Magic Lanthon

               

কাজী মামুন হায়দার

প্রকাশিত ১১ নভেম্বর ২০২২ ১২:০০ মিনিট

অন্যকে জানাতে পারেন:

টিভি-নাটকের ডিসকোর্স, টেলিফিল্ম ও ফিল্ম কোন্‌টাকে বলি ফিল্ম

কাজী মামুন হায়দার

 

প্রশ্নটা প্রথম মনে এসেছিলো কয়েক বছর আগে, যখন ফারুকীর ব্যাচেলর (২০০৩) চলচ্চিত্রটি দেখি। ব্যাচেলর দেখার আগে অবশ্য আমি চড়ুইভাতি দেখিনি। এক বন্ধু বললো, এই চলচ্চিত্রটির প্রিকুয়্যাল একটি নাটক আছে, নাম চড়ুইভাতি। সে-সময় খুব আগ্রহ নিয়ে দেখেছিলাম সেই নাটক। জেনেছিলাম, ব্যাচেলর-এ অপি করিমের বিদেশে থাকা ফয়সাল নামের সেই প্রেমিকটির পরিচয়। তখন আসলে নাটক, টেলিফিল্ম, চলচ্চিত্র বা ফিল্ম এগুলোর পার্থক্য নিয়ে এভাবে ভাবিনি। কারণ তখন নতুন কোনো চলচ্চিত্র দেখার জন্য প্রেক্ষাগৃহেই যেতে হতো। চলচ্চিত্র তখনও প্রেক্ষাগৃহেই দেখার জিনিস ছিলো। এখনকার দিনের মতো তখন অহরহ সিনেমার প্রিমিয়ার টেলিভিশনে হতো না। আর কালেভদ্রে দু-একটি প্রিমিয়ার টেলিভিশনে হলেও তা দর্শক-চৈতন্যে প্রভাব ফেলতো না। আমার অবশ্য সে-সময়ে টেলিভিশনে কেবল হঠাৎ বৃষ্টি  নামের চলচ্চিত্রটির প্রিমিয়ারের কথাই মনে আছে।

যাহোক প্রেক্ষাগৃহে চলচ্চিত্র দেখার ইতিহাস ও চর্চা থেকে চলচ্চিত্রের যে-ডিসকোর্স মাথায় কাজ করতো, সেটা কখনই সে-সময় চলচ্চিত্র, নাটক কিংবা টেলিফিল্মের পার্থক্য নিয়ে ভাবায়নি। ভাবলেও তা কেবল ৩৫ মিমি ও ভিডিও ফরমেটের পার্থক্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিলো। নাটক ও টেলিফিল্ম হলে টিভিতে দেখা যাবে, আর চলচ্চিত্র প্রেক্ষাগৃহে। এমনকি নাটক-টেলিফিল্ম এবং চলচ্চিত্রের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের মধ্যেও ছিলো তখন বিশাল ফারাক। দু-একজন ছাড়া কেউই একই সঙ্গে দুটি মাধ্যমে অভিনয় করতো না। একই সঙ্গে উভয় মাধ্যমের অভিনেতা-অভিনেত্রীদের স্ট্যাটাসগত পার্থক্যও ছিলো। একটু শিক্ষিত, চাকরি করে, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা সাধারণত টিভি-নাটকে কাজ করতো। আর চলচ্চিত্রে এ-গুলোর বাইরে শারীরিক সৌন্দর্যকেই মনে হয় বেশি প্রাধান্য দেওয়া হতো।

এই যখন অবস্থা তখন পরিষ্কার বুঝতে পারছেন আমার কাছে নাটক, চলচ্চিত্রের পার্থক্য কোথায়। তবে এই পার্থক্যে যে আমি একেবারে সন্তুষ্ট থেকেছি এমন নয়। মাঝে মাঝে আমার কাছে মনে হওয়া এ-বিষয়ে বিশেষজ্ঞ দু-চারজনকে যে এ-প্রশ্ন করিনি এমন নয়; তারা দু-চারটি তাত্ত্বিক কথা বলে আমাকে থামিয়ে দিয়েছেন। কেউ শট, কেউ ফরমেটের পার্থক্য দিয়ে বুঝিয়েছেন, আবার কেউ দেখিয়েছেন ব্যাপ্তি। আমি কিন্তু সন্তুষ্ট হতে পারিনি। এরই এক ফাঁকে সত্যজিতের পিকু দেখে পড়ি আরেক সমস্যায়। তালিকায় দেখি ২৬ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি আসলে সত্যজিৎ নির্মিত টেলিফিল্ম। তখন মনে প্রশ্ন জাগে সত্যজিৎ-এর মতো এতো বড়ো পরিচালকও টেলিফিল্ম বানিয়েছেন। তার মানে টেলিফিল্ম হেলাফেলা ব্যাপার নয়। কিন্তু এর মধ্যে গোল বাঁধলো মোরশেদুল ইসলামের আগামী নামের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রটি। হঠাৎ একদিন এর সিডি বাজারে পেলাম, কিনলাম; সিডির গায়ে লেখা স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, ১৬ মিমি ফরমেটে নির্মিত। আবার মাথা নষ্ট। তখন চিন্তা, এটি তাহলে কোন্‌ ধাঁচের। এসব চিন্তা আগে মাঝে মাঝেই অলস মাথায় ঘুরপাক খেতো। তুমুল আড্ডায় এ-নিয়ে প্রশ্ন করে দু-একজন ‘চলচ্চিত্রবোদ্ধা’কে যে বিব্রত করিনি তা নয়। তারা চলচ্চিত্রের অনেক কিছু বোঝেন কিন্তু নাটক আর চলচ্চিত্রের পার্থক্য নিয়ে বলতে বললেই কাই-কুই করেন। অনেক দিন চিন্তাটা ছেড়েই দিয়েছিলাম। সম্প্রতি মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ-এর প্রজাপতি (২০১১) চলচ্চিত্রটি দেখার পর থেকে চিন্তাটি আবারও বড়ো আকারে আমার সামনে দেখা দিয়েছে। কারণ প্রজাপতি দেখার আগে আমি তারই নির্মিত ৪৫ মিনিট ৫০ সেকেন্ড ব্যাপ্তির ‘নাটক’ জুয়া দেখি। মূলত জুয়াপ্রজাপতি নিয়ে সৃষ্ট জটের উত্তর খোঁজার জন্যই আজকের এ-লেখার চেষ্টা।   

১.

যতোদূর মনে পড়ে, আগে যখন শুধু বাংলাদেশ টেলিভিশন বা বিটিভি ছিলো তখন দু-ধরনের নাটক দেখানো হতো। এক. ধারাবাহিক নাটক (হাল আমলে যাকে আমরা ডেইলি সোপ বলি); দুই. সাপ্তাহিক নাটক। ধারাবাহিক নাটকে মূলত বড়ো কোনো কাহিনী ১০-১৫ ভাগ করে সপ্তাহে বিশেষ একটি দিনে দেখানো হতো। ওই সময়ের উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে রয়েছে এইসব দিনরাত্রি, ঢাকায় থাকি, সংসপ্তক, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, রূপনগর ইত্যাদি। সেই সময় এসব ধারাবাহিক নাটক অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিলো। মানুষ তীর্থের কাকের মতো এক সপ্তাহ বসে থাকতো নাটকের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে দেখার জন্য। কোনো কারণে নাটকের একটি পর্ব না দেখা হলে সে-কি আফসোস! তখন অবশ্য এখনকার মতো এক নাটক সকাল, দুপুর, রাত, মধ্যরাতে বহুবার প্রচার হতো না।

সাপ্তাহিক নাটক হতো এক পর্বের। একদিনেই ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এ-নাটক শেষ হয়ে যেতো। এ-নাটক নিয়েও দর্শকদের সে-কি উত্তেজনা! তখন অবশ্য এতো চ্যানেলও ছিলো না। তাই বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বিটিভির জনপ্রিয়তা ছিলো আকাশচুম্বী| যাহোক সেই সময় মাসে একদিন টেলিভিশনে চলচ্চিত্র সম্প্রচার হতো। রাত আটটার বাংলা সংবাদের পর শুরু হওয়া সেই চলচ্চিত্র চলতো মধ্যরাত অবধি। মনে আছে চলচ্চিত্র সম্প্রচারের দিনগুলোতে বাড়িতে এক ধরনের উৎসব-উৎসব ভাব হতো। কারণ তখন ঘরে ঘরে এতো টেলিভিশন ছিলো না। পুরো গ্রামে হয়তো দু-একটি বাড়িতে টেলিভিশন ছিলো; সেই টেলিভিশনে চলচ্চিত্র দেখার জন্য মানুষজন জড়ো হতো। আর মফস্বল শহরে ক্লাব ছিলো আমজনতার চলচ্চিত্র দেখার অন্যতম জায়গা। আজ এই সময়ে এসে চলচ্চিত্র দেখার সেই বাস্তবতাকে বেশিরভাগই রূপকথার গল্প মনে করবে। কিন্তু রূপকথা মনে হলেও এই বাস্তবতা ৮০-৯০ দশক পর্যন্ত কিন্তু এই বাংলাদেশেই ছিলো।

বিটিভিতে প্রচারিত সেই সময়ের এসব নাটক প্রযোজনা করতো তারা নিজেরাই। বিটিভির নিজস্ব প্রযোজকরাই এই নাটক নির্মাণ করতো এবং সেখানে অভিনয় করতো বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পীরা। তখন অবশ্য বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হওয়া অত্যন্ত গর্বের ব্যাপার ছিলো। একজন শিল্পী তিনি নাচ, গান, অভিনয়, যাই করুন না কেনো-জীবনের অন্যতম লক্ষ্য ছিলো বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হওয়া। কারণ, সেই শিল্পীদের সমাজে একটা স্ট্যাটাস ছিলো। লোকে বলতো উনি টিভি-আর্টিস্ট, বেতার-আর্টিস্ট। প্রযোজনায় ফিরে আসি, নিজস্ব প্রযোজনায় নাটক নির্মাণের এই প্রক্রিয়া বিটিভিতে কিন্তু দীর্ঘদিন চালু ছিলো।

এরপর শুরু হলো নাটক নির্মাণের নতুন এক ধারা। সালটা ঠিক মনে করতে পারছি না, বিটিভি বিজ্ঞাপন প্রচার করতে থাকলো, তারা বাইরে থেকে নাটক কিনবে। সেই নাটকের তারা নাম দিলো ‘প্যাকেজ নাটক’। কোনো ‘দায়দায়িত্ব’ ছাড়া কেবল একটি ভিডিও ক্যাসেট কিনে নাটক সম্প্রচার করার এই প্রক্রিয়াটি একটি প্যাকেজ প্রস্তাব ছিলো বলে হয়তো এর নাম ছিলো প্যাকেজ নাটক।

এই ধরনের নাটক সম্প্রচার শুরুর পর নাটকের মানগত দিকে কিছুটা পরিবর্তন আসা শুরু হলো। এসব নাটকে অবশ্য বিটিভির তালিকাভুক্ত অভিনয় শিল্পীর বাইরে যে-কেউ অভিনয় করতে পারতো। ভালো দামে এসব নাটক বিক্রি করা যেতো বিধায় প্রথমের দিকে প্যাকেজ নাটক নির্মাণ নিয়ে এক ধরনের সুস্থ প্রতিযোগিতা ছিলো। কে কতো ভালো মানের নাটক করতে পারে এই নিয়ে পাল্লা চলতো।

২.

এই সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যমে একটি পরিমাণগত পরিবর্তন ঘটে। অবশ্য সেটি একধরনের গুণগত পরিবর্তনও। ২০০০ সালের ৮ মার্চ বেসরকারি চ্যানেল হিসেবে সম্প্রচার শুরু করে একুশে টেলিভিশন। টেরিস্টেরিয়াল সম্প্রচারের অনুমতি পাওয়ায় সারা দেশেই তুমুল জনপ্রিয় হয়ে ওঠে একুশে। বিশেষ করে সংবাদ পরিবেশনে তারা ভিন্ন মাত্রা যোগ করায় একুশে টেলিভিশন ঘরে ঘরে গুরুত্বপূর্ণ অতিথি হয়ে ওঠে। খবরের পাশাপাশি তারা সম্প্রচার করতে থাকে ‘সাপ্তাহিক’ ও ‘ধারাবাহিক’ নাটক। প্যাকেজের আওতায় এই নাটকগুলো নির্মিত হওয়ায় মানগত দিক দিয়ে এ-গুলো বেশ প্রশংসা পায়।

এরপর যা হলো কাহিনীর ঘরানা, অভিনয়ের অকৃত্রিমতায়, ক্যামেরার অবস্থানে, সংলাপরীতির আটপৌর ধাঁচের পরিবর্তন হলো। নতুন নির্মাতারা টেলিভিশন নাটককে স্টুডিওর সেকেলে সেট আর তিন ক্যামেরার বাইরের বাস্তব পৃথিবীতে টেনে আনলেন। এই কাজটি যাদের হাত ধরে হয়েছিলো তাদের অন্যতম ছিলেন আজকের তুমুল জনপ্রিয় নির্মাতা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। একুশে টেলিভিশন-এ নাটক সম্প্রচারের মাধ্যমেই এ-জগতে পথচলা শুরু করেছিলেন তিনি। এরপর নূরুল আলম আতিক, অমিতাভ রেজা, গিয়াসউদ্দিন সেলিম, আরও পরে অনিমেষ আইচ, মেজবাউর রহমান সুমন, মাসুদ হাসান উজ্জল-এদের নাম না বললেই নয়। তারা খুব গর্ব-সহকারে এই পরিবর্তনের কথা অবশ্য দাবিও করেন। ফারুকীর জবানিতে বিষয়টা অনেকটা এরকম, ‘একটা সময় বাংলাদেশের সিনেমা হতো যাত্রার মতো। আর টেলিভিশনে গল্প বলা হতো থিয়েটারের মতো। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে এসে একটা পরিবর্তনের হাওয়া লাগল ভিডিও ফিকশনের ক্ষেত্রে।’

হয়তো হাওয়া লেগেছে টেলিভিশন নাটকে। হয়তো বললে ভুলই হবে, বড়ো ধরনের পরিবর্তনের হাওয়া টিভি-নাটকে লেগেই গেছে। তা না হলে কী আর  ৪৫ মিনিটের টিভি-নাটককে টেনে এক ঘণ্টা ৪৫ মিনিটের ‘চলচ্চিত্র’ বানানো যায়! আলোচনা মূলত এ নিয়েই চলতে থাকবে, তার আগে কিছু কথা বলে নেওয়া জরুরি বলে মনে করছি।

৩.

এই পর্যায়ে টেলিভিশন-নাটকের ডিসকোর্স নিয়ে কথা বলবো। বাংলাদেশে টেলিভিশন-নাটকের শুরুর চিন্তাটা কিন্তু পুরোপুরি মঞ্চনাটক থেকে আসা। উদ্দেশ্যটা অনেকটা এ-রকম যে, টেলিভিশন মাধ্যমের সুযোগগুলোকে কাজে লাগিয়ে মঞ্চের নাটকে কীভাবে একটা নতুন মাত্রা আনা যায়। একই সঙ্গে টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে একধরনের নতুন শৈলী আনার চেষ্টাও ছিলো। আর এ-কাজটি করেছিলেন মূলত শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ার। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে তার ওপর অনেকখানি দায়িত্ব পড়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে নতুন কিছু করার। তারই ধারায় সৃষ্টি টিভি-নাটকের। শুরুতেই মুস্তাফা মনোয়ারের পরিচালনায় নির্মিত হলো রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত নাটক ‘রক্তকরবী’ নিয়ে টিভি-নাটক রক্তকরবী। নাটকটি বেশ প্রশংসিত হয়। এরপর তিনি নির্মাণ করলেন শেক্সপিয়ারের বিখ্যাত নাটক ‘টেমিং অব দ্য শ্রু’ অবলম্বনে মুনীর চৌধুরীর অনুবাদে মুখরা রমনী বশীকরণ। শুরু অনেকটা এ-ভাবেই। এই দিয়েই শুরু হলো টেলিভিশন-নাটকের ধারা। এই নাটক মূলত বিটিভির স্টুডিওর ভিতরে নির্মিত সেটে তিন ক্যামেরায় শ্যুট করা হতো। এসব নাটকের সাহিত্যপনা সংলাপ ও অভিনয়রীতিতে ছিলো পুরোপুরি মঞ্চনাটকের ঝোঁক। সেই সঙ্গে যোগ হয় মঞ্চনাটক-সংশ্লিষ্টদের টেলিভিশনে চাকরির ঐতিহাসিক বাস্তবতা।

এসব কিছু বাংলাদেশের টেলিভিশন-নাটকের ঐতিহাসিকতা হিসেবে কাজ করে। এরপর সময়ের পরিক্রমায় নাটক ডাকতে-ডাকতে মঞ্চনাটকের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশে টিভি-নাটকের নতুন এক ধারা সম্পর্কিত জ্ঞান উৎপাদন হয়। সেই জ্ঞানের জোরেই আজ আমরা অনেক চলচ্চিত্র দেখে বলি এটা ‘সিনেমা’ হয়নি, ‘নাটক’ হয়েছে। খুব নির্দিষ্ট প্রশ্ন করলে এ-দুইয়ের পার্থক্য করা খুব কঠিনই হয়ে পড়ে, তারপরও চর্চার মধ্যে দিয়ে টিভিনাটক-সংক্রান্ত উৎপন্ন জ্ঞান আমাদের মনে নাটক, সিনেমার মধ্যে একটা ভেদরেখা সৃষ্টি করে দেয়।

৪.      

এবার টেলিফিল্ম নিয়ে দু-চার কথা একেবারে না বললেই নয়। আগেই বলেছি প্যাকেজ নাটক আসার আগে বাংলাদেশে নাটকের দুটি ধারা ছিলো, সাপ্তাহিক নাটক এবং ধারাবাহিক নাটক। একদিনের নাটকগুলো পরিচিত ছিলো সাপ্তাহিক নাটক হিসেবে। এর সময়কাল ছিলো ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট। বিজ্ঞাপনসহ তা সম্প্রচার হতো এক ঘণ্টা থেকে এক ঘণ্টা ২০ মিনিটের মধ্যে। এরপর প্যাকেজ এর আওতায় নির্মিত নাটক সম্প্রচার শুরু হলো। এর কিছুদিন পর আসলো একুশে টেলিভিশন। যতোদূর সম্ভব একুশে টেলিভিশন বাংলাদেশে প্রথম টেলিফিল্ম সম্প্রচার শুরু করে।

টেলিফিল্ম এর একাডেমিক সংজ্ঞা যাই থাকুক না কেনো দর্শকদের কাছে তা পরিচিত হলো ব্যাপ্তির দিক থেকে নাটকের চেয়ে বড়ো চলচ্চিত্রের চেয়ে ছোট একটি ফর্ম হিসেবে। যদিও টেলিফিল্ম হলো টেলিভিশনের দর্শকদের জন্য নির্মিত এক ধরনের চলচ্চিত্র, এ-ক্ষেত্রে ব্যাপ্তির চেয়ে মাথায় রাখা হয় দর্শক ও ফরমেট। কারণ ১৯৮০-তে সত্যজিৎ যখন টেলিফিল্ম পিকু বানাচ্ছেন তখন তার ব্যাপ্তি ছিলো মাত্র ২৬ মিনিট। ১৯৮১-তে নির্মিত সদগতি ছিলো ৫২ মিনিটের। অথচ আমাদের দেশে টেলিফিল্মের সংজ্ঞা নির্ধারিত হলো ব্যাপ্তির ওপর।

তবে এ-ব্যাপারে ফারুকীর কথায় বেশ যুক্তি আছে। তার ভাষায়, ‘কেউ বলে ৪০ মিনিট হলে নাটক। কেউ বলে ৮০ মিনিট হলে টেলিফিল্ম। কেউ বলে ডায়ালগ বেশি হলে নাটক।’ কিন্তু ফারুকীর প্রশ্ন, ‘তাহলে আব্বাস কিয়োরোস্তামির টেন, ক্লোজ-আপ  কী? কেউ বলে নাটক হলো ক্লোজ মিডিয়া। মানে ক্লোজ শটে গল্প বলা হবে। আর ফিল্মের ক্যানভাস হবে বড়। এটা বলে কেউ বোঝায় লঙ শট বা শটের ভলিয়মের কথা। আবার কেউ বলে বিষয়ের গভীরতার কথা।’

তবে ফারুকী নিজে এ-সমস্যার সমাধান করেছেন। তার বয়ানে, ‘ভাইরে ক্লোজ, লং যেভাবে যা-ই বানান-সবই ছবি। গভীর, অগভীর যে বিষয় নিয়েই বানান-সবই ছবি। ২০ বা ৯০ মিনিট যাই বানান-সবই ছবি। পার্থক্য শুধু করতে পারেন, ভালো বা মন্দ ছবি-এ দুই ক্যাটাগরিতে।’

কিন্তু ফারুকীর এ-উপসংহার নিয়েও আমার কথা আছে। সেটা এখানে বলছি না, একটু পরে আসছি। একটু খেয়াল রাখুন; ফারুকীর ভাষায়, ‘যাই বানান-সবই ছবি।’       

৫.

চলচ্চিত্র শিল্পের শুরু থেকেই মঞ্চ ও চলচ্চিত্রের মধ্যে এক ধরনের আদান-প্রদান ছিলো। প্রযুক্তির আবিষ্কারের অল্প দিনের মধ্যেই নির্মাতারা বুঝে গিয়েছিলেন এই নতুন প্রযুক্তিতে শুধু বাস্তব ঘটনা নয়, সাজানো ঘটনাও রেকর্ড করা যায়। চলচ্চিত্রকে তখন দেখা হলো মঞ্চনাটকের বিস্তারের উপায় হিসেবে। পরে মঞ্চনাটকের পরীক্ষিত কাহিনী চলচ্চিত্রের কাহিনীর একটি বড়ো ভাণ্ডার হয়ে উঠেছিলো। আমাদের উপমহাদেশে চলচ্চিত্র যার হাত দিয়ে পথচলা শুরু করেছিলো, সেই হীরালাল সেনও কিন্তু মঞ্চনাটকের নির্বাচিত অংশ চলচ্চিত্রায়িত করার মধ্যে দিয়েই এ-মাধ্যমে যাত্রা শুরু করেছিলেন। ইতিহাসের কথা বাদ থাক। বরঞ্চ দেখি আমাদের সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন চলচ্চিত্র বলতে কী বুঝতেন? আগেই বলেছি, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষের কাছে ২০০২-২০০৩ সাল পর্যন্ত চলচ্চিত্র ছিলো প্রেক্ষাগৃহে দেখার জিনিস। আর ৭০ ও ৮০ দশকে মাঝে-মাঝে টেলিভিশনে চলচ্চিত্র প্রদর্শন ছিলো অনেকটা বোনাস-এর মতো। কারণ তখনও ভিসিআর-ডিভিডির এতো ছড়াছড়ি ছিলো না; ছিলো না স্যাটেলাইটের এতো চ্যানেল, এতো সিনেমা। তাই তারা বদ্ধ অন্ধকার ঘরে ঘামে ভিজে সিনেমা দেখাকেই বিনোদন মনে করতো। এখানে প্রয়াত তারেক মাসুদের একটা কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। তিনি বলতেন, ‘কেউ কেউ ধর্মাচারের সঙ্গে চলচ্চিত্র সংস্কৃতির মিল খুঁজে পান। ধর্মের দুটো দিক আছে-অনুশাসন ও সংস্কৃতির দিক। তেমনি চলচ্চিত্র মাধ্যমেরও আছে আকার, আকৃতি ও প্রকার, প্রকৃতির দিক। অর্থাৎ কারিগরি ও সংস্কৃতির দিক। সিনেমার সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি, ‘তুলনামূলকভাবে একটি বড় আকারের অন্ধকার ঘরে অনেকে একত্রে অথচ নিঃশব্দ একাকিত্বের সঙ্গে বড় পর্দার কাছে আত্মসমর্পণ করা।’ রিমোট আর মোবাইল টেপার ফাঁকে, লোডশেডিং আর বিরতির আগে পরে, ফোন আর বাচ্চা সামলানোসহ যাবতীয় গার্হস্থ্য কাণ্ডকারখানার মাঝে মাঝে কেব্‌ল ও ডিভিডির কল্যাণে আমরা টিভির মিনি পর্দায় যা দেখি, তা দেখা নয়, ‘তাকানো’, চলচ্চিত্র নয়, ‘চলমান চিত্র’ মাত্র।’  

এর সঙ্গে আমি একটা কথা যোগ করতে চাই, খুবই আশঙ্কাজনক একটা ব্যাপার লক্ষ করার মতো, বর্তমানে এমন এক প্রজন্ম গড়ে উঠছে যারা কোনোদিন প্রেক্ষাগৃহেই যায়নি। ফলে সিনেমা দেখার প্রেক্ষাগৃহকেন্দ্রিক সংস্কৃতি তাদের মধ্যে গড়েই উঠেনি। তাদের কাছে টেলিভিশন ও কম্পিউটারে চলচ্চিত্র দেখাই এখন স্বাভাবিক  হয়ে উঠেছে। তাই এই প্রজন্মের কাছে আপনার-আমার লঙ শট, ওয়াইড অ্যাঙ্গেল শটের কোনো দাম নেই। কারণ টেলিভিশনের ২৪ ইঞ্চি আর কম্পিউটারের ১৮ ইঞ্চি মনিটরে আপনি যাই দেখান তাতে ক্লোজ-আপ, লঙ-শট কিংবা টপ-শট খুব বেশি ফারাক তৈরি করে না; সবই একই মনে হয়। তাই টিভি-নাটকের ডিসকোর্স মাথায় থাকা ওই প্রজন্মের কাছে অনেক কিছুকেই ‘নাটক’ মনে হয়। আপনি চিৎকার করে যতোই বলুন এটা ‘ভিডিও ছবি’, ‘ভিডিও ফিকশন’ কিংবা ‘ডিজিটাল চলচ্চিত্র’।

আমাদের দেশে চলচ্চিত্র এখন যে-জায়গায় দাঁড়িয়েছে সেখানে চলচ্চিত্র নিয়ে গাস্তঁ রোবের্জ কথা খুব একটা খাটছে না। চলচ্চিত্র নিয়ে তার অসাধারণ বয়ান এমন-‘ছায়াছবির পর্দার দিকে তাকানো খানিকটা আয়নার দিকে তাকানোর মত। আয়নাও সমতল। কিন্তু তিন ফুট দূরে দাঁড়িয়ে আয়নার দিকে চাইলে আমরা ছবি দেখব আয়নার তিন ফুট পিছনে, অর্থাৎ যেখানে আছি তার থেকে ছ’ফুট দূরে। এই ছয় ফুট দূরে দেখা ছবি কল্পচিত্র। আমি যেন আয়না ভেদ করে তার ওপাশে দেখছি। কোনো ছায়াছবি যখন দেখি, তখন কল্পচিত্র দেখি বা দেখছি বলে মনে করি। কিন্তু সে চিত্র আমার প্রতিবিম্ব নয়।যে ছবি দেখি, তা চিত্রনির্মাতার ‘প্রোগ্রাম করা’। আমি তার মধ্যে নেই, আয়নায় দেখার মতো নিজেকে দেখতে পারি না, কিন্তু আমাকে ছবির ভিতরে যেতে বা ছবির ভিতরে যাওয়া অনুভব করতে আমন্ত্রণ করা হচ্ছে। চলচ্চিত্রের ছবিও দেখি এমনভাবে, যেন পর্দা ফুঁড়ে তার ওপাশে দেখছি। ওভাবে দেখার মতো করেই তা তৈরি হয়েছে। অন্যরকমভাবে দেখার মতন ছায়াছবি করা যায়। কখনও সখনও সেরকম করাও হয়েছে। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে, আমি ‘সিনেমা’ বলতে সাধারণ গল্প-বলা ছায়াছবির কথাই বলছি।’   

আমাদের এখন সাধারণ-অসাধারণ কোনো সিনেমাই নাই, পর্দাও নাই। তাই এখন আর কল্পচিত্র তৈরি হয় না। তাই বলে হতাশ হওয়ারও কিছু নেই, সম্ভাবনাও আছে।

৬.

এখন আবার ফিরে আসি ফারুকীর কথায়, ‘যাই বানান-সবই ছবি।’ ভালো কথা, আমি যতোটুকু বুঝি তাতে আমার নিজের মতামত তাই। লঙ শট, ক্লোজ শট, ব্যাপ্তি, ক্যানভাস, সংলাপ সবকিছুকে খারিজ করে দিয়ে ফারুকী বললেন; তিনি সচেতনভাবে কানামাছি থেকে এগুলো কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন আপনি নিজে এটা কী করলেন? চড়ুইভাতির সিক্যুয়াল ব্যাচেলর (অবশ্য আমি জানি না ফারুকী এটাকে সিক্যুয়াল বলেন কিনা, তবে আমার কাছে মনে হয়েছে) বানালেন। অথচ চড়ুইভাতিকে বললেন, ভিডিও ফিকশন বা ভিডিও ছবি বা টেলিফিল্ম, আর ব্যাচেলরকে গর্ব করে বললেন আপনার প্রথম কাহিনীচিত্র। এটা কেমন যেনো হয়ে গেলো না! আমি কিন্তু টিভি-নাটকের ডিসকোর্স মাথায় থাকা অনেকের কাছে ব্যাচেলর ‘বড়ো নাটক’ মন্তব্য করতে শুনেছি।

অমিতাভ রেজার একটা কথা এখানে না বললেই নয়। তিনি বলছেন, ‘স্টুডিও থেকে বের হয়ে এসে টিভি-নাটক যখন আউটডোরে একক ক্যামেরায় চিত্রায়িত হতে শুরু করলো, সংগত কারণেই তখন চলচ্চিত্রের ভাষায় কথা বলার প্রয়োজনীয়তা এসে পড়ে। তখন প্রশ্ন দেখা দিল, চলচ্চিত্রের ভাষায় আসলে কারা ভালো গল্প বলতে পারেন? একেবারেই নতুন একদল নির্মাতার জন্ম হলো।’ বুঝলাম এই নতুন নির্মাতারাই আজকের ফারুকী, অমিতাভ, আতিক, সেলিম-তাই না? তো নাটকে চলচ্চিত্রের ভাষা আনলেন ভালো কথা। কিন্তু প্রশ্ন টিভি-নাটকে চলচ্চিত্রের ভাষা এনে আপনারা কী করলেন? চড়ুইভাতি নাকি ব্যাচেলর। কোনোটাই নাটক কিংবা চলচ্চিত্র হিসেবে দাঁড়ালো না। আর দাঁড়াবেই কীভাবে ফারুকীর ভাইবেরাদর মুহাম্মদ মোস্তফা কামাল রাজ আবার সর্বশেষ যেটি করলেন সেটা কী? আগেই বলেছি আমার মূল প্রশ্ন ওইটা নিয়েই।

ফারুকী ও তার ভাইবেরাদরদের নাটক আমার ভালোই লাগে, আলোচনা-সমালোচনা যাই হোক আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের অনেক কিছুই সমর্থন করি। সেই জায়গা থেকেই প্রেক্ষাগৃহে প্রজাপতি দেখতে যাওয়া। কিন্তু প্রশ্ন, কী দেখলাম? প্রজাপতিজুয়া দুটোরই প্রথম দৃশ্য শুরু হয় একইভাবে; নায়িকা মৌসুমী অফিসে যাওয়ার জন্য রিকশা খুঁজছেন। ভাড়া না মেলায় রিকশা না নিয়েই তিনি হাঁটতে শুরু করেন। তারপর টাইটেলকার্ড। কাহিনী এগোতে থাকে, কিন্তু গোটা দুয়েক গান আর অভিনেতার পরিবর্তন ছাড়া জুয়া আর প্রজাপতির মধ্যে আমি কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। যেহেতু জুয়া আমার আগেই দেখা, তাই মিনিট চল্লিশেক দেখার পর আমার ভিতরে প্রজাপতি বিরক্তির উদ্বেগ করতে থাকে। বারবার টেলিভিশন-নাটক টেনে লম্বা করে টেলিফিল্ম বানানোর কথা মনে পড়তে থাকে। প্রজাপতি চলচ্চিত্র হিসেবে কতোখানি দাঁড়িয়েছে সে-প্রসঙ্গে আমি যাবো না। আমার কথা কেবল নাটক আর সিনেমা নিয়ে। তারেক মাসুদ বলেন, ‘৩৫ মিলিমিটারের সঙ্গে ১৬ মিলিমিটারের পার্থক্য মাত্র ১৯ মিলিমিটারের-একথা মানতে অনেক চলচ্চিত্রপণ্ডিতই প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ষাট-সত্তর দশকের প্রথম সারির অনেক নির্মাতাই তাঁদের মাস্টার পিস তৈরি করেছেন ১৬ মিলিমিটার ফরম্যাটে। শুধু তাই নয় প্রখ্যাত জার্মান চলচ্চিত্রকার ফাসবিন্ডারের আলেকজান্ডার প্লাস  নামক বায়ান্ন পর্বের টিভি সিরিয়াল মাস্টার পিস হিসেবে বিবেচিত হয়।’

তার মানে আপনি চাইলে যেকোনো ফরমেটে যেকোনো মাধ্যমে মাস্টার পিস নাহোক ভালো কাজ করতে পারেন। কিন্তু আপনার হাতে ক্ষমতা আছে, আপনার জনপ্রিয়তা আছে-তাই আপনি দর্শকের আবেগ অনুভূতি নিয়ে যা খুশি তাই করবেন! এটাতো হয় না। এখানে মাস্টার পিস যে হয়নি তা বলবো না। সে উদাহরণও আছে স্বয়ং ফারুকী বানিয়েছেন স্পার্টাকাস ৭১। যদিও নাম দিয়েছেন ভিডিও ছবি বা ভিডিও ফিকশন; অথচ এটিই মাস্টার পিস। এখানেও তারেক মাসুদকে স্মরণ করতে হয়, ‘আমাদের দেশে চলচ্চিত্র ফরম্যাটে, এমনকি স্বাধীন ধারায়ও এমন কিছু চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, যা সম্ভবত চলচ্চিত্র হয়ে উঠেনি। অথচ ভিডিও ফরম্যাটে এমনকিছু ভালো কাজ হয়েছে যে, যেগুলো নিয়মিত ভিডিও ফরম্যাটে না করে ডিজিটাল ফরম্যাটে চিত্রায়ণ করলে তা ৩৫ মিলিমিটারে উন্নীত করে দেশে-বিদেশে বড়ো পর্দায় পরিবেশনার সুযোগ নেয়া যেতো। এ-ক্ষেত্রে অনেকের সঙ্গে স্বাধীন ধারায় নির্মিত নূরুল আলম আতিক ও শামীম আখতারের ভিডিও ফিল্মসহ বেশকিছু উদাহরণ দেওয়া যায়। দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, এ-রকম ভিডিওচিত্রগুলোর চূড়ান্ত পরিণতি টিভি চ্যানেলগুলোর অফ পিক আওয়ার।’১০ এ-ক্ষেত্রে ফারুকী, রাজ কিংবা আতিক কী বললেন!

৭.   

নূরুল আলম আতিক একটা সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘...শুরুতে কিছু বিভ্রান্তির জন্ম দিতে পারে... কিছু আবোল-তাবোল কাজ করে বলবো ডিজিটাল সিনেমা। হয়তো একটা খারাপ টেলিফিল্ম, যেটা হয়তো টেলিভিশনও নেবে না, সেটাকে আমরা ডিজিটাল সিনেমা হিসেবে চালানো শুরু করবো। এসব কারণে আমি সংজ্ঞায়নের পক্ষপাতী না।’১১

ভালো কথা। আপনার কথা মেনে নিলাম। আতিক আবার বললেন, ‘...৩৫-এ (৩৫ মিলিমিটারে) যেমন ৬০ লাখ টাকা ওঠাতে নায়ক-নায়িকা, নৃত্য-গীতের বাধ্যবাধকতা থেকে যেমন মুক্তি পাওয়া সম্ভব এই (ডিজিটাল) ফরম্যাটের কারণে, তেমনি এক ধরনের জালে আটকা পড়ার সম্ভাবনা আছে। আমি কিন্তু যা খুশি করতে পারি না। যা খুশি করে সিনেমা বলে চালিয়ে দেবার সম্ভাবনা আছে।’১২

এটাও মেনে নিলাম। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো আপনি নিজে এই যে এতো-এতো ভালো কাজ করলেন, সাহস করে বলতে পারলেন না চতুর্থমাত্রা সিনেমা, সাইকেলের ডানা সিনেমা। ফারুকী, অমিতাভ কিংবা মেজবাউর রহমান সুমনের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। প্রত্যাবর্তন, হাওয়া ঘর, তারপরও আঙ্গুরলতা নন্দকে ভালোবাসে; এগুলো সিনেমা হলো না। সিনেমা হলো ব্যাচেলর। আতিককে সিনেমা বলার জন্য ডুবসাঁতার পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হলো। ডুবসাঁতার যদি আপনার সিনেমা হয়, তাহলে চতুর্থমাত্রা-র দোষ কী? এখন কেউ যদি একটু খারাপ বানিয়েও সাহস করে বলে এটা তার সিনেমা তাতে দোষ কী? আর ‘আবোল-তাবোল’ কাজের কথা বলছেন; এর কি কোনো মানদণ্ড আছে? এই দেশে দর্শকের যে-বিচিত্রতা তাতে আপনি নির্দিষ্ট করে কোনোকিছুকেই ‘আবোল-তাবোল’ বলতে পারবেন না। কারণ ডিজিটাল নিয়েই আপনার এতো চিন্তা, ৩৫-এ কী হচ্ছে? তাই নতুন ফরমেট হিসেবে এই মাধ্যমে সিনেমা বানাতে গেলে এতো চিন্তা করতে হবে কেনো? কারণ আমরা যে-জায়গায় আছি, আমাদের এখন অনেক অনেক সিনেমা দরকার, সিনেমা প্রদর্শনের ব্যবস্থা দরকার; সে ৩৫, ডিজিটাল-যে ফরমেটেই হোক। 

৮.

ফ্রেডরিক জেমসন (Fredric Jamson) একটি তত্ত্ব১৩ দিয়েছেন। তার মতে পুঁজিবাদে তিনটি মুখ্য আভ্যন্তরীণ বিপ্লব ঘটেছে-১৮৬০-এর দশকে বাজারি পুঁজিবাদ, ১৮৯০-এর দশকে একচেটিয়া পুঁজিবাদ আর ১৯৪০ সাল থেকে বহুজাতিক সংস্থার পুঁজিবাদ। এই তিন ধরনের পুঁজিবাদে ব্যবহার হয়েছে তিন ধরনের প্রযুক্তি। এর ভিত্তি যথাক্রমে বাষ্প, বিদ্যুৎ ও পরমাণুশক্তি। তাদের সাংস্কৃতিক বিচারধারাও তিন রকম-যথাক্রমে বাস্তববাদ, আধুনিকতাবাদ, উত্তর-আধুনিকতাবাদ। এই তত্ত্বকে সম্প্রসারিত করে ভিভিয়ান সোবচাক১৪ (Vivian Sobchack) বলেন, এই তিন ধরনের পুঁজিবাদের তিন রকম দৃশ্যশ্রাব্য উপস্থাপনার রূপ ও প্রতিষ্ঠান হয়েছে-যথা, ফটোগ্রাফি, চলচ্চিত্র ও টেলিভিশন। ফ্রেডরিক বলছেন, বহুজাতিক সংস্থার পুঁজিবাদের কথা, আর ভিভিয়ান সেই সময়কে বলছেন টেলিভিশনের। আমাদের দেশে আমরা যে পুঁজিবাদের ওই দুটি পর্যায় অতিক্রম করে এসেছি-এমন নয়। কিন্তু আমরা সব ডিঙিয়ে বর্তমানে বহুজাতিক পুঁজিবাদে আটকা পড়েছি। তাই ভিভিয়ানের তত্ত্ব মতে, টেলিভিশন এখন আমাদের দৃশ্যশ্রাব্য উপস্থাপনার প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে।

এ-দেশের নব্যবণিকরা যখন কিছু টাকা জমিয়ে শিল্প প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী হয়েছিলো, ঠিক সে-সময় ব্রিটিশরা তাদের লোভ দেখালো ভূমির, বড়ো বড়ো জমিদার বাড়ির। নিম্নবর্গ থেকে উঠে আসা নব্যবণিকরা এই লোভ সামলাতে পারলেন না। বৃটিশের ফাঁদে পা দিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও সূর্যাস্ত আইন করে নব্যবণিকদের শিল্প উদ্যোগকে তারা সরিয়ে নিলেন জমিদারি কেনার নিষ্ফল আয়োজনে। ফলে সবই হলো, শিল্পবিপ্লব আর হলো না। যেটা ব্রিটিশরা চেয়েছিলো সেটাই হলো-বাজার; পণ্য বিক্রির ভালো বাজার। তাই পুঁজিবাদের প্রথম দুটি স্তর না পেরিয়েই আমরা তৃতীয় স্তরে গেলাম। একইভাবে ফটোগ্রাফি, চলচ্চিত্রের যুগকে ভালোভাবে না পেরিয়েই আমরা আসলাম টেলিভিশনে।

এখন আমাদের চুল বাঁধা থেকে পায়ের নখ কাটা পর্যন্ত, সবই পাওয়া যায় টেলিভিশনে। আর এই চুল কতোভাবে বাঁধা যায়, কী কী দিয়ে বাঁধা যায়, কোথায় বাঁধা যায় ঠিক করে দেয় টেলিভিশন। আমরা করিও তাই। গাস্তঁ রোবের্জ-এর একটি কথা বলার লোভ সামলাতে পারছি না। ‘টেলিভিশন আমার কাছেও আসে না, আমাকে টেনেও নিয়ে যায় না। সে শুধু আছে। তা শুধুই উপর-ভাসা ছবি, আমি যোগ দিলাম কি না দিলাম, তাতে তার কিছু এসে যায় না; এমন কি আমি আছি না আছি তাতেও তার কিছু এসে যায় না। টিভির ছবি একাই দুলে দুলে কেঁপে কেঁপে চলে।...চলচ্চিত্রেরও দর্শকের প্রয়োজন, যদিও দর্শকের উপস্থিতি হতে পারে নানা স্থানে, নানা সময়ে। কিন্তু টেলিভিশন সর্বদাই আছে। বিদ্যুৎ সরবরাহের মতোই, আপনি প্লাগ করুন বা নাই করুন, টিভি হাজির।’১৫ আমরা এখন সেই টেলিভিশন নিয়ে আছি। এই টেলিভিশন এখন আমাদের নাটক, সিনেমাকে নিয়ন্ত্রণ করছে, সংজ্ঞায়িত করছে। আতিকের ভাষায়, ‘আমরা চলচ্চিত্র নিয়ে কথা বলি, আর টেলিভিশন করে খাই।’১৬ আরেকটু যোগ করি আমি বলি, টেলিভিশনও আমাদের খেয়ে ফেলছে।

তাই সাবধান। চলচ্চিত্রের এই অস্থির সময়ে, ডিজিটাল ফরমেটের সিনেমা তৈরির এমন অবাধ সুযোগে খুব ভেবেচিন্তে পা ফেলতে হবে। নইলে ডিজিটাল ফরমেটের সিনেমার অসাধারণ যে-সুযোগ তৈরি হয়েছে তাকেও কিন্তু এই টেলিভিশন খেয়ে ফেলবে (মতান্তরে বললে অনেকখানি খেয়ে ফেলেছে)। ‘ভিডিওচিত্রের চুড়ান্ত দৌঁড় টেলিভিশন পর্যন্ত। পরিকল্পিতভাবে এগোতে হবে, দখল করে নিতে হবে মূলধারা। মাত্র ১০ বছর আগেও বাংলাদেশের একজন নির্মাতার পক্ষে ইউরোপ, আমেরিকার ছবির কারিগরি মানের সঙ্গে পাল্লা দেওয়া সম্ভব ছিলো না। কিন্তু চলচ্চিত্র মাধ্যমে ডিজিটাল ফরম্যাটের আবির্ভাব প্রযুক্তির গণতন্ত্রায়ণ এনে সবাইকে এ কাতারে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।’১৭  তাই এখানে টিভি-নাটক, টেলিফিল্ম কিংবা চলচ্চিত্রের আর কোনো ফারাক নেই।

 

লেখক : কাজী মামুন হায়দার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ সাংবাদিকতা বিভাগে পড়ান।

kmhaiderru@gmail.com    

 

তথ্যসূত্র

১. চৌধুরী, ইকবাল হোসাইন (২০১১ : ৬০); ‘ছোট পর্দায় খোলা হাওয়া’; চলচ্চিত্র অধ্যয়নং তপ; শুদ্ধস্বর, ঢাকা।

২. হুসাইন, সাজ্জাদ সম্পাদিত (২০১১); ‘সখা ভিডিও ছবি কাহারে বলে...’; রাফকাট; ঐতিহ্য, ঢাকা।

৩. প্রাগুক্ত; হুসাইন, সাজ্জাদ সম্পাদিত (২০১১)।

৪. প্রাগুক্ত; হুসাইন, সাজ্জাদ সম্পাদিত (২০১১)।

৫. মাসুদ, তারেক (২০১২ : ১২৫);‘ডিজিটাল মাধ্যম ও বাংলাদেশের চলচ্চিত্র’; চলচ্চিত্রযাত্রা; প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা।

৬. রোবের্জ, গাস্তঁ (২০০৪ : ১৩৯);‘সিনেমা ও টেলিভিশন’; সংযোগ সিনেমা উন্নয়ন; বাণীশিল্প, কলকাতা।

৭. প্রাগুক্ত; হুসাইন, সাজ্জাদ সম্পাদিত (২০১১)।

৮. প্রাগুক্ত; চৌধুরী, ইকবাল হোসাইন (২০১১ : ৬০)।

৯. প্রাগুক্ত; মাসুদ, তারেক (২০১২ : ১২৪-১২৫)।

১০. প্রাগুক্ত; মাসুদ, তারেক (২০১২ : ১২৮)।

১১. হক, ফাহমিদুল (২০১২ : ৪৫); বাংলাদেশের ডিজিটাল চলচ্চিত্র; অ্যাডর্ন পাবলিকেশন, ঢাকা।

১২. প্রাগুক্ত; হক, ফাহমিদুল (২০১২ : ৪৫)।

১৩. Jameson, Fredric (1991 : 1-55); Postmodernism, or the Cultural Logic og Late Capitalism, London; Verso.

১৪. Sobchack, Vivian (1994 : 83-106); উদ্ধৃত, রোবের্জ, গাস্তঁ (২০০৪ : ১৪৩)।

১৫. প্রাগুক্ত; রোবের্জ, গাস্তঁ (২০০৪ : ১৩৯)।

১৬. ব্যক্তিগত সম্পর্কের বদৌলতে বহুবার আলোচনায় নূরুল আলম আতিক এর মুখে এমন কথা শুনেছি।

১৭. প্রাগুক্ত; মাসুদ, তারেক (২০১২ : ১২৯)।

 

বি. দ্র. এ প্রবন্ধটি ২০১২ সালের জুলাইয়ে ম্যাজিক লণ্ঠনের তৃতীয় সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ করা হয়।

এ সম্পর্কিত আরও পড়ুন