভবঘুরেকে। চমৎকার এই সিক্যুয়েন্সটি আসলে সমাজ বাস্তবতায় একজন  মানুষের জীবনসংগ্রামের চিত্র। তৎকালীন ওই সমাজের মানুষগুলোকে এই রকম লড়াই করে বেঁচে থাকতে হয়েছিলো, যা আজও  হচ্ছে। ইউরোপে শিল্প-বিপ্লবের মধ্য দিয়ে সামন্ততান্ত্রিক অবস্থা ভেঙ্গে আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়ায় ইউরোপীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার দ্বারা পুঁজিবাদ ছড়িয়ে পড়ে সারা বিশ্বে। আর  এসব অঞ্চলের গ্রাম ও শহরের মধ্যে পার্থক্য তৈরি হতে থাকে পণ্য উৎপাদন ও বিক্রয়কে কেন্দ্র করে।

বিংশ শতকের শুরুর দিকে সামন্তবাদী সমাজ ভেঙ্গে যখন বাজারি সমাজ পরিণত অবস্থায়; মানুষের শহরমুখীতা ক্রমে বেড়ে চলছিলো। তখন মোহগ্রস্থ মানুষ না বুঝে ছুটে চলেছিলো পুঁজিবাদী ‘স্বপ্ন’ দুনিয়ায়, যেখানে ছিলো মিথ্যা সম্পদের হাতছানি। গ্রাম থেকে শহরে আসা এসব মানুষ নিজের অজান্তেই ঢুকে পড়ছিলো শ্রম-শোষণের বাজারে। সেখানেই শুরু হয় তাদের জীবনসংগ্রাম। আজকেও আমরা দেখতে পাই প্রতিদিন আমাদের দেশের হাজার হাজার মানুষ ছুটে চলে শহরের দিকে। আর সেখানে শুরু হয় মানুষের নতুন করে বাঁচার সংগ্রাম। চ্যাপলিন ওই দৃশ্যর মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজচিত্র তুলে ধরেছেন। চ্যাপলিনও নিজের জীবন-জীবিকার তাগিদে দেশ ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। আর  পুঁজিবাদের বিরোধিতা করায় পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো পুঁজিবাদী দেশ থেকে একসময় বিতাড়িতও হয়েছিলেন।

৪.

পরিত্যক্ত একটি বাড়ি। কে হবে এই বাড়ির মালিক? জিম মাক্‌কে নাকি ব্ল্যাক লারসন। এই নিয়ে ক্ষমতার লড়াইয়ে নামে তারা, বন্দুক নিয়ে হাতাহাতি শুরু করে দুইজন। আর এই লড়াইয়ে বন্দুকের নল ঘুরতে থাকে দর্শক ভবঘুরের দিকে। ভীত-সন্ত্রস্ত্র ভবঘুরেটি কখনও টেবিলের নিচে কখনও টেবিলের উপর উঠে চেষ্টা করে বন্দুকের নলের বাইরে যেতে, কিন্তু তার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। খুব স্বাভাবিকভাবেই অনেকের দেখে মনে হতে পারে এটি ঠাট্টা বা হাসির একটি দৃশ্য। কিন্তু চ্যাপলিনের বিশেষত্ব অন্যখানে, তিনি মানুষকে হাসাতে হাসাতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথাটি বলেন। আজকে সারা পৃথিবীতে বিভিন্ন লড়াই, অরাজকতা দেখি, সেটি রাষ্ট্র এবং ক্ষমতার লড়াই। এই লড়াইয়ে মারা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয় ভবঘুরের মতো সাধারণ মানুষ। কেউ এর প্রতিবাদ করবে তারও উপায় নেই, বন্দুকের নল যে তার মাথার উপর অনবরত ঘুরতে থাকে।

আফগানিস্তান,ইরাক আমাদের কাছে এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ। আবার তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে হরতাল, জাতিগত দাঙ্গা-সে-গুলোতেও থাকে ক্ষমতার লড়াই। সমাজে ক্ষমতার এই লড়াই শুধু আজকের নয়, যুগ-যুগ ধরে চলে আসছে। দাস সমাজে এক গোষ্ঠীর সঙ্গে আরেক গোষ্ঠীর লড়াই, সামন্ততান্ত্রিক সমাজে এক রাজার সঙ্গে আরেক রাজা,আর পুঁজিবাদি সমাজে কখনও নিজ রাষ্ট্রের ভিতরে আবার কখনও অন্য রাষ্ট্রের সঙ্গে লড়াই। যুগ-যুগ ধরে শাসকদের লাভ-ক্ষতির হিসাব এভাবেই মেলাতে হচ্ছে জনগণকে। অথচ সবার মুখে বুলি গণতন্ত্রের! পাঠক, চ্যাপলিন একটি সিক্যুয়েন্স দিয়ে আজ থেকে প্রায় ১০০ বছর আগে দেখালেন যুগ-যুগ ধরে ঘটে যাওয়া সমাজের বাস্তবচিত্র।

৫.

প্রচণ্ড বরফ-ঝড়ের মধ্যে খাবারের ব্যবস্থা হিসেবে ভবঘুরে নিজের জুতা সিদ্ধসহ যাবতীয় আয়োজন সম্পন্ন করে। কিন্তু খাবার বণ্টনের সময় ভবঘুরের অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেশি অংশটা নিয়ে নেয় জিম। বাধ্য হয়ে কোনোরকম প্রতিবাদ ছাড়া কম অংশটা খেতে হয় ভবঘুরেকে। কারণ, ইতোমধ্যে ব্ল্যাক লারসনের সঙ্গে লড়াইয়ে জয়ী হয় জিম, আর সেই ক্ষমতার কাছে বাধ্য হয়ে ‘নত স্বীকার’ করে ভবঘুরেটি। নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকলেও প্রতিবাদের কোনো ক্ষমতা তার কাছে থাকে না। বাজারি এই সমাজের শ্রমিকদের ক্ষেত্রে ঠিক একই চিত্র দেখতে পাই। পৃথিবীতে কোটি-কোটি শ্রমিক তাদের শ্রমের বিনিময়ে মানুষের জন্য পণ্য উৎপাদন করে চলেছে। কিন্তু দিন শেষে তাদের নিজেদের বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম যে-চাহিদা তাও মেটাতে পারছে না।

শ্রমের বিনিময়ে শ্রমিককে যে-মজুরি দেওয়া হয় তা মূলত শ্রমশক্তির মূল্যের রূপান্তরিত ধরন বলা হলেও বাজারি সমাজের মালিকরা শ্রমের এই রূপান্তরিত ধরনে তৈরি করে চরম বৈষম্য। আর এই বৈষম্য থেকে যে উদ্বৃত্ত-শ্রম তৈরি হয় তা থেকে বৃদ্ধি পেতে থাকে পুঁজি। এর ফলে মালিকরা আরও ধনী হয়, আর শ্রমিকরা আটকে থাকে শোষণের জালে। মার্কস এটিকে বর্ণনা করলেন এভাবে, ‘যে বুর্জোয়া চিন্তা কারখানার শ্রমবিভাজন, আজীবন একটি খন্ডিত কর্মকান্ডে মানুষকে আটকে রাখা এবং উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য শ্রমকে সংগঠিত করবার কথা বলে তাকে পুঁজির সম্পূর্ণ অধস্তন করে রাখার অবিরাম প্রশান্তি করে, সেই একই বুর্জোয়া চিন্তা একইরকম  জোর গলায় উৎপাদনকে সামাজিকভাবে সংগঠিত ও নিয়ন্ত্রণ করবার বিরোধিতা করে। পুঁজিপতির অনিয়ন্ত্রিত কর্মকান্ড অব্যাহত রাখবার জন্য তারা সম্পত্তির ওপর অধিকার, স্বাধীনতা ইত্যাদি অজুহাত তুলে শোরগোল করে। তারা কারখানার শৃঙ্খলের পক্ষে, কিন্তু সমাজকে পরিকল্পিত বিন্যস্ত করবার পক্ষে নয়।’ শ্রমিকরা সমাজকে বিন্যস্ত করার দাবিতে, তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ে কখনও প্রতিবাদ করে কারখানা বন্ধ করে দেয়। তাদের শ্রম ছাড়া যেহেতু আর কোনো সম্পদ নেই, তাই বাধ্য হয়ে আবার তাদের ফিরে আসতে হয় সেখানেই। আর এ-দুর্বলতা থেকেই পুঁজি সবসময় শ্রমিকদের অবিরাম অবাধ্যতা মোকাবিলা করে।

আমরা কয়েক মাস আগে দেখেছি কীভাবে আর্জেন্টিনার শ্রমিকরা বন্ধ কারাখানার তালা ভেঙ্গে তাদের কারখানা আবার চালু করেছিলো। হয়তো-বা এখান থেকেই শুরু। পুঁজিবাদি সভ্যতা যেহেতু আজ  পরিপূর্ণ, শ্রমিকদের শুধু কাজের মধ্যে বুদ করে রাখা হচ্ছে। এটি একদিকে যেমন শোষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে, তেমনি বাড়াচ্ছে শ্রমিকদের দক্ষতা। আর এই দক্ষতা থেকে তাদের মুক্তির সংগ্রাম শুরু হতে পারে। মার্কস যেমন বলেছিলেন, ‘মানুষের চরিত্র এমন যে, যতই সে দক্ষ হয়ে ওঠে ততই সে নিজের ইচ্ছার দ্বারা পরিচালিত হয় এবং সবকিছুর ওপর বড় ক্ষতি করতে পারে।’

৬.

রুশোর একটা উদ্ধৃতি দেওয়ার লোভ সামলাতে পারছি না, ‘মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায়, কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত।’ এর চেয়ে সংক্ষিপ্ত ও তীব্রভাবে মানুষের ইতিহাস বুঝি আর ব্যক্ত করা যায় না। কারণ মানুষ মানুষের কাছেই পরাধীন। একদল মানুষ যুগ-যুগ ধরে এসব সাধারণ মানুষদের বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চেষ্টা করেছে; আজও করছে। ক্ষমতাধররা মানুষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে একটা সময় গড়ে তোলে কারাগারের মতো প্রতিষ্ঠান; ধোঁয়া তোলে ‘অপরাধী’ সংশোধন করার। এক সময় ছিলো যখন ‘অপরাধী’দের শাসকরা শাস্তি দিতো শারীরিকভাবে; মাথা কেটে ফেলা, হাত কাটা ইত্যাদি ছিলো শাস্তির নানা ধরন। কিন্তু যখন আমরা নিজেদের সভ্য বলতে শুরু করেছি, পুঁজিবাদ বিকাশ করে ‘গণতন্ত্রের’ দিকে ঝুঁকেছি, তখন এই চিন্তা পরিবর্তন করে তাকে কারাগারে পুরে রাখার ব্যবস্থা শুরু হলো। সঙ্গে-সঙ্গে এই কারাগার সিস্টেমে গড়ে ওঠে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থা। যেখানে এমন এক পদ্ধতি চালু হয়, মানুষের কর্মকাণ্ডকে একরকম নজরদারির মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। বিদ্যালয় থেকে শুরু করে হাসপাতাল-সবকিছুই এই সিস্টেমের আওতাভূক্ত হয়ে পড়লো। সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু কারাগার আর  আইন  নয়, আরও  কিছু জায়গা দরকার পড়লো ডিসিপ্লিন শেখাতে; এই চিন্তা থেকে তৈরি হলো বিদ্যালয়ের। আমরা যদি আধুনিক বিদ্যালয়ের ইতিহাস দেখি, সতের শতকে শিশুদের গোল্লায় যাওয়া থেকে রক্ষা করতে বিদ্যালয় গড়ে উঠেছিলো; উদ্দেশ্য ছিলো এক ধরনের ডিসিপ্লিন-এর মধ্যে রাখা। ছাত্ররা ময়লা পোশাক পরলে, আচরণ ঠিক না হলে এ-গুলো এক ধরনের দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেব দেখা হতো। এসব ক্ষেত্রে দৃশ্যমান বস্তুকে প্রাধান্য দেওয়া হতো, কিন্তু আচরণ কেনো এমন হয়-এসব বিষয় কখনও মাথায় রাখা হতো না। ফুকো এই বিদ্যালয়গুলোকে বলেছিলেন ‘ছোট আদালত’। 

আধুনিক কারাগার ব্যবস্থা দার্শনিক জেরমি বেন্থামের সূত্রের মাধ্যমে গড়ে ওঠে। তিনি শাস্তিকে সংশোধনের পথ হিসেবে দেখেছিলেন। তা এমন হতে হবে যাতে অপরাধী অপরাধ সম্পর্কে সজাগ হয়ে অপরাধ-প্রবৃত্তি পরিহার করতে পারে। যদি আমরা এই সূত্রের আলোকেও কারাগারকে দেখি, তবুও দেখবো বর্তমান কারাগারপ্রথা ষোড়শ শতকের সেই সিস্টেমেই রয়ে গেছে। আজও   আবুগারিব বা গুয়ান্তানামো বে কারাগারে বন্দিত্বের নামে নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা চালানো হয়। এ-রকম ঘটনা হয়তো আমাদের সামনে কোনোভাবে এসেছিলো বলে জানতে পেরেছি। কিন্তু পৃথিবীর কোটি-কোটি বন্দিদের নির্যাতনের খবর আমাদের কাছে আসে না।

চার্লিও হয়তো তখনই বুঝতে পেরেছিলেন এই প্রতিষ্ঠানের নির্মম আচরণ। তাই বিচলিত হয়েছেন। মানুষের এই শাস্তির ব্যবস্থা হিসেবে বন্দিত্ব মেনে নেননি চার্লি। তাইতো চলচ্চিত্রটির একটি দৃশ্যে এই চিন্তার প্রতিফলন দেখতে পাই। ভবঘুরেটি তার প্রেমিকা জর্জিয়াকে একদিন ডিনারের আমন্ত্রণ জানান তার আশ্রিত বাড়িতে। কিন্তু ডিনার করানোর মতো টাকা-পয়সা তার নেই। টাকা আয়ের জন্য মানুষের বাড়ির সামনে বরফ পরিষ্কারের দায়িত্ব নেয় ভবঘুরেবেশী চার্লি। বাড়ির বরফ পরিষ্কার করতে গিয়ে পাশের বাড়ির দরজায় আবার বরফ জমা করতে থাকেন। এই  ধারাবাহিকতায় তিনি একপর্যায়ে বন্ধ করে দেন আধুনিক কারাগারের দরজা।

৭.

সমাজে প্রতিটি মানুষ সমান হলেই সমাজে সুখ আসবে-চার্লি নিশ্চয় এমন দর্শনে বিশ্বাস করতেন। এটা কেনো বলছি, সে-কথায় আসছি একটু পরে। স্বর্ণের খনি পাওয়া ধনী ভবঘুরেটিকে সুখী করতে পারে না অর্থবিত্ত। জীবনের এই প্রাপ্তির মাঝেও তার প্রেমিকা জর্জিয়ার অপ্রাপ্তি তাকে তাড়া করে বেড়ায়। তাই জাহাজ ভ্রমণে বের হলে ভবঘুরেটিকে হতাশ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখা যায় জর্জিয়ার ছবির দিকে। এরপর একজন ফটোগ্রাফার ছবি নিতে আসে ভবঘুরের। ছবি ওঠার জন্য ভবঘুরেটি অভিজাত পোশাক ছেড়ে হাজির হয় চিরচেনা ছেঁড়া পোশাক আর একপায়ে জুতা পরিহিত অবস্থায়। ছবির পোজ ঠিক করতে গিয়ে নিচের ডেকে পড়ে যায় ভবঘুরে। আর  সেখানেই দেখা মেলে জর্জিয়ার; অবসান হয় দীর্ঘ হতাশার। পাঠক একটু ভেবে দেখুন, ধনী ভবঘুরের সঙ্গে চ্যাপলিন কিন্তু জর্জিয়ার মিলন ঘটালেন না। ঘটালেন দরিদ্র ভবঘুরের সঙ্গে। খুব সচেতনভাবে চ্যাপলিন উঁচু থেকে ভবঘুরেকে সেই চিরচেনা পোশাকে নিয়ে আসলেন জর্জিয়ার কাছে। এর মধ্য দিয়ে বৈষম্য ভেঙ্গে গাইলেন সাম্যের ‘গান’।

৮.

বাইরে প্রচণ্ড তুষার ঝড়। খাবার নেই, পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা-এরকম পরিস্থিতিতে জিম মাক্‌কে তার মানবিক সত্তা হারিয়ে ফেলে। ভবঘুরেকে (চার্লি) দেখতে পায় মুরগীর মতো; খাবার ভেবে হত্যা করতে যায় তাকে। মানুষের চরিত্রই এমন-যখন পেটের ক্ষুধা নিবারণের তথা জীবনধারণের কোনো পথ থাকে না, তখন সে তার মানবিক সত্তা হারিয়ে ফেলে। ভালো-মন্দের সব যুক্তি ফেলনা মনে হয় তার কাছে। ফলে এর জন্য যেকোনো কাজ করতে আর  সে দ্বিধা করে না। পুঁজিবাদী সমাজ সম্পদের যে ব্যাপক অব্যবস্থাপনা তৈরি করে, তার কারণে সৃষ্টি হয় ক্ষুধা, দারিদ্র, বেকারত্ব। আর এর ফলে সমাজে অপরাধ বেড়ে যায়, অভাবের তাড়নায় অপরাধমূলক কার্যক্রমে লিপ্ত হয় অনেক মানুষ। পুঁজিবাদী সমাজ একদিকে বৈষম্য করে সমাজে যেমন ‘অপরাধী’ তৈরি করে চলেছে, আবার তারাই এই মানুষগুলোকে কারাগারে বন্দি করে রাখছে। চার্লি মানুষের মানবিক সত্তা হারানোর কারণটি দেখিয়ে দিয়েছিলেন; আঙ্গুল তুলেছিলেন পুঁজিবাদী সমাজের দিকে। মানুষের ক্ষুধা কীভাবে অপরাধ তৈরি করে তার উপযুক্ত দৃষ্টান্ত চার্লির এই সিকোয়েন্সটি। চার্লির মৃত্যুর পর তার লাশ নিয়ে ঘটা একটা পরিস্থিতির কথা এখানে না বলে পারছি না।

১৯৭৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর চ্যাপলিন মারা গেলে তাকে সুইজারল্যান্ডের বেভিতে সমাধিস্থ করা হয়। দুই মাস পর হঠাৎ কে বা কারা সমাধি থেকে তুলে জিম্মি করে চার্লির লাশটি। পরবর্তী সময়ে জিম্মিকারীরা পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানায়, তারা আসলে পেশাদার কোনো চোর নয়, নিতান্ত সাধারণ বেকার যুবক। এই ধরনের কাজ করার কোনো ইচ্ছে তাদের ছিলো না। কিন্তু অভাবের তাড়নায় খাবারের টাকা জোগাড় করার জন্য তারা মহান এ-শিল্পীর লাশ জিম্মি করতে বাধ্য হয়েছে। জীবিত চার্লি মানুষের অসহায়ত্বের এই কথাগুলোই সিনেমায় বারবার বলতে চেয়েছিলেন।

 

৯.

মানুষের লোভ, ক্ষুধা, রাগ এ-গুলো সহজাতভাবেই থাকে। কিন্তু এর বহিঃপ্রকাশ নির্ভর করে অবস্থান, পরিস্থিতি ও পরিপ্রেক্ষিতের ওপর। যদিও মানুষ নিজ চেষ্টা দ্বারা কিছু নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা রাখে। এই তিনটি কারণে উন্নত দেশে মানুষের আচার-আচরণ, লোভ, রাগ একরকম, আবার আমাদের দেশে অন্যরকম। চার্লিকে শুধু একজন স্ল্যাপস্টিক শিল্পী হিসেবে যারা দেখতে চান, তারা ভুল করেন। তার সবকিছুর প্রকাশভঙ্গি যদিও হাসির মধ্য দিয়ে, কিন্তু দেশকাল ভেদে মানুষকে বুঝতে, শোষণকে বুঝতে তা এতোটুকু সমস্যায় ফেলে না। এই জায়গাতেই চ্যাপলিন অনন্য হয়ে রয়েছেন, যুগ-যুগ ধরে থাকবেনও বটে।

চ্যাপলিন সম্পর্কে ঋত্বিক ঘটকের একটি মূল্যায়ন দিয়ে এই আলোচনা শেষ করতে চাই। ‘শিল্পের যত সুষ্ঠু প্রয়োগই হোক, সম্পর্কের অভিনবত্ব প্রকাশের যত মাধুর্যময় ভঙ্গীই হোক, আঙ্গিকের অবকাশকে বাড়িয়ে তোলার সম্ভাবনা প্রকট করে না তুললে কিছুতেই এক্সপেরিমেন্টের পর্যায়ে ফেলতে আমি রাজি নই। এত দ্বারা লজ্জা পেয়ে যাবার কোনো কারণ নেই। চার্লি চ্যাপলিনকে কেউ এক্সপেরিমেন্টাল বলে অপবাদ দেয় না। এক্সপেরিমেন্টের ফলিত প্রয়োগে তিনি স্বার্থকতম। শিল্পের নব আবিষ্কার করতে তার বাধা ছিলো না। কিন্তু করেননি। তাতে তিনি কিছু ছোট হয়ে গেছেন কী?

 

লেখক : তাহ্‌সিন আহমেদ রাজাশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগের স্নাতকোত্তর পর্বের শিক্ষার্থী।

 tahsin_mcj@yahoo.com

 

তথ্যসূত্র

 

১. আহমদ, মমতাজউদদীন (২০০৯ : ৪৪); ‘আমার সোনার হরিণ চাই’; চার্লি চ্যাপলিন ভাঁড় নয় ভবঘুরে নয়; বিশ্ব সাহিত্যভবন, ঢাকা।

২. শাহাদুজ্জামান (২০০৬ : ২৪); ‘আইজেনষ্টাইনের মূল্যায়ন’; চ্যাপলিন, আজো চমৎকার; জনান্তিক, ঢাকা।

৩. উদ্ধৃত, মুহাম্মদ, আনু; ‘শ্রমবিভাজন : ‘সমাজে ও কারখানায়’; নতুন দিগন্ত; সম্পাদক-সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী; বর্ষ-৯ম, সংখ্যা-২য়, পৃ-৬৬, ধানমন্ডি, ঢাকা।

৪. প্রাগুক্ত; উদ্ধৃত, মুহাম্মদ, আনু, পৃ-৭০।

৫. গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল (২০১০ : ৬); ইতিহাসের স্বপ্নভঙ্গ;  আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা।

  1. 6. বন্দোপাধ্যায়, সন্দীপ (২০০৭ : ২৪৯); ‘পাঠশালা, কারাগার; ফুকো’; মিশেল ফুকো পাঠ বিবেচনা; সম্পাদনা-পারভেজ হোসেন; সংবেদ, ঢাকা।

৭. প্রাগুক্ত; শাহাদুজ্জামান (২০০৬ : ২২)।


বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১৩ সালের জুলাইয়ের ম্যাজিক লণ্ঠনের তৃতীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।



এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন